Home মহিলাঙ্গন ইসলামে নারী শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম

ইসলামে নারী শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম

।। মাওলানা আব্দুল হান্নান ।।

পরম করুণাময় আল্লাহ তাআলা মানব জাতিকে সৃষ্টি করে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন একমাত্র তাঁর ইবাদতের জন্য। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে- ‘আমি সৃষ্টি করেছি জ্বিন ও মানুষকে এই জন্য যে, তারা একমাত্র আমারই ইবাদত করবে’। (সূরা জারিয়াত, আয়াত -৫৬)।

একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করার নির্দেশ দিয়ে মহান আল্লাহপাক ইরশাদ করেন- ‘হে মানুষ! তোমরা তোমাদের সেই প্রতিপালকের ইবাদত কর যিনি তোমাদেরকে ও তোমাদের পূর্ববর্তীদেরকে সৃষ্টি করেছেন যাতে তোমরা মুত্তাকী হতে পার’ (সূরা বাকারা, আয়াত-২১)।

সেই ইবাদত কবুল হওয়ার জন্য আল্লাহপাক একটি শর্ত যুক্ত করেছেন। সেই শর্তটি হচ্ছে ইলম বা জ্ঞান। ইলম বা জ্ঞান ব্যতীত কোন ইবাদত আল্লাহর দরবারে কবুল হবে না। এজন্য ইবাদত করার পূর্বে এ সম্পর্কে শিক্ষা অর্জন করা সকলের উপর ফরয।

শিক্ষা লাভ করা থেকে নর-নারী কাউকে বাদ দেয়া যাবে না। কেউ বিরত থাকতে পারবে না। আল্লাহপাক পুরুষকে যেমন শিক্ষা অর্জনের নির্দেশ দিয়েছেন তেমন নারীকেও শিক্ষা অর্জনের নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহর বিধানে শিক্ষা অর্জন করা নর-নারীর সমান অধিকার। শিক্ষা ক্ষেত্রে সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য পবিত্র কোরআন নাযিল করে মহান আল্লাহপাক সর্বপ্রথম যে নির্দেশ দিয়েছেন সেই নির্দেশটাই হচ্ছে নর-নারীর জন্য শিক্ষা বিষয়ক।

ইরশাদ হচ্ছে- ‘পড় তোমার প্রভুর নামে” (সূরা আলাক: আয়াত-১)।

শিক্ষা ছাড়া আল্লাহকে জানা বুঝা যাবে না বিধায় শিক্ষা অর্জন করা প্রথম ও প্রধান ফরয। এই ফরয কাজ থেকে বিরত থাকা মানেই সকল ক্ষেত্রে ধ্বংস ডেকে আনা। মানবতার ইহ-পরকালীন শান্তির একমাত্র পথ হচ্ছে শিক্ষা। আর এই শিক্ষা নর-নারী উভয়কেই অর্জন করতে হবে। ইলম অর্জন করা সকল নর-নারীর উপর ফরয ঘোষণা করে হযরত আনাস (রাযি.) বর্ণিত হাদীসে রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন- ‘ইলম অর্জন করা প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর উপর ফরয’। (ইবনে মাজাহ, বায়হাকী)।

ইসলামে নারী শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। ব্যক্তি পরিবার সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নয়নে নারীশিক্ষার বিকল্প নেই। বিশেষ করে একটি পরিবারকে সুশিক্ষিত করে তুলতে হলে শিক্ষাক্ষেত্রে নারীকে অবশ্যই অগ্রাধিকার দিতে হবে।

কোরআন হাদীস যদি আমরা পর্যালোচনা করি, তাহলে দেখতে পাব, নবী (সা.) সর্বপ্রথম নারীদেরকে শিক্ষার প্রতি উৎসাহিত করেছেন এবং এই শিক্ষার বিধান সর্বপ্রথম বাস্তবায়ন করার সুবর্ণ সুযোগ পেয়েছিলেন হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.)এর প্রিয় সহধর্মিণী হযরত খাদীজাতুল কুবরা (রাযি.)।

কাজেই নারী শিক্ষার বিষয়টাকে খাটো করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। অগণিত হাদীস দ্বারা এটা সুস্পষ্ট ও প্রমাণিত যে, হযরত নবী (সা.) নিজেই নারীদেরকে শিক্ষাদান করতেন, নারীদেরকে শিক্ষার প্রতি উৎসাহিত করতেন। সাহাবায়ে কেরামের নিকট থেকে নারীরা শিক্ষা গ্রহণ করতেন। এমনকি বড় বড় সাহবীগণও নারীদের নিকট থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতেন।

হযরত জুবায়ের ইবনে মুতইম (রাযি.) বর্ণিত হাদীসে আছে- ‘একবার এক মহিলা সাহাবিয়্যাহ হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.)এর দরবারে এসে কিছু বিষয় শিক্ষা গ্রহণ করলো। বিদায় নিয়ে ফিরে যাবার সময় রাসূল (সা.) তাকে বললেন, আর জানার মত কিছু থাকলে অন্য সময় জেনে নিও। মহিলাটি আরজ করলো- ইয়া রাসূলাল্লাহ! যদি আপনাকে না পাই অর্থাৎ যদি আপনি দুনিয়াতে না থাকেন তখন কি হবে? রাসূল সা. বললেন- আবু বকর (রাযি.)এর নিকট তখন শিক্ষা গ্রহণ করিও’ (বুখারী, মুসলিম ও তিরমিযী)।

উক্ত হাদীস দ্বারা দিবালোকের ন্যায় প্রমাণিত যে, হযরত নবী (সা.) স্বয়ং নিজে নারীদেরকে শিক্ষা দিতেন এবং তার অনুপস্থিতিতে অন্যজনের কাছে গিয়ে শিক্ষা গ্রহণ করার জন্য নারীদেরকে উৎসাহিত করতেন। রাসূলুল্লাহ (সা.)এর যুগে এবং পরবর্তী সময়ে অগণিত মহিয়সী মুসলিম নারী শিক্ষাদান করেছেন এবং তারা শিক্ষকতা করে নিরক্ষরতা দূর করেছেন।

মহিলা সাহাবীদের মধ্যে অনেকে ছিলেন অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী। হযরত আয়শা (রাযি.) ছিলেন তেমনি একজন উঁচুমাপের ইসলামী জ্ঞানের অধিকারী। বিশেষ করে হাদীস ও ফিকাহ শাস্ত্রের এক মহান পণ্ডিত। চার খলিফা’সহ বড় বড় সাহাবীরা পর্দার আড়ালে থেকে তাঁর নিকট থেকে বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণ করেছেন।

হযরত আবু মুসা আশআরী (রাযি.) বর্ণিত হাদীসে তিনি বলেন- “আমরা রাসূলুল্লাহ (সা.)এর সাহাবীরা যখনই কোন মাসআলার ব্যাপারে সন্দেহ বা সমস্যায় পড়তাম তখনই আমরা হযরত আয়শা (রাযি.)এর নিকট গিয়ে জিজ্ঞেস করতাম এবং সঠিক সমাধান পেয়ে যেতাম। (তিরমিযী, মিশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা-৫৭৪)।

পুরুষ সাহাবীগণ মহিলা সাহাবীদের নিকট মাসআলা শিক্ষার জন্য যেতেন, যা উক্ত হাদীসে উল্লেখ আছে।

এর দ্বারা প্রমাণ হলো, মহিলাদের জন্য শিক্ষকতা করা বা মহিলাদের নিকট গিয়ে শিক্ষা গ্রহণ করার ব্যাপারে ইসলামের কোনো বাধা নেই। তবে শর্ত হলো সর্বদা শরয়ী পর্দা পরিপূর্ণরূপে রক্ষা করতে হবে এবং পরিবেশ সকল ফিতনা থেকে মুক্ত ও নিরাপদ হতে হবে। কেউ যদি পর্দাহীন হয় তাহলে সে তার চরিত্র ও নৈতিকতা হারিয়ে ফেলবে এবং তাকে অনিরাপদ করে তুলবে। আর চরিত্র নষ্ট হলে বা নিজের নিরাপত্তা বিঘ্ন হলে তো শিক্ষা লাভ করেও লাভ নেই। সাহাবায়ে কেরামগণ (নারী-পুরুষ) শিক্ষার জন্য পরস্পর আলোচনা করতেন। ইলমের ব্যাপারে পরস্পর মতবিনিময় করতেন সত্য। কিন্তু এতে তাঁদের মাঝে পর্দার এতটুকু ব্যাঘাতও ঘটতো না। তারা সর্বদা পরিপূর্ণ পর্দা রক্ষা করেই চলতেন।

নারীদের জন্য শুধু প্রাথমিক শিক্ষা নয়, বরং উচ্চ শিক্ষা লাভ করতেও ইসলামের কোনো বাধা নেই। যদি নারীরা পর্দা রক্ষা করে চলতে পারেন এবং ইজ্জত-আব্রুর নিরাপত্তার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সুনিশ্চিত হয়। কারণ, শিক্ষা অর্জন করা একটি ফরয কাজ এবং এর চেয়ে বড় ফরয হল পর্দা রক্ষা করা এবং নিজেদের ইজ্জত-আব্রুর সুরক্ষা নিশ্চিত করা। পুরুষের মত নারীরাও উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করবে, শিক্ষকতা করবে এবং শিক্ষার প্রসার করবে এ সম্পর্কিত নির্দেশ পবিত্র কুরআনেই রয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে- ‘হে নবী পরিবার! তোমাদের গৃহে যে আল্লাহর বাণী পাঠ করা হয় এবং হিকমত পরিবেশন করা হয় তা তোমরা স্মরণ কর এবং প্রচার কর’ (সূরা আহযাব, আয়াত-৩৪)।

বাংলাদেশে বর্তমানে নারীদের চলাচলের জন্য পরিবেশ চরম অনিরাপদ হয়ে ওঠছে। এটা খুবই উদ্বেগজনক। প্রতিনিয়ত গণমাধ্যমে নারী ধর্ষণ, নারী যৌন হয়রানী ও ইভটিজিং এর শিকার হওয়ার খবর প্রকাশত হয়। সাম্প্রতিক সময়ে এমন অপরাধের মাত্রা বহুগুণ বেড়ে গেছে। একজন অভিভাবক তার কন্যা সন্তানকে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়ে ঘরে ফেরার আগ পর্যন্ত টেনশন মুক্ত থাকতে পারেন না। একটা সভ্য সমাজের জন্য এটা খুবই হতাশার ও উদ্বেগের।

আমরা শিক্ষামন্ত্রণালয়সহ সরকারের কাছে জোর দাবি জানাই, নারীদের জন্য স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল স্তরে পৃথক শিক্ষালয় ও গবেষণাগার চালু করুন এবং যাতায়াতের জন্য পৃথক যানবাহনসহ উপযুক্ত নিরাপদ পরিবেশ গড়ে তুলুন। যেখানে বাংলাদেশের ধর্মপ্রিয় মুসলিম নারীরা পরিপূর্ণ শরয়ী পর্দা মেনে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করার সুযোগ পাবেন এবং তাদের অভিভাকগণও নিজের কন্যাদেরকে উচ্চশিক্ষিত করতে দিয়ে দুশ্চিন্তা মুক্ত থাকতে পারবেন। সরকার আন্তরিক হলে দেশে নারীদের জন্য শিক্ষার নিরাপদ পরিবেশ গড়ে তোলা কঠিন কিছু নয়। এমন পরিবেশ গড়ে উঠলে নারীদের উচ্চশিক্ষার হার অনেক বেড়ে যাবে। নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, যৌন হয়রানী ও ইভটিজিং এর হারও অনেক কমে যাবে। এতে করে দেশ ও জাতি উপকৃত হবেন।