Home ইসলাম কেন মহামারির প্রাদুর্ভাব ঘটে এবং একজন মু’মিনের কী করা কর্তব্য

কেন মহামারির প্রাদুর্ভাব ঘটে এবং একজন মু’মিনের কী করা কর্তব্য

।। মুফতি জাকির হোসাইন কাসেমী ।।

বিশ্বব্যাপী মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছে মরণব্যাধি ভাইরাস ‘করোনা’র ভয়ে আজ সারাবিশ্বের মানুষের মতো আমাদের দেশেও চরম আতঙ্কজনক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে গত প্রায় দেড় বছর ধরে দফায় দফায় দেশব্যাপী লক ডাউন পরিস্থিতি বিরাজ করছে। মানুষজন ঘর থেকে সহজে বের হচ্ছেন না। কলকারখানা, গাড়ি, বিমান, শপিং মল, পর্যটন, জনপরিবহণ সবই বন্ধ। স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসাসহ সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। প্রাণঘাতি এই ভাইরাসের সাথে কিছুদিন আগেও মানুষ পরিচিত ছিলো না। কারণ, এমন প্রাণঘাতি ও ব্যাপকভাবে ছড়িয়েপড়া ভাইরাস নিকট অতীতে দেখা যায়নি।

মহামারির বিপর্যয়ের কারণ উল্লেখ করে আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন, ‘মানুষের কৃতকর্মের ফলে স্থলে ও সমুদ্রে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়ে; যার ফলে তাদের কৃতকর্মের কোনো কোনো কর্মের শাস্তি তাদের তিনি আস্বাদন করান, যাতে তারা ফিরে আসে। (সূরা রূম- ৪১ আয়াত)।

অনুরূপ হাদীসেও হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন- যখন কোন জাতির মধ্যে প্রকাশ্যে অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়ে, তখন সেখানে মহামারী আকারে প্লেগরোগের প্রাদুর্ভাব হয়। তাছাড়া এমন সব ব্যাধির উদ্ভব হয়, যা পূর্বেকার লোকদের মধ্যে কখনো দেখা যায়নি। (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং- ৪০১৯)।

সুতরাং পবিত্র কুরআন-হাদীসের ভাষ্যমতে ব্যাপক হারে মানুষ আল্লাহ তাআলার অবাধ্য হলে আল্লাহ পাক পৃথিবীতে গজব নাজিল করেন; যাতে মানুষ তাদের ভুল বুঝতে পেরে তাওবার মাধ্যমে আবার ফিরে আসতে পারে। এই গজব বা মহামারি আসলে তখন করণীয় কী? ইসলামে এ সম্পর্কে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা রয়েছে। যে কোন মহামারি থেকে বাঁচতে প্রথম ও প্রধান করণীয় হচ্ছে- নিজেদের কৃতকর্ম থেকে তাওবা করা এবং বেশি বেশি ইস্তেগফার করা।

এই মুহূর্তে আমাদের সবার উচিত, মহান আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া এবং অশ্লীলতা থেকে বিরত থাকা। সর্বদা পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন থাকা। কারণ, কিয়ামতের নিদর্শনগুলোর একটি হলো মহামারি।

রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, কিয়ামতের আগের ছয়টি নিদর্শন গণনা করে রাখো। আমার মৃত্যু, অতঃপর বায়তুল মুকাদ্দাস বিজয়, অতঃপর তোমাদের মধ্যে ঘটবে মহামারি, বকরির পালের মহামারির মতো, সম্পদের প্রাচুর্য, এমনকি এক ব্যক্তিকে একশ’ দিনার দেয়ার পরও সে অসন্তুষ্ট থাকবে। অতঃপর এমন এক ফিতনা আসবে, যা আরবের প্রতিটি ঘরে প্রবেশ করবে। অতঃপর যুদ্ধবিরতির চুক্তি, যা তোমাদের ও বনি আসফার বা রোমকদের মধ্যে সম্পাদিত হবে। অতঃপর তারা বিশ্বাসঘাতকতা করবে এবং ৮০টি পতাকা উড়িয়ে তোমাদের বিপক্ষে আসবে; প্রতিটি পতাকার নিচে থাকবে ১২ হাজার সৈন্য। (বুখারী শরীফ, হাদীস নং- ৩১৭৬)।

উক্ত হাদীসের ভাষ্য আমাদের বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে অনেকাংশেই মিলে যায়; বিশ্বব্যাপী মানুষের মধ্যে প্রাচুর্য বেড়েই চলছে। নতুন নতুন রোগ আত্মপ্রকাশ করছে। এগুলো বন্ধ করার সাধ্য কারো নেই। তবে এই পরিস্থিতিতে আমরা রাসুল (সা.)এর দেখানো পথ অনুসরণ করতে পারি।

আল্লাহ তাআলা কুরআন শরীফে ইরশাদ করেন, ‘আমি অবশ্যই তোমাদেরকে কিছু না কিছু দিয়ে পরীক্ষায় ফেলবোই: মাঝে মধ্যে তোমাদেরকে বিপদের আতঙ্ক, ক্ষুধার কষ্ট দিয়ে, সম্পদ, জীবন, পণ্য-ফল-ফসল হারানোর মধ্য দিয়ে। আর যারা এসব পরীক্ষার মধ্যেও ধৈর্য-নিষ্ঠার সাথে সবর করে, তাদেরকে জান্নাতের সুখবর দাও’। (সূরা বাক্বারাহ ১৫৫)।

যে কোন মুসিবত ও কঠিন পরিস্থিতিতে রাসূলুল্লাহ (সা.) সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে নামাযে রত হয়ে পড়তেন। কারণ, পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন- ‘তোমরা আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করো ধৈর্য ও নামাজের মাধ্যমে’। (সূরা বাকারা, ১৫৩ আয়াত)।

আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মেনে চলতে হবে, যেখানে এ ধরনের মাহামারির প্রাদুর্ভাব দেখা যাবে, সেখানে যাতায়াত করা থেকে বিরত থাকতে হবে। নিরাপদ এলাকার কেউ আক্রান্ত এলাকায় যেমন প্রবেশ করবে না, তেমনি আক্রান্ত স্থানের কেউও অন্য এলাকায় যাবে না।

মহামারি প্রসঙ্গে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, “কোথাও প্লেগ বা মহামারি দেখা দিলে এবং সেখানে তোমরা অবস্থানরত থাকলে সে জায়গা ছেড়ে অন্যত্র গমন করো না। অন্যদিকে কোনো এলাকায় মহামারি দেখা দিলে এবং সেখানে তোমরা অবস্থান না করলে সে জায়গাতে প্রবেশ করো না”। (বুখারী শরীফ- ৫৭২৯, তিরমিযী শরিফ, হাদীস- ১০৬৫)।

রাসূলুল্লাহ (সা.) প্লেগ বা মহামারি সম্পর্কে বলেন, “এটা হচ্ছে একটা আযাব। আল্লাহ তাঁর বান্দাদের মধ্যে যাদের উপর ইচ্ছা তাদের উপর তা প্রেরণ করেন। তবে, আল্লাহ মুমিনদের জন্য তা রহমতস্বরূপ করে দিয়েছেন। কোনো ব্যক্তি যদি প্লেগে আক্রান্ত জায়গায় সওয়াবের আশায় (পালিয়ে না বেড়িয়ে) ধৈর্য ধারণ করে অবস্থান করে এবং তার অন্তরে দৃঢ় বিশ্বাস থাকে যে, আল্লাহ তাকদীরে যা লিখে রেখেছেন তাই হবে, তাহলে সে একজন শহীদের সওয়াব পাবে।” (সহীহ বুখারী- ৩৪৭৪)।

তাই আমাদের উচিত, যেখানে এ ধরনের রোগের প্রকোপ দেখা দেবে, সেখানে যাতায়াত থেকে বিরত থাকা। এরই মধ্যে বিভিন্ন দেশ সরকারিভাবে করোনা আক্রান্ত দেশগুলোতে যাতায়াতে সতর্কতা জারি করেছে। যেহেতু চিকিৎসকদের মতে এ ভাইরাসটি একজনের দেহ থেকে আরেকজনের দেহে ছড়ায়। সাধারণত ফ্লু বা ঠান্ডা লাগার মতো তীব্র নিউমোনিয়া সিনড্রোমের মতো করেই এ ভাইরাস ছড়ায়। তাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে ঘরে অবস্থান করাতেও ইসলামে বাধা নেই। এমনকি, হাদীসে মহামারির পরিস্থিতিতে সকলকে নিজ নিজ অবস্থানে থাকতেই বলা হয়েছে। পরিস্থিতির ভয়াবহতা অনুপাতে বা অন্যদের জন্য অস্বস্তি তৈরি করলে মসজিদে না গিয়ে ঘরে বসে নামায আদায়ের অনুমতিও ইসলামে রয়েছে।

করোনা মহামারির প্রাদুর্ভাব থেকে রক্ষায় সকলের কর্তব্য অতীত কর্মকাণ্ডের উপর তাওবা করে নিজেকে ইবাদত-বন্দেগী, কুরআন তিলাওয়াত ও দোয়া-মুনাজাতে মশগুল রাখা। নিজের জন্য, দেশবাসীর জন্য এবং সমগ্র মুসলিম উম্মাহর জন্য দোয়া করা উচিত।

বর্তমান করোনা মহামারিকে সরাসরি আল্লাহর গযব না বলে কঠোর সতর্কতা হিসেবে ব্যাখ্যা করাই উত্তম মনে করি। মহামারিকে আল্লাহর গযব বলা হলেও এতে আক্রান্ত মৃত ব্যক্তিকে পাপী-জাহান্নামী মনে করা যাবে না। রাসুল (সা.)এর ভাষায় মহামারিতে মারা যাওয়া ব্যক্তিও শহীদ। আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, পাঁচ প্রকার মৃত শহীদ—মহামারিতে মৃত, পেটের পীড়ায় মৃত, পানিতে ডুবে মৃত, ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়ে মৃত এবং যে আল্লাহর পথে শহীদ হলো। (বুখারী শরীফ, হাদীস নং- ২৮২৯)।

অন্য হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, আনাস ইবনে মালিক (রাযি.) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, মহামারিতে মৃত্যু হওয়া প্রতিটি মুসলমানের জন্য শাহাদাত। (বুখারী শরীফ, হাদীস নং- ২৮৩০)।

অন্য হাদীসে ইরশাদ হয়েছে, রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি সন্ধ্যায় তিনবার বলবে ‘বিসমিল্লা-হিল্লাজী লা ইয়াদ্বুররু মাআসমিহি শাইউন ফিল আরদ্বি ওয়ালা ফিস সামা-ই, ওয়াহুয়াস সামী‘উল আলীম’, অর্থাৎ ‘আল্লাহর নামে, যাঁর নামের বরকতে আসমান ও জমিনের কোনো বস্তুই ক্ষতি করতে পারে না, তিনি সর্বশ্রোতা ও মহাজ্ঞানী’; সকাল হওয়া পর্যন্ত তার প্রতি কোনো হঠাৎ বিপদ আসবে না। আর যে তা সকালে তিনবার বলবে সন্ধ্যা পর্যন্ত তার ওপর কোনো হঠাৎ বিপদ আসবে না। (আবু দাউদ, হাদীস নং- ৫০৮৮)।

এছাড়া নবীজী (সা.) মহামারী থেকে বাঁচতে বেশি বেশি এই দোয়া পড়তে বলেছেন, ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিনাল বারাসি, ওয়াল জুনুনি, ওয়াল জুযামি,ওয়া সাইয়ি ইল আসক্কাম’। 

আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে করোনা মহামারির এই কঠিন সঙ্কট থেকে হেফাজত করুন এবং অতীত গুনাহ ও বদ আমলের তাওবা ও আগামীতে সৎ ও আদর্শ জীবন গঠন করে পরিপূর্ণ সীরাতুল মুস্তাকীমের উপর আমল করার তাওফীক দান করুন। আমীন।