Home ইসলাম মুসলমানদের পারস্পরিক সুদৃঢ় ঐক্য ও সম্প্রীতি ঈমানের অপরিহার্য দাবী

মুসলমানদের পারস্পরিক সুদৃঢ় ঐক্য ও সম্প্রীতি ঈমানের অপরিহার্য দাবী

।। মুহাম্মদ আবুল বাশার (বাবু) ।।

প্রকৃত মু’মিন হচ্ছে যারা সর্বক্ষেত্রে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সার্বক্ষণিক আনুগত্য করে। দুনিয়ার লোভ-লালসা-মোহ তাদেরকে কিছুতেই আল্লাহর বিধান ও রাসূলের আদর্শ থেকে দূরে ঠেলে দিতে পারে না। আর একজন ঈমানদারের প্রতিটি কাজ হতে হবে স্রেফ আল্লাহর জন্য। নবী-রাসূলগণ মানুষের মাঝে আল্লাহ তাআলার ওয়াহ্দানিয়্যাতের দাওয়াত দেওয়ার পাশাপাশি মু’মিনদেরকে কালেমার ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ করার গুরুদায়িত্বও পালন করেছেন।

প্রকৃতপক্ষে মু’মিনগণ পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধ, মায়া-মমতা ও সৌহার্দপুর্ণ সম্পর্কে একটি অবিচ্ছিন্ন দেহের মতই। তারা একে অপরের প্রতি অত্যন্ত সহনশীল ও কোমল প্রাণ। মহান রাব্বুল আলামীন ইসলামের সৌহার্দপূর্ণ ভ্রাতৃত্বের পরিপূর্ণতা প্রতিষ্ঠার জন্যই ইসলামী বিধানের সামনে সবল-দুর্বল, আশরাফ-আতরাফ ও ধনী-গরীব সকলকে সমান মর্যাদা দিয়েছেন। সাইয়্যিদুল মুরসালীন হযরত রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঐক্যের মজবুত ভিত্তি রচনার উদ্দেশ্যেই মুহাজির ও আনসারদের মাঝে এক অভূতপূর্ব ভ্রাতৃত্ব বন্ধনের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ধন-সম্পদ ও ভোগের অসাধারণ ত্যাগ ও কুরবানীর মাধ্যমে গড়া এ ভ্রাতৃত্ব বন্ধনের প্রভাব ছিল অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী।

মুসলমানরা সংখ্যায় কম হওয়া সত্ত্বেও একতার বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার কারণেই কাফির, মুশ্রিক, ইহুদী, নাসারাদের বিশাল বিশাল শক্তিশালী সৈন্যবাহিনীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে নিরঙ্কুশভাবে বিজয়ী হয়েছিলেন। মুসলমানরা সেদিন একতাবদ্ধতা ধরে রাখার ফলেই অনেক বড় বড় শক্তিধর সম্রাট ও দাম্ভিক শাসকদের নির্যাতন ও দুঃশাসনের অবসান ঘটিয়ে দেশ-দেশান্তরে আল্লাহর কালেমার বিজয়ী পতাকা উড়াতে সক্ষম হয়েছিলেন। তারা সামরিক শক্তি, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও ধন-সম্পদ প্রভৃতিতে অপ্রতিদ্বন্দ্বি হয়েছিলেন এবং চারিত্রিক গুণাবলীতে দুনিয়া, আখেরাত উভয় জাহানে সফলতা অর্জন করেছিলেন।

সে যুগে মুসলমানরা সর্বসম্মত সিদ্ধান্তের মাধ্যমেই কাজ সমাধা করতেন। নেক আমল ও খোদাভীতির উপর মজবুত থেকে পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে তারা দায়িত্ব পালন করতেন। ফলে আল্লাহ তাআলার অবারিত সাহায্য তাদের হাত ও মনোবলকে মজবুত করতো।

আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন- “পৃথিবীতে যাদেরকে দুর্বল করে রাখা হয়েছিল আমার ইচ্ছা হল তাদের প্রতি অনুগ্রহ করার তাদেরকে নেতা বানাবার এবং তাদেরকে দেশের উত্তরাধিকারী করে দেবার”। ডান হাত অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী ও ফযীলতপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও বাম হাতের সহযোগিতা ছাড়া কোন কাজ সহজে করা যায় না। তেমনিভাবে মু’মিনরা পরস্পর বিভক্ত ও বিচ্ছিন্ন হয়ে কোন মহৎ উদ্দেশ্য সাধন করতে পারে না।

তারা যদি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ন্যায়-নীতির উপর একতাবদ্ধ হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে চূড়ান্ত বিজয় তাদের জন্য অবধারিত। আর আল্লাহ তাআলা ধৈর্যশীলদের সহায় হয়েই আছেন। কুরআনে কারীমে ইরশাদ হচ্ছে- যাদের ধারণা ছিল যে, আল্লাহর সামনে তাদেরকে উপস্থিত হতে হবে। তারা বলতে লাগল সামান্য দলই তো বিরাট দলের মোকাবেলায় বিজয়ী হয়েছে আল্লাহর হুকুমে। আর আল্লাহ নিশ্চয়ই ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন। (সূরা বাক্বারা)।

আমরা বদরের যুদ্ধের দিকে তাকালে দেখতে পাই যে, হক্ ও বাতিলের মাঝে সংঘটিত প্রথম সশস্ত্র লড়াইয়ে পর্যাপ্ত যুদ্ধাস্ত্রে সুসজ্জিত হাজার কাফির যোদ্ধার বিরুদ্ধে মাত্র তিন শত তের জন নির্ভীক মু’মিন মুজাহিদ অস্ত্রের স্বল্পতা সত্ত্বেও নিঃসংকোচে বিজয়ী হয়েছিলেন, যা ইতিহাসের পাতায় আজো ঝকঝক করছে। আর এই বিজয়ের একমাত্র কারণ হচ্ছে, আল্লাহ তাআলা এ সত্যনিষ্ঠ বান্দাদের সাহায্য করেছিলেন। যারা সত্যকে জেনে বুঝে আন্তরিকতার সাথে কবুল করেন, শরীরের কাল-সাদা, লাল-পাতী বর্ণের পার্থক্য ভুলে গিয়ে বংশ মর্যাদার সকল তারতম্য উপেক্ষা করে মজবুত অবস্থান গ্রহণ করে অন্যায় ও অসত্যকে সমলে উৎপাটিত করার এক ঐক্যবদ্ধ সংকল্প গ্রহণ করেছিলেন।

অন্যদিকে কৌশলগত কারণে ওহূদ যুদ্ধে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে আদেশ দিয়েছিলেন, তা পুরোপুরি পালনে ব্যর্থ হয়ে তারা এক ধরনের ইজতিহাদী ভুল করেছিলেন। যার ফলেই মুসলমানরা সাময়িক পরাজয়ের সম্মুখীন হয়েছিলেন। বস্তুতঃ এটা ছিল আল্লাহর পক্ষ থেকে তার প্রিয় বান্দাদের জন্য একটি ফলপ্রসূ শিক্ষা, যা যুগের পর যুগ মু’মিনদের পাথেয় হিসেবে কাজ করবে এবং তারা যেন ঐক্যের সুফল ও অনৈক্যের চরম পরিণাম উপলব্ধি করতে পারে।

কারণ, আল্লাহ তাআলার বিধানই হল, তিনি কৃতজ্ঞতা আদায়কারী বান্দাদের পুরস্কৃত করবেন এবং সাথে সাথে বিরুদ্ধাচরণকারীদেরকে তাদের কর্মফল অনুযায়ী শিক্ষা পাওয়ার ব্যবস্থা করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিদায়ের পর মুসলমানরা বেশ কিছুদিন ধরে ঐক্যবদ্ধ থাকার ফলে সমগ্র বিশ্বের তারা ইজ্জত-সম্মান, প্রভাব-প্রতিপত্তি ও দুর্জয় মনোবল নিয়ে এক অপ্রতিরোধ্য শক্তি হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত ছিলেন। দুনিয়ার বড় বড় ক্ষমতাধর সম্রাট, সেনাপতি, শাসকরা তাদের ভয়ে কম্পমান থাকতো।

কিন্তু যখনই মুসলমানদের কিছু অংশ বিভিন্ন ভ্রান্ত ও গোমরাহী আক্বীদা-বিশ্বাসে লিপ্ত হয়ে খারেজী, রাফেযী, শিয়া ইত্যাদি বিভিন্ন  দলে উপদলে বিভক্ত হয়ে শতধা বিচ্ছিন্ন হলেন। তখনই তাদের সেই অপ্রতিরোধ্য শক্তি সম্পূর্ণ মাটিতে পরিণত হল, লাঞ্ছিত অপমানিত হল মুসলমানরা। আজো সেই অনৈক্য আমাদের মাঝে বিরাজ করছে। তবে কে হক্ব আর কে বাতিল- তা বলা এখানে আমার উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু হক-বাতিলের ফারাক বাদ দেওয়ারও কোন সুযোগ নেই।

অনেকে ঐক্যের শ্লোগান দিয়ে হক-বাতিল, সত্য-মিথ্যাকে জগাখিচুড়ি বানাতে চায়, যা মোটেই কাম্য নয়। তাই যত শীঘ্রই মুসলমানরা নিজেদের ভুল স্বীকার করে ঐক্যের পথে না আসবে, ততদিন তারা লাঞ্ছনার গ্লানি বোঝা হিসেবেই বহন করতে থাকবে। আল্লাহ তাআলা মুসলমানদেরকে সত্যকে বোঝার, গ্রহণ করার এবং একতাবদ্ধ থাকার তাওফীক দান করুন। আমীন।

আরও পড়ুন- ‘পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের কর্তব্য’