Home প্রবন্ধ-নিবন্ধ বাংলাদেশে মাদ্রাসা শিক্ষার বিরুদ্ধে শুরু হয়েছে সাম্রাজ্যবাদী প্রজেক্ট!

বাংলাদেশে মাদ্রাসা শিক্ষার বিরুদ্ধে শুরু হয়েছে সাম্রাজ্যবাদী প্রজেক্ট!

।। তারেকুল ইসলাম ।।

ড. আবুল বারকাতের ‘মাদ্রাসা শিক্ষার রাজনৈতিক অর্থনীতি’ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে কেবল অধ্যাপক মেসবাহ কামালই মাদ্রাসাবিদ্বেষী বক্তব্য দেননি। আবুল বারকাত সাহেবও স্রেফ বিষোদ্গার করে মাদরাসা শিক্ষাকে ‘পশ্চাদপদ’ বলেছেন। আরো বলেছেন, মাদরাসা শিক্ষা নাকি অসাম্প্রদায়িক শিক্ষার্থী তৈরিতে ব্যর্থ হয়েছে। ‘জঙ্গিত্ব উৎপাদনে এ শিক্ষা উর্বর’ বলেছেন।

ড. মেসবাহ কামালের মতো বারকাত সাহেবও প্রপাগান্ডামূলক ও বিদ্বেষপ্রসূত বক্তব্য দিয়েছেন।

জঙ্গি উৎপাদন মাদরাসা থেকে হয় না কি অন্য কোথা থেকে, তা কিন্তু এখন সবাই জানে। অন্যদিকে, অসাম্প্রদায়িক শিক্ষার্থী তৈরিতে মাদরাসা ব্যর্থ হয়েছে বলেছেন। আচ্ছা, নিরীহ দর্জি হিন্দু বিশ্বজিৎকে নির্মমভাবে কারা দিনের আলোতে কুপিয়ে হত্যা করেছিল? বারকাত সাহেব বলবেন কি? তারা কি মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ছিল? সবাই জানে, সেই অসাম্প্রদায়িক সোনার ছেলেরা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী কাম একটি রাজনৈতিক দলের কর্মী ছিল। উপরে থু-থু ছিটানোর সময় নিজের মুখের দিকে একটু খেয়াল রাখলে এমন বক্তব্য দিতেন না।

জঙ্গিত্ব উৎপাদন এখন নামকরা প্রাইভেট ভার্সিটিগুলোতেও হয়। তাই বলে ভার্সিটি ও জেনারেল শিক্ষাব্যবস্থার বিরুদ্ধে যেমন ফাও বিষোদ্গার করা উচিত নয়, তেমনি মাদ্রাসাকেও জঙ্গিত্বের অপবাদ দিয়ে দোষারোপ করা অনুচিত। আপনারা ‘আমাদের সন্তানেরা’ ও ‘তাদের সন্তানেরা’ উল্লেখ করে মাদরাসা ও জেনারেল শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করছেন।

যাই হোক, প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যন্ত সবাই এখন মাদ্রাসাকে ক্লিন সার্টিফিকেট দিয়ে যাচ্ছেন একের পর এক। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কয়েকদিন আগে হাটহাজারী মাদরাসা সফরকালে বলেছেন, ‘যারা বলে কওমি মাদ্রাসায় জঙ্গি আছে তারাই আসল জঙ্গি।’ বারকাত সাহেব, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথা ধরে এখন যদি আপনাকেও জঙ্গি বলি, তাহলে এটা কি খুব বিবেকোচিত হবে? কেননা আপনিও তো কওমি মাদ্রাসায় জঙ্গি আছে বলে প্রপাগান্ডা চালান।

বারকাত সাহেব, মানুষ এখন এত বোকা না যে, বুদ্ধিজীবীর বেশ ধরে যা বলবেন তা-ই মানুষ গিলবে। সেই দিন এখন আর নাই। মানুষ এখন যথেষ্ট সচেতন ও ওয়াকিফহাল। হোলি আর্টিজান হোটেলে বিদেশিদের জিম্মি করে হত্যা করা আইএস জঙ্গি নিব্রাসরা কিন্তু ভার্সিটিরই ছাত্র ছিল। জঙ্গি নিব্রাসরা ছিল আধুনিক স্যুটেড বুটেড। তাদের প্যান্ট ছিল টাখনুর নিচেই। অথচ অধ্যাপক আমেনা মহসিন কিনা টাখনুর ওপরে যারা প্যান্ট পরে তাদের প্রতি উগ্রবাদের অভিযোগ তুলেছিলেন। বুঝি না, আজকাল সব পাগলেরই মাথা খারাপ হয় নাকি!

আপনি আরো বলেছেন, “মাদ্রাসায় অধ্যয়ন করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৯২ শতাংশ দরিদ্র পরিবার থেকে আসে। পরিবারে যে ছেলেটি ‘কম মাথাওয়ালা’ (কম মেধাবী), তাকে মাদ্রাসায় পড়তে দেন অভিভাবকরা।”

আচ্ছা, ‘কম মেধাবী’রা মাদ্রাসায় পড়লে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কীভাবে ‘উচ্চতর মাদ্রাসা’ হয়ে উঠলো মেসবাহ কামালের ভাষায়? মেসবাহ সাহেবের বক্তব্য যদি আমলে নিই, তাহলে কম মেধাবী হয়েও কীভাবে ঢাবিতে ৬০ ভাগেরও বেশি শিক্ষার্থী মাদরাসা থেকে এসে ভর্তি হতে পেরেছে? নিশ্চয়ই মেধার জোরেই তারা ভর্তি হতে পেরেছে, তাই না?

ড. বারকাত ও মেসবাহ সাহেবদের বক্তব্যগুলো একটা আরেকটার সাথে হাস্যকরভাবে সাংঘর্ষিক!

তাছাড়া ঢাবিতে ভর্তিপরীক্ষায় প্রক্সি, জালিয়াতি ও নকলে কখনো কোনো মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ধরা পড়েছে শুনিনি। বরং এতদিন যতগুলা ধরা পড়েছে, তারা সবাই জেনারেল লাইনের শিক্ষার্থী।

এছাড়া প্রান্তিক দরিদ্র এলাকাগুলোতে প্রাথমিক শিক্ষার আলো পৌঁছে দিতে সরকার যেখানে এখনতক পুরোপুরি সফল নয়, সেখানে ছোট ছোট কওমি মাদ্রাসাগুলোই শিক্ষার আলো পৌঁছে দিয়ে দেশে স্বারক্ষরতার হার বৃদ্ধি করছে এবং নিরক্ষরতা দূরীকরণে মাদ্রাসাগুলোর অবদান উল্লেখযোগ্য।

আবুল বারকাত বলেছেন, ‘মাদ্রাসায় শিক্ষিত হওয়া ৭৫ শতাংশ ছাত্রছাত্রী কোনো না কোনোভাবে বেকার রয়েছেন।’

অথচ “উচ্চশিক্ষার্থীদের প্রায় অর্ধেকই বেকার” শিরোনামে প্রথম আলো’র এক রিপোর্টে জানা যায়, বিশ্বখ্যাত ব্রিটিশ সাময়িকী ইকোনমিস্ট-এর ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) এক বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে বাংলাদেশের ৪৭ শতাংশ স্নাতকই বেকার। (০২ মার্চ, ২০১৪, প্রথম আলো)।

মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের বেকারত্ব নিয়ে তেমন উল্লেখযোগ্য রিপোর্ট নেই। তবে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের মধ্যে বেকারত্ব একদমই নেই, তা বলছি না। কিন্তু জেনারেল উচ্চশিক্ষিত বেকারদের তুলনায় মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের মধ্যে বেকারত্ব কম। মাদ্রাসায় পড়িয়ে, মসজিদে মুয়াজ্জিন ও ইমামতি করে কিংবা ছোটখাটো ব্যবসা করে তাদের দিব্যি চলছে। তাদের সুখটা খুব বেশি বস্তুবাদী নয়, তাদের সুখটা হলো আধ্যাত্মিক (তাকওয়াপূর্ণ)। সেই সুখ আপনাদের মতো উচ্চশিক্ষিত পুঁজিবাদী চাকর গোলামদের বুঝার কথা নয়। কারণ, আপনারা তো পুঁজিবাদী সেক্যুলার। সেক্যুলাররা আবার স্পিরিচুয়াল আবেদনের মর্ম কীইবা বুঝবে?

উল্লেখ্য যে, আরবি ও উর্দু ভাষা জানার কারণে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলোতে গিয়ে প্রবাসে পরিশ্রম করে এদেশে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে রেমিটেন্স পাঠায়। তাই, আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সমৃদ্ধকরণে মাদরাসা শিক্ষার্থীদের অবদান কম নয়।

এছাড়া মেসবাহ সাহেব ইংরেজি জানা নিয়ে মাদরাসা শিক্ষার্থীদের সাথে বেশ ফাঁপর নিয়েছেন। তার এই কথার জবাব আমি ইতোমধ্যেই অন্য লেখায় দিয়েছি। তবে এটুকু বলা বাকি যে, ইংরেজি ভাষা নিয়ে আস্ফালন ও ফটকা বাহাদুরি দেখানোর মানে হলো, মেসবাহ সাহেবদের মনে-মগজে আজও ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের গোলামিত্ব প্রকট। ঔপনিবেশিক যুগে ভারতবর্ষে দখলদার ব্রিটিশরা পাশ্চাত্য মূল্যবোধ ও ইংরেজি মাধ্যমের যেই তথাকথিত আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা করে দিয়েছিল, সেটার মূল লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশদের সরকার পরিচালনায় সার্ভিস দিতে পারে এমন দক্ষ ইংরেজি জানা চাকর বানানো। এখন প্রশ্ন তোলা জরুরি যে, ইংরেজি জানা চাকর তৈরির সেই ঔপনিবেশিক ভাবধারার শিক্ষাব্যবস্থা থেকে কতটুকু স্বতন্ত্র ও দেশজ করে গড়ে তুলতে পেরেছি আমাদের আজকের মূলধারার জেনারেল শিক্ষাব্যবস্থাকে? বারকাত ও মেসবাহ সাহেব, আগে এ বিষয়ে গবেষণা করুন।

তবে, বাংলাদেশের বর্তমান তরুণপ্রজন্মের মধ্যে এখন ইসলামী মনোভাবের নীরব জাগরণ ঘটে যাচ্ছে। তাদের মধ্যে সচেতন প্র্যাকটিসিং মুসলিম হওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। পাশ্চাত্যের সেক্যুলার মডারেট মূল্যবোধ থেকে দূরে সরে গিয়ে তারা ইসলামী মূল্যবোধ ও সংস্কৃতির দিকে ক্রমাগত ঝুঁকছে। আমার মতে, এর পেছনে মূল অবদান রেখেছে তাবলীগের ব্যাপক দাওয়াতি মেহনত ও মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থা। এটা আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদী ইসলামবিরোধী শক্তিগুলো ভালোভাবেই টের পেয়েছে।

আর সেজন্যই, ইসলামী সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ এবং মাদরাসা শিক্ষার বিরুদ্ধে সম্প্রতি এদেশের একশ্রেণীর ইসলামবিদ্বেষী সেক্যুলার প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীকে টাকার বিনিময়ে মাঠে নামিয়েছে সাম্রাজ্যবাদীদের এনজিও সংস্থাগুলো।

সাম্প্রতিককালে ঢাবি’র অধ্যাপক আমেনা মহসিন, মেসবাহ কামাল ও আবুল বারকাতদের একের পর এক মাদ্রাসাবিরোধী প্রপাগান্ডা ও বক্তব্য আসছে। সম্ভবতঃ টাকার বিনিময়ে তারা ইসলামী মূল্যবোধ ও মাদরাসা শিক্ষার বিরুদ্ধে বানোয়াট গবেষণা ও লিপ সার্ভিস দিচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে।

কারণ, তারা এত উচ্চ পজিশন থেকে যেভাবে ভিত্তিহীন ও কাণ্ডজ্ঞানহীন ফাউল তথ্য ও যুক্তি দিয়ে বক্তব্য দিচ্ছেন, তাতে করে সন্দেহ হয় যে, যদি সুস্থ ও স্বাভাবিক হয়ে থাকেন, তাহলে মাদরাসা শিক্ষা ও ইসলাম সংক্রান্ত নিজেদের বক্তব্যগুলোও তারা বিশ্বাস করেন কিনা।

তরুণপ্রজন্ম হুঁশিয়ার হোন। এদেশে ইসলামী সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ ধ্বংস করে পাশ্চাত্যের সেক্যুলার মডারেট মূল্যবোধ ও শিক্ষাকে ইসলামী তরুণপ্রজন্মের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার প্রকল্প শুরু হয়েছে। এই সাম্রাজ্যবাদী ইসলামবিরোধী প্রকল্প বাস্তবায়নে টাকার বিনিময়ে ব্যবহৃত হচ্ছে ঢাবি’র কিছু সেক্যুলার ইসলামবিদ্বেষী অধ্যাপক।

লেখক: তরুণ রাজনৈতিক বিশ্লেষক, গবেষক ও জাতীয় পত্রপত্রিকার কলাম লেখক।