Home প্রবন্ধ-নিবন্ধ স্মৃতিতে হজ্জ!

স্মৃতিতে হজ্জ!

।। তানজিনা রহমান ।।

তখন পর্যন্ত আমি, জীবনে কোনদিন প্লেনে উঠিনি!এমন কি ডমেস্টিক ফ্লাইটেও না!

বাবার বদলীর চাকরি সুবাদে ভাই বোনেরা বিভিন্ন জায়গায় ঘোরার সূযোগ পেলেও,বাবা মার ছোট সন্তান হিসাবে আমি সবসময় ব্যস্ত বাবা মা পেয়েছি। আমি হবার আগেই বাবা ঢাকায় থিতু হয়েছেন। মা স্কুলে চাকরি নিয়েছেন। কখনও বোনের পরীক্ষা তো কখনো ভাইয়ের! আর আমাদের পরীক্ষা না থাকলে মার স্কুলের.. এরকম চলতে চলতে এক ফাঁকে বড় হয়ে গেলাম কোথাও আর যাওয়া হল না!

বিয়ের পরও নানা কারণে আমার কোথাও যাওয়া হয়নি। যখন দ্বীনের রাস্তায় চলতে শুরু করলাম তখন বেশ দেরি হয়ে গেছে। যাক আলহামদুলিল্লাহ! আল্লাহর রাস্তায় ফিরে আসার কোন নির্দিষ্ট সময় হয় না। আল্লাহ হিদায়াহ না দিলে তো আমি পথভ্রষ্টই থেকে যেতাম!

যখন থেকে দ্বীন কে জানতে শুরু করলাম তখনই মনের ভেতর ‘হাজ্জ’ এ যাবার আকুলতা তৈরি হল! আবার ভাবতাম, সবাই তো শেষ বয়সে যায়…. হঠাৎই একদিন নিজের মনেই অদ্ভুত একটা কথা বললাম, আমি কোনদিন প্লেনে উঠিনি ,” ইয়া রাব্বী! আমার জীবনে প্রথম প্লেন যাত্রা যেন হাজ্জ এর উদ্দেশ্যেই হয়….”।

ইতিমধ্যে আমি একটি কন্যা সন্তানের মা। মেয়েকে একটি ইসলামিক স্কুলে ভর্তি করাই। মেয়েও ৪ বছর বয়স থেকেই হাজ্জ এর ব্যাপারে অনেক কিছু শিখেছে। ইব্রাহিম (আ.)এর গল্প, ইহরাম কি, তাওয়াফ কি, তালবিয়াও তার মুখস্ত! মিনা,আরাফা মুযদালিফায় কি হয় তাত্ত্বিকভাবে এসব সে জানে। আমি তার সাথেই তালবিয়া মুখস্ত করেছি। কাজেই হাজ্জ এ যখন যাব মেয়েকে সাথে নিয়েই যাব ইন শা আল্লাহ, এ ব্যাপারে আমি আর আবু সালসাবীল একমত ছিলাম। যদি ইউরোপ আমেরিকা বেড়াতে যেতাম বাচ্চা সহই যেতাম আর আল্লাহর ঘরে যাবার সময় বাচ্চা রেখে যাব? সন্তান তো আল্লাহর দেয়া দায়িত্ব! ছোট বয়সে আল্লাহর ঘর দেখলে তার মনে এর প্রভাব থাকবে! মেয়েদের জন্য জিহাদ হল হাজ্জ আর উমরাহ!

একবার এও আলোচনা হল, মেয়ে বালিগ হলেই চলে যাব মেয়ের ফরজ হাজ্জ টাও এক সাথেই হয়ে যাবে বিইযনিল্লাহ….। মানে, মনের ভেতর নিয়ত আছে হাজ্জ এ যাব একদিন। আলোচনাও চলছে। কিন্তু কখন কিভাবে যাব জানি না! শুনেছি অনেক টাকার ব্যাপার….. কোত্থেকে পাব তাও জানি না।

মেয়ের যখন সাড়ে পাঁচ বছর বয়স, তখন এলোহা ন্যাশনাল কম্পিটিশনে চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় ওর টিচার খুব চাচ্ছিল আমরা ওকে চায়নায় ইন্টারন্যাশনাল কম্পিটিশনে নিয়ে যাই। বাচ্চা এত ছোট এরকম একটা সূযোগ পাচ্ছে, তাদের আগ্রহে আমরা নিজেরাও প্রবল আগ্রহ উদ্দীপনা নিয়ে পাসপোর্ট করলাম! যেদিন ট্রাভেল এজেন্টকে টাকা দেয়ার মিটিং সেদিন হঠাৎ সেখানে বসেই মনটা কেমন করতে থাকল… “আমি তো আমার রাব্বের কাছে হাজ্জের উদ্দেশ্যেই প্রথম প্লেনে উঠতে চেয়েছিলাম!! আমি কি আমার রব্বের কাছে করা ওয়াদা ভেংগে ফেলছি দুনিয়ার লোভে পড়ে?” সন্তান সম্পদ তো ফিতনা রাসূল বলেছেন! আবু সালসাবীলকে ব্যাপারটা বললাম… শেষ মুহূর্তে আমাদের দুজনেরই আর মন টানল না আমরা টাকা না দিয়েই বাড়ি চলে এলাম…সেটা ২০১৪ সালের কথা।

পবিত্র বায়তুল্লাহ তাওয়াফ করছেন হাজিগণ। – ফাইল ছবি।

পরের বছরও আমরা একই কারনে যখন ফিলিপিন যেতে চাইলাম না তখন মেয়ের মিস তাওহিদা পারভিন লুনা, যিনি ২০১৪ তে হাজ্জ করে এসেছেন আমাদের বললেন, “আপা, আপনাদের তো হাজ্জ ফরজ হয়েছে! যখন ওর হাজ্জ ফরজ হবে তখন না হয় আবার যাবেন! এই বারই হাজ্জ করে আসুন।”

রিক্সা করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে আলোচনা চলল। ঠিকই বলেছেন তিনি, আমাদের হাজ্জ ফরজ হয়েছে, যদি মরে যাই? আল্লাহ চাইলে মেয়ের হাজ্জ ফরজ হলে আবার যাব! রিক্সায় বসেই সিদ্ধান্ত নিলাম এ বছরই হাজ্জ এ যাব কুড়িয়ে বাড়িয়ে যা হবে আমাদের সঞ্চয় তা দিয়ে ৩ জনের টাকা দেয়া যাবে, ইনশা আল্লাহ!

বাসায় ফিরে ভাইকে জানানোর সাথে সাথে সেও এক বাক্যে রাজি! সংগী হলেন আরও দুজন বয়স্ক আত্মীয়। তখন মার্চের শেষ… প্রথম প্রস্তুতি কোন এজেন্সির মাধ্যমে যাব! শুনেছি, এজেন্সির লোকেরা নাকি ওখানে গিয়ে টিনের চশমা পরে! আমাদের সাথে যেহেতু ৭ এবং ১০ বছরের দুটো বাচ্চা,ইবাদতের ক্ষেত্রে যেন কোন ঘাটতি না হয়, সেটিকে প্রধানত বিবেচনায় রেখে একটি পরিকল্পনা করে এজেন্সি খুঁজতে লাগলাম, যারা ওয়াদা ঠিক রাখে! দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের মাধ্যমে পেয়েও গেলাম..আল্লাহর উপর ভরসা রেখে যা ছিল সব টাকা দিয়ে বুকিং করে নিলাম।

আরও পড়তে পারেন-

সে বছর হাজ্জ ছিল সেপ্টেম্বরে। হাতে ৫ মাস সময়…আমি পেশায় সনোলজিস্ট। হাজ্জ এ যাব সিদ্ধান্ত নেয়ার পর থেকেই এই দুনিয়াবী কাজে মন বসত না! পরিস্থিতিও হঠাৎ কাজ করার জন্য প্রতিকূল হয়ে উঠল! আল্লাহও মনে হয় চাইছেন না, এখন আমি কাজ করি!

এপ্রিল মাস থেকে সপ্তাহে একদিন চেম্বার রেখে বাকি কাজ ছেড়ে দিলাম.. কেন জানি মনে হত বার বার, হাজ্জ থেকে যদি আর ফিরে না আসি তাহলে এই দুনিয়ার কাজ আমার কোন কাজে আসবে?এখন আখিরাতের প্রস্তুতি নেয়ার সময় এসেছে!

কোন দুআর বই সাথে নিব, বাইতুল্লাহ প্রথম যখন দেখব কি দুআ করব…যারা হাজ্জ করেছে তাদের সাথে কথা বললাম ধারনা নিতে….একেক জনের একেক কথা! কেউ বলে বেশী তাওয়াফ করার দরকার নাই! আবার কেউ বলে ১৫০-২০০ তাওয়াফ করেছি! কেউ বলে মসজিদে যাওয়ার দরকার নাই কাছের হোটেল হলে সালাহ হোটেলে পড়াই ভাল!!আবার কেউ বলে সকালে মসজিদে গিয়ে মাগরিব পড়ে ফিরেছি!

এ যেন অন্ধের হাতি দেখার মত! এ বলে হাজ্জ এমন তো সে বলে হাজ্জ তেমন! মসজিদের বর্ননার ব্যাপারেও কেউ তেমন কিছু বলেনা! এই মানে গেইট কয়টা বা কোন মূল গেইট আছে কিনা ইত্যাদি! একটু বিভ্রান্তিতেই পড়ে গেলাম! কথা বলা বাদ দিয়ে ঠিক করলাম নিজের মত করে নিজের ইবাদতের পরিকল্পনা করব যেহেতু আমি বাচ্চা নিয়ে যাচ্ছি!

যাক সময় ঘনিয়ে এল..অগাস্টের ২৪ তারিখ বিকেল ৫ টার ফ্লাইট। সৌদি এয়ারলাইনস।২ রাকাহ সালাহ পড়ে যখন ইহরাম পরি মনে হচ্ছিল অনেক ভারি একটি দায়িত্ব নিচ্ছি। ইহরাম পরার সাথে সাথেই অনেক কাজ আমার জন্য হারাম হয়ে যাবে! সব যেন ঠিক থাকে আল্লাহ সহায় হোন!

বাবা, মা, শশুর, শাশুড়ীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে, নির্দেশনা মাফিক সকাল দশটায় এজেন্সির দেয়া লাগেজ নিয়ে এয়ারপোর্ট রওনা হলাম সবাই। কেন জানি খুব ভয় লাগছিল! এয়ারপোর্টে ঢুকতেই এত ভাল লাগল, চারদিকে শুধু সাদা সাদা ইহরাম,বোরকা হিজাব পরা ভাই বোনেরা..কিছুক্ষন পরপর একেকটা কাফেলা থেকে তালবিয়া ভেসে আসছে! সব মুসলিম ভাই বোনেরা আমরা এক আল্লাহর ঘরের দিকে যাচ্ছি!! কি অপূর্ব !!

যথা সময়ে ফ্লাইটে চেপে বসলাম.. ঠিক যে মূহুর্তে প্লেন চলতে শুরু করল চোখের পানি ধরে রাখতে পারলাম না..আমার মনে হচ্ছিল ” সত্যিই আমি আল্লাহর ঘরে যাচ্ছি!! আমার মত গুনাহগার বান্দাকে আল্লাহ তার ঘরের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন স্বামী সন্তান সহ! এই শুকরিয়া আমি কিভাবে আদায় করব!!”

ফ্লাইটে আলহামদুলিল্লাহ বাচ্চাদের কোন অসুবিধাই হয় নি। একটু দুঃশ্চিন্তা হচ্ছিল, আগেই জেনেছি ইমিগ্রেশনে অনেকক্ষন দাঁড়িয়ে থাকতে হয়! যাক “আল্লাহ ব্যবস্থা করে দেবেন উনি যখন এনেছেন উনিই আমাদের দেখবেন” চিন্তার বোঝা দূর হয়ে গেল..

আমরা জেদ্দা পৌঁছলাম সৌদি সময় রাত ১১ টায়…প্লেন থেকে নেমে ইমিগ্রেশন এ যখন দাঁড়ালাম তখন চারদিক একেবারেই ফাঁকা যেটা হাজ্জের সময় বিরল। একটা লাইনের পেছনে দাঁাড়াতেই পাশের খালি কাউন্টার থেকে ঠিক আমাদের দিকেই ইশারা করে ওখানে দাঁড়াতে বলল।মানে ইমিগ্রেশন লাইনে শুরুতেই আবু সালসাবীল তারপর মেয়ে, আমি আমার ভাই এর পরিবার। ইমিগ্রেশন পার হয়েই লাগেজ এর স্থানে আমাদের সবার লাগেজ এক সাথেই পেলাম। রব্বের প্রতি কৃতজ্ঞতায় আবার মনটা পরিপূর্ণ হল। “যে, আল্লাহর উপর ভরষা করে তার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট হয়ে যান” হাতে কলমে উপলব্ধি করলাম।

সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে বাসে জেদ্দা থেকে মক্কা রওনা হলাম রাত ১২.৩০ কি পৌনে একটায়। বাসে উঠে মেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে!! আমি ভাবছি বাইতুল্লাহ প্রথম দেখে দুআ করব, হঠাৎ যদি বাস থেকেই বাইতুল্লাহ চোখে পড়ে যায়! আমার তো দুআ মিস হয়ে যাবে! আমি পুরাটা সময় খুব সচেতন থাকলাম আমি ধরেই নিয়েছিলাম মক্কা ঢুকলে রাস্তা থেকেই বাইতুল্লাহ দেখা যায়!! বাস বিভিন্ন জায়গায় থামল চেকিং হল হাজীদের জন্য সৌদি সরকারের দেয়া খাবার পানির বক্স আর খেজুরের উপহারে ব্যাগ ভর্তি হয়ে গেল।

আরাফাহ ময়াদানে অবস্থিত জাবালে রহমত। -সংগৃহিত ছবি।

আমরা হোটেল পৌঁছলাম ঘড়িতে তখন ঠিক ভোর ৪ টা। ফজরের আযান হচ্ছে! এজেন্সি থেকে বলল, কিছু খেয়ে, ফ্রেস হয়েই আমরা ফজরের পর উমরাহ করে ফেলব ইন শা আল্লাহ ! আলহামদুলিল্লাহ বাচ্চারাও রেডি।

মোয়াল্লেম জনা আসাদুল হক মামুন ভাই আমাদের সাথে নিয়ে মাসজিদুল হারামে ঢুকলেন..হারামের সাদা মার্বেলে খালি পা রেখে মনটা প্রশান্তিতে ভরে গেল! আমরা ফজর পড়ে মাসজিদ চত্ত্বরে বসলাম.. উমরাহর নিয়ম নিয়ে কিছুক্ষন আলোচনা চলল, মেয়েকেও সব মনে করিয়ে দিলাম আরেকবার! মামুন ভাই বললেন, উনি আমাদের কাফেলার সব চাইতে লম্বা ব্যাক্তি, সবার সামনে থাকবেন কাজেই উনার সাদা টুপি কে ফলো করতে যেন কেউ দলছুট হয়ে হারিয়ে না যাই।

এরপর ধীরে ধীরে কিং ফাহাদ গেইট দিয়ে ঢুকে একটু এগোতেই কা’বার কালো কিসওয়া চোখে পড়ল!যে মূহুর্তের জন্য আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম….সুবহানআল্লাহ! প্রথম কা’বা দেখার অনুভূতি পৃথিবীর কোন ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। আমার রাব্ব যে সম্মান দিয়েছেন এত সম্মান পাওয়ার যোগ্য তো আমি ছিলাম না! এটা আমার রাব্বের অনুগ্রহ! আলহামদুলিল্লাহ।

মেয়ে পায়ে হেঁটেই আমাদের সাথে তাওয়াফ, সায়ী সম্পন্ন করল। হোটেলে ফিরে হালাল হলাম। তখন সকাল ৭ টা। পুরো ২৪ ঘন্টা পর এখন একটু বিশ্রাম। আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহ আমাদের বাচ্চাদের সুস্থ রেখেছেন,তাদেরও ঠিক আমাদের মতই উমরাহ করার শারিরিক সামর্থ দিয়েছেন।

মক্কায় আমাদের রুটিন ছিল প্রতি ওয়াক্তে সালাহ মাসজিদেই আদায় করা। কেবল মাগরিব,ইশা এই দুই ওয়াক্ত এর সালাহ পড়ে একবারে আমরা হোটেলে ফিরতাম। আমি আর আবু সালসাবীল এই রুটিনের মাঝেই এক ফাঁকে তাওয়াফ সেরে নিতাম। আমাদের সাথে সাথে আমাদের ৭ বছরের মেয়েও কোন সালাহ মাসজিদে গিয়ে পড়তে মিস করেনি।

মাসজিদুল হারামে বসেই আমি আর মেয়ে ৪০ রব্বানার অনেক দুআ একসাথে মুখস্থ করেছি, কা’বা র দিকে তাকিয়ে থেকেছি।বৃষ্টিতে ভিজেছি, হাতিমে সালাহ পড়েছি! আর ঐতিহাসিক স্থানে জিয়ারা তো ছিলই…একদিন পর পর এজেন্সির আলেম সন্ধ্যায় হালাকা করতেন…

দেখতে দেখতে মক্কার দিন গুলো শেষ হয়ে এল। অমূল্য কিছু স্মৃতি হ্রদয়ে নিয়ে সেপ্টেম্বরের ৯ তারিখ সকালে মদিনার পথে রওনা হলাম…মনে হচ্ছিল খুব আপন কাওকে ছেড়ে যাচ্ছি এখানে.. এই কষ্ট অন্য রকম।

মদিনা যখন পৌঁছলাম মাগরিবের আযান হচ্ছে। পরদিন আমরা মাগরিব এর সালাহ আদায় করতে মাসজিদ যাচ্ছি এমন সময় হঠাৎ একটা দমকা হাওয়া আমাদের প্রায় ফেলে দিচ্ছিল! মেয়ে সামলাতে পারল না পড়েই গেল!রাতে ইশার সালাহর পর মাসজিদে বসেই পেলাম মক্কার দূর্ঘটনার সংবাদ। তাড়াতাড়ি হোটেলে ফিরে টিভির খবরে দেখলাম, যে স্থানটিতে ক্রেন পড়ে অনেক মানুষ মারা গেছে আমরাও প্রায়ই ওই একই জায়গায় মাগরিবের পর বসে ইশার জন্য অপেক্ষা করতাম..১ টা দিন এদিক ওদিক..আল্লাহ যার মৃত্যু যেখানে যেভাবে রেখেছেন সেভাবেই হবে।

এজেন্সি থেকে মেয়েদের জন্য রাসূলের রওজায় যাবার নির্দিষ্ট সময় জানিয়ে দিল। আমরা ঠিক করলাম ফজরের পর যাব। পরদিন ফজরের পর মেয়েকে বাবার কাছে দিয়ে চলে গেলাম!

অপেক্ষা আর অপেক্ষা। কিছুক্ষন পর পর এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্থান পরিবর্তন।সাথে পাকিস্তানি খাদিমাদের সতর্ক বানী, “শান্ত থাক! কেউ বাচ্চা নিয়ে ঢুকবে না। কেবল ২ রাকাহ সালাহ পড়বে! অন্যদের সূযোগ দাও! ভেতরে ধাক্কাধাক্কি করবে না! কেউ যদি চাপা পড়ে মরেও যাও তোমাকে উদ্ধার করতেও আমাদের ২-৩ ঘন্টা লেগে যাবে। আমরা জানব কিন্তু কিছুই করতে পারব না কাজেই নিজেরা সাবধান থাক!”

কিন্তু কোন লাভই যেন হল না! রিয়াজুল জান্নাহ-য় সালাহ র জন্য পৌঁছে মহিলারা যেন উন্মাদ হয়ে যায়। অন্যকে ফেলে,মাড়িয়ে,চাপা দিয়ে অন্যের কষ্টের কারন হয়ে এভাবে এখানে সালাহ পড়তে কি রাসূলাল্লাহ আমাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন? মনে মনে বললাম ইয়া আল্লাহ আমাদের অজ্ঞতাকে ক্ষমা করে দিন! প্রিয় রাসূলের রওজায় এসে যারা বিদাতে লিপ্ত হচ্ছি তাদের হিদায়া দিন.. দুনিয়ায় জান্নাতের টুকরাটিকে আমরা মহিলারা কি বানিয়ে ফেলেছি! ইয়া আল্লাহ সত্যিই আমি বড় লজ্জিত।

মক্কায় এবং মদিনায় দু জায়গাতেই আমার মেয়েকে সালাহ পড়তে দেখে অনেকেই খুব খুশি হত কেউ চকলেট দিত কেউ রিয়াল..নাম শুনলেও সবাই উৎফুল্ল হত…দুই হারামেই ফজরে প্রায়ই দিন সুরা ইনসান তিলাওয়াত হয়। আমার মেয়ে খুব খুশি “মা হারামে আমার নাম বলছে”।

মক্কায় যেমন একদম সময় পাওয়া যায় না,তাওয়াফ থাকে,হাতিমে সালাহ পড়ার একটা তাগিদ থাকে..মদিনায় ঠিক উল্টো সময় কাটে বেশ ঢিলে ঢালা…সালাহ র পর রাস্তায় ৫ রিয়াল ১০ রিয়ালের দোকান গুলো খুব আকর্ষনীয়..হাজীরা কেনা কাটা বেশির ভাগ মদিনা থেকেই করে। এভাবে মদিনার ৯ দিনও শেষ হয়ে আসল..মেয়েকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়ে সবাই ইহরাম পড়লাম এবার হাজ্জ এর জন্য…দুরু দুরু বুকে তালবিয়া পড়তে পড়তে চোখে পানি নিয়ে প্রিয় রাসূলের শহর ছেড়ে আবার মক্কা রওনা হলাম।

আজিজিয়া পৌঁছতে বিকেল।আমাদের থাকার জায়গাটা ভাল। আলহামদুলিল্লাহ। পাশেই ২ টা পাকিস্তানি পরিবার। আমরা আসার সাথে সাথে তারাই খাবার পাঠাল। তাদের পরিবারের নতুন বিয়ে হওয়া ছেলে আর বউ কে হাজ্জ করানোর উদ্দেশ্যে নানী দাদী সহ সবাই হাজ্জ করতে এসেছে। কালচার টা খুব ভাল লাগল। এবার হাজ্জ এর অপেক্ষা।

সময় ঘনিয়ে এল, ৭ যুলহিজ্জা রাতে আমরা ছোট ব্যাগ এ আমাদের দু একটা কাপড় আর কিছু বিস্কিট সাথে নিয়ে এজেন্সির বাস এ তালবিয়া পড়তে পড়তে মিনা রওনা হলাম। মিনায় আমাদের নির্দিষ্ট তাবু তে পৌঁছে দেখলাম সোফা বেড এর ব্যবস্থা..বাথরুম ও খারাপ না। আলহামদুলিল্লাহ। সারাদিন সালাহ জিকির বিশ্রামে কাটালাম.. আমার মেয়ে,আমি মিনায় তেমন কিছু খাইনি..বিকেলে দেখলাম অন্য দেশের হাজিরা নিজেরাই তাবু এনে টানিয়ে নিয়েছে পাহাড়ে..

পরদিন আরাফায় পৌছলাম। উপরে তাবু , নীচে ঘাস আর বালুর উপর চাদর বিছিয়ে বসে পড়লাম। আমার পরিচিত এক বোন যোহরা নূর, আপার উপহার দেয়া হাজ্জ ম্যানুয়াল আমাদের ভীষণ কাজে এসেছিল) পরামর্শ দিয়েছিলেন আরাফায় প্রচুর খাবার আর লাবাং দেয়, বেশী খেয়ে মানুষ পেট খারাপ করে ফেলে! আমি আর আমার মেয়ে আরাফায়ও শুকনা কিছু বিস্কিট,পানি ছাড়া তেমন কিছু খেলাম না। যতই বেলা বাড়তে লাগল গরম ও বাড়তে লাগল! এখানে জোহর, আসর সালাহ এক সাথে পড়তে হয়।

জোহরের পর সবাই গরমে অস্থির হয়ে পড়ল! আমরা তাবু থেকে বেরিয়ে সবুজ নীম গাছের ছায়ায় বসে যে যার মত তাসবীহ, যিকর দুআ করতে থাকলাম…হালকা পানির সংকটও দেখা দিল.. আমাদের মোয়াল্লেম নিজেই আমাদের জন্য পানির ব্যবস্থা করলেন…কিন্তু বিকেলের দিকে পুরা আরাফাই পানিশূন্য হয়ে গেল! কোক, জুস, লাবাং আছে সেভেন আপ আছে পানি নাই। আমাদের কাফেলার একজন বয়স্ক ভদ্রমহিলা অসুস্থ হয়ে পড়লেন তাকে নিয়ে ছেলে আর বউ হাস্পাতালে চলে গেলেন।

খুতবার পর আমাদের কাফেলার আলেম অনেক সময় নিয়ে খুব সুন্দর করে দুআ করলেন.. আল্লাহ সুব হানা হুয়া তা’লা একবার আসার সূযোগ দিয়েছেন,গুনাহ মাফের এই জায়গায় এসে যে গুনাহ মাফ করাতে পারল না তার মত হতভাগ্য আর কে আছে?

সন্ধ্যা হতেই একে একে সবাই আরাফা ছাড়তে শুরু করল! বাস আসতে দেরি করায় কেউ কেউ হেঁটেই রওনা হল..অবশেষে বাস আসলে আমরা বাকিরা মুযদালিফা রওনা হলাম…আল্লাহর রহমত বাস এ উঠেই ঠিক জানালার পাশে সিট পেলাম..মেয়েটা প্রচন্ড গরমেও ঘুমিয়ে গেল! এক ভাই বমি করে অসুস্থ হয়ে পড়লেন..আরেক ভাই পুরোটা সময় তাকে বাতাস করলেন…ভীড় ঠেলে বাস চলছিল খুব ধীরে.. এক সময় বাস মুজদালিফা পৌছল..মাগরিব ইশা পড়ে পাথর কুড়িয়ে শুয়ে পড়লাম খোলা আকাশের নীচে মাটিতে চাদর বিছিয়ে!

নিজের দেশে যে যত বড়ই হোক না কেন এখানে যেন সবাই ভিখিরি।

পিঠের নীচে পাথরের ছোট বড় টুকরো, তবুও এমন শান্তির ঘুম আর কোন দিন হয়নি! ঘুম ভাঙ্গল ফজরের আযানে। একটু দূরের ওয়াসরুমে অজু করে ফজর পড়ে রওনা হলাম জামারায়। আমার আর আমার মেয়ের পাথর আবু সালসাবীল ছুড়ে দিল..আমার ভাইয়ের পারিবারের টা ভাই..ওই দিনই সকাল ১১ টার দিকে জামারায় পাথর মারতে গিয়ে আরেকটি দূর্ঘটনায় অনেক মানুষ মারা যায়।

১০ ই যুলহিজ্জা মক্কার চিত্র একটু ভিন্ন থাকে। ঈদের উৎসবের কোন চিহ্ন নেই। চারিদিকে ইহরাম পরা মানুষ ছুটে বেড়াচ্ছে! কেউ যাচ্ছে জামারায়, কেউ যাচ্ছে ফরজ তাওয়াফে! ফুটপাতে এদিকে সেদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কাটা চুল! আমরা বিকেলে কুরবানির পর হালাল হলাম এবং তার কিছু সময় পরেই রাত ৮ টার দিকে ফরজ তাওয়াফের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।

টানেলের ভেতর দিয়ে হেঁটে যখন হারামে যাচ্ছি ২-৩ টা মৃতদেহ ফুটপাতে দেখতে পাই..হাজ্জ এর সময় এটা খুব স্বাভাবিক ঘটনা.. প্রায় রাত ১ টায় তাওয়াফ সেরে আবার রওয়ানা হলাম টানেল দিয়ে হেঁটে। পথে হোটেলে রাতের খাবার যখন খাচ্ছি এই সময়টাতে হঠাৎই এই প্রথম মেয়ে একটু কেঁদেছে। ৩ দিন প্রায় অভুক্ত, ছোট্ট শরীর মিনা,আরাফা, মুজদালিফার পর এত হঁাটার ধকলে হয়ত ক্লান্ত! খাওয়া শেষে একটি পিকআপ এর পেছনে চড়ে বসলাম মিনার উদ্দেশ্যে! মিনাতেই নির্জন পাহাড়ের মাঝে পথ হারিয়ে সারারাত আমরা আমাদের তাবু আর খুঁজেই পেলাম না!

মিনার শেষ রাতে খুব মন খারাপ লাগছিল, আমি আর আবু সালসাবীল পাহাড়ের মাঝে সিড়ির উপর বসে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবলাম জায়গাটা একদম খালি হয়ে যাবে আবার ১ বছরের জন্য।

দেখতে দেখতে ৩৫ দিন প্রায় শেষ..বিদায় তাওয়াফ এর দিন আমাদের হারাম যেতে আর ফিরতে হয়েছিল সম্পূর্ণ হেঁটে! বাচ্চারাও হেঁটেছে। দূরত্ব ৯-১০ কিলোমিটার… ক্লান্ত হলে রাস্তায় বসে বিশ্রাম নিয়েছি।

পরিশেষে ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা….।

কিছু ব্যাপারকে কেন্দ্র করে কিছু অপ্রিতিকর পরিস্থিতি সবার ক্ষেত্রেই ঘটে! যেমন বাসে এসি আছে না নাই, বাস বড় না ছোট! খাবারের মেনু..অন্যরা কি সুবিধা পাচ্ছে! মনে রাখবেন এসবই শয়তানের ওয়াস ওয়াস!

আমাদের এগুলো নিয়ে কোন মাথা ব্যাথাই ছিল না। আল্লাহপাক এনেছেন, রিযক এ যা রেখেছেন তাই খাব..এর জন্য অন্যকে দোষারোপ করার কিছু নাই..আল্লাহর ঘরে আসতে পেরেছি আল্লাহ সুবহানা হুয়া তা’লার অশেষ মেহেরবানি। তাই কোন অভিযোগ কারো বিরুদ্ধেই ছিল না। মনে রাখবেন, আপনার অন্তর যখন নরম থাকবে আল্লাহই আপনার জন্য সব কিছু সহজ করে দেবেন!

হাজ্জ খুব সহজ নয়! বাচ্চা সাথে নিয়ে হাজ্জ এ যেতে হলে বাচ্চাকে(এবং নিজেকেও) কিছু ট্রেনিং আগে থেকেই দিতে হবে, যেমন – যখন যা পাব তাই খেতে হবে। অনেক গরম সহ্য করার আর অনেক হাঁটার প্র‍্যাক্টিস থাকতে হবে। হাজ্জ এর ভ্রমনে আছে ইবাদতের আনন্দ এই ব্যাপারে তাকে অনুপ্রানিত করতে হবে। যখনই সালাহ র জন্য ডাকা হবে উঠে পড়তে হবে,গড়িমসি করা চলবেনা, কারন হাতে সময় থাকে খুব অল্প। আমার বাচ্চা যখন পেরেছে আপনার বাচ্চাও পারবে ইন শা আল্লাহ যদি ট্রেনিং থাকে! আল্লাহ সহজ করে দেবেন, ইন শা আল্লাহ।

মাসজিদে ব্যাগ রেখে অন্যকে সালাহ-র জায়গা না দেয়া বা অনেক জায়গা নিয়ে বসে সালাহ পড়া এই কাজটি করা যাবে না! “সামনে স্যান্ডেল রেখে সালাহ পড়া যায় না” এই ভূল ধারনার বশবর্তী হয়ে অত্যন্ত অনুচিত একটি কাজ অনেকেই করেন!! অন্যের সালাহ-র জায়গায় নিজের স্যান্ডেল ঠেলে দেন!! এসব ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।

আমাদের বুঝতে হবে এক রুমে ৪-৫ জন থাকতে গেলে সবার সুবিধা অসুবিধা বিবেচনা করতে হয়।কারো ঠান্ডা লাগবে,কারো গরম! বয়স্ক কেউ থাকলে,শ্বাস কস্টের কেউ থাকলে জানালা খুলতে চাইবে..আপনার খাবার তাকে শেয়ার করতে হতে পারে…একই বালতিতে ৪-৫ জন কাপড় ধোবে..শুচিবায়ু বা স্বার্থপর হওয়া চলবে না!..প্রত্যেক জনকে পাশের মানুষটির সুবিধা অসুবিধা দেখতে হবে কেবল মাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। আমরা নিশ্চই চাইব না এসব দুনিয়াবি তুচ্ছ ব্যাপার আমার হাজ্জ নষ্টের কারণ হোক! কারো সাথে একটু কিছু হল তো মুখ বাঁকিয়ে রাখব, নামাজেও তার পাশে দাঁড়াব না! এই মানষিকতা নিয়ে হাজ্জ করলে কি সেই হাজ্জ কবুল হবে? আমার মূল্যবান হাজ্জ টির রক্ষনাবেক্ষনের দায়িত্ব কিন্তু আমার।

আল্লাহর ঘরে যাবার পর, দুনিয়ার আর কোন জায়গা আমাকে এখন টানে না! আমি বার বার কেবল আল্লাহর ঘর আর রাসূলের মাসজিদেই যেতে চাই! আর কোথাও নয়!

আল্লাহ আযযা ওয়াজাল আমাকে এবং তার মুত্তাকী বান্দাদের সকলকে বার বার তঁার ঘরে মেহমান হবার সূযোগ করে দিন। আমীন।

[১ সেপ্টেম্বর, ২০২০ খ্রীস্টাব্দ, ১১ই মুহাররাম, ১৪৪২ হিজরী]

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।