Home বুক রিভউ কবি মালেকা ফেরদৌস-এর কাব্যগ্রন্থ ‘স্বদেশ প্রকৃতি ও প্রেমের কবিতা’ এবং কিছু কথা

কবি মালেকা ফেরদৌস-এর কাব্যগ্রন্থ ‘স্বদেশ প্রকৃতি ও প্রেমের কবিতা’ এবং কিছু কথা

।। নূরুল হক ।।

বইয়ের নাম- স্বদেশ প্রকৃতি ও প্রেমের কবিতা
লেখক- মালেকা ফেরদৌস
প্রকাশক- একাত্তর প্রকাশনী
মেলায় পাওয়া যাবে- ‘গল্পকার’ ও ‘রিদম’-এর স্টলে

সুন্দর, সৌন্দর্যের অনুভব, অনুভূতি কাব্যিক পরিমণ্ডলে এক প্রকার মিথে পরিণত হয়ে গেছে। কবিতা লিখা হলো, অথচ কবিতার অন্তর্নিহিত ভাবে শৃংখলা নেই, ছন্দ নেই, পরিমিতিবোধ নেই, কিংবা অনুভব অনুভূতির অভাবে কবিতার জমিন জুড়ে দেখা যায় প্রখর খরা আর জরা।

তর্ক অথবা যুক্তির মাধ্যমে যেমন সুন্দরকে প্রতিষ্ঠা করা যায় না, ঠিক তেমনিভাবে মনগড়া কিছু অসামঞ্জস্য শব্দের সমভিব্যাহারে সুন্দরকিছু সৃষ্টি করা যায় না। মানব জীবনে মানুষ প্রতিনিয়ত জগৎ ও প্রকৃতির প্রতিটি শিরা-উপশিরায় সুন্দরকে খুঁজার এবং তাকে প্রতিষ্ঠিত করবার নিরন্তর সাধনায় লিপ্ত থাকে। সেই অধরা সুন্দরকে পাওয়ার এবং তাকে উপস্থাপন করার প্রচেষ্টা আদিম গুহাবাসী থেকেই শুরু হয়েছে শিল্পের মাধ্যমে। আর এই শিল্প চিরায়ত চিরন্তন ও চিরপ্রবহমান। কাব্য কলা নাটক নৃত্য’সহ সবকিছুকে ঘিরেই তার আবর্তন বিবর্তন।

একথা আজ সর্বজনগ্রাহ্য ও স্বীকৃত যে, শিল্পের সবচেয়ে শক্তিশালী শাখাই হচ্ছে কবিতা। সেই কবিতার ফেরিওয়ালা কবিতাকর্মি ‘মালেকা ফেরদৌস’ নিরন্তর খুঁজে চলেছেন সুন্দরকে, তার সৃষ্টির ভেতর রুপায়ণ করার প্রত্যয়ে। আর খোঁজাখুজি করতে গিয়ে কবি নিজেই কখনো শাদা পালক হয়ে উড়ে কখনো কৈশোর স্থির হয়ে হয়ে বসে থাকেন ছাদে, আর বুকের ভেতর ভাংতে থাকে শব্দহীন সহস্র পাখির নৈশব্দ্য উড়াল।

কবি মালেকা ফেরদৌস এর কবিতায় গদ্যভঙ্গিকে উপস্থাপন মাধ্যম হিসেবে ব্যবহারের পাশাপাশি যথাযথভাবে নান্দনিক প্রকাশভঙ্গিকে গুরুত্ব দিয়েছেন প্রায়ই সমহারে। এ কারণে তাঁর কবিতার গদ্যভাষাতে যাবতীয় অস্পষ্টতা ও ধোঁয়াশার ভেতরও বক্তব্য প্রকাশের প্রচ্ছন্ন সূত্র সবসময় বিদ্যমান।

মালেকার কবিতার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, কবিতার প্রকাশভঙ্গি জৈবিকতার চেয়েও বেশি আত্মজৈবনিক বা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী। তাঁর এই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ স্পষ্ট। কবি এ-সময়ে মিথাশ্রয়ী বা প্রতীকাশ্রয়ী হয়ে পড়েন। বিষয় হিসেবে বেছে নেন প্রেম-প্রকৃতির মাধুর্য ও সৌন্দর্য, লোকজ উপাদান ও শব্দ, রাত্রির নির্জনতা, গাছের পাতা, দিনের শব্দমুখরতা, পাখির কাকলি। বস্তুত জলে, স্থলে, বাতাসে, অন্তরীক্ষে তিনি কবিতা হাতড়ে বেড়ান। আর এভাবেই মালেকা ছায়াঘেরা গ্রামবাংলার চিরচেনা প্রকৃতির সঙ্গে নগরসভ্যতার একটি যোগসূত্র স্থাপন করে চলেছেন। এক্ষেত্রে তাঁকে সফল বলা যায় অনেকাংশে। আর এজন্যেই হয়তো বিভিন্ন সমালোচক তাঁকে ‘নগর সভ্যতার বিশুদ্ধ উচ্চারণ’ বলতে দ্বিধাবোধ করেন না।

কবি এভাবেই তার কাব্যে নগর-চেতনার পাশাপাশি অত্যন্ত নিপুণ হাতে গ্রামবাংলার আবহমান পটভূমিকে ভাষার বিমূর্ত চিত্রে অঙ্কন করে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত। এই প্রকৃতির কাছে ফিরে যাওয়ার মধ্যেও তিনি তাঁর সমকালীন সমাজ, রাজনীতি, পারস্পরিক সমাজবাস্তবতা থেকে বিমুখ হননি। বস্তুত গ্রামীণ আলোছায়ার ভেতরেই তিনি অত্যন্ত সফলভাবে ভাষা দিয়েছেন নগরের শাশ্বত যাতনাকে। যেখানে কালবোধ, সমাজবোধ, দর্শন ও চলমান চালচিত্র অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। বহুবর্ণখচিত আর বহুরৈখিক তার কবিতার ভাষা এবং সম্ভাষণ বহুমাত্রিক গভীরতা গম্ভীর অগতানুগতিক।

কবি মালেকা বৃষ্টিকে যেমন স্বমহিমায় নিজের হৃদয়ে প্রোথিত করেন, তেমনিভাবে নদী, প্রকৃতি আর বহমান বাংলার রূপে মুগ্ধ হয়ে খোদাই করে রাখেন সেই প্রত্নতাত্ত্বিক স্মৃতি তার মনের গহীনে একান্তভাবেই নিজের মত করে। আমি কবির স্বদেশ প্রকৃতি ও প্রেমের কবিতা গ্রন্থের সম্পাদনা করতে গিয়ে তাঁর রচিত প্রায় কবিতাই পড়ার বিরল সোভাগ্য অর্জন করি। মালেকার কবিতায় যেমনটি আছে প্রবহমানতা তেমনই তার নিজস্ব তৈরি চিত্রকল্প অনেকখানিই স্বমহিমায় উদ্ভাসিত।

এখন তোমাকে দেখার জন্য আমার তৃষ্ণা বেড়ে যায় প্রতিদিন,
জন্মান্তর থাকলে আমি বৃক্ষ হতাম,
আলতা রাঙা ভোর অতল সন্ধ্যায়।
অপেক্ষার মোম হয়ে মিশে যেতাম প্রকৃতি মৃত্তিকায়, কেবল-
তোমার জন্য এই শব্দের কলরোল-
কখনও ছবি কখনও কুয়াশা সাগর, নিলয়, উদ্যানের সুগন্ধ,
কখনও বকুল।
তোমাকে দেখার জন্য আমার কবিতারা
দিকভ্রান্ত পাখি আকাশে আকাশে,
চাঁদের জ্যোৎস্না নামে ফুলের বাগানে
চারদিকে ফিসফাস – কি কথা কাহার সনে?
তোমাকে দেখার জন্য স্রোতবেগহীন
নদীরা জেগেছে স্বচ্ছতোয়া।
প্রাচীন ভারতবর্ষ থেকে মেঘেরা এসেছে,
তোমার জন্য, বৃষ্টি নেমেছে বহুদিন পর, বিস্তৃত মাঠ ভরে গেছে
তৃণ-গুল্মে, সতেজ ঝোঁপ-ঝাড় হারিয়ে যাওয়া পাখিরা ফিরেছে নীড়ে
বহুকাল পর, তোমার জন্য চোখের একবিন্দু জল আলোর বৃত্তের মত
জ্বলে উঠল আজ….

আমার বিশ্বাস, কবি মালেকার স্বদেশ প্রকৃতি ও প্রেমের কবিতাগ্রন্থটি পাঠকের হৃদয় ছুঁয়ে যাবে।

– নূরুল হক, মতিঝিল, ঢাকা।