Home ইসলাম গীবত ও পরনিন্দার ভয়াবহ পরিণতি এবং শরয়ী বিধান

গীবত ও পরনিন্দার ভয়াবহ পরিণতি এবং শরয়ী বিধান

- আল্লামা হাফেজ নাজমুল হাসান। ছবি- উম্মাহ।

।। আল্লামা হাফেয নাজমুল হাসান কাসেমী ।।

কোন ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে তার এমন কোন দোষ বর্ণনা করা যা শুনলে সে অসন্তুষ্ট হয়- তাকে শরীয়তের পরিভাষায় গীবত বলে। তা বাচনিক বা লেখনির মাধ্যমে অথবা অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে কিংবা অন্য কোন পন্থায় হোক না কেন। সে ব্যক্তি মুসলিম হোক বা অমুসলিম। অন্যদিকে যদি এমন কোন দোষ বর্ণনা করা হয় যা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মধ্যে নেই, তবে তা মিথ্যা অপবাদ হিসেবে গণ্য হবে। কুরআনের ভাষায় যাকে বলা হয় বুহতান।

গীবত মূলতঃ এমন একটি মারাত্মক বিষয় যার পরিণতি অত্যন্ত ভয়ঙ্কর। এটি মানুষের মধ্যে পরশ্রীকাতরতা ও শত্রুতার সৃষ্টি করে, সৎকর্মসমূহ ধ্বংস করে, সমাজে অশান্তি ডেকে আনে এবং আখেরাতকে বরবাদ করে। এজন্য আল্লাহ তাআলা গীবত করাকে আপন মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার সমতুল্য ঘৃণ্য অপরাধ বলে ঘোষণা করেছেন।

গীবতের পরিণামফল খুবই ভয়াবহ। যেমন কোন ব্যক্তি অনেক কষ্ট-ক্লেশ সাধন করে অতীব মূল্যবান ও আকর্ষণীয় একটি গৃহ নির্মাণের পর স্বেচ্ছায় আগুন জ্বালিয়ে সেটিকে পুড়িয়ে দিল। এতে করে তার বিপুল পরিমাণ অর্থ, শ্রম, উদ্দেশ্য যেমন বিফলে গেল, তেমনি গীবতকারী তার শ্রম, কষ্ট ও সময় ব্যয়ে কৃত সমুদয় সুন্দর আমলসমূহ নষ্ট করে দিল। নিম্নে এতদসংক্রান্ত কয়েকটি হাদীস ও সাহাবায়ে কিরামের উক্তি উল্লেখ করা হল।

একবার নবীজি (সা.)এর দরবারে জনৈক বেঁটে স্ত্রীলোক আগমন করে। সে চলে যাওয়ার পর হযরত আয়েশা (রাযি.) তার দৈহিক কাঠামো বেঁটে হওয়ার ত্রুটি বর্ণনা করেন। তা শুনে হুযূর (সা.) বলেন- হে আয়েশা! তুমি স্ত্রীলোকটির গীবত করলে। তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (সা.)! আমি বাস্তব ঘটনার বিপরীত কিছু বলিনি। অবশ্য আমি তার বেঁটে হওয়ার কথা বলেছি এবং এই ত্রুটি তার মধ্যে রয়েছে। হুযূর (সা.) বলেন, হে আয়েশা! যদিও সত্য কথা বলেছ কিন্তু তুমি তার অগোচরে ত্রুটি বর্ণনা করায় তা গীবত হয়ে গেল। (ফক্বীহ আবুল লাইস)।

তাবিঈ হযরত ইব্রাহীম (রাহ.) বলেন, কারো প্রকৃত দোষ বর্ণনা করলে তুমি তার গীবত করলে। তোমার বর্ণিত দোষ তার মধ্যে না থাকলে তুমি তাকে অপবাদ দিলে। (কিতাবুল আসার)।

অন্য এক সময় নবী কারীম (সা.) সাহাবায়ে কিরামকে জিজ্ঞাস করলেন, গীবত কি জিনিস, তা কি তোমরা জান? সাহাবায়ে কিরাম বলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ (সা.)! আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলই ভাল জানেন, আমরা জানি না। হুযূর (সা.) বলেন- ‘যিকরুকা আখাকা বিমা ইয়াকরাহু’ অর্থাৎ তোমার ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে তার সমালোচনা করা হল গীবত, যা শুনলে সে অসন্তোষ প্রকাশ করবে। সাহাবায়ে কিরাম জানতে চাইলেন, তার মধ্যে যদি সেই দোষ বিদ্যমান থাকে তাহলেও কি তা গীবত হবে? তিনি বললেন, তুমি যদি সত্যিকার দোষ-ত্রুটি বর্ণনা কর তাহলেই তা গীবত হবে আর যদি সেটি তার মধ্যে না থাকে তাহলে তা হবে তার প্রতি মিথ্যা দোষারোপ। (মাআলিমুত তানযীল-৫/২০৫, মুসলিম শরীফ-২/৩৩১, তিরমিযী শরীফ-২/১৫)।

উক্ত হাদীসে হুযূর (সা.) ‘আখাকা’ (তোমার ভাই) শব্দের ব্যবহার করে ইঙ্গিত করেছেন যে, তুমি যার গীবত করছ সে তোমার নিকটাত্মীয় না হলেও মূলতঃ তোমার ভাই। কেননা (১) তার ও তোমার আদি পিতা একই ব্যক্তি, তিনি হচ্ছেন হযরত আদম (আ.)। (২) তার ও তোমার আদি মাতা একই নারী, তিনি হচ্ছেন হযরত হওয়া (আ.)। (৩) তোমরা উভয়েই মুসলমান, আর সকল মুসলমান পরস্পর ভাই ভাই। অতএব সহোদর ভাইয়ের গীবত করা থেকে মানুষ যেরূপ বিরত থাকে, অন্যদের গীবত করা থেকেও তদ্রুপ বিরত থাকা উচিত।

একবার হুযূর (সা.) বলেন- গীবত হচ্ছে, কারো এমন দোষ-ত্রুটি বর্ণনা করা যা প্রকৃতপক্ষেই তার মধ্যে রয়েছে। সাহাবায়ে কিরাম জানতে চাইলেন, হে আল্লাহর রাসূল (সা.)! আমরা তো মনে করতাম যে, কারো মধ্যে যে দোষ নেই তার সাথে সে দোষ সংশ্লিষ্ট করে বর্ণনা করাই হচ্ছে গীবত। তিনি বললেন, এটা তো মিথ্যা অপবাদ। (দুররুল মনসূর-৭/৫৭১)।

গীবত অনেক ধরনের হতে পারে। নিম্নে গীবতের প্রকার ভেদ উল্লেখ করা হল-

মুসলমানের গীবতঃ

কোন মুসলমানের গীবত করা অকাট্যভাবেই হারাম। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন- তোমরা একে অপরের গীবত করো না। তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পছন্দ করে? তোমরা তা ঘৃণা কর। (সূরা হুজুরাত- ১২)।
উক্ত আয়াতে মুসলমানদের একে অপরের গীবত করা হারাম ঘোষিত হয়েছে।

(খ) অমুসলিমের গীবতঃ ইসলামী রাষ্ট্রে বসবাসকারী অমুসলিম নাগরিকের গীবত করাও হারাম। কারণ ইসলামী রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে জান-মাল, ইজ্জত-আব্রুর ক্ষেত্রে সে মুসলমানের সমমর্যাদা সম্পন্ন। অতএব মুসলমানদের মতই তার ইজ্জত-আব্রু, জান-মালে হস্তক্ষেপ করাও হারাম। (রদ্দুল মুহতার)।

মৃত ব্যক্তির গীবতঃ

জীবিত ব্যক্তির গীবত করা যেমন হারাম তেমনি মৃত ব্যক্তিকে গালি দেওয়া, মন্দ বলা, দোষ-ত্রুটি বর্ণনা তথা মৃতব্যক্তির গীবত করাও হারাম। তারা জীবদ্দশায় পাপকর্মে লিপ্ত থাকলেও। হুযূর (সা.) এ ব্যাপারে অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে বলেছেন- তোমাদের কেউ মারা গেলে তাকে ছেড়ে দাও এবং তার গীবত কর না। (আবুদাঊদ, গীবত অধ্যায়- ৬৭১)।

তোমাদের মৃতদের গালি দিয়ো না। কারণ তারা তাদের কৃতকর্মের প্রতিদান পাওয়ার স্থানে পৌঁছে গেছে। (তারগীব)। তোমরা তোমাদের মৃতদের সৎগুণাবলী আলোচনা কর এবং তাদের দুর্নাম করা থেকে বিরত থাক। (আবুদাঊদ শরীফ- ৬৭১)।

এছাড়া বিবেকও বলে যে, মৃত ব্যক্তির গীবত করা বৈধ নয়। এর চারটি কারণ রয়েছে। (এক) মৃত ব্যক্তি জীবিতদের গীবত করতে অক্ষম। অতএব জীবিতদেরও মৃতদের গীবত করা উচিত নয়। (দুই) মৃতদের দ্বারা জীবিতরা উপকৃত হতে পারে। কেননা তাদের কথা স্মরণ করলে, তাদের কবরের কাছে গেলে আখেরাতের কথা মনে পড়ে এবং পার্থিব জীবন যে ক্ষণস্থায়ী এ কথার বিশ্বাস দৃঢ় হয়। (তিন) মৃতদের দোষ-ত্রুটি বর্ণনা করলে জীবিতরা কষ্ট পায় অর্থাৎ মৃতের আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও শুভাকাঙ্খিরা অসন্তুষ্ট হয়।

জনৈক লোক প্রায়ই সূরা লাহাব পাঠ করত। আবু লাহাব কাফির হলেও সে ছিল নবীজি (সা.)এর চাচা। এই সূরায় স্বয়ং আল্লাহ তাআলা আবু লাহাবের প্রতি অভিসম্পাত করেছেন এবং তার করুণ পরিণতির কথা বলেছেন। এজন্য সে ব্যক্তির প্রায়ই সূরা লাহাব পাঠ করা এবং কথায় কথায় আবু লাহাবের দোষ চর্চা করাটা হুযূর (সা.) পছন্দ করলেন না। তিনি বললেন, ওহে! এই সূরা ছাড়া অন্য কোন সূরা কি তোমার মুখস্থ নেই?

হুযূর (সা.) ইরশাদ ফরমান- তোমরা তোমাদের মৃতদের উত্তম গুণাবলীসহ স্মরণ কর। কারণ তারা জান্নাতী হয়ে থাকলে তোমরা তাদের গীবত করে গুনাহগার হবে। আর তারা দোযখী হলে এটাই (দোযখের শান্তি) তাদের জন্য যথেষ্ট। (ইহইয়া উলূমুদ্দীন, আবুদাঊদ শরীফ- ৬৭১)।

দৈহিক কাঠামোগত গীবতঃ

কোন ব্যক্তিকে হেয় প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে তার দৈহিক ত্রুটি উল্লেখ করে গীবত করা হারাম।

যেমন- অমুক ব্যক্তি খুবই স্থূলদেহী বা বেঁটে, তার নাক লম্বা, চোখ খুব ছোট ছোট অথবা খুবই কুৎসিত, কানে শুনে না, চোখে দেখে না, তার নাক কাটা ইত্যাদি। এভাবে কাউকে অপমান করার জন্য তার দৈহিক ত্রুটি বর্ণনা করা গীবতের অন্তর্ভুক্ত। হযরত ইব্নে আব্বাস (রাযি.) বলেন, আল্লাহ তাআলা মু’মিন ব্যক্তির যে কোন প্রকার গীবত করা হারাম ঘোষণা করেছেন। যেরূপ তিনি মৃত প্রাণী খাওয়া হারাম করেছেন। (দুররে মনসূর-৭/৫৭৩)।

হযরত আয়েশা (রাযি.) বলেন, হে আল্লাহর রাসূল (সা.)! আপনি কি সাফিয়্যার বেঁটে হওয়াটা অপছন্দ করেন না? তিনি বললেন, হে আয়েশা! তুমি এমন একটি কথা বল্লে যা নদীর পানির সাথে মিশিয়ে দিলে তার উপরও প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে। (আবুদাঊদ শরীফ-৬৬৮)। উম্মত জননী হযরত উম্মে সালমা বেঁটে ছিলেন। এজন্য হুযূর (সা.)এর অন্যান্য বিবিগণ তাঁকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করতেন।

এ প্রেক্ষিতে আল্লাহ তাআলা আয়াত নাযিল করেন, অর্থাৎ হে মু’মিনগণ! কোন পুরুষ যেন অপর কোন পুরুষকে উপহাস না করে; কেননা যাকে উপহাস করা হয় সে উপহাসকারী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে এবং কোন নারী অপর কোন নারীকেও যেন উপহাস না করে; কেননা যাকে উপহাস করা হয় সে উপহাসকারিনী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে। তোমরা একে অপরের প্রতি দোষারোপ করো না এবং তোমরা একে অপরকে মন্দ নামে ডেক না; ঈমানের পর মন্দ নামে ডাকা গর্হিত কাজ। যারা এ ধরনের আচরণ থেকে নিবৃত্ত না হয় তারাই জালিম। (সূরা হুজরাত- ১১ আয়াত)।

সুরাইয়া ইব্নে কারইয়া বলেন, যদি তোমার সামনে দিয়ে হাত কাটা কোন লোক অতিক্রম করে এবং তুমি বল, তার হাত কাটা, তবে এটাও গীবত হয়ে যাবে। (সুয়তীর দুররে মানসূর; আব্দ ইবনে হুমাইদের বর্ণনা)।

উপরোক্ত আলোচনা থেকে জানা গেল যে, কারো দেহের কোন ত্রুটি বর্ণনা করা গীবত এবং হারাম। প্রতিটি দৈহিক কাঠামো আল্লাহর সৃষ্টি। কেউ সুন্দর, কেউ কুৎসিত, এবং এসব দৈহিক ত্রুটিও আল্লাহই সৃষ্টি করেছেন। প্রত্যেক ব্যক্তিরই কিছু না কিছু দৈহিক ত্রুটি রয়েছে।

পোশাকের গীবতঃ

যেমন বলা হয় যে, অমুক ব্যক্তি অত্যন্ত কৃপণ, তাই সে কৃপণের পোশাক পরিধান করে। অমুক ব্যক্তি হারাম পোশাক পরে, সে খাট পোশাক পরিধান করে অথবা সে কম দামের পোশাক পরে। অমুক নারী এমনভাবে পোশাক পরে যে তার আবরণীয় অংশ খোলা থাকে। অমুক নারী আবরণীয় অঙ্গ বের করে মানুষের সামনে চলাফেরা করে ইত্যাদি গীবতের অন্তর্ভুক্ত।

হযরত আয়েশা (রাযি.) বলেন, অমুক স্ত্রীলোকের আঁচল খুব লম্বা। রাসূলুল্লাহ (সা.) একথা শুনে বলেন, হে আয়েশা! তুমি তার গীবত করলে। তোমার থুথু ফেলা কর্তব্য। হযরত আয়েশা (রাযি.) বলেন, আমি থুথু ফেল্লে মুখ থেকে গোশ্তের একটি টুকরা বের হয়ে আসে। (তারগীব-৩২৮)।

জনৈক বুযুর্গ আলেম বলেন, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের উদ্দেশ্যে তুমি যদি বল, অমুক ব্যক্তির পরিধেয় বস্ত্র খুব সংকীর্ণ অথবা খুবই লম্বা, তাহলে এটাও গীবত হবে। (ফক্বীহ আবুল লাইস, গীবত অধ্যায়)।

বংশের গীবতঃ

তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ও হেয় প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে কেউ যদি বলে যে, অমুক ব্যক্তির বংশ, অমুক গোত্র বা অমুক জায়গার বাসিন্দাদের বংশ ভাল নয়। কারণ তাদের পূর্ব বংশীয় লোকেরা ছিল নীচ ও ইতর অথবা তাদের বংশ তালিকা অজ্ঞাত, এটা গীবত হবে। হুযূর (সা.) বলেন, দ্বীনদারী ও সৎকর্ম ব্যতীত কারো উপর কারো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। (কাশফুল উম্মাহ)।

অভ্যাস ও আচার-আচরণের গীবতঃ

অভ্যাসের গীবত হল, কাউকে কাপুরুষ, ভীরু, দুর্বলচিত্ত, অলস, পেটুক ইত্যাদি বলে গাল দেওয়া। এক সফরে হযরত আবুবকর ও উমর (রাযি.)এর সাথে এক দরিদ্র খাদেম সঙ্গী হিসেবে ছিল। এক মঞ্জিলে পৌঁছে তাঁরা উভয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। কিছুক্ষণ পর খাদেমও ঘুমিয়ে পড়ল। অথচ কথা ছিল রুটি বানাবার। তারা উভয়ে ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে ব্যাপার দেখে বললেন, লোকটি ঘুম কাতুরে। তাঁরা খাদেমকে জাগিয়ে তুলে হুযূর (সা.)এর দরবারে কিছু খাবার আনার জন্য পাঠালেন।

লোকটি নবীজির দরবারে উপস্থিত হয়ে বল্ল, ইয়া রাসূলাল্লাহ (সা.)! হযরত আবুবকর ও উমর (রাযি.) সালাম পাঠিয়েছেন এবং কিছু খাবার চেয়েছেন। তিনি বললেন, তারা দু’জনেই তৃপ্ত হয়ে আহার করেছে। তারপর তাঁরা উভয়েই হুযূর (সা.)এর দরবারে উপস্থিত হয়ে আরয করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ (সা.)! আমরা তো আজ কিছু খাইনি? তিনি বললেন, তোমরা আজ এই খাদেমের গোশ্ত খেয়েছ, আমি এখনো তোমাদের দাঁতে গোশ্তের রং দেখতে পাচ্ছি। একথা শুনে তাঁরা আরয করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (সা.)! আমাদের ত্রুটি মার্জনা করুন এবং আল্লাহর কাছে আমাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন। তিনি বললেন, আল্লাহর ক্ষমাই তোমাদের জন্য যথেষ্ট হবে না, বরং তোমাদের উচিত এই খাদেমের কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নেওয়া। তাকে বল, সে যেন আল্লাহর কাছে তোমাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। (দুররে মনসূর-৭/৫৭২)।

ইবাদতের গীবতঃ

ইবাদতের ত্রুটি-বিচ্যুতি উল্লেখপূর্বক সমালোচনা করাও গীবত। যেমনঃ অমুক ব্যক্তি উত্তম রূপে নামায পড়ে না অথবা তাহাজ্জুদ পড়ে না, সবগুলো রোযা রাখে না, লোকটি মাকরূহ ওয়াক্তে নামায পড়ে ইত্যাদি। জনৈক ব্যক্তি কারো গীবত করল এবং বলল, আমি আল্লাহর জন্য অমুক ব্যক্তির প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করি।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি এ কথা জানতে পেরে হুযূর (সা.)এর দরবারে হাজির হয়ে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ (সা.)! অমুক আমার সমালোচনা করেছে, আমার প্রতি বিদ্বেষ পোষণের খবর দিয়েছে। আপনি তার বিচার করুন। হুযূর (সা.) তাকে ডাকলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কেন তার প্রতি বিদ্বেষ পোষণ কর? সে বলল, সে পাঁচ ওয়াক্ত নামায ছাড়া অন্য কোন নামায পড়ে না। রমযানের রোযা ব্যতীত অন্য কোন রোযা রাখে না এবং যাকাত ব্যতীত অন্য কোন দান-খয়রাত করে না। তাই আমি তার প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করি। তার বক্তব্য শেষ হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রাসূল (সা.)! তাকে জিজ্ঞাস করুন, আমি ফরয আদায় করতে কোনরূপ ত্রুটি করি কি-না।

আরও পড়তে পারেন-

এ ব্যাপারে তাকে জিজ্ঞেস করা হলে সে বলল, না, সে ফরয আদায়ে কোন ত্রুটি করে না, যথারীতি আদায় করে। কিন্তু যেহেতু সে নফল ইবাদত পালন করে না, তাই তার প্রতি আমার মন বিরক্ত। হুযূর (সা.) ইরশাদ ফরমালেন- খুব সম্ভব পরিশেষে সে তোমার তুলনায় ভাগ্যবান হবে। অতএব তার গীবত করা এবং তার প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করা তোমার জন্য সমীচিন নয়। (ইহইয়া উলূমুদ্দীন-৩/১৪৫)।

গুনাহের গীবতঃ

যেমন, অমুক ব্যক্তি যিনা করেছে, গীবত করেছে, তার অন্তর অহংকারে ভরা, অমুক ব্যক্তি চোর, সে আত্মীয়তা ছিন্নকারী ইত্যাদি বলা গীবত।

আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মতানুযায়ী নবী-রাসূলগণ ব্যতীত আর কোন মানুষই নি®žাপ নয়। প্রত্যেক ব্যক্তির মধ্যে কিছু না কিছু দোষ-ত্রুটি অবশ্যই রয়েছে। এজন্য মানুষের এত দোষ ধরে পারা যাবে না। তাই কারো দোষের কথা মনে এলে নিজের দোষগুলো স্মরণ করা উচিত। তাহলে এই পাপ থেকে বেঁচে থাকা সম্ভব। হযরত উমর ফারূক (রাযি.) বলেন, একজন মু’মিন পথভ্রষ্ট হওয়ার জন্য তিনটি জিনিসই যথেষ্ট। (১) নিজে যে অপকর্মে লিপ্ত আছে অপরকে সে অপকর্মে লিপ্ত দেখলে তার সমালোচনা করা। (২) অন্যের দোষ দেখে বেড়ানো অথচ নিজের দোষ সম্পর্কে অসচেতন থাকা। (৩) নিজের প্রতিবেশী বা সহচরকে অযথা কষ্ট দেওয়া, হয়রানী করা। (আবুল লাইস গীবত অধ্যায়)।

সরাসরি বা অভিনয়ের মাধ্যমে গীবতঃ

সুস্পষ্ট বাক্যে সরাসরি যেমন গীবত হতে পারে তেমনি অভিনয়ের মাধ্যমেও গীবতের ন্যায় অপরাধ সংঘটিত হতে পারে। সরাসরি যেমন- কোন ব্যক্তির নাম উল্লেখপূর্বক তার দোষ-ত্রুটি বর্ণনা করা। অভিনয়ের মাধ্যমে যেমনঃ অন্ধ, বোবা ইত্যাদি সেজে অভিনয় করে কারো দোষ-ত্রুটির প্রতি ইঙ্গিত করা অথবা চাল-চলন, পোশাক-আশাক ইত্যাদি নকল করে বর্ণনা করা।

রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, আমি পরানুকরণ পছন্দ করি না। প্রচুর সম্পদের বিনিময়েও না। (তিরমিযী শরীফ, আবুদাঊদ শরীফ-৬৬৮, তারগীব-৩/৩২৮)। একবার হযরত আয়েশা (রাযি.) জনৈক মহিলাকে অনুকরণ করে দেখালে রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, কাউকে নকল করা আমার কাছে মোটেই পছন্দনীয় নয়। প্রচুর  সম্পদের বিনিময়েও নয়। (ইহইয়া উলূমুদ্দীন, গীবত অধ্যায়-৩/১৪২)।

ইশারা-ইঙ্গিতে গীবতঃ

সরাসরি নাম উল্লেখ না করে এমন কিছু ইঙ্গিতবহ উপমা ব্যবহারের মাধ্যমে কারো দোষ বর্ণনা করা, যাতে মানুষ বুঝে নিতে পারে যে, অমুক ব্যক্তির দোষ বর্ণনা করা হয়েছে।

মুখের গীবতঃ

হুযূর (সা.) কতিপয় লোককে বললেন, তোমরা খিলাল করে নিজেদের দাঁতের ফাঁক থেকে গোশ্ত বের করে নাও। তারা বল্ল, হে আল্লাহর রাসূল (সা.)! আজ আমরা তো গোশ্ত খাইনি। তিনি বললেন, আমি তোমাদের দাঁতের ফাঁকে লাল গোশ্তের টুকরা দেখতে পাচ্ছি। নিশ্চয় তোমরা কারো গীবত করেছো। আর বাস্তবেও তারা এক ব্যক্তির গীবত চর্চায় লিপ্ত হয়েছিল।

কানের গীবতঃ

কারো গীবত শোনা, তাতে বাধা না দেওয়া কানের গীবত। কারণ শ্রবণ করা এবং বাধা না দিয়ে নীরব থাকাও এক ধরনের গীবত। হুযূর (সা.) বলেন, কারো গীবত করা হলে আর তুমি সেখানে উপস্থিত থাকলে, তাকে তুমি সাহায্য করবে এভাবে যে, তুমি তার প্রশংসা শুরু করে দিবে, যাতে সে তার গীবত করা থেকে বিরত হয়ে যায়। গীবতকারীকেও বাধা প্রদান করবে অতঃপর স্থান ত্যাগ করবে। (দুররে মনসূর-৭/৫৭৬)।

ন্তরের গীবতঃ

কোন ব্যক্তির প্রতি বিদ্বেষ বশতঃ মনে মনে কু-ধারণা করা এবং কোন খোদাভীরু সৎকর্মপরায়ণ ব্যক্তি সম্পর্কে কোন প্রকার তথ্য প্রমাণ ও কারণ ছাড়াই মনে মনে খারাপ ধারণা বদ্ধমূল করে নেওয়া অন্তরের গীবত।

অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের গীবতঃ

নিজের হাত, পা, চোখ ইত্যাদির ইশারায় অন্য কারো দোষ বর্ণনা করা হল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের গীবত। একবার খর্বাকৃতির জনৈক মহিলা হুযূর (সা.)এর নিকট আগমন করল। মহিলা চলে যাওয়ার পর হযরত আয়েশা (রাযি.) হেয় প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে মহিলার দিকে হাতে ইশারা করেন। হুযূর (সা.) বললেন, হে আয়েশা! তুমি তার গীবত করেছ। (বাইহাকী, দুররে মুনসূর-৭/৫৭১)।

অন্য হাদীসে আছে, কোন মুসলিম ব্যক্তির জন্য তার ভাইয়ের প্রতি চোখের ইশারায় এমনভাবে ইঙ্গিত করা বৈধ নয় যাতে সে মর্মাহত হয়। (হুকুকুল মুসলিম)। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হুমাযাহ’ এবং ‘লুমাযাহ’র প্রতি অভিশাপ।

ইমাম বাইহাকী (রাহ.) এর তাফ্সীরে বলেন- যে ব্যক্তি চোখ বা হাতের দ্বারা লোকদের কষ্ট দেয় তাকে বলা হয় ‘হুমাযাহ’ এবং যে ব্যক্তি মুখের দ্বারা লোকদের কষ্ট দেয় তাকে বলা হয় ‘লুমাযাহ’। তাফ্সীরে জালালাইনের টীকায় বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি তার সহযোগিদেরকে মুখের দ্বারা কষ্ট দেয় সে হচ্ছে ‘হুমাযাহ’ এবং যে ব্যক্তি চোখের ইশারায় কটাক্ষ করে সে হচ্ছে ‘লুমাযাহ’। (তারগীব-৩/৩২৮)।

লিখনীর মাধ্যমে গীবতঃ

কাউকে হেয় প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে তার দোষের কথা বর্ণনা করে কারো নিকট পত্র লেখা অথবা সংবাদপত্রে প্রকাশ করা অথবা বই-পুস্তকে লিপিবদ্ধ করা হচ্ছে লেখনীর মাধ্যমে গীবত।

গীবতের বৈধ পন্থাঃ

বিচারক, মুফতী, পদস্থ সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রমুখের জুলুমের শিকার হলে যথাস্থানে এর প্রতিকার প্রার্থনা করতে পারবে। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন, মানুষ খারাপ ব্যাপারটি বলুক তা আল্লাহ পছন্দ করেন না। তবে যার উপর জুলুম করা হয়েছে তার ব্যাপারটি স্বতন্ত্র। (সূরা নিসা- ১৪৮ আয়াত)।

* কেউ কোন দোষের কাজে বা পাপাচারে লিপ্ত থাকলে সে সম্পর্কে এমন ব্যক্তিকে অবহিত করা গীবত হবে না, যে তাকে বারণ করতে পারবে, উপদেশ দিতে পারবে বা তার উপর প্রভাব খাটিয়ে তাকে সংশোধন করতে পারবে। (রদ্দুল মুহতার, নুজহাতুল মাজালিস, আইনুল ইলম)।

* কেউ প্রকাশ্যে পাপাচারে লিপ্ত থাকলে তাকে হেয় প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে তার গীবত করা বৈধ। যেমন- কেউ নামায পড়ে না, মদ পান করে অথবা অন্যের উপর জুলুম করে প্রভৃতি। এজন্যই আলেমগণ স্বৈরাচারী শাসকের গীবত করেন। সুফিয়া ইবনে উয়াইনা বলেন, তিন ব্যক্তির গীবত করা বৈধ। যথা- জালিম শাসক, প্রকাশ্যে পাপাচারে লিপ্ত ব্যক্তি ও বিদ্আতী কার্যকলাপে লিপ্ত ব্যক্তি যে অন্যদেরও বিদ্আতে লিপ্ত করে। (বাইহাকী ও দুররে মনসূর-৭/৫৭৭)।

* কারো দ্বারা কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কিন্তু সে অবহিত নয় যে, তার দ্বারা অন্য কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এমতাবস্থায় তাকে অবহিত করার লক্ষ্যে গীবত করা বৈধ। যাতে সে অন্য কারো ক্ষতির কারণ না হয়। (ইহইয়া উলূমুদ্দীন-৩/১৪২, রদ্দুল মুহতার)।

* যে ব্যক্তি নির্লজ্জভাবে প্রকাশ্যে পাপ কাজ করে বেড়ায় এবং তার সমালোচনা করলে কোন প্রতিক্রিয়া হয় না, এ ধরনের লোকের গীবত করা বৈধ।

* কারো নাম উল্লেখ না করে গীবত করা বৈধ। (র্দুরুল মুখ্তার, তাম্বীহুল গাফিলীন)।

আলোচনা দীর্ঘায়িত করে পাঠকের বিরক্তির কারণ যেন না হতে হয় সে লক্ষ্যে এখানে সমাপ্তি টানছি। এ থেকে পাঠকবর্গ সামন্যতমও উপকৃত হলে অধমের শ্রম স্বার্থক বলে মনে করব। আল্লাহ আমাদের সকলকে গীবত ও পরনিন্দার মারাত্মক গোনাহ থেকে বেঁচে থাকার তাওফীক দান করুন। আমীন॥

লেখকঃ সাবেক প্রিন্সিপাল ও সিনিয়র মুহাদ্দিস- জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা-ঢাকা, প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক- জামিয়াতুন নূর আল কাসেমিয়া-উত্তরা, ঢাকা ও রওজাতুস সালিহাত মহিলা মাদ্রাসা, উত্তরা-ঢাকা, খতীব- উত্তরা ১২নং সেক্টর কেন্দ্রিয় জামে মসজিদ, উপদেষ্টা- উম্মাহ ২৪ডটকম এবং সাংগঠনিক সম্পাদক- জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ।

উম্মাহ২৪ডটকম:এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।