Home রাজনীতি মানবিক বিপর্যয়ের আরেক ভরকেন্দ্র হতে চলেছে আসাম

মানবিক বিপর্যয়ের আরেক ভরকেন্দ্র হতে চলেছে আসাম

।। আলতাফ পারভেজ ।।

আপাত কিছু দিন আসাম নিয়ে আলাপ না করলেই নয়। আরাকানের পর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মানবিক বিপর্যয়ের আরেক ভরকেন্দ্র হতে চলেছে আসাম। না চাইলেও বাংলাদেশের এই বিপর্যয়ের বাইরে থাকার সুযোগ নেই। সুতরাং আলাপ-আলোচনা জরুরী। ধারাবাহিক এই বিবরণের মূল অংশে প্রবেশের আগে একটি প্রতীকী তথ্য দিয়ে আলাপ শুরু হোক।

উপরের ছবির মানুষটিকে অনেকেই চেনেন হয়তো। বদরুদ্দিন আজমল। দেখতে মাওলানা ভাসানীর মতো। আসামের ধুবরি থেকে গত দুই মেয়াদে লোকসভার এমপি। স্থানীয়রা তাঁকে ‘ধুবরির হুজুর’ বলে। বলা যায়, আজমল এখন ভারত নিয়ন্ত্রিত রাজ্যটির দ্বিতীয় ভাসানী।

আসামের নওগাঁ জেলায় জন্ম নেয়া বদরুদ্দীন আজমল পারিবারিকভাবে বড় ব্যবসায়ী। আগর ব্যবসা করেন তাঁরা। ব্যবসা-বাণিজ্য ও সমাজ সেবার জগতেই ছিল তাঁর বিচরণ। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বড় গ্রামীণ হাসপাতাল হাজী আবদুল মজিদ মেমোরিয়াল হাসপাতাল ছাড়াও আসাম জুড়ে শত শত দাতব্য কাজে যুক্ত বদরুদ্দিন আজমল। তবে ২০০৬-এ রাজনীতিতে যোগ দিয়েই আসামের রাজনীতির পুরনো ছকটি পাল্টে দিতে শুরু করেন।

বদরুদ্দিন আজমলের নেতৃত্বাধীন দলের নাম ‘অল ইন্ডিয়া ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট’। জন্মের ছয় মাসের মাথায় এই দল নির্বাচনে (২০০৬) অংশ নিয়ে আসন পায় ১২৬-এর মধ্যে ১০টি; পরের নির্বাচনে পায় ১৮টি এবং সর্বশেষ নির্বাচনে পেয়েছে ১৩টি।

আসামের সবচেয়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠী বাংলাভাষী মুসলমানরা এই দলের সমর্থকদের একটা বড় অংশ। বাংলাভাষী এই মুসলমানরা অতীতে বিভিন্ন দলের সামান্যই মনযোগ পেতো। কিন্তু বদরুদ্দিন আজমল তাদের পৃথকভাবে সংগঠিত করা শুরু করলেই ভারত নিয়ন্ত্রিত রাজ্যটির ভোটের হিসাব-নিকাশ পাল্টাতে শুরু করে। ভারতীয় মিডিয়ার বিশেষ মনযোগ পড়ে সমাজের একেবারে তলদেশীয় বর্গের দরিদ্র মুসলমানদের প্রতি এবং এরূপ ঘৃণাপূর্ণ শোরগোলও শুরু তখন থেকেই- ‘আসাম ভারতের দ্বিতীয় মুসলমানপ্রধান রাজ্য হয়ে যাচ্ছে’।

এরূপ ভয়ার্ত এবং উস্কানিমূলক প্রচারণার গূঢ় কারণ হলো, আসামের ১২৬টি নির্বাচনী এলাকার ৩৫টিতে বাংলাভাষী মুসলমানরা সংখ্যায় উল্লেখযোগ্য।

এরপরই আসে আসামের ডেমোগ্রাফি পাল্টে দেয়ার প্রকল্প। বিজেপি প্রকাশ্যেই বলতে থাকে- আসাম থেকে ‘অবৈধ’ বাঙলাভাষী মুসলমানদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হবে। তারই সূচনা পদক্ষেপ হিসেবে গত ৩১ ডিসেম্বর রবিবার রাতে আসামের বিজেপি সরকার নাগরিকত্বের যে তালিকা প্রকাশ করেছে, তাতে গত ৯ বছর ধরে লোকসভার সদস্য থাকা বদরুদ্দিন আজমলের নামটিই নেই।

বলাবাহুল্য, আসামের নাগরিকত্বের প্রথম তালিকা থেকে আরও ১ কোটি ৪০ লাখ বাদ পড়া মানুষের সঙ্গে আজমলের নামটি যুক্ত হওয়ার গুরুত্বপূর্ণ প্রতীকী বার্তা আছে।

 

আসামের বাঙ্গালি বন্দি শিবিরগুলো এবং আসামের অর্থনীতি

অনেকেই মনে করছেন বর্মায় রোহিঙ্গাদের সর্বশেষ গণহত্যা ও বিতাড়ন উদ্যোগের সফলতা দেখে ভারত নিয়ন্ত্রিত আসামে বিজেপি অনুরূপ উদ্যোগ শুরু করেছে। এটা এই অর্থে ভুল ধারণা যে, আসামে এই উদ্যোগটি অনেক পুরানো।

আসামে বাংলাভাষীদের গণহত্যা ও বিবিধ নিপীড়নের অনেক ইতিহাস রয়েছে। বহুরূপে নিয়মিতই এসব ঘটছে। কিন্তু বাংলাদেশের সীমান্ত দেশে এসব ঘটলেও বাংলাদেশের বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদী এগুলো সম্পর্কে শুনতে-বুঝতে চায়নি অতীতে। চূড়ান্ত গণহত্যা শুরুর আগে রোহিঙ্গাদের অতীত নিপীড়িত অধ্যায় সম্পর্কে আমরা যেমন জানতে চাইতাম না, আসামের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে।

সর্ব-সাম্প্রতিক নাগরিক তালিকার আগে থেকেই আসামের বাংলাভাষীরা কীরূপ ধর-পাকড়-নিপীড়নের মধ্যে আছে, তার একটা বড় উদাহরণ সেখানকার ‘ডিটেনশন সেন্টার’গুলো। বর্তমানে আসামের অন্তত ছয়টি স্থানে (গোয়ালপাড়া, কোকড়াঝাড়, শিলচর, দিব্রুগড়, জোড়হাট, তেজপুর) কারাগারের মতো করে তৈরি এইরূপ ডিটেনশন সেন্টারগুলোতে বাংলাভাষীদের বন্দি করে রাখা হয়েছে- সন্দেহজনক মানুষ তথা ‘ডি-ভোটার’ (ডাউটফুল ভোটার) এবং ‘বিদেশী’ তকমা দিয়ে। গোয়ালপাড়াতে ২০ বিঘা জমির উপর নির্মিত হচ্ছে সমগ্র ভারতের সবচেয়ে বড় ডিটেনশন সেন্টার (এবং অবশ্যই এটা আসামের একটা মুসলিম প্রধান জেলা!)

ছবিতেই দেখতে পাচ্ছেন আলোচ্য ডিটেনশন সেন্টারগুলোর বন্দিদের মধ্যে পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও আছেন এবং এরা আসামের সবচেয়ে দরিদ্র মানুষদের অংশ। বর্তমানে প্রায় দুই হাজার মানুষ আছেন এসব সেন্টারে। তবে প্রতিনিয়তই এসব ডিটেনশন সেন্টারের বন্দি সংখ্যা বাড়ছে এবং বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর তা আরও বেগবান হয়েছে। যাদের কাছেই নাগরিকত্বের ‘সন্তোষজনক’ কাগজপত্র পাওয়া যায় না- এমন বাংলাভাষীদেরই এইরূপ ডিটেনশন সেন্টারে পুরে দেয়া হচ্ছে। আসামের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এরকম প্রায় এক লাখ ‘অবৈধ মানুষ’-এর তালিকা নিয়ে নিয়মিতই অনুসন্ধান ও গ্রেফতার কার্যক্রম চালায়।

ছবিটি দেখুন। এই তরুণের নাম মঈনাল মোল্লা। আসামের বরপেটা জেলার বাসিন্দা। ২০১৩ সালের ৫ সেপ্টেম্বর তাকে নিজ বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে ডিটেনশন সেন্টারে পুরে রাখা হয়েছিল। প্রায় তিন বছর পর আইনযুদ্ধের মাধ্যমে তিনি মুক্তি পান। বলা হচ্ছে, মোল্লা আসামে নাগরিক নয় (সুতরাং বাংলাদেশী)। অথচ মঈনাল মোল্লাদের পরিবারের ১৯৩৮ সালে করা জমি রেজিস্ট্রেশনের প্রমাণও রয়েছে। তার দাদার নামও রয়েছে সেখানকার ১৯৬৬ সালের ভোটার লিস্টে। মুশকিলের দিক হলো, ভারত জুড়ে আর খুব কম প্রদেশেই মানুষকে নাগরিকত্ব প্রমাণের এই বোঝা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে- যেমনটি করতে হচ্ছে আসামের বাংলাভাষীদের।

২০০৪ থেকে সেখানে এই কার্যক্রম চলছে- যদিও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মানবাধিকার আন্দোলনে আসামের বাংলাভাষীদের এই বঞ্চনাদগ্ধ অধ্যায় কোন বড় এজেন্ডা হয়ে ওঠেনি। বরং প্রতিনিয়ত ভারতীয় প্রধান প্রধান প্রচার মাধ্যমে এই ‘অবৈধ বাংলাভাষী’দের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানো ছাড়াও এই মর্মেও মন্তব্য জুড়ে দেয়া হয়- এরা বাংলাদেশ থেকে যাওয়া মানুষ।

ভারতের প্রদেশগুলোর মধ্যে আসাম প্রধানতম এক দারিদ্র্য কবলিত অঞ্চল। এখানে জনসংখ্যার ৩২ শতাংশ দারিদ্র্যসীমার নীচে অবস্থান করে। এটা বিশ্বব্যাংকের হিসাব। অন্যদিকে একই সংস্থার হিসাবে বাংলাদেশে হতদরিদ্রদের হার এখন ১৩ শতাংশের মতো এবং সাধারণ দারিদ্র্যের হার ২০ শতাংশের নীচে।

আমি এখানে এই মর্মে দুটি গ্রাফ তুলে ধরছি যাতে সাধারণ কান্ডজ্ঞান সম্পন্ন মানুষমাত্রই বুঝতে পারবেন যে, বাংলাদেশ থেকে অর্থনৈতিকভাবে উন্নত জীবন-যাপনের জন্য আসামে যাওয়ার ধারণাটি কত অযৌক্তিক।

দারিদ্র্য পরিস্থিতিতে অসমের অবস্থা ভারতীয় গড়ের চেয়েও খারাপ (হলুদ চিহ্ন) (ভারতীয় গড় দেখুন দশম কলামে)

প্রথম গ্রাফটিতে দেখুন, দারিদ্র্য পরিস্থিতিতে আসামের অবস্থা কী এবং কীভাবে তা ভারতীয় গড়ের চেয়েও খারাপ।

লাল রঙ দারিদ্র্যের মাত্রা নির্দেশ করছে

দ্বিতীয় গ্রাফটিতে দেখুন আসামের দারিদ্র্য পরিস্থিতিতে (লাল রঙ দারিদ্র্যের মাত্রা নির্দেশ করছে) সবচেয়ে খারাপ জেলাগুলোই মুসলমান প্রধান (যেমন, ধুবরি, নওগাঁ ইত্যাদি।) আবার মাথাপিছু আয়ে আসামের নাগরিকদের অবস্থান বাংলাদেশের অর্ধেকের চেয়েও খারাপ।

স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, দারিদ্র্য পীড়িত উপরোক্ত জনপদে বাংলাদেশের মানুষ কেন যাবে? কিন্তু এইরূপ যৌক্তিক প্রশ্নের ধার না ধেরেই এখানকার শাসক এলিট সফলতার সঙ্গে একটি কাজ করে চলেছেন- তাহলো বাংলাভাষী দরিদ্র মানুষ পেলেই তাকে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া ‘বিদেশী’ অভিহিত করা, তার নাগরিক অধিকার অস্বীকার করা এবং তাকে ডিটেনশন সেন্টারে পাঠিয়ে দেয়া।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে এবং যুদ্ধকালে নাজিরা অনেক কনসেনট্রেশন ক্যাম্প গড়ে তুলেছিল।

প্রথম দিকে রাজনৈতিক ভিন্নমতালম্বীদের এবং পরে ধীরে ধীরে ‘অগ্রহণযোগ্য নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীগুলো’কে এগুলোয় রাখা হতো। ১৯৪৫ নাগাদ এসব ক্যাম্পে বন্দি মানুষের সংখ্যা সাত লাখ অতিক্রম করেছিল। কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের বাইরে নাজিরা গড়ে তুলেছিল ‘এক্সট্রামিনেশন ক্যাম্প’। কনসেনট্রেশন ক্যাম্পকে যদি বন্দিশিবির বলি, ‘এক্সট্রামিনেশন ক্যাম্প’কে বলতে হবে নির্মূল শিবির।

আসামের বর্তমান ‘বাংলাদেশী বন্দিশিবিরগুলো’ কী ৭০ বছর আগের নাজি শিবিরগুলোর সঙ্গে তুলনীয়? জানি সিরিয়াস ভিন্নমত থাকবে অনেকের। তবে স্পষ্টতঃ খানিকটা নাজি মাইন্ডসেটের ছাপ আছে এতে।

[চলবে]