Home স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা চিকিৎসায় হয়রানি বা অবহেলার মুখে পড়লে যেভাবে অভিযোগ করবেন

চিকিৎসায় হয়রানি বা অবহেলার মুখে পড়লে যেভাবে অভিযোগ করবেন

দেশের হাসপাতাল ও চিকিৎসা কেন্দ্রসমূহে প্রায়শই চিকিৎসকের অবহেলা আর সে নিয়ে রোগীর আত্মীয়দের সাথে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বাদানুবাদ বা ভাঙচুরের খবর শোনা যায়। বাংলাদেশে রোগীদের সুরক্ষায় খুব বেশি না হলেও অল্প কিছু ব্যবস্থা রয়েছে। চিকিৎসকদের অবহেলার অভিযোগ নিয়ে যাওয়ার জন্য সরকারি একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে যা অনেকেই জানেন না। জানলেও সেই সংস্থার উপর আস্থা রাখতে পারেন না অনেকেই।

অভিযোগ নিয়ে কোথায় যাবেন?

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল বা বিএমডিসি একটি সরকারি সংস্থা। এখানে যারা কর্মরত রয়েছেন তারা সবাই চিকিৎসক। সংস্থাটির ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার ডাঃ মোহাম্মদ আরমান হোসেন বলছেন কিভাবে বিএমডিসিতে চিকিৎসকের বা স্বাস্থ্যসেবা বিষয়ক প্রতিষ্ঠানের অবহেলার বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ করা যায়।

* যে হাসপাতাল বা চিকিৎসক সম্পর্কে অভিযোগ, সেখানে যে সেবা নিয়েছেন তার সকল কাগজপত্র, চিকিৎসক, প্রতিষ্ঠানের নাম, চিকিৎসার তারিখ, সময় সহ সে কেন মনে করছে অবহেলা হয়েছে তার একটি ব্যাখ্যা সহ বিএমডিসির রেজিস্ট্রার বরাবর অভিযোগকারীর সই ও ঠিকানা সহ লিখিত অভিযোগ করতে হবে।

* এরপর অভিযুক্ত ব্যক্তির কাছে সেই অভিযোগের কপি পাঠানো হবে। তাকে কাউন্সিলের কাছে জবাব দিতে নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেয়া হবে।

* সেই বক্তব্য পাওয়ার পর বিএমডিসি অভিযোগকারীকে সেটি জানাবে।

* তার সেই বক্তব্যে আপত্তি থাকলে তিনি সেটি গ্রহণ না করার অধিকার রাখেন।

* অভিযোগ তখন একটি শৃঙ্খলা কমিটির কাছে যাবে । কমিটি যদি মনে করে এই ঘটনার তদন্ত করা প্রয়োজন তাহলে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। তারা দরকারে হাসপাতালে যাবে এবং প্রতিবেদন জমা দেবে।

কিন্তু বাস্তবতা হল এই সংস্থা সম্পর্কে জানেন না প্রায় কেউই। হাসপাতালগুলো থেকে সেই বিষয়ে জানানো হয় না। তাই সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি প্রায়শই তার ক্ষোভ হাসপাতাল বা ক্লিনিকেই প্রকাশ করে ফেলেন। যার ফল হল প্রায়শই ভাঙচুর বা চিকিৎসককে মারধোর। সবচেয়ে বড় সমস্যা হল বিএমডিসির রাজধানী ঢাকায় কার্যালয় মাত্র একটি। আর সেখানে কেউ অভিযোগ নিয়ে গেলেও তাতে অনেক সময় লেগে যায় বা পুরো প্রক্রিয়া নিয়ে অভিযোগ তৈরি হয়।

কন্যাসন্তান হারানো এক বাবা যেভাবে এখনো লড়ছেন

গত বছরের জুলাই মাসে চিকিৎসকদের অবহেলায় চট্টগ্রামে আড়াই বছর বয়সী একটি কন্যা শিশু মৃত্যুর অভিযোগ নিয়ে বেশ বিতর্ক হয়েছিলো। সেখানকার সিনিয়র সাংবাদিক রুবেল খান তার কন্যাসন্তান রাইফাকে হারিয়েছিলেন।

রুবেল খান বলছেন, “গলায় ব্যথা আর ঠাণ্ডার সমস্যা নিয়ে রাইফাকে চট্টগ্রামের একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। কিন্তু পরদিন রাতেই সে মারা যায়।” তিনি বলছেন চিকিৎসকরা তাকে একটি অ্যান্টিবায়োটিক দেয়ার পর থেকেই মেয়েটি দুর্বল হয়ে পড়তে থাকে। চিকিৎসকদের সেটি জানানোর পরও তারা সেটি দেয়া অব্যাহত রাখেন।

পরদিন রাতের এক পর্যায়ে তাকে একটি সাপোজিটর দেয়া হলে তার খিঁচুনি ওঠে। সেসময় কোন চিকিৎসককে পাওয়া যায়নি বলে তিনি অভিযোগ করেন। সাংবাদিক হওয়ায় হয়ত তিনি দ্রুতই বিষয়টি কর্তৃপক্ষের নজরে এনেছিলেন। বিতর্ক তৈরি হওয়ার পর বিষয়টি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বিএমডিসিকে তদন্তের আদেশ দেয়।

রুবেল খান বলছেন তিনি কোন সমাধান পাননি। তিনি বলছেন, “বিএমডিসি থেকে কয়েকজন চট্টগ্রামে এসে আমাকে সেই হাসপাতালে ডেকে পাঠান। আমার জন্য সেখানে আবার ফিরে যাওয়া খুব আবেগের বিষয় ছিল। এটা তো কোন সালিশি নয়। আমি তাদের বাসায় আসতে বললে তারা আমাকে একটা রেস্টুরেন্টে আসতে বলে। আমি এমন একটা বিষয়ে কথা বলতে রেস্টুরেন্টের মতো জায়গায় যেতে রাজি হইনি।”

রুবেল খান বলছেন, “ফলে তারা চট্টগ্রামে এসেও আমার সাথে কথা না বলেই ঢাকা ফিরে যান এবং প্রতিবেদনে লেখেন যে বাবার সাথে কথা বলা যায়নি। আমার বক্তব্য না নিয়েই তারা একপেশে প্রতিবেদন দিয়েছেন।” রুবেল খান এখন সেই প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে আদালতের আশ্রয় নিয়েছেন। আদালত বিএমডিসিকে বিষয়টি নতুন করে তদন্তের আদেশ দিয়েছে।

বিএমডিসিতে অভিযোগ নিয়ে যান না অনেকে

বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে মান-নিয়ন্ত্রক প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করেন শামীম আরা নীপা। সিলেটে গিয়ে সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়েছিলেন ২০১৫ সালে। এরপর তার দুটি হাতেই অস্ত্রোপচারের দরকার হয়। শুরুতে সিলেটে একটি হাসপাতালে গিয়েছিলেন। এরপর ঢাকার একটি হাসপাতালে চলে আসেন।

তিনি বলছেন, “একটা মারাত্মক অবহেলার শিকার হয়েছি আমি। আমার ডায়াবেটিস আছে। আমার দুই হাতে ব্যান্ডেজ। আমি দুর্ঘটনার রোগী। এই অবস্থায় আমাকে নার্সরা ইনসুলিন নিতে বা অন্য কিছু লাগলে তাদের ওখানে ডেকে পাঠাতো। অনেকদূর হেঁটে আমাকে সেগুলো নিয়ে আসতে হতো। তার প্রতিবাদ করলে আমাকে বলা হয়েছে আপনি এত কথা বলেন কেন?”

শামীম আরা নীপা বলছেন, সেসময় কোথাও অভিযোগ করা যায় কিনা সে সম্পর্কে তিনি কিছুই জানতেন না। তিনি অবশ্য বলছেন, অভিযোগ করলে তাতে কোন বিচার হবে বলে তার আস্থাও নেই। তিনি মনে করেন, “যেহেতু ওটা ডাক্তারদের প্রতিষ্ঠান। তারা একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে সঠিকভাবে তদন্ত করবে বলে আমি মনে করি না।”

আস্থা আনতে যা করা হচ্ছে

বিএমডিসির ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার ডাঃ মোহাম্মদ আরমান হোসেন বলছেন, “যে কথাটা বলেছেন তিনি সেটি যে একেবারে অযৌক্তিক তা নয়। আমরা চেষ্টা করছি তদন্ত কমিটিতে চিকিৎসক ছাড়াও অন্য কোন পেশার কাউকে তদন্ত প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করা যায় কিনা।” ঢাকার বাইরেও কীভাবে অভিযোগ করা যায় সে নিয়েও তারা ভাবছেন তারা কী করতে পারেন।

স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন

বাংলাদেশে ২০১৬ সালে “রোগী এবং স্বাস্থ্যসেবা দানকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান সুরক্ষা আইন” নামে একটি আইন প্রস্তাব করে সরকার। কিন্তু এই আইনটি এখনো পাশ হয়নি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডাঃ আবুল কালাম আজাদ জানিয়েছেন,” এটির খসড়া মন্ত্রিসভায় পাঠানো হয়েছিলো। মন্ত্রিসভা কিছু প্রশ্ন পাঠায়। সেগুলো সংযুক্ত করে আবারো মন্ত্রিসভায় পাঠানো হয়েছে।”

কিন্তু অভিযোগ রয়েছে চিকিৎসকদের আপত্তির কারণেই তা এখনো পাশ করা সম্ভব হয়নি। আইনটির খসড়া প্রকাশিত হয় যখন, সেই সময় থেকেই এর সমালোচনা শুরু হয়েছে এই নিয়ে যে এতে রোগী নয় বরং চিকিৎসকদের সুরক্ষার দিকে বেশি নজর দেয়া হয়েছে। ভুল চিকিৎসার অভিযোগে রোগীর আত্মীয়দের সাথে চিকিৎসকদের নানা সময়ে যে বিবাদ, ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে সেই বিষয়টি নজর পেয়েছে বেশি।

কী আছে প্রস্তাবিত আইনে

বিশেষ করে দুটি বিষয় নিয়ে আপত্তি উঠেছে। আর তা হল চিকিৎসকের ভুলের অভিযোগ উঠলে চিকিৎসক বা অন্য সেবা-দানকারীদের সাথে সাথে গ্রেপ্তার করা যাবে না।

অন্যদিকে কোনও ব্যক্তি স্বাস্থ্য সেবা-দানকারীদের প্রতি সহিংস আচরণ করলে এবং প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর করলে তা জামিন অযোগ্য অপরাধ হবে বলে গণ্য হবে। আর এ কারণেই অনেকে মনে করছেন চিকিৎসক ও প্রতিষ্ঠানের সুরক্ষা নিয়ে আইনটিতে বেশি মনোযোগ দেয়া হয়েছে।

[ প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন- বিবিসি বাংলা’র ঢাকা সংবাদদাতা শাহনাজ পারভীন ]