Home জাতীয় সুন্নাহ’র অনুসরণের মাঝেই দুনিয়া-আখিরাতের শান্তি নিহিত: জামিয়া সুবহানিয়ায় আল্লামা কাসেমী

সুন্নাহ’র অনুসরণের মাঝেই দুনিয়া-আখিরাতের শান্তি নিহিত: জামিয়া সুবহানিয়ায় আল্লামা কাসেমী

উম্মাহ প্রতিবেদক: জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ’র মহাসচিব ও রাজধানীর জামিয়া মাদানিয়া বারিধারার প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক শায়খুল হাদীস আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী (হাফি.)এর প্রতিষ্ঠিত টঙ্গী জামিয়া সুবহানিয়া মাহমূদনগর মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদীস সমাপনী বর্ষের বিদায়ী ছাত্রদের বুখারী শরীফের আখেরী সবক, সম্মানসূচক পাগড়ি পরানো এবং দোয়া মাহফিল গতকাল (১৩ মার্চ) আখেরী মুনাজাতের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়েছে।

সমাপনী দরস ও দোয়া মাহফিল পরিচালনা করেন প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ও প্রবীণ আলেম শায়খুল হাদীস পীরে কামেল আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী। বাদ মাগরীব থেকে শুরু হয়ে রাত ৮টা পর্যন্ত অনুষ্ঠিত এই দ্বীনি সমাবেশে দাওরায়ে হাদীস (টাইটেল)এর সমাপনী দরস সম্পন্ন হয়। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা থেকে হাদীস শাস্ত্রের বিশুদ্ধ ও প্রধান কিতাব বুখারী শরীফের আখেরী দরস বা সমাপনী ক্লাস শুরু হয়ে রাত ৮টায় শেষ হয়।

খতমে বুখারীর দরস শেষে বিদায়ী তরুণ আলেম এবং উপস্থিত উলামায়ে কেরাম, তালেবে ইলম ও মুসল্লীদের উদ্দেশ্যে বিশেষ হিদায়াতী বয়ানে শায়খুল হাদীস আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী বলেন, দেশে বিদেশে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে নানামুখী ষড়যন্ত্র ও আঘাত চালানো হচ্ছে। দাড়ি-টুপী ও হিজাব পরিহিতা মুসলমান নারী-পুরুষ নানাভাবে হয়রানীর শিকার হচ্ছেন।

তিনি ঈমান ও ইসলামের হেফাজতের লক্ষ্যে উলামা-মাশায়েখ ও সাধারণ মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ অবস্থানের উপর গুরুত্বারোপ করে তরুণ আলেমদের উদ্দেশ্য করে বলেন, এই কঠিন পরিস্থিতিতে ইসলামের শান্তি, সাম্য ও ঐক্যের বাণী জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছাতে আপনাদেরকে জোরদার ভূমিকা রাখতে হবে। দেশ ও জাতির কল্যাণে ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করতে হবে। মুসলিম ভ্রাতৃত্ব ও স্বকীয়তাবোধ বজায় রেখে সহনশীল আদর্শ সমাজ গড়তে আপনাদেরকে নিরলস কাজ করে যেতে হবে।

আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী খতমে নবুওয়াতের গুরুত্ব ও ত্যৎপর্যের উপরও গুরুত্বপূর্ণ বয়ান করে বলেন, পবিত্র কুরআন যেমন শেষ আসমানী কিতাব, তেমনি হযরত মুহাম্মদ (সা.)ও শেষ নবী। কুরআনের পর যেমন নতুন কোন আসমানী কিতাব আর আসবে না, তেমনি হযরত মুহাম্মদ (সা.)এর পরও আর কোন নতুন নবী কিয়ামত পর্যন্ত আসবেন না। এর উপর বিশ্বাস স্থাপন করা প্রতিটি মুসলমানের জন্য আবশ্যকীয়। রাসূল (সা.)কে শেষ নবী স্বীকার না করে কেউ মুসলিম দাবি করতে পারে না। গোলাম আহমদ কাদিয়ানী রাসূল (সা.)কে শেষ নবী মানেন না। তাই কাদিয়ানী ও তার অনুসারীরা মুসলিম নয়। তারা মুসলিম বলে দাবি করার অধিকার রাখে না। সুতরাং কাদিয়ানীদের বিভ্রান্তি সম্পর্কে আপনাদেরকে জাতিকে সতর্ক করতে হবে।

তিনি তরুণ উলামায়ে কেরামের প্রতি ইলমে ওয়াহীর পরিপূর্ণ অনুকরণ-অনুসরণ করার উপদেশ দিয়ে বলেন, ওয়াহী দুই প্রকার। একটা হল ওয়াহী মাতলু, যার শব্দ ও বাখ্যা পুরোটাই আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ। এটা হল পবিত্র কুরআনে কারীম। অন্যটা হল ওয়াহী গায়রে মাতলু। যার শব্দ নবীর তরফ থেকে এসেছে। কিন্তু অর্থ ও ভাব আল্লাহর তরফ থেকে। আর এটা বাস্তবায়ন করে দেখিয়েছেন সাহাবায়ে কেরাম (রাযি.)। সুতরাং মুসলমানদের কাছে কুরআন-হাদীস উভয়ই অপরিহার্য গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং পবিত্র কুরআন যেমন ইলমে ওয়াহী, হাদীসে রাসূল (সা.)ও ইলমে ওয়াহী। সুতরাং আপনাকে আমাকে যদি জান্নাতে যেতে হয়, জাহান্নাম থেকে বাঁচতে হয়, তাহলে পরিপূর্ণরূপে ইলমে ওয়াহীর পরিপূর্ণ অনুসরণ অনুকরণ করে চলতে হবে।

তিনি বলেন, সত্যিকারের শান্তি পেতে হলে তার একমাত্র রাস্তা কুরআন হাদীসের রাস্তা, দ্বীন ইসলামের রাস্তা। আপনাদের সন্তানকে কুরআন-হাদীসের শিক্ষা দিবেন। এতে আখেরাতের জীবনও শান্তিময় হবে, দুনিয়ার জীবনও শান্তিময় হবে। আপনার সন্তান কুরআন হাদীসের শিক্ষা পেলে কোন পিতামাতাকে বৃদ্ধাশ্রমে যেতে হবে না। সন্তানের কাছ থেকে ভাল কিছু পেতে চান, সুন্দর আচরণ পেতে চান, দেশ ও জাতির মঙ্গল চান, সর্বস্তরে শান্তি চান, তাহলে অবশ্যই সন্তানকে কুরআন-হাদীসের শিক্ষায় শিক্ষিত করুন।

তিনি বলেন, ইসলাম কখনোই টেকনলোজির বিরুদ্ধে নয়। উলামায়ে কেরাম কখনো গবেষণা ও বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে নয়। ইসলামে সব সময় গবেষণা ও পড়াশোনাকে উৎসাহিত করেছে। কেউ বিরুদ্ধে ভাবলে এটা ভুল ব্যাখ্যা। আমরা বিজ্ঞান ও টেকনলোজির উত্তম ব্যবহার চাই। উত্তম কাজের জন্য গবেষণা চাই। আমরা সব সময় দেশ, জাতি ও মানবতার কল্যাণে কাজ করতে চাই। আমরা সর্বস্তরে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চাই।

আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী তরুণ আলেমদেরকে সতর্ক করে বলেন, ঈমান-আক্বীদা ও ইসলামের জন্য যে কোন পদক্ষেপ যেন শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক হয়, সে দিকে নজর রাখবেন। কারণ, মুসলমানরা সুশৃঙ্খল জাতি। ইসলামে বিশৃঙ্খলা, হানাহানি, ভাংচুর ও সন্ত্রাসের কোন স্থান নেই। হেকমত, বুদ্ধিমত্তা ও শৃঙ্খলা বজায় রেখে দ্বীনি কাজ আঞ্জাম দিবেন।

দরসের শুরুতে আখেরী হাদীসের পুরো সনদসহ মতন পাঠের পর আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী বিদায়ী ছাত্রদের উদ্দেশ্যে হাদীসের উপর বিশদ আলোচনা করেন।

আলোচনায় হাদীসের বিশুদ্ধ কিতাব বুখারী শরীফ ও এর রচয়িতা ইমাম আবু আব্দিল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে ইসমাঈল বুখারী (রাহ.)এর কিছু বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ইমাম বুখারী (রাহ.) দীর্ঘ ১৬ বছর পর্যন্ত সিয়াম সাধনার মাধ্যমে ১,০৮০ জন উস্তাদ থেকে অর্জনকৃত ৬ লক্ষ হাদীস থেকে বাচাই করে ৭,২৭৫টি হাদীস সংকলন করেছেন। প্রত্যেক হাদীস লেখার পূর্বে গোসল করে দুই রাকাত নামায আদায় করে আল্লাহ্ তাআলার দরবারে এই দোয়া করতেন, হে আল্লাহ! হাদীস যদি ভুল হয়, তাহলে শুদ্ধতা অন্তরে ঢেলে দিন। রওজায়ে আক্বদাসের পাশে বসে ৩,৩৮৮টি বাব (অধ্যায়) নির্ধারণ করেছেন। আল্লামা কাসেমী এ বিষয়ে আরো বিস্তারিত বক্তব্য রাখেন।

সম্প্রতি বিশ্বব্যাপী মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়া করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব প্রসঙ্গে আল্লামা কাসেমী বলেন, এই মহামারি থেকে রক্ষা পেতে হলে আমাদেরকে আল্লাহমুখী হতে হবে। বেশি বেশি তাওবা-ইস্তিগফার করতে হবে এবং আল্লাহর সাহায্য কামনা করে রোনাজারি করতে হবে। একমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লাই আমাদেরকে এই বিপদ থেকে মুক্তি দিতে পারেন।

দৈনন্দিন জীবনকে সুন্নাহ অনুযায়ী গড়তে পারলে করোনার প্রাদুর্ভাব থেকে হেফাজতে থাকা যাবে উল্লেখ করে আল্লামা কাসেমী বলেন, ইসলামে পাক-পবিত্র তথা সার্বক্ষণিক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার সাথে চলাফেরাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। সুন্নাহ মতে জীবন সাজানো গেলে করোনাভাইরাস আক্রান্ত করতে পারবে না। এ জন্য সবসময় অজুর সাথে থাকতে চেষ্টা করবেন। কারণ, অজু করতে হলে হাত-পা, মুখমণ্ডল বার বার ধোয়া হয়ে যাবে। নিয়মিত পাঁওয়াক্ত নামাযের আগে মিসওয়াক করবেন। দৈনিক গোসল করবেন। খাওয়ার আগে ভালভাবে হাত ধুইবেন। জনসমক্ষে হাঁচি-কাশির সময় মুখ আড়াল করবেন, যাতে অজানা জীবাণু ছড়াতে না পারে। জামা-কাপড় পরিষ্কার রাখবেন। খাবারের ব্যবহৃত থালা-বাসন, জগ-গ্লাস ও আসবাবপত্র পরিষ্কার -রিচ্ছন্ন রাখবেন। বিনাকারণে জনসমাগম পরিহার করবেন। আর বেশি বেশি ইসতিগফার ও আল্লাহর সাহায্য চেয়ে দোয়া করবেন। ইনশাআল্লাহ করোনাভাইরাস থেকে মুক্ত থাকা সহজ হবে।

দরস ও হিদায়াতী বয়ান শেষে আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী বিদায়ী ছাত্র, উপস্থিত মুসল্লী এবং দেশ ও মুসলিম উম্মাহর কল্যাণ ও শান্তির কামনা করে বিশেষ মুনাজাত পরিচালনা করেন। মুনাজাতে তিনি করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব থেকে জাতিকে রক্ষায় মহান আল্লাহর সাহায্য কামনা করেন। বিশ্বের মজলুম মুসলমানদের জন্য দোয়া করেন। বিশেষভাবে ফিলিস্তিন, আরাকান, দিল্লিসহ ভারতের নির্যাতিত মুসলমানদের জন্য দোয়া করেন।