।। মুফতি জাকির হোসাইন কাসেমী ।।
গত দেড় মাস ধরে ৩০-৩৫ টাকা মূল্যের পেঁয়াজের দাম বাড়তে বাড়তে ১৫০ থেকে ৩০০ টাকার মধ্যে এখন ঘুরফাক খাচ্ছে। শুধু পেঁয়াজ নয়, বাজারের প্রায় প্রতিটি পণ্যের মূল্যে যেন আগুন জ্বলছে। কাঁচাবাজার, মাছ-মাংসের বাজার, চাল-ডাল-তেল-মরিচ থেকে শুরু করে প্রতিটি পণ্যের দাম লাগামহীন। সব জায়গায় জ্বলছে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির আগুন। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের বাড়তি দাম। প্রিপেইড মিটারের কারসাজির হরিলুট। শোনা যাচ্ছে, আবারও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব চূড়ান্ত হতে চলেছে।
এদিকে নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্যের প্রতিযোগিতায় ঔষধের মূল্য কেন স্থিতিশীল থাকবে? এ জন্যই হয়তো নতুন খবর হল ঔষধের দামেও আগুন লেগেছে। দ্বিগুণ-তিন গুণ এমনকি জীবন রক্ষাকারী কোন কোন ঔষধ কিনা চার গুণ পর্যন্ত বেড়েছে। ডায়াগনোস্টিক সেন্টারের পকেট কাটা ব্যবসার কথা কি আর বলব!
পত্রিকায় খবর বের হচ্ছে, বিদেশ থেকে আমদানী করা পেঁয়াজের ক্রয় মূল্য ঠেলেঠুলে ৩৮ টাকা পর্যন্ত পড়ছে। কিন্তু দেশে আসার পর এই ৩৮ টাকার পেঁয়াজ হয়ে যাচ্ছে। ১৫০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত। কারণ, বাজার মূল্যের হরিলুটের এই সময়ে আবার সব বাজারে, সব দোকানে সমান মূল্য নেই। যদিও ছোট বেলায় দেখতাম, পণ্যমূল্যে এ দোকান ও দোকান ১/২ টাকার বেশ কম হলেই ক্রেতা-দোকানী ঝগড়া শুরু হয়ে যেতো কেন এই তারতম্য। কিন্তু এখন ক্রেতাদের সহ্য ক্ষমতা অনেক বেড়ে গেছে। এখন মূল্যের আকাশ-পাতাল তফাৎ হলেও নিরবে সয়ে থাকা ছাড়া উপায় নেই। দোকানীর হাঁক, ফুসলে নেন, না হয় অন্য দোকানে যান। কাকে এবং কোথায় এই অন্যায়ের বিচার দিবেন? বিচারের বাণী তো নীরবে কাঁদে এখন।
নিজের ঘটনাই বলি, আজ সকালে বাজারে গেলাম প্রয়োজনীয় সদাই করতে। দোকানী পেঁয়াজের দাম ধরলো কেজি ২৬০ টাকা। টমেটো ১২০ টাকা। লাউ ৭০ টাকা। পাকিস্তানী ব্রয়লার মুরগী ২৬০ টাকা। বাজার শেষে রাস্তা পার হয়ে আরেক দোকানের পেঁয়াজগুলো আমার কেনা পেঁয়াজের চেয়ে সুন্দর মনে হলে দাম জিজ্ঞেস করলাম। দোকানী বলল, ১৬০ টাকা কেজি। এবার কৌতুহল থেকে জানতে চাইলাম- টমেটোর দাম ৬০ টাকা, লাউ ৫০ টাকা, মুরগী ২২০ টাকা। রাস্তার এ পাশ ও পাশের দামের তফাতের চিত্র এই। কিন্তু বিচারহীনতার এই দেশে মুখ বুঝে সহ্য করা ছাড়া যে কিছুই করার নেই, তা তো জানা।
দেশের সামগ্রীক আইন-শৃঙ্খলার কথা বলে কি শেষ করা যাবে? আজকে নিজে রাস্তার এ পাশ আর ওই পাশের বাজার মূল্যের যে চিত্র দেখলাম, তাতে দেশে আসলে জনস্বার্থ বান্ধব কোন সরকার আছে, ভাবার কি কোন অবকাশ আছে? সাধারণ জনগণের এমন জিম্মিদশা ও অসহায়ত্বের মধ্যেও আমাদেরকে উন্নয়নের জোয়ারের গল্প গিলতে হয়। নীতি, আদর্শ ও অধিকার সচেতনতা হারিয়ে ফেললে এসব হরিলুট ও অনাচার সহ্য করা ছাড়া তো কিছুই করার থাকে না।
দ্রব্যমূল্যের এই ঊর্ধ্বগতি মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত সমাজে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ না পারছে এত দাম দিয়ে জিনিস কিনতে, না পারছে অনাহারে থাকতে। এদিকে শ্রমিক, মজদুর, খেটে খাওয়া মানুষ, গ্রামীণ কৃষক, গরীব জনতার দিন গুজরানে কীভাবে হচ্ছে, মনে উঠলেও আঁতকে উঠতে হয়। যাঁরা প্রতিদিনের খাবার প্রতিদিন কিনে খান, তাঁরা যে এই লুটপাটের দু:সময়ে কতটা চরম হতাশাজনক ও কঠিন সময় পার করছে, বুঝানোর উপায় আছে? তাঁরা কীভাবে এই বাড়তি দামের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলবেন? জিনিসের দামের সঙ্গে তাঁদের শ্রমের মূল্য তো বাড়েনি।
কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো, এই অস্থিতিশীল অবস্থা নিরসনে সরকার কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া তো দূরের কথা, এই সাধারণ জনতার এই সংকটকে গুরুত্ব দিয়ে ভাবছে- এমন আলামতও তো চোখে দেখছি না।
এই কঠিন দু:সময়ে শুধু এটাই বলব, পরম করুণাময় দয়াময় আল্লাহ, আমরা দুর্বল, অসহায়, সাহসহারা, জুলুম-নিপীড়নের শিকার, চেতনাহীন, নেতৃত্বহীন। তুমিই আমাদের রব, অভিভাবক, প্রভু, উদ্ধারকর্তা। তুমি এই অসহায় জাতিকে সকল অন্যায়, জুলুম, নিপীড়ন থেকে রক্ষা করো। আমীন।
লেখকঃ মুহাদ্দিস- জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা ঢাকা, খতীব- তিস্তা গেট জামে মসজিদ টঙ্গী, গাজীপুর, উপদেষ্টা- উম্মাহ ২৪ ডটকম এবং কেন্দ্রীয় অর্থসম্পাদক- জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ।
ই-মেইল- muftijakir9822@gmail.com