গত বছরের ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের সময় ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্যারিসে অবস্থান করছিলেন। ৮ আগস্ট দেশে ফিরে তিনি বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, “বাংলাদেশের সামনে একটি অসাধারণ সুযোগ এসেছে। এই সুযোগ আর হাতছাড়া করা যাবে না।” তাঁর কথায় দেশবাসী আশাবাদী হয়েছিল।
কিন্তু আজ ১০ মাস পর, সেই আশাবাদ যেন ধীরে ধীরে হতাশায় রূপ নিচ্ছে। দেশের মানুষ মনে করছে, এই সুযোগটি জনগণের জন্য নয়, বরং একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর স্বার্থেই ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী না হয়েও কার্যত প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে তাঁর ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠেছে।
নিঃসন্দেহে, ড. ইউনূস একজন নোবেলজয়ী বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তি। তাঁর প্রতি সবারই সম্মান ও প্রত্যাশা ছিল যে, এই সঙ্কটকালে তিনি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে গণতান্ত্রিক পথে এগিয়ে নেবেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে দেখা যাচ্ছে, তিনি ক্রমেই একটি পক্ষবিশেষের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। এতে জনগণের আস্থা ও নিরপেক্ষতার ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে।
ড. ইউনূস দায়িত্ব গ্রহণের পরই তাঁর বিরুদ্ধে থাকা কর ফাঁকির মামলাগুলো দ্রুত প্রত্যাহার করা হয়, আদালতও একাধিক মামলা বাতিল করেন। অথচ রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে বিগত সরকারের আমলে দায়ের করা হয়রানিমূলক মামলাগুলোর নিষ্পত্তিতে তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। বিশেষ করে বিএনপির নেতাদের মামলা দীর্ঘসূত্রতায় বন্দী।
এছাড়াও, তাঁর স্বার্থসংশ্লিষ্ট গ্রামীণ ব্যাংকের বিষয়ে নেওয়া সিদ্ধান্ত, নতুন বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন কিংবা রিক্রুটিং এজেন্সির ছাড়পত্র দেওয়া অনেকের কাছেই প্রশ্নবিদ্ধ। এসব পদক্ষেপ একটি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানের পক্ষে কতটা যুক্তিযুক্ত, তা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে।
১০ মাসে তাঁর ১০টি বিদেশ সফরও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। এই সময়ে মধ্যপ্রাচ্যসহ বেশ কয়েকটি দেশ বাংলাদেশিদের ভিসা বন্ধ করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কও দৃশ্যত দুর্বল হয়েছে।
আরও উদ্বেগজনক বিষয় হলো, জুলাই বিপ্লবের প্রেক্ষিতে গঠিত এনসিপি নামের নতুন রাজনৈতিক দলের প্রতি ড. ইউনূসের প্রকাশ্য পক্ষপাতিত্ব। এই দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দুইজন ব্যক্তি এখনো সরকারে উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন, যদিও সরকারকে নিরপেক্ষ থাকা উচিত।
সবচেয়ে বড় প্রশ্ন উঠেছে নির্বাচন নিয়ে। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বারবার বলা হয়েছে, ১ জানুয়ারির মধ্যে নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে। অধিকাংশ রাজনৈতিক দলও ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন চায়। কিন্তু ড. ইউনূস বারবার সময় বাড়ানোর কথা বলেছেন। এমনকি জাপান সফরে গিয়ে তিনি মন্তব্য করেন, “ডিসেম্বরে শুধু একটি দলই নির্বাচন চায়,” যা স্পষ্টতই পক্ষপাতমূলক ও বিভ্রান্তিকর।
এছাড়া ইশরাক হোসেনের মেয়র পদে শপথ বিলম্ব, রাজনৈতিক সংলাপের ব্যর্থতা ও আন্দোলনের প্রতিক্রিয়ায় তাঁর পদত্যাগের ইচ্ছা প্রকাশ—সব মিলিয়ে মনে হয়েছে তিনি নিজেই নির্বাচন পিছিয়ে দিতে চান, এবং যারা নির্বাচন চায় না তাদের একত্রিত করার চেষ্টা করছেন।
সম্প্রতি রাখাইন করিডর ও চট্টগ্রাম বন্দর ইস্যুতে সরকারের কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েও জাতীয় পর্যায়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো বলছে, এসব বিষয়ে সরকার বিদেশি শক্তির প্রতি দায়বদ্ধ। এই প্রশ্নও উঠেছে—ড. ইউনূস কি কোনো বিশেষ এজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজ করছেন?
ড. মুহাম্মদ ইউনূস একজন সম্মানিত মানুষ, এবং দেশের মানুষ তাঁর কাছ থেকে নিরপেক্ষতা ও নৈতিকতার দৃষ্টান্ত আশা করে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, তিনি যেভাবে বিতর্কে জড়িয়েছেন তা তাঁর সম্মানকেই ক্ষতিগ্রস্ত করছে। আমরা আশা করি, তিনি দ্রুত তাঁর অবস্থান পুনর্মূল্যায়ন করবেন এবং এমন সিদ্ধান্ত নেবেন, যা জাতীয় স্বার্থ ও গণতন্ত্রকে অগ্রাধিকার দেয়।