Home সম্পাদকীয় দেশব্যাপী কিশোর গ্যাং চক্র ভয়ংকর হয়ে উঠেছে: এদের উৎখাতে শক্তহাতে পদক্ষেপ নিতে...

দেশব্যাপী কিশোর গ্যাং চক্র ভয়ংকর হয়ে উঠেছে: এদের উৎখাতে শক্তহাতে পদক্ষেপ নিতে হবে

রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে কিশোর গ্যাং চক্র ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। এই চক্র এতটাই বেপরোয়া যে পাড়া-মহল্লায় ভীতিকর পরিবেশে চাঁদাবাজি, ছিনতাই থেকে শুরু করে খুন পর্যন্ত করছে। বিগত কয়েক বছর ধরে উঠতি কিশোররা বিভিন্ন নামে গ্রুপ সৃষ্টি করে এলাকা এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করে চলেছে।

আধিপত্য বিস্তার করা নিয়ে নিজেদের মধ্যে সংঘাত-সংধর্ষে লিপ্ত হচ্ছে। সোস্যাল মিডিয়ায় গ্রুপের পেজ খুলে সেখানে কি করতে হবে তা উল্লেখ করে সন্ত্রাসী কাজেও নেমে পড়ছে। তারা এতটাই দুর্বীনিত হয়ে উঠেছে যে কোনো কিছুরই তোয়াক্কা করছে না। খোদ রাজধানীরই বিভিন্ন এলাকায় সক্রিয় রয়েছে প্রায় অর্ধশত কিশোর গ্যাং। বলা হচ্ছে, শীর্ষ সন্ত্রাসীদের অবর্তমানে আন্ডারওয়ার্ল্ড এসব গ্যাং নিয়ন্ত্র করছে।

এসব কিশোর গ্যাং চক্রের সদস্যরা ইয়াবা, মদ, ফেনসিডিল, গাঁজাসহ নানা ধরনের নেশায় আসক্ত। নেশার টাকা জোগাড় করার জন্য চুরি, ছিনতাই চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। আবার বনিবনা না হলে কিংবা তুচ্ছ ঘটনার জেনে এক বন্ধু আরেক বন্ধুকে মারধর ও খুন করছে। রাজধানীর সাথে পাল্লা দিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলাশহরেও এই কিশোর গ্যাং গড়ে উঠছে। এ নিয়ে সমাজ বিজ্ঞানীরা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, বিপথে যাওয়া গ্যাং চক্রের কিশোরদের নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে তারাই ভয়ংকর সন্ত্রাসী হয়ে উঠবে।

কিশোর গ্যাং চক্রের কথা প্রথম উঠে আসে ২০১৭ সালের ৬ জানুয়ারি উত্তরায় নবম শ্রেণীর ছাত্র আদনান হত্যার ঘটনার মধ্য দিয়ে। এ হত্যার কারণ খুঁজতে গিয়ে বের হয়ে আসে উত্তরায় কিশোর গ্যাংয়ের চিত্র। বের হয়ে আসে ডিসকো গ্রুপ এবং নাইন স্টার গ্রুপ নামে কিশোর গ্যাং চক্রের কথা। ডিসকো গ্রুপের হাতে নাইন স্টার গ্রুপের আদনান হত্যার শিকার হয়। শুধু উত্তরায় নয়, রাজধানীর ধানমন্ডি, গুলশানসহ বিভিন্ন এলাকায় এই কিশোর গ্যাং চক্রের কথা উঠে আসে। বিচিত্র নামে গড়ে উঠেছে এসব কিশোর গ্যাং চক্র।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভৌতিক সিনেমা কিংবা ভিডিও গেমের নামে চক্রের নাম দেয়া হয়। এলাকার বিভিন্ন দেয়ালে দেয়ালেও চক্রের নাম লেখা হয়ে থাকে। সাধারণত এসব চক্রের সদস্য হয় স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী। তারা একসাথে আড্ডা, ঘোরাঘুরি করতে করতেই একসময় সন্ত্রাসের পথে ধাবিত হয়। পাড়া-মহল্লায় মেয়েদের উত্যক্ত করা থেকে শুরু করে এক গ্রুপের সাথে আরেক গ্রুপের আধিপত্য বিস্তার নিয়ে মারামারি, চাঁদাবাজি, ছিনতাই এমনকি খুন-খারাবিতে জড়িয়ে পড়ে।

এসব কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের চালচলন এবং আচার-আচরণ হয়ে উঠে কেয়ারলেস। নিজেদেরকে এলাকার নিয়ন্ত্রক ভাবা শুরু করে। তাদের কাছে হেনস্থা হওয়ার ভয়ে এলাকার মানুষজনও তটস্থ থাকে। সামাজিক প্রতিরোধ ও শাসন-বারণ না থাকায় তারা ক্রমেই দুর্বীনিত হয়ে উঠে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যথাযথ নজর না থাকায় এই কিশোর গ্যাং কালচার এতটাই বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে যে, তারা আন্ডার ওয়ার্ল্ডের সাথে যুক্ত হয়ে পড়ছে।

আন্ডার ওয়ার্ল্ডের যেসব শীর্ষ সন্ত্রাসী দেশের বাইরে তারা এসব কিশোর গ্যাং চক্রকে ব্যবহার করে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, এলাকা নিয়ন্ত্রণ এবং খুনের কাজে ব্যবহার করছে। এছাড়া রাজনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তিও তাদের পেছনে কাজ করে। সংশ্লিষ্ট এলাকার একশ্রেণীর প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের দ্বারা তারা নিয়ন্ত্রিত হয়।

সমাজ বিজ্ঞানীরা বলছেন, কিশোর বয়সীদের সহজেই প্রভাবিত করা যায়। তাদের বোধ-বুদ্ধি বিকাশের এ সময়টাতে যদি ‘ক্ষমতা’ নামক বিষয়টি মাথায় ঢুকিয়ে দেয়া হয়, তাহলে তারা সহিংসতাকেই বেছে নেয়। এক্ষেত্রে প্রযুক্তিও তাদের ওপর কুপ্রভাব ফেলে।

বর্তমান সময়ের কিশোররা উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে পশ্চিমা সংস্কৃতিতে আকৃষ্ট হচ্ছে এবং তা নিজেদের মধ্যে ধারণ করার প্রবণতা রয়েছে। তবে তারা তা সঠিকভাবে ধারণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। যে সংস্কৃতি গ্রহণ করতে চায় তা বিচার-বিশ্লেষণ করতে না পারায় বিপদগামী হয়ে পড়ছে। এটা অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়। এক্ষেত্রে অভিভাবকদের দায়-দায়িত্ব রয়েছে। সন্তানের হাতে উন্নত প্রযুক্তি দেয়ার ক্ষেত্রে তাদের মধ্যকার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার বিষয়টি অভিভাবকদের ভাবতে হবে।

কিশোর গ্যাং কালচার সমাজের জন্য উৎপীড়ক এবং নতুন বিপদের কারণ হয়ে উঠেছে। এখন থেকেই যদি এই কিশোরদের লাগাম টেনে ধরা বা থামানো না যায়, তবে তা ভয়ংকর আকার ধারণ করবে। মানুষের নিরাপত্তা বলে কিছু থাকবে না। কারণ এই অপরাধের সাথে যারা যুক্ত এবং যুক্ত হচ্ছে তারা কোনো কিছুরই তোয়াক্কা কিংবা বোধ-বিবেচনার প্রয়োজন মনে করে না। এটা শিশুর হাতে আগুণ বা ছুরি ধরিয়ে দেয়ার মতো হয়ে উঠছে। এদের প্রতিহত করতে পারিবারিক ও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির বিকল্প নেই।

অভিভাবকদের এক্ষেত্রে মূল ভূমিকা পালন করতে হবে। তাদের সন্তান কোথায় যাচ্ছে, কার সাথে মিশছে-এ বিষয়গুলোর দিকে সবসময় খেয়াল রাখতে হবে। বিদ্যমান যেসব কিশোর গ্যাং রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ‘জিরো টলারেন্স’ দেখাতে হবে।

গ্যাং চক্রকে কারা মদদ দিচ্ছে এবং ব্যবহার করছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের দায়িত্ব রয়েছে। তাদেরও এই গ্যাং কালচার প্রতিরোধে এগিয়ে আসতে হবে।