Home ইসলাম আধ্যাত্মিকতায় ভরা সেই সোনালী মাহফিল ফিরে আসুক!

আধ্যাত্মিকতায় ভরা সেই সোনালী মাহফিল ফিরে আসুক!

- মাওলানা সানাউল্লাহ মাহমূদী।

সুন্দর একটা আধ্যাত্মিক আবহ থাকতো বাংলার শহর বন্দরে, গ্রামগঞ্জে, পাড়াগায়েঁর আনাচে কানাচে। দূর-দুরান্ত থেকে সুমধুর কণ্ঠে পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত, সুললিত কণ্ঠে হামদ, নাত, গজল ভেসে আসতো।

আজ এখানে তো কাল ওখানে। পরিচিত, অপরিচিত, প্রখ্যাত, অখ্যাত ওলামায়ে কেরামের ওয়াজ শুনত । হাসতো, কাদঁতো, আখেরাতের ভয়, জীবনের পাপ-পুণ্যের হিসেব মিলাতো মানুষ। সবশেষে তওবা করে আল্লাহর প্রিয় বান্দাহ হওয়ার ওয়াদা করে বাকি জীবনকে আল্লাহর হুকুম ও রাসূলের সুন্নাত অনুযায়ী জীবন চলার প্রত্যয় নিয়ে বাড়ি ফিরে যেতেন শ্রোতারা।

এসব দ্বীনি মাহফিলসমুহে ঈমানী মৃত্যুর জন্য দোয়া, পিতা মাতার জন্য, স্ত্রী ছেলে মেয়েদের জন্য দোয়া, তথা দুনিয়া আখেরাতের শান্তির জন্য আল্লাহ্‌র কাছে চোখের পানি ফেলে কান্না কাটি করতেন।

যারা মাহফিলে উপস্থিত হতে পারতেন না, তারা বিছানায় শুয়ে শুয়ে মাইকের আওয়াজে কান পেতে রাখতেন। ঘরের মা বোনেরা বারান্দায় পাটি বিছিয়ে মাহফিলের কথাগুলো মনযোগ সহকারে শুনতেন।

এমন মাহফিলসমূহে সত্যিই একটা আধ্যাত্মিক পরিবেশের বাংলার রূপ ফুটে উঠতো।

এখনো সারাদেশ ব্যাপী মাহফিল হয়, বরং বলতে হয়- অনেক বেশিই মাহফিল হয়! সুরের লহরীতে আকাশ বাতাস গুঞ্জরিত হয়। ঈমানদারদের বরফ হওয়া রক্তে অনল বর্ষণ করে ঈমানকে তেজোদিপ্ত করে দেওয়া হয়। শ্রোতারা উত্তেজনায় বজ্র কন্ঠে ধ্বনি দিতে থাকেন বার বার। নারায়ে তাকবিরে প্রকম্পিত হয় আকাশ বাতাস। দূর থেকে মাইকের সেই বজ্রশব্দ শুনে মনে হয় এই বুঝি জেহাদের ঢাক এসে গেলো !!

এক সময় মাহফিল শেষ হয়, মাইক খোলা হয়, প্যান্ডেল খোলা হয়, খাওয়া, দাওয়া, আদায়, বিদায় । এ রাত যেন শেষ হল আরেক রাতের আশায়।

[ দুই ]

একসময় এই মুসলিম অধ্যুষিত সোনার বাংলার গ্রাম জনপদের বিনোদন ছিল যাত্রা, সার্কাস, আর মেলার নামে জুয়া, হাউজীর মত চরিত্র বিধ্বংসী বিনোদন। এক শ্রেণীর পেশাদারী মস্তানরা এগুলো নিয়ন্ত্রণ করতো। টাকার ভাগ বাটোয়ারা হত টপ টু বটম।

অসহায় দ্বীনদার, পরহেজগার মুরুব্বীগণ চুপচাপ থাকতেন ব্যথিত মনে। আলেম, ইমাম, ওলামাগণ রুমাল দিয়ে মাথা মুখ ঢেকে মসজিদ মাদ্রাসায় যেতেন আর আসতেন। পীর মাশায়েখদের এই বাংলা, মাদ্রাসা মসজিদের এই বাংলা, দাওয়াত ও তাবলীগের এই বাংলা, হাজারো অলি আল্লাহর এই বাংলার জনপদ এধরনের চরিত্রবিধ্বংশী সংস্কৃতি, ঈমান আমল ধ্বংসকারী এই বিনোদন যে চলতে পারে না – তা আজকে বিলুপ্ত প্রায় ঐসব অপসংস্কৃতির ধারক বাহকদের হা হুতাশ দেখলেই বুঝা যায়। যদিও সে স্থানে তারচেয়েও ভয়ংকর অপসংস্কৃতি ডিজিটাল রূপে আগ্রাসন চালাচ্ছে।

ক্যাসিনো, ডিজে পার্টি, এবং সোস্যাল মিডিয়ার চ্যাটিং ম্যাসেন্জার, ইমু, হোয়াটসঅ্যাপ, ঘরে ঘরে নয় বরং হাতে হাতে পুরো সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে চরিত্র ধ্বংসের এক মহৌৎসব চালাচ্ছে । সর্বস্তরের মানুষকে গ্রাস করছে স্মার্ট মোবাইলের এই গজব।

এসব মাধ্যমে ভালো যতটুকু আছে তার ব্যবহার কতটুকু, আর অপব্যবহার কত ব্যাপক; তা প্রত্যেক সচেতন মানুষ মাত্রই অবগত আছেন। ভার্চুয়াল জগতের প্রতি মানুষের আগ্রহ কতটা ব্যাপক তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে এজগৎটাকে ইসলামী ভাবধারার মানুষেরা যতটা কল্যাণে ব্যবহার করছেন অপব্যবহার সে তুলনায় কি বেশী করছেন না?? !

[ তিন ]

বিষয়ে ফিরে আসি। শহর, গ্রামগঞ্জের মাহফিলের কথাই বলছিলাম। আজও তা আব্যাহত আছে বরং ব্যাপক ভাবে আছে। এটা দ্বীনের জন্য আশাব্যাঞ্জক হলেও সমসাময়িক কালের এই ব্যাপকতার ফলাফল হীতে বিপরীত হচ্ছে বলে বোদ্ধা মহল আলোচনা সমালোচনা করছেন।

অতি লোভে তাতী নষ্ট বা অধিক কচলানো লেবু খাওয়ার অযোগ্য তিতা হয়। বিষয়টা সে পর্যায়ে যাচ্ছে না তো ?

লাইভ প্রোগ্রামের ওয়াজ, ইউ টিউবের ওয়াজ গুলোতে শ্রোতারা কি দেখছেন, কি শুনছেন? অবাধ এই মিডিয়ার যুগে কতটা সতর্ক হতে হয় একজন দায়ীকে, একজন বক্তাকে – সে উপলব্ধি কি এইসব নামধারী, পদবীধারী বক্তাদের নেই? নিশ্চয়ই আছে…..।

কি অধিকারে আমাদের আবহমান কালের এই আধ্যাত্মিক পরিবেশকে আপনারা দূষিত করছেন? আমাদের আকাবিরগণ মাহফিলের আয়োজন কি এই উদ্দেশ্যে করেছিলেন যে, আপনারা আয়-রোজগারের মাধ্যম বানাবেন? কেউ সুর বিক্রি করবেন! কেউ দ্বীনি মাহফিলকে কৌতুককর তামাশার মজমা বানাবেন! কেউ হুংকার দিয়ে রক্ত গরম করবেন! মঞ্চে উঠে একে অন্যের বিরুদ্ধে ঝাল মিটাবেন! সরল সহজ মুরিদদের কে নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য উগ্র বানাবেন!

খেলোয়াড় আর শিল্পীদের মত চুক্তি করবেন!! কেউ কেউ নিজের ঢোল নিজে বাজিয়ে সেল্ফি তুলে প্রচার করবেন- আজকে অমুক জেলায় যাচ্ছি, বিমানে উঠ্ছি, এ যেন ফটো তোলা, সেল্ফি তোলা, ভিডিও করার এক মহা উৎসবে মেতে উঠেছে বর্তমান কালের নামধারী, পদবীধারী বক্তাগণ।

মিনতি করছি, ক্ষমা করবেন। আপনাদের এসব কর্মকাণ্ডের জন্য ওয়াজ মাহফিলের আমল আমাদের পূর্বসুরী ওলামায়ে কেরামগণ জারি করেননি। জনসাধারণকে বছরে একবার হলেও এলমে-দ্বীন শিক্ষা দেওয়ার মহান উদ্দেশ্য নিয়ে আলেমদের জিম্মাদারী আদায় করার জন্যই আয়োজন করেছিলেন প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রিক এই ওয়াজ মাহফিল। যার ব্যাপকতা আজকে সীমাহীন বটে। তবে আধ্যাত্মিকতা যে ব্যাপক ভাবে হ্রাস পেয়েছে, তা স্বীকার করতে মোটেও কুন্ঠা বোধ করছি না।

কারও মাহফিল বন্ধ হলে উৎফুল্ল হই। কাউকে কাফের মুশরিকের ট্যাগ লাগিয়ে দেই। মাহফিলের মাইকের উচ্চ চিৎকারের ক্ষতি বা শব্দদূষণ নিয়ে সতর্ক করলে তাকে বাতিল আর ইসলামবিদ্বেষের ফতোয়া দেই। নিম্ন মানের শব্দ ব্যবহার করে অকথ্য ভাষার বমি করি একে অপরের বিরুদ্ধে।

এই বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে মুখে কসটেপ মেরে চুপ থাকতে হবে। বহু রংএর চশমা পরে চোখ থাকতেও অন্ধ সাজতে হবে! রুহানী আবহের সেই ওয়াজ মাহফিল ফিরে পাওয়ার, তাকওয়া পরহেজগারী অর্জনের সেই মাহফিল প্রত্যাশা করা কি খুব অসম্ভব!?

না, মোটেও তা নয়। এখনও আল্লাহর সেই সব মুখলিস বান্দারা আছেন, যাঁরা ইখলাছের সাথে নির্লোভ অন্তর নিয়ে ওয়াজ নসিহত করে যাচ্ছেন। পেশাদার বক্তাদের অতি প্রচারের ডামাডোলে হয়তো তাঁরা প্রখ্যাত বা বহুল আলোচিত হচ্ছেন না বটে। তবে যতটুকু রুহানীয়্যাত এসকল মুখলিস ওলি-আল্লাহগণের মাহফিলসমূহে এখনও অবশিষ্ট আছে, তা তাঁদের ইখলাছ এবং কোরবানীর কারণেই আছে।

অধিক লোকসমাগম, অধিক বাজেট, সেলিব্রিটি পেশাদার বক্তাদের উপস্থিত করতেই হবে- এই চিন্তা চেতনা থেকে আমরা যতদিন মূক্ত না হব, ততদিন আমরা আধ্যাত্মিকতার সেই সোনালী মাহফিল ফিরে পাব বলে মনে হয় না। আনুষ্ঠানিকতার এই মাহফিল আয়োজন হয়তো বন্ধ হবে না। তবে ফেতনার ডালপালা যে আরও বিস্তৃত হবে, তা বিলক্ষণ অনুভব করতে বেগ পেতে হয় না। বিজ্ঞ ওলামায়ে কেরামের গঠনমূলক পরামর্শ এবং দিকনির্দেশনা এ অবস্থায় একান্ত প্রয়োজন বলে ব্যাক্তিগত ভাবে মনে করছি।

পরম করুণাময় আল্লাহ আমাদের সকলকে সঠিক পথের দিশা দান করুন। আমীন।

লেখক: চিন্তক, আলেমে-দ্বীন, ইসলামী রাজনীতিবিদ।