Home ইসলাম সকালের মক্তব: দ্বীনি শিক্ষার বুনিয়াদী দুর্গ

সকালের মক্তব: দ্বীনি শিক্ষার বুনিয়াদী দুর্গ

।। মাওলানা এহতেশামুল হক ক্বাসিমী ।।

সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ বেনিয়াগোষ্টির অভিশপ্ত কদম রাখার পূর্বে পাক-ভারত উপমহাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা ছিলো মসজিদ-মাদরাসা কেন্দ্রিক। মুসলিম সুলতানি যুগ থেকে মোঘল আমল পর্যন্ত দীর্ঘ সাড়ে ৮ শত বছর যাবৎ মুসলমানদের প্রধান শিক্ষাব্যবস্থা ছিলো ধর্মীয় শিক্ষা। সেসব প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন রাষ্ট্রের অধিপতি শাসকগণ। ধূর্ত ইংরেজরা ছলে বলে কৌশলে এদেশের রাজ্য ক্ষমতা ছিনিয়ে নিয়ে বন্ধ করে দেয় মুসলমানদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো। আর তদস্থলে চাপিয়ে দেয় পাশ্চাত্য ধ্যান-ধারণায় প্রসূত আধুনিক শিক্ষা।

কিন্তু ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণ তাদের সন্তানদেরকে ইংরেজ প্রবর্তিত ও পরিচালিত স্কুল-কলেজে পাঠাতেন না। বরং তারা মসজিদ ও কাঁচারি ঘরে সীমিত পরিসরে হলেও আপন সন্তানদের শিক্ষা-দীক্ষার ব্যবস্থা করতেন। এভাবে শহরে-বন্দরে, গ্রামে-গঞ্জে তখন গড়ে উঠেছিল হাজার হাজার মক্তব-মাদরাসা। সকালবেলা শিশু-কিশোররা টুপি, পাঞ্জাবী পরে কায়দা-সিপারা হাতে নিয়ে মক্তবে যেতো। পাড়া-মহল্লায় বিদূষী রমণীগণ পাটি, মাদুর বিছিয়ে ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের কুরআন শিক্ষার ব্যবস্থা করতেন। সেসময় কুরআন পড়া নারীদের যথেষ্ট কদর ছিলো। বিবাহ-শাদীর ক্ষেত্রে কুরআন পড়তে পারে, এরকম মেয়েদের তালাশ করা হতো। কিন্তু সে অবস্থা এখন আর নেই বললেই চলে।

এখন আমাদের দেশের মক্তবগুলোর জৌলুশ হারিয়ে গেছে। টুপি-পাঞ্জাবী-লুঙ্গি-শার্ট পরে দলবেঁধে মক্তবে যাওয়ার দৃশ্য আগের মতো নজরে পড়ে না। মুসলমানদের ঐতিহ্যের স্মারক সাবাহী মক্তবগুলো এখন মৃতপ্রায়। শহর বা বন্দরের কোনো মসজিদেই আজ সাবাহী মক্তব চোখে পড়ে না। গাঁও-গেরামে কিছু মক্তব থাকলেও ছাত্র-ছাত্রীদের উপস্থিতি খুবই নগণ্য।

অভিভাবকগণও এব্যাপারে বড্ড উদাসীন। এর জন্য প্রধান দায়ী মসজিদের ইমাম সাহেব, তারপর মসজিদকমিটি বা মুতাওয়ালী, অতঃপর অপরিণামদর্শী অভিভাবক, এরপর ফেরিওয়ালা টিওশনমৌলভী। শহর-বন্দরের অভিভাবকগণ যেভাবে স্কুল শিক্ষার জন্য প্রাইভেট টিচার নিয়োগ দেন তদ্রুপ বাচ্চাদেরকে ধর্মীয় শিক্ষার জন্যে টিওশনী মৌলভীদের আশ্রয় নিয়ে থাকেন।

এখানে পার্থক্য হলো, যারা প্রাইভেটে বাংলা-ইংরেজি পড়ায় তারা মোটামোটি যোগ্য হলেও আরবী যারা পড়ান তাদের অনেকেই থাকেন অযোগ্য। এদের অনেকের সূরা কেরাতও শুদ্ধ থাকে না। দ্বীনের মৌলিক জ্ঞানও থাকে কম। তারপর তারা থাকেন ভাসমান বা অস্থায়ী। কয়েক দিন পড়িয়ে অন্যত্র চলে যান। নতুন আরেকজন আসেন। আবার শুরু থেকে শুরু করেন। এই শুরুতেই শহরের বাচ্চাদের বাল্যজীবন শেষ হয়ে যায়। কিন্তু কুরআন শুদ্ধ করা তো দুরের কথা সূরা ফিল পর্যন্ত সূরাগুলোও তাদের শুদ্ধ হয়ে ওঠে না। সরজমিনে প্রদক্ষিণ করে শুধু হতাশ হয়েছি। হতবাক হয়েছি।

সকাল বেলার মক্তবের অভাবেই মুসলিম ছেলেমেয়েদের দ্বীনিয়াত শিক্ষায় দেখা দিয়েছে চরম সংকট। কেজি স্কুল নামে আধাকেজি আর দেড়কেজি সাইজের স্কুলগুলো আজ সাবাহী মক্তবের স্থান দখল করে বসেছে। সাবাহী মক্তবের প্রভাব শহর-বন্দরের মুসলমান পিতা-মাতাগণ অনুধাবন করতে না পারলেও ইহুদি-খ্রিস্টানরা শিশু-কিশোরদের এ প্রাতকালীন শিক্ষাব্যবস্থার প্রভাব গভীরভাবে লক্ষ করেছে।

তারা লক্ষ্য করেছে যে, শিশুর মন নরম কাদামাটির মতোন। যে বীজই তাতে বপন করা হবে, তা থেকে উন্মেষ ঘটবে প্রাণবন্ত বৃক্ষের। তাই শিশুদের কচিমনে ইসলামী মূল্যবোধের পরিবর্তে বিজাতীয় কালচারে অভ্যস্ত করতে তারা মরিয়া। জন্মসূত্রে মুসলিম হলেও চিন্ত-চেতনা ও আদর্শগতভাবে যেনো হয় বিজাতীয়, সেটাই তাদের কামনা ও ভাবনা। আর এ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে ব্রাক, আশা প্রভৃতির মাধ্যমে শহরে, গ্রামে তারা চালু করেছে কেজি স্কুল নামে পাশ্চাত্যমুখী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান।

কচি কচি ছেলে-মেয়েরা যেখানে সকালবেলা কায়দা, কুরআন নিয়ে মক্তবে যাওয়ার কথা, সেখানে তারা এক গাদা বই কাঁধে করে ছুটছে স্কুলের দিকে। এটা যে বিধর্মীদের সুদূরপ্রসারী চক্রান্ত তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কেননা কোমল হৃদয়ের শিশুদেরকে কুরআন শিক্ষা থেকে বঞ্চিত রাখা গেলে আগামীতে তারাই হবে ধর্মের প্রতি ভীতশ্রদ্ধ। এমনকি আশ্চর্যের বিষয় হলো, স্কুলের পাঠ্য বইয়ে আজ স্থান পাচ্ছে নাস্তিক্যবাদী কবিদের কুরআন বিরোধী কবিতা। যার কয়েকটি চরণ হচ্ছে “যে বই তোমায় দেখায় ভয়, সেগুলো কোনো বই-ই নয়, সে তুমি পড়বে না। যে বই তোমায় অন্ধ করে, যে বই তোমায় বন্ধ করে, সে বই তুমি ধরবে না।”

তাই গাঁও-গেরামের মত শহর-সিটির প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় সবাহী মক্তব চালু করা আগের তুলনায় এখন বেশি প্রয়োজন। এ মক্তব ব্যবস্থা শুধু আমাদের দেশেই নয়, বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম দেশে প্রচলিত আছে।

বিখ্যাত দার্শনিক আল্লামা কবি ইকবাল সকালের মক্তব সম্পর্কে যা বলেছেন, তার সারমর্ম হলো- যদি এ মক্তব মাদরাসা না থাকতো, তাহলে মুসলমানের সন্তানেরা ইহুদি-খ্রিস্টানের অন্ধ অনুসরণে নিজেদের পরিচয়টুকুও হারিয়ে ফেলতো। মুছে যেতো মুসলমানের আদর্শ, স্বকীয়তা ও আত্মগৌরব। বাংলাদেশে মুসলমানদের আধ্যাতিক রাহবার দারুল উলূম দেওবন্দের কয়েকজন সূর্যসন্তান তথা থানভী ও মাদানী রাহ. এর সকল খলীফার স্বপ্ন ছিলো গ্রামে গ্রামে কুরআন শিক্ষার জন্য মক্তব ব্যবস্থা চালু করা। তাঁরা তাদের স্বপ্ন পূরণে ছুটে গেছেন গ্রাম থেকে গ্রামে। প্রতিষ্ঠা করেছেন অসংখ্য অগণিত মক্তব মাদরাসা। বর্তমানে সমগ্র বাংলাদেশে নুরানি পদ্ধতিতে কুরআন শিক্ষার যে ধারা চালু হয়েছে তা অতীত আকাবির উলামায়ে কেরামেরই স্বপ্নের ফসল।

এখন আমাদের কর্তব্য হচ্ছে, এ শিক্ষাধারাকে বেগবান করা। সারা বাংলাদেশে কুরআনি শিক্ষা চালু করা। তা না হলে ইসলামের চিরশত্রুদর দোসররা আমাদের কচি কচি সোনামণিদের বিপথগামী করার জন্য যে জাল পেতেছে তাতে আটকা পড়ে গোমরাহির অতল গহ্বরে হারিয়ে যাবো আমরা। নিজেদের এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের ঈমান-আকিদা, দ্বীন-ইসলাম টিকিয়ে রাখতে হলে মুসলিম ঐতিহ্যের মৃতপ্রায় মক্তবসমূহকে ফিরিতে আনতে হবে। কোনো সমস্যা থাকলে সমাধান করতে হবে সম্মিলিতভাবে। গ্রামে গ্রামে প্রতিষ্ঠা করতে হবে কুরআন শিক্ষার মকতব। তাহলে বাতিলের মোকাবেলায় আমরা টিকে থাকতে পারব।

লেখক: মুহাদ্দিস, জামেয়া দারুল কুরআন সিলেট।

উচ্চশিক্ষিত বেকারদের হতাশার দায়ভার কার?