Home রাজনীতি আদর্শবান মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়তে হলে যেসব গুণাবলী অর্জন করতে হবে

আদর্শবান মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়তে হলে যেসব গুণাবলী অর্জন করতে হবে

।। মুফতি জাকির হোসাইন কাসেমী ।।

উম্মাহ রিপোর্ট: ছাত্র জমিয়ত বাংলাদেশ একটি আদর্শ ছাত্র সংগঠন। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী এই সংগঠনের সকল নেতাকর্মীকে একজন আদর্শবান মানুষের গুণাবলী অর্জন ও চর্চা করে চলতে হয়। আশরাফুল মাখলুকাত তথা উত্তম সৃষ্টজীব হয়ে নিজেকে ছাত্র জীবন থেকেই গড়ে তুলতে হবে।

আদর্শ জীবন গড়ার জন্য ৪টি শর্ত রয়েছে। এই ৪টি শর্ত আত্মস্থ করে সকলকে ছাত্র জীবনে থেকেই অনুশীলন করে চলতে হবে। এর এক নম্বর শর্ত হচ্ছে, পাক-পবিত্র ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা। জীবনের সর্বস্তরে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, পাক-পবিত্র, সুন্দর ও পরিপাটি হয়ে হয়ে চলতে হবে। নোংরা, অপরিষ্কার, অগোছালো ও বিশৃঙ্খল হয়ে চলা যাবে না।

দ্বিতীয় শর্ত হচ্ছে, সুস্থির, ধৈর্যশীল, সহিষ্ণু এবং জ্ঞান খরচ করে কাজ করা। অস্থির, অধৈর্য ও আবেগাপ্লুত হয়ে কাজ না করা। যে কোন কাজের সময় বুঝে, শুনে, সুস্থির হয়ে, ভাবনা-চিন্তা ও ভবিষ্যত ভাল-খারাপের পরিণতি বিশ্লেষণ করে আল্লাহর উপর ভরসা করে কাজ শুরু করা। চিন্তা-ভাবনা ছাড়া হুটহাট বা মন যা চাইল তা করা যাবে না।

উন্নত জীবন গঠনের তৃতীয় শর্ত হচ্ছে, ইনসাফ ও ন্যায়-নিষ্ঠাবান হওয়া। ব্যক্তি, পারিবারিক, সমাজ ও জাতীয় জীবনে যে কোন কাজকর্ম ও লেনদেনের সময় ন্যায়-নিষ্ঠা, সততা, আমানতদারি, ইনসাফ ও সুবিচারের পরিপূর্ণ অনুগামী হওয়া। কারো অধিকার ও হক বিন্দু পরিমাণও নষ্ট করার বা খেয়ানত করার মানসিকতা পরিত্যাগ করতে হবে। ব্যক্তি জীবনে নিজের উপর অর্পিত সকল দায়িত্ব পরিপূর্ণ সততা ও ইনসাফের সাথে আদায় করতে হবে। হক্কুল্লাহ ও হক্কুল ইবাদ তথা আল্লাহর হক ও বান্দার হক্ব এর বিষয়ে সামান্যতম খেয়ানতের চিন্তাও দিল থেকে সম্পূর্ণ পরিত্যাগ করতে হবে। জীবনের সর্বস্তরে ইনসাফ, সুবিচার ও সততার সাথে চলতে হবে। নিজের শরীরের, স্ত্রীর, সন্তানদের, আত্মীয়-স্বজনদের, পাড়া-প্রতিবেশী এবং দেশ ও জাতির হক্ব নিজের অবস্থান অনুপাতে ন্যায় ও ইনসাফের সাথে আদায় করতে হবে।

উন্নত জীবন গড়ার চতুর্থ শর্ত হচ্ছে, ইহসান তথা উদারতার গুণ থাকা। মনকে বড় ও উদার করতে হবে এবং সংকীর্ণতা ও কৃপণতা পরিহার করতে হবে। মানবিক দয়া-মায়ার গুণ অর্জন করতে হবে। নিজের রাগ দমন এবং ক্ষমা ও দয়াপ্রদর্শন করা। মানুষকে সাহায্য-সহযোগিতা করা। যার যার সাধ্যমতো মানবতার জন্য ও মাখলুকের কল্যাণে কাজ করা। নিজের চাওয়া-পাওয়ার বাইরে স্ত্রী, সন্তান, আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী, সমাজ ও জাতির কল্যাণকামী হওয়া এবং সাধ্যমতো সেবা করা।

এই চার গুণের সমাবেশ যার মধ্যে পাওয়া যাবে, বুঝতে হবে তাঁর মধ্যে আদর্শ মানুষ রূপে বিবেচিত হওয়ার গুণাবলী আছে। আর যার মধ্যে এই চার গুণ নেই, বুঝতে হবে সে দেখতে মানুষ হলেও মানবিক গুণাবলীর কাতারে পড়ে না। সে পশু বা পশুর চেয়েও অধম। সুতরাং ছাত্র জমিয়তের প্রতিটি কর্মীকে এই চার গুণাবলী অর্জনে সবসময় সজাগ ও চেষ্টা সাধনা করে যেতে হবে।

মনে রাখতে হবে, রাজনীতির পাঠ অনেক কঠিন ও সাধনার বিষয়। উপযুক্ত জ্ঞান, প্রশিক্ষণ এবং নীতি-আদর্শের প্রতি দৃঢ় আনুগত্য ছাড়া রাজনীতি করা এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বের দিকে অগ্রসর হওয়া অনেকটা মাঝ দরিয়ায় নাবিকহীন জাহাজের মতো। সুতরাং ছাত্র রাজনীতিতে জড়িত নেতাকর্মীদেরকে আগামীতে দেশ ও জাতিকে দক্ষতার সাথে নেতৃত্ব দিতে মুরুব্বীদের তত্ত্বাবধানে থেকে উপযুক্ত জ্ঞান অর্জন এবং দিক-নির্দেশনা গ্রহণ করে যোগ্য হয়ে গড়ে উঠতে হবে।

রজনীতির ময়দানে সফলতা পেতে হলে এবং উপযুক্ত নেতা হিসেবে গড়ে উঠতে চাইলে ১১টি গুণাবলী অর্জন করতে হবে। এসব গুণাবলী অর্জন করতে না পারলে রাজনীতির ময়দানে কেউ ইতিবাচক ভূমিকা যেমন পালন করতে পারবেন না, তেমনি নেতৃত্বে নিজের দৃঢ় অবস্থানও নিশ্চিত করতে পারবেন না। এই ১১টি গুণাবলী ও যোগ্যতা হচ্ছে, যথা-

১. আদর্শ রাজনীতিবিদ ও নেতাদের জীবনী পড়া। কারণ, রাজনীতির ময়দানে দিক-নির্দেশনা লাভ, প্রতিকূলতার মোকাবেলা এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে কৌশলী হতে হলে অবশ্যই পূর্বসুরী সফল রাজনীতিবিদদের জীবনী মনোযোগ দিয়ে পড়তে হবে। এতে কর্মপন্থা নির্ধারণ ও সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে অনেক সহযোগিতা পাওয়া যায়।

২. উদারমনা হওয়া তথা অনেক বড় মনের অধিকারী হওয়া। কারণ, সংকীর্ণমনা কোন মানুষ কোন যোগ্যতা বলে নেতা হতে পারলেও তাকে আদর্শ নেতা বলা যাবে না। কারণ, সংকীর্ণমনারা দলের ভেতরে এবং যে কোন দায়িত্বে আসীন হতে পারলে স্বৈরাচারি নেতায় পরিণত হয়ে পড়েন। সংকীর্ণমনারা কখনোই সহকর্মী ও অধঃস্তনদের প্রতি ন্যায়চারি হতে পারেন না, যে কারণে তারা ন্যায়নিষ্ঠ ও জনপ্রিয় নেতা হতে পারেন না। সংকীর্ণমনা হওয়ার কারণে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে তারা ঝুঁকি নিতে পারেন না। সবসময় হীনমন্যতা ও সিদ্ধান্তহীনতায় ভূগে থাকেন।

৩. পরোপকারের মানসিকতা লালন করা। একজন সৎ ও দক্ষ রাজনীতিবিদকে অবশ্যই সমাজ, দেশ ও আর্তমানবতার সেবায় নিজেকে সবসময় নিয়োজিত রাখার মানসিকতা লালন করতে হবে। পরোপকারের চিন্তা লালন করেন, এমন একজন নেতা তৃণমূল পর্যায় থেকে সহজেই সকলের মাঝে জনপ্রিয় হয়ে ওঠতে পারেন। পরোপকারের চিন্তাহীন স্বার্থপর ও আত্মকেন্দ্রিক চিন্তার নেতা কখনোই দলে ও বাইরে জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেন না।

৪. বক্তব্য, ভাষণ ও বিতর্কে সংযত হওয়া এবং মিষ্টভাষী হওয়া। বৈঠক, জনসভা, জনসমাবেশে ফ্লোর পেলেই অসংযত ও লাগামহীন বক্তব্য দেওয়া যাবে না। বক্তব্য দিতে হবে পরিবেশের চাহিদা অনুযায়ী, গোছানো এবং বিষয়ভিত্তিক। বল্গাহীন আবেগ দিয়ে যেমন যা খুশী তা বলে সস্তা আবেগ তৈরি করা যাবে না, তেমনি বক্তব্য একেবারে আবেগহীনও রাখা যাবে না। বক্তব্য দেওয়ার সময় স্রোতাদের আগ্রহ বুঝে বক্তব্য দিতে হবে। বিরক্ত তৈরি করে, এমন বিষয়ে এবং অতিরিক্ত সময় নিয়ে বক্তব্য দেওয়া যাবে না। বক্তব্যের ভাষা সুমিষ্ট, যৌক্তিক, তথ্যভিত্তিক এবং আকর্ষনীয় উপস্থাপনার চেষ্টা করতে হবে।

৫. দূরদৃষ্টির অধিকারী হওয়া। পরিবেশ-পরিস্থিতি বুঝে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার যোগ্যতা থাকা।

৬. দৃঢ়চেতা মনোভাবের অধিকারী হওয়া। হামলা, মামলা, হুমকি, ধমকির কাছে মাথানত না করার দৃঢ় মানসিকতা লালন করতে হবে। সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ নেওয়ার সময় যেমন বুদ্ধি-পরামর্শ ও যাছাই বাছাই করে নিতে হবে, তেমনি গৃহীত সিদ্ধান্তে ভুল প্রমাণিত না হলে যে কোন মূল্যে দৃঢ় ও অবিচল থাকতে হবে। ঘন ঘন সিদ্ধান্ত ও মত পরিবর্তন দুর্বল নেতৃত্বের পরিচায়ক।

৭. দায়িত্বজ্ঞান সম্পর্কে সদা সজাগ ও সতর্ক থাকতে পারা। প্রতিকূল বা অনুকূল পরিবেশে কখন কী করতে হবে না হবে, সে বিষয়ে সজাদ ও সতর্ক থাকার গুণাবলী অর্জন করতে হবে। দলের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যে অগ্রসর হতে হলে সার্বিক পরিস্থিতির উপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখে দলীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। জনমনোভাব এবং রাজনীতির গতি-প্রকৃতিকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। পরিবেশ অনুকূল না থাকলে অনেক সময় ইতিবাচক কথা না বলেও চুপচাপ সঠিক সময়ের জন্য অপেক্ষায় থাকতে হয়।

৮. নীতি-আদর্শের উপর অবিচল ও দৃঢ় থাকা। প্রতিকূল পরিবেশে হয়তো চুপ থাকা যায় সাময়িক; কিন্তু কোনভাবেই নীতি বা আদর্শ বদলানো যাবে না। নীতি ও আদর্শহীন রাজনীতিবিদ ব্যক্তিগত পর্যায়ে যত সৎই হোক না কেন, তিনি কখনোই মর্যাদাবান নেতা হতে পারেন না।

৯. একগুঁয়েমি পরিহার করা এবং নিজের মতের বিরুদ্ধে গেলেও গঠনমূলক যে কোন পরামর্শ ও প্রস্তাব গ্রহণে উদার মানসিকতা থাকা। কারণ, একগুঁয়েমি কখনোই মানুষ পছন্দ করেন না। নিজের মতকে সঠিক মনে হলে সেটা যৌক্তিকভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করতে হবে, অথবা অন্যদেরকে যৌক্তিকভাবে খণ্ডন করার আমন্ত্রণ জানাতে হবে। কিন্তু কোনভাবেই একগুঁয়েমির সাথে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা যাবে না। কারণ, এতে অনেকেই সংক্ষুব্ধ হয়ে পড়তে পারেন, যেটা ভবিষ্যতের জন্য নেতিবাচক পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে।

১০. নিজেকে খাদেম মনে করা এবং মাখদুম মনে না করা। রাজনীতির ময়দানে সহকর্মী ও অধঃস্থনদের প্রতি সবসময় আন্তরিকতা ও সহযোগিতার মানসিকতা লালন করতে হবে। যথাসাধ্য অন্যদের ভাল-মন্দের খোঁজ-খবর রাখতে হবে। যে কারো প্রয়োজনে সাড়া দিতে হবে। নিজের ব্যক্তিগত সমস্যার কথা যথাসম্ভব বলাবলি থেকে এড়িয়ে চলতে হবে।

১১. আমানতদার হওয়া। হিসাব-নিকাশ ও যে কোন লেনাদেনা এবং কাজকারবারে স্বচ্ছ্বতা বজায় রেখে চলতে হবে। খেয়ানতের প্রবণতা যার থাকবে, সে কখনো নেতা হতে পারবে না। ক্রমান্বয়ে দলের ভিতরে ও বাহিরে সে সমালোচিত হতে থাকবে এবং এটা তার আগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করবে।

ছাত্র জমিয়তের নেতাকর্মীদেরকে এই ১১টি বিষয়কে আত্মস্থ করে সেই মতে চলতে মনোযোগী হতে হবে।

ছাত্র জমিয়তের নেতাকর্মীদেরকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে আত্মশুদ্ধি ও উন্নত চারিত্রিক বৈশিষ্ট মন্ডিত জীবন গঠন, যথাযথভাবে সাংগঠনিক শৃঙ্খলা রক্ষা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটিকালীন সময়ে সংগঠনের সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধির প্রতি মনোনিবেশ, জনসম্পৃক্ততা বাড়ানো, সেবামূলক সামাজিক কর্মকাণ্ডে শরীক হওয়া, নিয়ম মেনে দাওয়াতী কার্যক্রম পরিচালনা এবং দলের কেন্দ্রীয় নির্দেশনা গুরুত্বের সাথে বাস্তবায়নের রূপরেখা পালনে যত্নবান হতে হবে।

ছাত্ররাই সামাজিক ও জাতীয় পর্যায়ে ইনসাফ, সুশাসন ও সুবিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আগামী দিনে দেশের নেতৃত্ব দিবে। পাশাপাশি সাধারণ মুসলমানদেরকে বিভ্রান্ত ও ঈমানহারা করার মিশনে নিয়োজিত বিভিন্ন বাতিল ফিরকার মোকাবেলা করতে হবে আপনাদেরকে। বিশেষ করে এনজিও ও খ্রীস্টান মিশনারী কর্তৃক মুসলমানদেরকে ঈমানহারা করার সুগভীর চক্রান্তের জাল থেকে জাতিকে উদ্ধার করতে ছাত্র জমিয়তকে বিশেষ ভূমিকা রাখতে হবে। শক্তিশালী বাংলাদেশ গড়া এবং সুশাসন ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠার মহৎ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে তৃণমূল পর্যায় থেকে কাজ করতে হবে আপনাদেরকে। এসব গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করার কাজে দুর্বল ইলম ও উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ছাড়া জাতিকে সঠিকভাবে নেতৃত্ব দিতে পারবেন না।