Home মহিলাঙ্গন ধর্ষণবিরোধী সামাজিক আন্দোলন সময়ের অত্যাবশক দাবি

ধর্ষণবিরোধী সামাজিক আন্দোলন সময়ের অত্যাবশক দাবি

।। হেলাল মহিউদ্দীন ।।

জঘন্য অপরাধসহ ধর্ষণ ও গণধর্ষণের মহামারি চলছে বাংলাদেশে। বীভৎস শিরোনামগুলোর কয়েকটি উদাহরণ লিখতে বসে কেটে দিয়েছি। মনে হলো দুর্বলচিত্তের মানুষ ও শিশু-কিশোরসহ সুস্থ মানুষদের অসুস্থ হয়ে পড়ার জন্য শিরোনামগুলোই যথেষ্ট। বাংলাদেশে অপরাধবিজ্ঞান চর্চা মৃতপ্রায়। কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধবিজ্ঞান বিভাগ আছে। কিন্তু যেভাবে অপরাধ প্রতিদিনই উত্তরোত্তর বাড়ছে, তাতে স্পষ্ট যে অপরাধ দমনে দিকনির্দেশনা দেওয়ার বেলায় এগুলোর ন্যূনতম অবদানও নেই।

‘কনভিক্ট ক্রিমিনোলজি’ নামে অপরাধবিজ্ঞানের একটি শাখা আছে। আগে অপরাধী ছিল, সাজাও খেটেছে, কিন্তু বর্তমানে অপরাধ করছে না বরং নানা রকম অপরাধ নিয়ে গবেষণা করছে—এই রকম মানুষদের কারণে ‘কনভিক্ট ক্রিমিনোলজি’ প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে। এই বিদ্যারই আরেকটি নতুন ধরন হচ্ছে সরাসরি অপরাধীর ‘পার্সেপশন’ বা গূঢ় দৃষ্টিভঙ্গি-উপলব্ধি নির্মোহভাবে ও পক্ষপাতহীনভাবে জানার চেষ্টা করা। বাংলাদেশে আমরা সাধারণ জনগণ বা ভুক্তভোগীদের ধারণা সহজেই পাই। বেশির ভাগ ধর্ষকদের রাজনীতি পরিচয়ের কারণে মানুষ ভয় পায়। জনমনে দৃঢ় বিশ্বাস আইন, পুলিশ, প্রশাসন ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান ধর্ষকদের পক্ষে কাজ করে ইত্যাদি। কিন্তু ধর্ষকদের দৃষ্টিভঙ্গি জানা অত্যন্ত প্রয়োজন।

২০১২ সালে ভারতে ধর্ষণ মহামারির আকার ধারণ করার পর ভারতের এক বিশ্ববিদ্যালয়ছাত্রী ১২২ জন কারাবাসী ধর্ষকের ধর্ষণের আগের ও পরের মানসিক অবস্থা ও দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্লেষণ করেন। তিনিই যে প্রথম চেষ্টা করলেন তা নয়। সত্তরের দশক থেকেই সমাজবিজ্ঞানী ও নারীবাদীদের একাংশ (কাঠামোবাদী সমাজমনস্তত্ত্ব বিশ্লেষকেরা) ‘রিফ্লেক্সিভ রোল প্লেয়িং’ [প্রতিবিম্বের ভূমিকা নেওয়া] পদ্ধতি ব্যবহার করে জেলের ভেতরে ধর্ষকদের নিয়ে গবেষণা করেন।

এই পদ্ধতিকে ধর্ষকদের একটি খেলায় নামানো হয়, যেখানে অপরাধী যেন ধর্ষক নন, বরং ধর্ষিতা। তাঁকে সেভাবে প্রস্তুত করা হয় যেন ধর্ষিতার ভূমিকায় থেকে ধর্ষিতার যন্ত্রণা, কষ্ট-বেদনাকে হৃদয় দিয়ে অনুভব করেন। ধর্ষিতার প্রতিচ্ছবি হয়ে জানান ধর্ষিতার দৃষ্টিভঙ্গি এবং সেই দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে ধর্ষক হিসেবে নিজেকে কী ঘৃণাযোগ্য বা কঠোর শাস্তিযোগ্য মনে হয় কি না? ১৯৮৮ সালে ডানা স্কালি নামের এক গবেষকের ‘সাজা খাটা ধর্ষকদের নিজের এবং আক্রান্তের দৃষ্টিভঙ্গি: ভূমিকা গ্রহণ ও আবেগময়তা’ প্রবন্ধটি সবিশেষ উল্লেখ্য।

ভারতীয় ছাত্রীটি জানালেন, বেশির ভাগ ধর্ষকই গভীরভাবে অনুতপ্ত। কিন্তু অনুতপ্ত হওয়াকে আপাত স্বস্তির মনে হলেও তাদের মনে-মগজে-মননে দেখা গেল নারীকে তারা যৌন-উপকরণ মনে তো করেই, নারী–পুরুষের অধীন, নির্ভরশীল, করুণা পাওয়ার অধিকারী ইত্যাদিও মনে করে। সামাজিক মাধ্যমের কল্যাণে আমরা জানি, একজন ধর্ষক তার দ্বারা ধর্ষিতা এক শিশু সম্পর্কে মতামত দিল যে সে খুবই অনুতপ্ত। কারণ, যে শিশুটি সতীত্ব হারিয়েছে তার আর বিয়ে হবে না। এ কারণে সে মেয়েটিকে বিয়ে করতে রাজি আছে। আরেক ধর্ষক পাঁচ বছরের ধর্ষিতা সম্পর্কে জানাল শিশুটি তাকে ইঙ্গিত জানিয়েছিল।

ছাত্রীটির গবেষণা ব্যতিক্রম কিছু নয়—ডানা স্কালির মত ‘রিফ্লেক্সিভ রোল-প্লেয়িং’ সমাজবিজ্ঞান গবেষকেরাও একই ধরনের তথ্যই দিয়েছেন। তবে তাঁরা দেখিয়েছেন, যতই অনুতপ্ত হোক ধর্ষক কোনো না কোনো ছুতা বা অজুহাত বা অন্য কিছুকে দায়ী করার সুযোগ নেয়। অন্য কিছুকে দোষ দিতে পেরে সে নিজেকে কম অপরাধী ভাবে। এই অনুভব নিজের শান্তি বা আত্মপ্রবোধের প্রয়োজনেও ধর্ষক কাজে লাগায়। অন্যথায় ধর্ষণের ক্ষতি খুনের চেয়ে কম তো নয়ই প্রায় সময়ই অনেক বেশি। ধর্ষিত আজীবন মানসিক যন্ত্রণা, অন্যের প্রতি অবিশ্বাস, পুরুষ ঘৃণা এবং সমাজের প্রতি অনাস্থা নিয়ে ভীতসন্ত্রস্ত ও অনিরাপদ অনুভব নিয়ে বাকি জীবন কাটায়।

খুন একটি অপরাধ, ধর্ষণও অপরাধ। খুনির অজুহাত বা একে-ওকে দায়ী করাকরি সহজে ধোপে টেকে না। ধর্ষকেরটি কিন্তু অনায়াসেই টিকে যায়। যেমন ধর্ষিতা যৌন-উত্তেজক পোশাক-আশাক পরেছিল, ইঙ্গিত করেছিল ইত্যাদি। এক ধর্ষক মাদ্রাসা অধ্যক্ষ যেমনটি বলেছেন, শয়তান তাঁকে দিয়ে কুকর্ম করিয়েছে, অন্যরাও অনায়াসে বলে বসে তার পর্নোগ্রাফি দেখার দোষ বা নেশা, ইয়াবা বা উত্তেজক ওষুধ সেবনের কারণে, কিংবা গভীর রাতে মেয়েটিকে একা চলায় মেয়েটিকে সে যৌনকর্মী ভেবেছিল। ধর্ষকেরা জানে এই সব যুক্তি সমাজের বড় অংশের দ্বারা সমর্থিত।

ধর্ষকেরা আরও জানে আইনের একধরনের লোকরঞ্জন চরিত্র আছে এবং ঠিকমতো অজুহাতগুলো সাজাতে পারলে আইন আমলেও নেবে। ফলে ‘উত্তেজক পোশাক’, ‘নৈতিক শিক্ষাহীনতা’, ‘ধর্মশিক্ষা না থাকা’, ‘ধর্মাচরণ ও ধার্মিকতা’ কমে যাওয়া ইত্যাদি অজুহাতগুলো আইনসংশ্লিষ্টদের অনেককেও বলতে শোনা যায় এবং স্পষ্টই আইন এসব বিবেচনায় নেয়। ধর্ষক জানে তার ধর্ষণকে আইনে বড় অপরাধ গণ্য করা হবে না; ‘কলা চুরি’র মতো অপরাধের পর্যায়ে নামিয়ে আনা যাবে। ‘কলা চুরির জন্য ফাঁসি হয় না’ লোকপ্রবাদটি বাংলাদেশে বহুল প্রচলিত। আইনের নমনীয়তার কারণেই বেশির ভাগ ধর্ষকের চিন্তায় ধর্ষণ একধরনের ‘কলা চুরির মতো’ ব্যাপার। সে জন্য ধর্ষণের কমতির লক্ষণ নেই।

বাংলাদেশে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০ ধর্ষণের নানা ধরনের শাস্তির মধ্যে মৃত্যুদণ্ডও রেখেছে। আইনে আছে ১৮০ দিনের মধ্যে ধর্ষণের বিচারকাজ শেষ করতে হবে। বাস্তবে কোনো কোনোটি ১০ বছরেও নিষ্পত্তি হয় না। পুলিশ হেফাজতেও যে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে বা ঘটতে পারে তার স্বীকৃতি দিয়ে আইন প্রণয়ন সম্ভবত বাংলাদেশ ছাড়া অন্য কোথাও নেই। পুলিশ হেফাজতে থাকাকালে ধর্ষণ হলে ধর্ষকের অনধিক ১০ বছর ও অন্যূন ৫ বছর সশ্রম কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডের আইন আছে।

আইন কড়া হলে কি আসে যায়, যদি প্রয়োগেরই সুযোগ না থাকে। এমনিতেই সাক্ষী পাওয়া যায় না, আইনের কড়াকড়ির ফলে সাক্ষীদের প্রাণের হুমকি দিয়ে দাবিয়ে রাখা হয়। অ্যাডভোকেট সালমা আলি গত বছর বলেছিলেন, ৯২ ভাগ ঘটনাই ধামাচাপা পড়ে যায়। মাত্র ৩ থেকে ৫ ভাগের বিচার হয়। আবার শাস্তিও উচ্চ আদালতে যেতে যেতে লঘু থেকে লঘু হতে থাকে। গত বছর নারী পক্ষের এক গবেষণায় জানা যায় যে ২০১১ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ৪ হাজার ৩৭২টি মামলার মধ্যে মাত্র পাঁচটির বিচার হয়েছিল। ধর্ষণের শিকার বেশির ভাগ নারীই নিশ্চুপ থাকেন বলে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের ঘটনাই নথিভুক্ত হয় না। কারণ, লোকলজ্জা, সমাজভীতি, পরিবারের মান-মর্যাদা, ক্ষমতাবানদের ভয়, নিরাপত্তা হুমকি ইত্যাদি। অনেক সময় থানা-পুলিশ ধর্ষণের অভিযোগ নথিবদ্ধ করে না নিজেদের থানায় অপরাধ কম হয়েছে দেখানোর প্রয়োজনে অথবা ক্ষমতাসীনদের ভয়ে।

ধর্ষণ বিষয়ে আইনের দুর্বলতা ও অকার্যকারিতা দিবালোকের মতো স্পষ্ট। তাই বাংলাদেশে ধর্ষণ মহামারির রূপ নিচ্ছে। এই বছরের ১০ মাসে প্রায় ৩ হাজার ধর্ষণ নথিভুক্ত হয়েছে। যদি ধরে নিই যে তিন ভাগের এক ভাগ নথিভুক্ত হয়েছে, অনুমান করা যায় যে ৯ হাজারের বেশি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে মাত্র ১৯ মাসে। অর্থাৎ বছরে বারো হতে তেরো হাজার ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে একেক বছর। আতঙ্ককর বিষয় এই যে অর্ধেকের কাছাকাছি সংখ্যা মিলছে শিশু ধর্ষণের ঘটনা হিসেবে। সাত মাস বয়সের শিশু থেকে শুরু করে অশীতিপর বৃদ্ধাও ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন।

তাহলে সমাধান কী? আপাতত সমাধান মিলবে ব্যাপকভিত্তিক সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে। কয়েক মাস আগে ধর্ষণ শেষে সাত বছরের একটি শিশুকে হত্যার ঘটনার পর সামাজিক মাধ্যমে তীব্র ধর্ষণবিরোধী মনোভাব তৈরি হয়েছিল। এই জনমতটি আরও ব্যাপক বিস্তৃত হতে পারত, কিন্তু হয়নি। সবারই আইনের দুর্বলতাগুলো ধরিয়ে দিয়ে কথা বলা ও লেখা প্রয়োজন। সামাজিক আন্দোলনের সপক্ষে মতামতগুলো পত্রপত্রিকায় ও সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক প্রচার প্রয়োজন। পাড়ায়-মহল্লায় সম্মিলিত প্রতিরোধ স্কোয়াড তৈরি হওয়া দরকার, যাতে ধর্ষকের মনে ভীতি তৈরি হবে যে আশপাশেই সামাজিক পুলিশ ওত পেতে আছে তার শাস্তির ব্যবস্থা করার জন্য। ধর্ষণবিরোধী একটি সামাজিক আন্দোলন এখন অত্যাবশ্যক সময়ের দাবি।

লেখক: নৃবিজ্ঞানী, কানাডার মানিটোবা বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ ফেলো।