Home সম্পাদকীয় আজ ৬৭তম শহীদ দিবস ও ২০তম আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস

আজ ৬৭তম শহীদ দিবস ও ২০তম আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস

উম্মাহ রিপোর্ট: বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার অমর একুশে ফেব্রুয়ারি আজ বুধবার। ৬৬তম শহীদ দিবস ও ১৯তম আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। জাতিসংঘের উদ্যোগে বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে ভাষাশহীদদের স্মরণে দিবসটি যথাযথ মর্যাদায় পালিত হবে। সরকারিভাবে গৃহীত বিস্তারিত কর্মসূচি গতকাল মঙ্গলবার দিবাগত মধ্যরাতে একুশে প্রথম প্রহরে  কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জাতির পক্ষ থেকে প্রেসিডেন্ট-প্রধানমন্ত্রীর বিনম্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের মাধ্যমে শুরু হয়। আজ জাতীয় ছুটির দিন। এদিন সূর্যোদয়ের সাথে সাথে সকল সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি ভবনসমূহে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হবে।

এদিকে শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সকল শহীদদের অমর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আলাদা আলাদা বাণী দিয়ে এবং শহীদ মিনারে পুস্পস্তবক অর্পণ করে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন।

মাতৃভাষা আন্দোলনের ৬৭ বছর পূর্ণ হবে আজ। জাতির জন্য এই দিবসটি হচ্ছে চরম শোক ও বেদনার, অন্যদিকে মায়ের ভাষা বাংলার অধিকার আদায়ের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত।

যে কোন জাতির জন্য সবচেয়ে মহৎ ও দুর্লভ উত্তরাধিকার হচ্ছে মৃত্যুর উত্তরাধিকার-মরতে জানা ও মরতে পারার উত্তরাধিকার। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদরা জাতিকে সে মহৎ ও দুর্লভ উত্তরাধিকার দিয়ে গেছেন।
রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১৯৫২ সালের এদিনে ‘বাংলাকে’ বাংলার (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) ছাত্র ও যুবসমাজসহ সর্বস্তরের মানুষ সে সময়ের শাসকগোষ্ঠির চোখ-রাঙ্গানি ও প্রশাসনের ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাজপথে নেমে আসে।

মায়ের ভাষা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে দুর্বার গতি পাকিস্তানি শাসকদের শংকিত করে তোলায় সেদিন ছাত্র-জনতার মিছিলে পুলিশ গুলী চালালে সালাম, জব্বার, শফিক, বরকত ও রফিক গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন।

তাদের এই আত্মদান নিয়ে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ সরদার ফজলুল করিম তার ‘বায়ান্নর আগে’ প্রবন্ধে লিখেছেন ‘বরকত-সালামকে আমরা ভালোবাসি। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা বরকত-সালাম আমাদের ভালোবাসে। ওরা আমাদের ভালোবাসে বলেই ওদের জীবন দিয়ে আমাদের জীবন রক্ষা করেছে। ওরা আমাদের জীবনে অমৃতরসের স্পর্শ দিয়ে গেছে। সে রসে আমরা জনে জনে, প্রতিজনে এবং সমগ্রজনে সিক্ত।’

এদের আত্মদানের মধ্যদিয়ে আমরা অমরতা পেয়েছি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আজ আমরা বলতে পারি দস্যুকে, বর্বরকে এবং দাম্ভিককে : তোমরা আর আমাদের মারতে পারবে না। কেননা, বরকত-সালাম রক্তের সমুদ্র মন্থন করে আমাদের জীবনে অমরতার স্পর্শ দিয়ে গেছেন।’

বরেণ্য শিক্ষাবিদ আবুল ফজল একুশ নিয়ে লিখেছেন ‘মাতৃভাষার দাবি স্বভাবের দাবি। ন্যায়ের দাবি, সত্যের দাবি- এ দাবির লড়াইয়ে একুশে ফেব্রুয়ারির শহীদরা প্রাণ দিয়েছেন। প্রাণ দিয়ে প্রমাণ করেছেন, স্বভাবের ব্যাপারে, ন্যায় ও সত্যের ব্যাপারে কোন আপোষ চলেনা, চলেনা কোন গোঁজামিল। জীবন-মৃত্যুর ভ্রুকুটি উপেক্ষা করেই হতে হয় তার সম্মুখীন।

মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ’৫২-এর একুশে ফেব্রুয়ারি ছিলো ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ ও শাসকগোষ্ঠির প্রভূসুলভ মনোভাবের বিরুদ্ধে বাঙালির প্রথম প্রতিরোধ এবং ভাষার ভিত্তিতে বাঙালির জাতীয় চেতনার প্রথম উন্মেষ।

মোস্তফা কামালের ‘ভাষা আন্দোলন, সাতচল্লিশ থেকে বায়ান্ন’ শীর্ষক গ্রন্থসহ ঐতিহাসিক দলিল-দস্তাবেজ অনুযায়ী, পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের ‘ হোমরা-চোমরা’ ব্যক্তিদের ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’ পুনঃপুনঃ এমন বক্তব্যের পর ওই সময় ছাত্র-শিক্ষকসহ সুধী সমাজে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। চাপা জনরোষ একসময় বাঁধভাঙ্গা আন্দোলনের রূপ নেয়। ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘তমদ্দুন মজলিস’-এর সংগঠিত ভাষা আন্দোলনে এক সময় রাজনৈতিক নেতাকর্মীরাও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।

১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের অব্যবহিত পর থেকেই রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে এ জনপদের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলা ভাষাভাষীরা ফুঁসে উঠতে থাকে। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান হয়ে ওঠে জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি। পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকার ভাষা আন্দোলনকে বানচাল করতে ২০ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা ৬টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় মাইকযোগে প্রচার করে ‘আগামী একমাস ১৪৪ ধারা চলাকালে কোনো মিটিং-মিছিল করা চলবে না। এমনকি পাঁচজন একত্রে হাঁটাচলাও করতে পারবে না।’ ঐদিন রাতেই রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ নেতৃবৃন্দ একুশে ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমতলায় ছাত্রসভা ও ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার সিদ্ধান্ত নেন। সে অনুযায়ী আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করা শ্লোগানে অগ্রসরমান একটি মিছিল বিকাল ৪টায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল হোস্টেলের সামনে পৌঁছলে পুলিশ অতর্কিতে গুলীবর্ষণ করে। শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করেন রফিক, জব্বার-সালামরা। তাদের বুকের তাজা রক্তে ভেসে যায় পিচঢালা রাজপথ। বৃক্ষশাখের পলাশ-শিমুল হয়ে ওঠে আরো লাল। সেই থেকেই আমরা পেয়েছি ‘অ আ ক খ’ আপন করে।

ভাষা শহীদদের রক্তের বিনিময়ে বাঙালি জাতি সেদিন ‘মায়ের ভাষার’ মর্যাদা অর্জনের পাশাপাশি রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রেও পায় নব প্রেরণা। এরই পথ বেয়ে শুরু হয় বাঙালির স্বাধীকার আন্দোলন এবং একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ।

পরবর্তী নয় মাস পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বিশ্বের মানচিত্রে সংযোজিত হয় নতুন এক স্বাধীন সার্বভৌম দেশ- ‘বাংলাদেশ’। একুশে ফেব্রুয়ারি শোকাবহ হলেও এর যে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় তা পৃথিবীর বুকে অনন্য। কারণ, বিশ্বে এ যাবতকালে একমাত্র বাঙালি জাতিই ভাষার জন্য জীবন দিয়েছে।

জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা (ইউনেস্কো) ১৯৯৯ সালে মহান একুশের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি দেয়ার পর থেকে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও গত কয়েক বছর ধরে দিবসটি পালিত হচ্ছে।