Home ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন মুসলিম হয়েও যারা নবী (সা.)এর উম্মত নয়

মুসলিম হয়েও যারা নবী (সা.)এর উম্মত নয়

- শায়খ আহমাদুল্লাহ।

।। শায়খ আহমাদুল্লাহ ।।

রাসুলে করীম (সা.) বিভিন্ন হাদীসে বিভিন্ন রকম হতভাগা মানুষদের সম্পর্কে বলেছেন- লাইছা মিন্নি অথবা লাইছা মিন্না। যার অর্থ হলো, তারা আমার উম্মত নয়। তারা আমার কেউ নয়।

কোন সে হতভাগা মানুষ- যাদের কিছু কিছু অপকর্মের কারণে, মন্দ কর্মের কারণে নবী (সা.) তাদের সম্পর্কে এতো শক্ত কথা বলেছেন। তাদেরকে নিজের উম্মত বলে পরিচয় দিতে চাননি। সে মানুষগুলো সম্পর্কে, সে কাজগুলো সম্পর্কে জানা একজন মুসলিম হিসেবে আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

এ জন্য রাসুলে (সা.) এর হাদীসের ভান্ডার থেকে খুঁজে এ রকম মানুষকে আমরা বের করেছি যাদের সম্পর্কে নবী (সা.) বলেছেন, তারা আমার উম্মন নয়, তারা আমার দলের নয়, তারা আমার কেউ নন। কোথাও কোথাও বলেছেন, আমিও তাদের কেউ নই।

তবে এখানে বলে রাখি, নবী (সা.) এর উক্তি- তারা আমার কেউ নয় অথবা আমি তাদের কেউ নই – একথা বলে তাদেরকে সবক্ষেত্রে ইসলাম থেকে খারিজ হওয়া বুঝাননি। আক্ষরিকভাবে বা বাহ্যিকভাবে বুঝা যাচ্ছে যে তিনি বুঝাতে চাচ্ছেন, তারা ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে গেছে। তারা আমার উম্মত নয়, আমার কেউ নয়, তার মানে তারা কাফির হয়ে গেছে।

কিন্তু বেশির ভাগ মুহাদ্দিসের বিশুদ্ধ মত হলো- নবী (সা.)এর এই কথা ছিল সতর্ক করবার জন্য, ইসলাম থেকে খারিজ হওয়া উদ্দেশ্য নয়। যেজন্য তিনি বলেছেন, তারা আমার উম্মত নয়। সে কাজটি যদি সাধারণ কোন কবিরাহ গুনাহ হয় বা সাধারণ কোন গুনাহ হয় তাহলে এর দ্বারা তিনি ইসলাম থেকে খারিজ হওয়া বুঝাননি।

এর থেকে তিনি বুঝাচ্ছেন যে, সে আমার আদর্শের অনুসারি হতে পারলো না। এ থেকে সাবধান করবার জন্যই বলেছেন। আর কাজটি যদি কুফরি হয়, ঈমান বিধবংসী হয় তাহলে তাকে ‘লাইছা মিন্নি’ বলার উদ্দেশ্য হলো তাকে ইসলাম থেকে খারিজ হওয়ার বার্তা পৌঁছে দেওয়া।

রাসূল (সা.)এর এই কথার মতোই আমরা মা-বাবা সন্তানদের প্রতি অসন্তুষ্ট হলে বলে থাকি- তুমি আমার কেউ নও। যাও তোমাকে আমি চিনি না। এই ধরণের কথাগুলির আমরা প্রকৃত অর্থ বুঝাতে চাই না। বরং আমারা বুঝাতে চাই যে, তোমার প্রতি আমার মনক্ষুন্নতা আছে , আমি তোমার প্রতি অসন্তুষ্ট আছি, তুমি চরম খারাপ কাজ করেছ। এই বার্তাটা আমরা তাকে দিতে চাই।

এখন জেনে নেই কোন হতভাগা মানুষদের রাসূল (সা.) বলেছেন যে, তারা আমার উম্মত নয়, আমার দলভুক্ত নয়, তারা আমার কেউ নয়।

১. প্রিয় কারো মৃত্যু হলে যে ধৈর্যহারা হয়ে বিলাপ করে, ভাংচুর করে

ওই ব্যক্তি যে কোন বিপদে আপদে বিশেষকরে কোন প্রিয়জনের মৃত্যুতে ধৈয্যহারা হয়ে যান। ধৈয্যহারা হয়ে কাপড় ছিড়েন, মুখ ছাপড়ান, বুক ছাপড়ান এবং নানারকম আাপত্তিকর মন্তব্য মুখ দিয়ে করেন।

হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তারা আমার উম্মতের অন্তর্ভূক্ত নয়, যে ব্যক্তি নিজের গালে চপোটাঘাত করে, জামার কলার ধরে টান দেয় অথবা বোতাম ছিড়ে ফেলে এবং জাহেলি যুগের লোকেরা বিপদ আপদের সময় যেভাবে আজেবাজে মন্তব্য করতো, অনেকে মালাকুল মাউতকে গালাগালি করে।

আরও পড়তে পারেন-

নাসাঈর বর্ণনায় এসেছে, রাসুল (স.) বলেছেন, যে ব্যক্তি কোন ব্যক্তির মৃত্যুতে বা বিপদে জোরে জোরে কান্নাকাটি করলো, মাথার চুল কামিয়ে ফেললো, কাপড় ছেড়াছেড়ি করলো ওই ব্যক্তি আমার উম্মত হতে পারে না।

২. যে ব্যক্তি বেশি ভালো হতে চেয়ে সংসার বিমূখ হয়ে যায়

বৈরাগ্যতার কোন স্থান ইসলামে নেই। হাদীসে এসেছে- লা রোহবানিয়াতা ফিল ইসলাম। ইসলামে বৈরাগ্যতার কোন অবকাশ নেই।

রাসুল (স.) বলেছেন, আল্লাহর কসম। নিশ্চয়ই আল্লাহর ডর-ভয় তোমাদের চেয়ে আমার বেশি। তবুও আমি নফল রোজা কখনো রাখি কখনো রাখি না। রাতের কিছু অংশ নফল ইবাদাতে কাটাই আর কছিু অংশে ঘুমাই এবং বৈবাহিক সর্ম্পক গড়ি। সুতরাং যে ব্যক্তি আমার সুন্নাত (বিবাহ) থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে সে আমার অনুসারী নয়। (বুখারী)।

রাসূল (সা.) একদিন আল্লাহর জন্য স্তুতি র্বণনা ও প্রশংসা করলেন, আর বললেন, আমি তো নামাজ আদায় করি ঘুমাই, রোজা পালন করি নফল রোজা রাখি কোনো সময় ত্যাগও করি নারীদেরকে বিয়ে করি; এসব আমার আর্দশভুক্ত। ফলে যে ব্যক্তি আমার এসব আর্দশ (জীবনযাপন পদ্ধতি ) থেকে বিমুখ হবে সে আমার উম্মতের অর্ন্তভুক্ত নয়।’ (বুখারি- ৫০৬৩; মুসলমি- ১৪০১)।

৩. যে ব্যক্তি কোন জালেম শাসকের জুলুমকে সমর্থন করে বা তাদের মিথ্যাকে প্রচার করে

দলবাজির কারণে, অন্ধত্বের কারণে যারা জালেম শাসকের মিথ্যাকে সত্য বলে প্রচার করে, তার মিথ্যাকে সত্যায়ন করে । এদের ব্যাপারে ইবনে হিব্বানের হাদীসে এসেছে, রাসুল (স.) বলেছেন, নিশ্চয়ই আমার পরে কিছু শাসক আসবে তারা মিথ্যা কথা বলবে, জুলুম করবে, এদের মধ্যে কিছু লোক আসবে যারা এসব শাসকদের মোসাহেবগিরি করবে। প্রজাদেরকে তাদের মিথ্য কথা বিশ্বাস করানোর চেষ্টা করবে এবং জুলুম অত্যারের ক্ষেত্রে সহায়তা করবে। তারা আমার উম্মন নয়। তাদেরকে আমি চিনিনা। কেয়ামতের ময়দানে তারা আমার হাউজে কাউসারের পানি পান করতে আসতে পারবে না।

৪. যে ব্যক্তি প্রতারণা করে

রাসুলুল্লাহ (সা.) একদিন স্তূপ করে রাখা খাদ্যশস্যের কাছ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি স্তুপের ভেতরে হাত প্রবেশ করালে আঙুলগুলো ভিজে গেল। স্তূপের মালিককে জিজ্ঞেস করলেন, ব্যাপার কী? মালিক জবাব দিল, হে আল্লাহর রাসুল! বৃষ্টির পানিতে তা ভিজে গিয়েছিল। রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, তবে তা ওপরে রাখলে না কেন, যেন মানুষ তা দেখতে পায়? যে ব্যক্তি প্রতারণা করে সে আমার দলভুক্ত নয়।’ (মুসলিম, হাদিস : ১০১)

৫. যারা ভাগ্য গণনা করার জন্য গনকের কাছে যায়

রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করছেনে, যে ব্যক্তি পাখি উড়িয়ে ভাগ্যের ভালো-মন্দ যাচাই করল, অথবা যার ভাগ্যের ভালো-মন্দ যাচাই করার জন্য পাখি ওড়ানো হলো, অথবা যে ব্যক্তি ভাগ্য গণনা করল, অথবা যার ভাগ্য গণনা করা হলো, অথবা যে ব্যক্তি জাদু করল অথবা যার জন্য জাদু করা হলো অথবা যে ব্যক্তি কোনো গণকের কাছে এলো, অতঃপর সে (গণক) যা বলল তা বিশ্বাস করল—সে ব্যক্তি মুহাম্মদ (সা.)-এর ওপর যা নাজিল করা হয়েছে তা অস্বীকার করল। (মাজমাউজ জাওয়াইদ : ৫/১২০)

৬. যে ব্যক্তি অমুসলিমদের সাদৃশ্য গ্রহণ করে

হযরত রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি অমুসলিমদের সঙ্গে সাদৃশ্য রাখে সে আমার উম্মতের অর্ন্তভুক্ত নয়। তোমরা ইহুদি ও খ্রিস্টানদের সঙ্গে সাদৃশ্য অবলম্বন কোরো না। কেননা ইহুদিদের অভিবাদন হলো আঙুল দ্বারা ইশারা করা আর খ্রিস্টানদের অভিবাদন হলো হাতের তালু দিয়ে ইশারা করা।’ (তিরমিজি হাদসি- ২৬৩৮)।

৭. যে ব্যক্তি সুন্দরভাবে কুরআন তিলাওয়াত করে না।

হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে র্বণতি, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করছেনে, ‘যে ব্যক্তি সুন্দর স্বরে কোরআন তেলাওয়াত করে না, সে আমাদের দলভুক্ত নয়।’ (বুখারি, হাদিস- ৭০১৯)।

৮. যে ব্যক্তি ছিনতাই বা জোর করে মানুষের কাছে সম্পদ নিয়ে যায়

মুসতাদরাকে হাকেমে বর্ণিত হয়েছে- রাসুল (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি ছো মেরে কিছু নিয়ে যায় সে আমার উম্মত হতে পারে না।

হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রাযি.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি অন্যের সম্পদ ছিনতাই করে সে আমাদের দলভুক্ত নয়।’ (আবু দাউদ, হাদিস- ৪৩৪০)

৯. ঐ শাসক যে রাসুল (সা.) আদেশের বাইরে শাসন করে

এ ব্যাপারে আবু দাউদ শরীফে হাদীস এসেছে। রাসুল (স.) কে একব্য ক্তি জিজ্ঞেস করলো, আপনার পরবর্তীতে কিভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করবে। রাসুল (স.) বলেন, যে আমার পদ্ধতিতে শাসন না করে অন্যভাবে চালাবে সে আমার অন্তর্ভুক্ত নয়।


এ ব্যাপারে আবু দাউদ শরীফে হাদীস এসেছে। রাসূল (সা.)কে একব্যক্তি জিজ্ঞেস করলো, আপনার পরবর্তীতে কিভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করবে। রাসূল (সা.) বলেন, যে আমার পদ্ধতিতে শাসন না করে অন্যভাবে চালাবে সে আমার অন্তর্ভুক্ত নয়।

১০. যে স্বামি-স্ত্রী বা মালিক-দাসের সম্পর্ক নষ্ট করার কারণ হয়

রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি কারো স্ত্রীকে তার স্বামীর বিরুদ্ধে অথবা দাসকে তার মনিবের বিরুদ্ধ প্ররোচিত করে সে আমাদের দলভুক্ত নয়।’ (আবু দাউদ, হাদিস- ২১৭৫)।

১১. যে ব্যক্তি গোঁফ ছোট করে না

রাসূলুল্লাহ (স.) ইশরাদ করেন, মুশরিকদের বিরোধিতা কর, দাড়ি লম্বা কর, আর গোঁফ ছোট কর। (বুখারী শরীফ-২/৮৭৫, মুসলীম)।

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি গোঁফ না ছাঁটে সে আমাদের অর্ন্তভুক্ত নয়। (নাসায়ী )।

১২. যে বিপরীত লিংগের সাদৃশ্য করে অথ্যাৎ মেয়ে পুরুষের এবং পুরুষ মেয়ের বেশ ধরে

রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, যেসব নারী পুরুষের সঙ্গে সাদৃশ্য অবলম্বন করে এবং যেসব পুরুষ নারীর সাদৃশ্য অবলম্বন করে তারা আমার উম্মতের অর্ন্তভুক্ত নয়।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস- ৬৫৮০)।

১৩. যারা মুসলিমদের উপর অস্ত্র তাক করে

রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘ওই ব্যক্তি আমাদের দলভুক্ত নয়, যে আমাদের ওপর (মুসলমানদের বিরুদ্ধে) অস্ত্র তোলে। আর যে আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করে সেও আমাদের দলভুক্ত নয়।’ (মুসলমি, হাদিস : ১০২)।

১৪. যে ব্যক্তি মুসলিম জনপদে সাপ প্রবেশ করলে তা হত্যা না করে অন্যদের বিপদের মুখে ঠেলে দেয়

তিরমিজি শরীফের হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তোমরা সব রকমের সাপকে হত্যা করো। যে বক্তি সাপের ভয়ে হত্যা করলো না, নিজেকে রক্ষা করলো সে আমাদের অন্তর্ভূক্ত হতে পারে না।

১৫. যে ব্যক্তি মুসলিম শাসকের আনুগত্য থেকে বের হয়ে যায়

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি তার আমীরের মধ্যে এমন কোন ব্যাপার প্রত্যক্ষ করলো যা সে অপছন্দ করে তবে সে যেন ধৈয্যধারণ করে। কেননা যে ব্যক্তি জামায়াত থেকে কিঞ্চিত পরমিাণ সরে গেল এবং এ অবস্থায় মৃত্যুবরণ করল সে জাহেলিয়াতের মৃত্যুই বরণ করলো।” ( মুসলমি- ৪৬৩৭)। অনুলিখন:ফয়েজ উল্লাহ ভূঁইয়া

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।