Home বুক রিভউ নতুন বই- “চীন: গ্লোবাল অর্থনীতির নতুন নেতা”

নতুন বই- “চীন: গ্লোবাল অর্থনীতির নতুন নেতা”

।। মুসতাইন জহির ।।

চীন: গ্লোবাল অর্থনীতির নতুন নেতা

লেখক- গৌতম দাস

প্রকাশক-  একাদেমিয়া প্রকাশনী

পরিবেশক- সূচীপত্র, ৩৮/২-ক বাংলাবাজার, ঢাকা।

অনলাইন পরিবেশক- www.boibajar.com মোবাইল- ০১৭১৭-৭১৫৬৭১

অনেকের মনে থাকার কথা এই শতকের সূচনালগ্নেও পরাশক্তি হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একক এবং অপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্ষমতা বড় ধরনের কোনো চ্যালেঞ্জ ছাড়া দীর্ঘ সময়ের জন্য দুনিয়া শাসন ও নেতৃত্ব দিতে যাচ্ছে – এরকম একটি ভবিতব্য কমবেশি সকলেই গ্রহণ করে নেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান থিংক ট্যাংক, ক্লিনটনের পরে জুনিয়র বুশকে নিয়ে যারা ক্ষমতায় এসেছিল তারা একে new american century বলে আখ্যা দেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তৈরি হওয়া আন্তর্জাতিক কাঠামোর গুরুত্বপূর্ণ দুটি উপাদান বলা চলে এই সময়ে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পরিপূর্ণ আকার নিয়ে বৈশ্বিক পরিম-লে বিস্তৃতি লাভ করে। এক. আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংস্থা বা WTO, দুই. মানবাধিকারের সনদ, কাঠামো ও পরিচালনায় নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান সমূহ। অর্থনৈতিক অনুষঙ্গকে মুক্তবাজার কিংবা বিশ্বায়ন নামে ডাকা হতো। আর রাজনৈতিক অনুষঙ্গকে লিবরাল ডেমোক্র্যাসি। আমেরিকার নেতৃত্বে দুনিয়া এই দু’টি উপাদানকে আশ্রয় করেই চলবে। এই প্রত্যয়জাত সিদ্ধান্ত থেকেই দুনিয়ার ইতিহাসের একটি সমাপ্তির কথা ঘোষণা করেছিলেন ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা।

কিন্তু খবর হিসেবে এখন আমরা শুনতে পাচ্ছি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অর্থনৈতিক পরাশক্তি হিসেবে হয়ত আর এক দশকও নেতৃত্বের আসনে বহাল থাকবে না। আমেরিকান শতকের যবনিকা পড়তে যাচ্ছে খুব দ্রুতই। এটা নিছকই দ্রুতলয়ে বাড়ন্ত একটি দেশের আর্থিক সক্ষমতা, উদ্বৃত্ত, বিনিয়োগ ও পণ্যের বাজার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে আর্থিক মূল্যে ছাড়িয়ে যাবার ঘটনার মধ্যে সীমাবদ্ধ নাই। সেরকম একটি সম্ভাবনা এর আগেও তৈরি হয়েছিল।

আশির দশকে জাপানের অর্থনীতি সেরকম একটা আলোচনার জন্ম দিয়েছিল। দীর্ঘদিন জাপান যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি দ্বিতীয় প্রধান অর্থনীতি হিসেবে অবস্থান করেছে। কিন্তু তাতে বিশ্বব্যবস্থায় আঁচড় লাগেনি, ক্ষমতার ভারসাম্যে বিশেষ বদল, নতুন মেরুকরণ কিংবা নতুন ধরনের বৈশ্বিক কাঠামো গড়ে উঠবার কোন সম্ভাবনা বা তৎপরতার কথা শোনা যায়নি। তাহলে চীন জাপানের জায়গায় পৌঁছানোর পর এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে গিয়ে সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ হিসেবে জায়গা করে নিলে দুনিয়ার ক্ষমতা ভারসাম্য সর্বোপরি বিশ্বব্যবস্থায় তাৎপর্যপূর্ণ বদল ঘটার সম্ভাবনা কতটুকু? বস্তুগত শর্ত কতটুকু তৈরি হয়েছে, এর বাস্তব কোন আলামত কি ইতোমধ্যেই দৃশ্যমান হয়েছে? যদি ঘটেওবা থাকে তাহলে সেটা অনিবার্য কেন? সেই অভিমুখ কি আর মাঝখানে বদলাবে না? অনিবার্য পরিবর্তনের যে নতুন অবয়ব দানা বেঁধে উঠছে, সে বিশ্বব্যবস্থার গতিপ্রকৃতি বোঝার জন্য পদ্ধতিগত আলোচনার সূচনা কীভাবে হতে পারে?

গৌতম দাস গত এক দশকের বেশি সময় আন্তর্জাতিক প্রসঙ্গ নিয়ে বিভিন্ন লেখাতে মূলত এই দিকটা বোঝাপড়ার জন্য একটি পদ্ধতিগত কাঠামো দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছেন। এখানে চীনকে প্রসঙ্গ করে যে লেখাগুলো একত্রিত করা হয়েছে, পাঠক তার মধ্যে অন্তর্গত ঐক্যটি ধরতে পারবেন।

তাঁর গুরুত্বপূর্ণ প্রথম প্রস্তাব হচ্ছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বাপর সময়কালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাত ধরে পুঁজি সর্বপ্রথম প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বিশ্ববাজারের কাঠামোগত ভীত তৈরি করতে সক্ষম হয়। এর আগে সত্যিকারের অর্থে বিশ্ববাজার ও তৎসঙ্গে পুঁজিতন্ত্রের একটি প্রতিষ্ঠানগত কাঠামোর উপস্থিতি ছিল না। কলোনি শাসনের যামানায় বসে কেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তথা তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট এর পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে একটি নতুন ধরনের বিনিময় ব্যবস্থা, বৈশ্বিক সম্পর্ক সূত্র তৈরির কথা ভাবলেন? আন্তরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের জন্য রাজনৈতিক কাঠামো, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও মুদ্রা ব্যবস্থাপনার জন্য নীতি নির্ধারনী সংস্থা, অবকাঠামো উন্নয়ন ও বিনিয়োগের ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে ব্যাংক ও এই ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজনের মধ্য দিয়ে বিশ্ব ব্যবস্থার আকার দিতে চাইলেন? বিশেষত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল ও বিশ্বব্যাংক, প্রতিষ্ঠান দু’টি তৈরির পেছনে উদ্দেশ্য এবং কার্যক্রম সম্পর্কে পরিচ্ছন্ন বোঝাপড়া ছাড়া বিশ্বব্যবস্থা কথাটার আদতে কোন অর্থ উদ্ধার করা সম্ভব হবে না। আর সেক্ষেত্রে আমাদের জন্য প্রধান প্রতিবন্ধকতা দীর্ঘদিন থেকে এক নিশ্বাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধীতার নামে স্নায়ু যুদ্ধের সময় সোভিয়েত রাশিয়ার তৈয়ার করা ভাষ্য মোতাবেক দুনিয়াকে এখনও বোঝা ও ব্যাখ্যা করার অক্ষম চেষ্টা। আলস্য আক্রান্ত প্রোপাগান্ডামূলক এই ভাষ্যের বাইরে থেকে, তিনি বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন বাস্তবে এটা দীর্ঘ প্রায় ৭০ বছর কীভাবে কাজ করেছে এবং এখন এ ব্যবস্থাটি কোন কোন বৈশিষ্ট্যের কারণে পশ্চিম থেকে পূর্বে নতুন ভারকেন্দ্রের দিকে দিকে হেলে পড়ছে।

লেখকের দ্বিতীয় প্রস্তাব, চীনের অর্থনৈতিক শক্তি বৃদ্ধি এবং তাকে আশ্রয় করে বৈশ্বিক পরিম-লে একটি নতুন সম্পর্ক নির্মাণের বৈষয়িক প্রায় সকল উপাদানই ইতোমধ্যে যথেষ্ট পরিমাণে তৈরি হয়েছে। সেটা চীনের উদ্যোগ ও নেতৃত্বে সচল হওয়া BRICS জোট, এশীয় অবকাঠামো উন্নয়ন ব্যাংক, কিংবা সর্বসাম্প্রতিক সিল্করুট প্রকল্প ইত্যাদির ভেতরে কতটুকু জমাট বাঁধছে, তা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ও তথ্য উপাত্ত সন্নিবেশ করে দেখিয়েছেন। কিন্তু রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের জায়গা থেকে বর্তমান দুনিয়া যতটুকু এগিয়েছে, তাকে বাদ দিয়ে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক সক্ষমতার জোরে, উদ্বৃত্ত বিনিয়োগ ও বাজারকে আশ্রয় করে একটি নতুন বিশ্ব ব্যবস্থার পত্তন করতে চাইলে তাতে চীন আদৌ কি সফল হবে? আর্থিক সক্ষমতা আর ক্ষেত্রবিশেষে সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে অন্যদের সম্মতি আদায়ে কিংবা নেতৃত্ব অর্জন করা চীনের পক্ষে সম্ভব হবে না। উদাহরণতঃ বার্মাকে রোহিঙ্গা মুসলমান গণহত্যায় অব্যাহত সমর্থন দেওয়া কিংবা কম্বোডিয়ায় চীনের ভূমিকা বিশ্লেষণ করে গৌতম দাস সেটা দেখানোর চেষ্টা করেছেন। অবকাঠামোতে বিনিয়োগ আর বাজার নিয়ে হাজির হওয়ার বাইরে অগ্রসর ও আকর্ষণীয় রাজনৈতিক কোনো লক্ষ্য ও কল্পনা এখনও পর্যন্ত চীন হাজির করতে পারেনি। যতক্ষণ পর্যন্ত চীন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে আরো অধিক সমতাপূর্ণ একটি স্বচ্ছ বাণিজ্য বিনিময় সম্পর্ক, রাজনৈতিক অধিকার, মানবিক মর্যাদা ও স্বাধীনতার সুরক্ষার প্রস্তাবনা হাজির করতে না পারবে, ততদিন অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে থাকার পরও নতুন একটি বিশ্বব্যবস্থা তৈরীর পক্ষে বাকিদের জড়ো করা, নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার কাজটি সম্পন্ন করতে সক্ষম হবে না।

ধরা যাক চীন সে ব্যাপারে মনোযোগী হল। তাহলে কি সে বিনা বাধায় নতুন একটি বিশ্ব ব্যবস্থা তৈরির কাজটি সম্পন্ন করতে পারবে? নিশ্চয়ই না। বিশ্ব অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্বের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রকের আসন থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরে যাওয়ার জন্য নিশ্চয়ই বসে বসে অপেক্ষা করবে না। আলামতগুলো যখন ২০০৫ সন থেকে স্পষ্ট হওয়া শুরু করেছে, ততোধিক উদ্যম নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পরিবর্তনের সম্ভাব্যতাকে বিলম্বিত কিংবা নষ্ট করে দিতে চেষ্টা করছে। সেই চেষ্টার আদলে গৃহীত পররাষ্ট্রনীতি এবং সামরিক পরিকল্পনার কারণে এশিয়া প্রধান যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হতে চলেছে। ওবামা প্রশাসনের সময়ে গৃহীত এশিয়া পিভোট সেই ডকট্রিনের অংশ। কিংবা তারও আগে ২০০৭ সালে বাংলাদেশে যে সামরিক অভ্যুত্থান ও সরকার পরিবর্তন প্রক্রিয়ার সূচনা ঘটে, তার সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ এশিয়া নীতি, চীনকে ঘিরে ধরা, ইন্ডিয়ার সাথে চীন বিরোধী মৈত্রী ইত্যকার ঘটনার অভিঘাত, চাপ ও তাপ আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে কীভাবে বদলে দিচ্ছে, কতটা কোথায় কখন নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে, তার যোগসূত্র পাঠক বুঝে নিতে পারবেন এখানে সংকলিত লেখাগুলোর মধ্যে।

এখানে একত্রিত করা লেখাগুলো থেকে পাঠক বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও পররাষ্ট্রনীতির গুরুত্বপূর্ণ সংবেদনশীল ক্ষেত্রগুলো খুব সহজেই চিহ্নিত করতে সক্ষম হবেন। একই সাথে ভারসাম্য রক্ষা ও চাপ মোকাবেলার কৌশলে বিপদজনক ব্যর্থতা, বাংলাদেশের উপর ক্রমেই প্রবল হয়ে পড়া ভারতীয় আধিপত্য কখন থেকে কীভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রশ্রয় ও সমর্থনে আজকের দুর্দমনীয় জায়গায় এসে উপনীত হয়েছে, সেই দিকটির হদিস পাবেন। আরো স্পষ্ট করে বললে, যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ এশিয়া নীতি কেন ইন্ডিয়ার চীন ভীতিকে উস্কে যুদ্ধংদেহী করে তুলতে চাইছে, আর মওকা পেয়ে ইন্ডিয়া এ অঞ্চলে রুস্তমী করা শুরু করেছে। অন্যদিকে, বিকারগ্রস্ত পেশী প্রদর্শনের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠছে দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সবকটি দেশের জনগণ।

[ফেব্রুয়ারি, ২০১৮, শ্যামলী, ঢাকা]