Home ওপিনিয়ন ইসলাম বিরোধীতা

ইসলাম বিরোধীতা

।। মুহাম্মদ হাবীবুর রহমান ।।

ইসলাম এবং মুসলমানের প্রথম দুশমন শয়তান। অতঃপর কাফিররা দুশমনী শুরু করে। ইহুদী-খ্রীস্টান-মুশরিক, যারা আল্লাহর তাওহীদ তথা একত্বে বিশ্বাস করে না, তারাই কাফির। আল্লাহ তাঁর কিতাবে এইসব দুশমন থেকে মুসলমানকে সাবধান থাকতে বলেছেন। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন, ‘তোমরা পরিপূর্ণভাবে ইসলামে প্রবেশ কর এবং শয়তানের অনুসরণ করিও না; নিশ্চয় সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু’। (সূরা বাক্বারাহ- ২০৮)।

কুরআন পাকে আরো ইরশাদ এসেছে, ইহুদী এবং মুশরিকদেরকে তুমি ঈমানদারদের প্রধান দুশমনরূপে দেখতে পাবে। (সূরা মায়েদা- ৮২)।

শয়তান আমরা দেখতে পাই না, কিন্তু বিশ্বাস করি। কেননা, কুরআন পাকে উল্লিখিত সকল কিছুই আমাদের দৃষ্টিগ্রাহ্য নয়। তবু ঈমানদারদের এ সবকিছুই বিশ্বাস করতে হবে। কুরআন পাকে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘হুদাল্লিল মুত্তাকিনাল লাযীনা ইউমিনূনা বিল গাইবি’। (সূরা বাকারাহ)। অদৃশ্যে বিশ্বাস স্থাপন না করলে খঁটি ঈমানদার হওয়া যায় না।

আর, ঈমানদারগণই কুরআন পাকের মধ্যে সঠিক পথের দিশা পেয়ে থাকেন। শয়তান না দেখলেও শয়তানের বন্ধু ইহুদী-মুশরিকদের আমরা দেখি। আর, তারা যে মুসলমানদের দুশমন তাও আমাদের কাছে প্রমাণিত সত্য। বিশ্ব জুড়ে তাদের দ্বারা বিভিন্নভাবে মুসলমানরা অত্যাচারিত। এটা প্রমাণসিদ্ধ ঐতিহাসিক সত্য। তা কারো অস্বীকার করার সুযোগ নেই। পূর্ব ইতিহাসের পুণরাবৃত্তির কোনো আবশ্যক নেই। অধুনা ফিলিস্তিন, মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশ, ভারত অধিকৃত কাশ্মীর, চীনের জিনজিয়াং প্রদেশের মুসলমানদের অবস্থার দিকে তাকালেই অত্যাচারের জাজ্জ্বল্যমান প্রমাণ পাওয়া যাবে।

ইসলামের মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)এর ইসলাম প্রচার এবং ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠার পর থেকেই কাফিররা বলে এসেছে যে, ইসলাম প্রতিষ্ঠা পেয়েছে তলোয়ারের জোরে। এ ধরণের ইতিহাসও কোনো কোনো কাফির ঐতিহাসিক লিখেছেন। কিন্তু ইসলাম যে তলোয়ারে নয়, উদারতায় প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, সেই ইতিহাসও আছে এবং তাই সঠিক ইতিহাস। তার প্রমাণ আজও মিলছে। আজও কোথায়ও কাউকে জোর করে কিংবা প্রলোভনে ভুলিয়ে ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করা হচ্ছে না।

এই কাজটি অতীতেও করেছে খ্রীস্টান মিশনারাীরা, এখনও তারাই তা’ করছে। তাদের খ্রীস্টান বাড়ানো দরকার। তাই তাদের এই মিশন চালাতে হচ্ছে। মুসলমানদের ছলে বলে কৌশলে মুসলমানের সংখ্যা বাড়ানোর আবশ্যক নেই। তাদের আবশ্যক খাঁটি মুসলমানের, ঈমানদার মুসলমানের। তারা বরং তাদের মধ্যকার বেঈমান মুসলমানদের মুরতাদ হিসেবে বর্জন করার পক্ষপাতী।

কাফিরদের বিবেচিত তলোয়ারবাজ মুসলমানদের ইসলাম সন্ত্রাসবাদের ধর্ম বলে এখন তারা প্রচার করে যাচ্ছে। আর মুসলমান হলো, জঙ্গী। এটা এখন শুধু কাফিররাই বলে না, বামপন্থী মুসলমানরাই বলতে শুরু করেছে। অথচ প্রথম মহাযুদ্ধ এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের বিশ্ববিধ্বংসী অস্ত্রবাজী এবং নরহত্যা ও ধ্বংসলীলা কাফিররাই করেছে। বসনিয়া, চেসনিয়া, হার্জেগোভিনা, ভিয়েতনাম, আফগানিস্তান, ইরাকে জঙ্গীপনা মুসলমানরা করেনি। তা করেছে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স এর যৌথ খ্রীস্টান বাহিনী। তলোয়ারে পরদেশ দখল করে ইহুদীরাই ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছে।

ফিলিস্তিনী মুসলমানরা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা দূরে থাক, আত্মরক্ষা করাই তাদের মুশকিল হয়ে পড়েছে। কাশ্মীরে, গুজরাটে, মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে, চীনের জিনজিয়াং প্রদেশ মুসলমানরা মার খেয়ে খেয়ে খতম হচ্ছে। অথচ এরা জংগী মুসলমান। আর যে সব বিধর্মীরা এই সব মুসলিম হত্যা চালাচ্ছে, তারা জঙ্গী নয়, বরং তারা সব শান্তিকামী ধর্মনিরপেক্ষ মহামানব। এই যে উল্টো পুরান, এসব আর কতোকাল লেখা হবে?

সেই অতীতকাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বিধর্মীরা ইসলাম এবং মুসলমানকে কটাক্ষ করে বই লিখেছে, নাটকের অভিনয় করেছে, ছবি এঁকেছে। কুরআন পাকে আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘তোমাদের পূর্ববর্তী কিতাবীদের মধ্যে যারা তোমাদের ধর্মকে উপহাস করে এবং তামাসা মনে করে, তোমরা তাদেরকে ও কাফিরদেরকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করিও না। (সূরা মায়েদা- ৫৭)।

ক’ বছর পূর্বে এক ইহুদী রমণী মহানবী (সা.)এর ব্যঙ্গ চিত্র আঁকে এবং তা ডেনমার্কের পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তারই অনুসরণ করে বাংলাদেশে রামুর এক বৌদ্ধ যুবক। কিছুদিন পূর্বের এক সংবাদে প্রকাশ বাংলাদেশের এক হিন্দু যুবক কা’বা গৃহের ছবিকে অবমাননা করেছে। কিছুকাল পূর্বে আমেরিকায় এক ইহুদী মহানবী (সা.)কে তুচ্ছ -তাচ্ছিল্য করে এক চলচ্চিত্র নির্মাণ করে।

পশ্চিম বঙ্গে মহানবী (সা.)কে নিন্দিত করে লিখেছিল ‘রঙিলা রসূল’ নামে একটি বই। সে অনেকদিন আগের কথা। পরবর্তী সময়ে ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ- ২১১নং রামবিহারী এভেনিউ, বালিগঞ্জ, কলিকাতা-১৯ থেকে প্রকাশিত হয়েছে ‘ওঁজয়িষ্ণু হিন্দু’ নামে একটি বই। লিখেছেন স্বামী বেদানন্দ। এ গ্রন্থে ইসলাম এবং মুসলমানদের অনেক অপবাদ দেওয়া হয়েছে। সেই বইয়ের ১০৩ পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে, ‘যিনি কুরআন পড়িয়াছেন এবং ইসলামের বিবর্তীনের ইতিহাস লক্ষ্য করিয়াছেন, তিনিই স্বীকার করিবেন যে, কুরআনে যে যে অংশে উচ্চভাব, সদ্ভাব ও সুক্ষ্মতত্ত্বের আলোচনা ও আদেশ উপদেশ আছে, সেই সেই বিষয়গুলি হিন্দু ধর্ম হইতে গৃহীত, আর যে যে অংশে ধর্মের নামে আল্লাহর নির্দেশের দোহাই দিয়া বর্বরতার সমর্থন রহিয়াছে, সেইটুকুই আদি, অকৃত্রিম আরবীয় বেদুইন রক্তের প্রেরণা’। (নাউজুবিল্লাহ)।

বেদানন্দ স্বামী অবশ্য চিহ্নিত করেননি, কুরআনে কী কী উচ্চভাব, সদভাব, সুক্ষèতত্ত্ব এবং আদেশ উপদেশ আছে, যা হিন্দু ধর্ম হতে গৃহীত হয়েছে। তাহলে কী করে জানা যাবে ইসলামে কী কী সদাচার হিন্দু ধর্ম থেকে গ্রহণ করা হয়েছে। আমরা জানি, ইসলাম হিন্দু ধর্মের মূর্তি পূজা, লিঙ্গ পূজা, বৃন্দাবনলীলা, নৃত্য-গীত, বাদ্য-বাজনা গ্রহণ তো করেইনি, বরং বর্জন করেছে। হিন্দুদের বহু ঈশ্বর এবং দেব-দেবী। তাদের প্রত্যেকের হাতে প্রচুর ক্ষমতা। তাদের এক শক্তিধর অপর শক্তিধরের সংগে প্রতিযোগিতায় অবর্তীণ হবার কাহিনীও আছে।

ইসলাম ধর্মের আল্লাহ এক অদ্বিতীয়; সর্ব শক্তিমান। তাকে কারও সংগে শক্তির ভাগভাগি করতে হয় না। মানুষের বিদ্যা, ধন, প্রতিপত্তি, সুখ-শান্তি, জন্ম মৃত্যু, তিরস্কার পুরস্কার ইত্যাদি সব কিছুর নিয়ামক আল্লাহ তায়ালা। হিন্দু ধর্ম এর সম্পূর্ণ বিপরীত। ‘সত্যম শিবম সুন্দরম’ বাক্য মুখে উচ্চারণ করলে কোনো ফায়দা পাওয়া যায় না। ইসলাম শব্দের অর্থ শান্তি। এ ধর্মে শান্তি, শৃঙ্খলা, সৌন্দর্য, মংগল তার আমল-আখলাকের মধ্যে নিহিত। আল্লাহর দোহাই দিয়ে ইসলামের কী কী বর্বরতা প্রচলিত, বেদনানন্দ তাও উল্লেখ করেননি। তবে আমার মনে হয়, ইসলাম জিহাদের কথা বলে, এটাই সম্ভবত; তার বিবেচনায় বর্বরতা।

বেদানন্দ নিশ্চয় জানে না যে, ইসলাম প্রচারক হযরত মুহাম্মদ (সা.) আরবীয় হলেও বেদুইন ছিলেন না। তার সাহাবাগণও কেউ বেদুইন ছিলেন না। মহানবী (সা.)এর যামানায় যে সকল জিহাদ সংঘটিত হয়েছে, তা আল্লাহর দোহাই দিয়ে নয়, বরং আল্লাহর কিতাব আল-কুরআনের নির্দেশ অনুসারেই হয়েছে।

আর, মুসলমানরা মক্কার কাফিরদের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে তাদের দ্বীন এবং জান রক্ষার্থে জিহাদে অবতীর্ণ হতে বাধ্য হয়েছে। জিহাদ বর্বরতা নয়। বর্বরতা হলো হিরোশীমা-নাগাসাকি বোমা হামলায় বিধ্বস্ত করা। বর্বরতা হলো আফগানিস্তান এবং ইরাক ধ্বংস স্তুপে পরিণত করা। বর্বরতা হচ্ছে রাখাইন প্রদেশের রোহিঙ্গা মুসলমানদের নির্বিচারে হত্যা করা। বর্বরতা হচ্ছে গুজরাটে, কাশ্মীরে মুসলমানকে অহেতুক হত্যা করা। জিহাদ মানে ধর্মযুদ্ধ।

স্বামী বেদানন্দকে জিজ্ঞেস করি, মুসলমানরা এটা হিন্দুধর্ম থেকে গ্রহণ করেছে, তা বললেন না কেন? হিন্দুর অন্যতম ধর্ম গ্রন্থ গীতার শুরু হয়েছে “ধর্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে সমবেতা যুযুৎসব” এই বাক্য দিয়ে।

এ বাক্য প্রমাণ করে যে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধটা ছিল ধর্মযুদ্ধ। আর, এই যুদ্ধে ধর্মের পক্ষে ছিলেন শ্রীকৃষ্ণ যিনি বলেছেন, ‘বিনাশায়চ দুস্কৃতাম, ধর্ম সংস্থাপনার্থায় সম্ভবানি যুগে যুগে’। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, হিন্দু ধর্ম মতেও ধর্মযুদ্ধের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার্য। আর, এই যুদ্ধে উৎসাহিত করার জন্য শ্রীকৃষ্ণ গীতায় অর্জুনকে বলেছিলেন-

হতো বা প্রাপ্স্যসি স্বর্গং জিত্বাবা ভোক্ষসে মহীম।

তন্মাদুত্তিষ্ঠ কৌন্তেয় যুদ্ধায় কৃতনিশ্চয়।। ২/৩৭

(যুদ্ধে হত হইলে স্বর্গ পাইবে, জয়লাভ করিলে পৃথিবী ভোগ করিবে; সুতরাং হে কৌন্তেয় (কুন্তী পুত্র অর্জুন) যুদ্ধে কৃত নিশ্চয় হইয়া উত্থান কর)।

মহাভারতের এই কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ বিধর্মীদের সংগে ছিল না। এই যুদ্ধছিল জ্ঞাতিদের সংগে রাজ্য উদ্ধারের উদ্দেশ্যে। অর্জুন জ্ঞাতিদের সংগে যুদ্ধ করতে সম্মত ছিলেন না। তাই শ্রীকৃষ্ণ উক্ত শ্লোক বলে যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন অর্জুনকে। এই যুদ্ধে উভয় পক্ষে অসংখ্য মানুষ হতাহত হয়। আর কৌরবেরাতো একেবারেই নির্বংশ হয়ে যায়।

এই যুদ্ধের ফলে হস্তিনাপুর রাজ্য পান্ডবদের দখলে আসে। যেমন ঐতিহাসিক যুগে ইয়োরোপের খ্রীস্টানেরা মুসলমানদের শাসনাধীন স্পেন রাজ্য দখলের জন্য দুইশত বছর ব্যাপী ক্রুসেড (ধর্মযুদ্ধ) চালিয়ে স্পেন থেকে মুসলমানদের হত্যা করে, তাড়িয়ে দিয়ে দেশটি দখল করে নেয়। এই বিজয়ের স্মৃতি তারা ধরে রাখছে প্রতিবছর পহেলা এপ্রিল তারিখে ‘এপ্রিল ফুল’ উৎসবের মধ্য দিয়ে। এই হলো হিন্দু এবং খ্রীস্টানদের ধর্মযুদ্ধের নমুনা। এ যেন কবি নজরুলের লেখা ‘হরি নামে রুচি, পরিনামে লুচি’ এই ধরনের ধর্মযুদ্ধ।

আর, ইসলামের মহানবী মদিনায় যে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেজন্য কোনো যুদ্ধ করতে হয়নি। প্রথমতঃ তা ছিল মুসলমানদের একটি ইসলামী জামায়াত। মক্কার কাফিররা বারংবার মদিনা আক্রমণ করেছে মহানবী (সা.) এবং অনুসারীদের বিরুদ্ধে, তাঁদের খতম করার উদ্দেশ্য নিয়ে। আল্লাহ তাঁর কিতাব আল-কুরআনে এ বিষয়ে ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ কর, যারা তোমাদের সংগে যুদ্ধ করছে। কিন্তু সীমালঙ্ঘন করিও না, কেননা আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারীকে ভালবাসেন না’। (সূরা বাকারাহ- ১৯০)।

মুসলমানের ধর্মযুদ্ধ (জিহাদ) অহেতুক রক্তপাত এবং রাজ্য দখলের জন্য নয়। ধর্মযুদ্ধ (জিহাদ) মুসলমানদের দ্বীন এবং জান রক্ষার জন্য। তাও আল্লাহ নির্ধারিত সীমার মধ্যে থেকে। আরবীয় ইসলামের ইতিহাস কুরআন, হাদিস, মহানবী (সা.)এর জীবন চরিত অধ্যয়ন করলে এ বিষয়ে সম্যক জানা যায় এবং তাই সঠিক। এ সম্পর্কে ফকিরদের লেখা ইতিহাস কিংবা জীবনচরিতে সঠিক তথ্য পাওয়া যাবে না। সুতরাং তা পরিত্যাজ্য।

স্বামী বেদানন্দ তার ‘ওঁজয়িষ্ণু হিন্দু’ বইয়ের ১০১ নং পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘মক্কাতীর্থে ছোট বড় এক লক্ষ শিব মন্দির ছিল। সর্বপ্রধান শিব মন্দির পরবর্তীকালে কাবা মসজিদে পরিণত করা হইয়াছে। উক্ত মন্দিরস্থ কষ্টি পাথরের নির্মিত সুবৃহৎ শিবলিঙ্গকে চুর্ণ করিয়ে ফেলা হয়। অদ্যাপি উক্ত শিবলিঙ্গের ভগ্নাংশ কাবা মন্দিরে স্থাপিত আছে। হজ যাত্রী মুসলমানগনকে উক্ত প্রস্তর খন্ড চুম্বন পূর্বক হাজী হতে হয়’।

এই গাঁজাখোরী গল্প বেদানন্দ কোত্থেকে সংগ্রহ করলেন? ইতিহাস বলে (অবশ্য প্রাচীন ইতিহাস, কতকটা আসমানী কিতাব সমূহের বর্ণনা থেকে পাওয়া) হযরত ইবরাহীম (আ.)এর নবুওয়াতীর আমলে বাবেল শহরের বাদশাহ নমরুদ নিজেকে আল্লাহ বলে দাবী করতো। সেকালে মানুষ শয়তানের প্ররোচনায় মূর্তিপূজা করতো, তবে সেই সকল মূর্তি ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব নামে কথিত হবার প্রমাণ পাওয়া যায় না। আরব দেশের মক্কানগরে অবস্থিত কাবা ঘর আল্লাহর ইবাদতের জন্য নির্মাণ করেন নবী হযরত ইবরাহীম (আ.)। কালক্রমে আরবের লোকেরা কা’বায় ৩৬০টি মুর্তি স্থাপন করে সেগুলির উপাসনা করতো। এই সব কর্ম তারা করতো শয়তানের প্ররোচনায়। কুরআন পাকে আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং মিথ্যা মূর্তি পূজা হতে দূরে থাক’। (সূরা নহল- ৩৬)।

মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)এর নবুওয়াত প্রাপ্তি থেকে তাঁর কাছে ফেরেশতা হযরত জিবরাঈল (আ.)এর মাধ্যমে আল্লাহর কিতাব আল-কুরআন ক্রমান্বয়ে নাযিল হতে থাকে। সেই কিতাবের নির্দেশনায় কাবাগৃহ থেকে মূর্তি অপসারিত হয়ে এক আল্লাহর (অদৃশ্য, নিরাকার) ইবাদত প্রচলিত হয়। হজরে আসওয়াদ নামে একখন্ড পাথর কাবাগৃহের সম্মুখে স্থাপিত ছিল। এ পাথরটি পবিত্র হিসেবে স্বীকৃত। আরবদেশে কখনো ব্রহ্ম, বিষ্ণু, শিব ছিল না। আর একমাত্র ভারতীয় হিন্দু ব্যতীত অন্য কোনো ধর্মাবলম্বীই কোনোদিন লিঙ্গপূজা করেনি, আজও করে না। এটা বাস্তব সত্য।

আরববাসীরা পৌত্তলিক হলেও লিঙ্গ পূজারী ছিল না। হযরে আসওয়াদ যে শিবের লিঙ্গের ভগ্নাশেষ তা যুক্তিহীন। কেননা পৌত্তলিক আরবীয়দের কাছেও ভারতীয় ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব কখনো পাত্তা পায়নি। কোনো প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ কিংবা ইতিহাসে লেখা আছে বলে কখনো শুনিনি। তবে কিছুদিন পূর্বে বাংলাদেশের ফেসবুকে জনৈক হিন্দু যুবক কা’বার ছবির উপর শিবলিঙ্গ স্থাপিত করে পোস্ট দিয়েছিল। নিশ্চয় যুবকটি স্বামী বেদানন্দের ‘ওঁ জয়িষ্ণু হিন্দু’ বইটি পড়েছে।

বর্তমানে বাংলাদেশে ফেসবুক, ব্লগ ইত্যাদি ইন্টার নেটওয়ার্কে ইসলাম ধর্ম, ধর্মীয় বিধান এবং মহানবী (সা.) সম্পর্কে কটূক্তি করছে কোনো কোনো মুসলমান যুবক। তাকে কেন্দ্র করে আততায়ী কর্তৃক নিহত হয়েছে এক ব্লগার। তারপরেও এক হিন্দু ব্লগার এবং তার রচিত বইয়ের মুসলমান প্রকাশক আততায়ী কর্তৃক নিহত হয়েছে। এ ধরণের হত্যাকান্ডকে বাংলাদেশের আলেম সমাজ ও মুসলমান অন্যান্য অপরাধী কাজের মতো শাস্তযোগ্য অপরাধ হিসেবেই বিবেচনা করে।

তবে ধর্মবিরোধী লেখাও চরম অপরাধ। যারা ধর্ম মানে না, কিংবা যারা ধর্ম নিরপেক্ষ, তাদের এসবে উত্তেজিত হবার কারণ না থাকতে পারে, কিন্তু দ্বীনদার মুসলমানের মনে খুব আঘাত পাওয়া স্বাভাবিক। তবু বিচারের দায়িত্ব কারো নিজ হস্তে নেওয়া উচিত নয়। তাতে আরও জটিলতা এবং নৃশংসতা বৃদ্ধি পায়।

এই খেলাটি একেবারে নতুন নয়। অনেক পূর্বে ভারতীয় মুসলমান সালমান রুশদী মহানবী (সা.)কে কটাক্ষ করে লেখেন “satanic verses” নামে এক উপন্যাস। ভারতীয় মুসলমানরা ক্ষীপ্ত হলে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করেন। আমাদের বাংলাদেশের কবি দাউদ হায়দার মহানবী (সা.)কে কটাক্ষ করে কবিতা লিখে দেশ ছাড়া। সে রকম তসলিমা নাসরিনও। তবে সাম্প্রতিক কালে ইসলামের বিরুদ্ধে লিখে কাউকে দেশ ছাড়া হতে হয় না।

কেননা, বাংলাদেশ ধর্মনিরপেক্ষ দেশ। তবে মুশকিল এখানে যে, যারা ধর্মের পক্ষে এ দেশটা তো তাদেরও জন্মভূমি। তাই তাদের ধর্ম ইসলামের নিন্দাবাদ, বিরোধিতা হিন্দু, বৌদ্ধ, বামপন্থী মুসলমান কিংবা নাস্তিক মুসলমান যেই করুক, ধর্মপ্রাণ মুসলমানের কাছে তা অসহ্য লাগে এবং এটাও অস্বাভাবিক নয়।

বাংলাদেশে পশ্চিম বঙ্গের সকল যুগের হিন্দু লেখিক-লেখিকাদের সাহিত্য গ্রন্থ প্রচুর পাওয়া যায়। কারণ সেগুলি এদেশের প্রকাশকরাই প্রকাশের সুযোগ পায়। কিন্তু পত্রিকা সেভাবে পাওয়া যায় না। তবে ২/৪টি পত্রিকার পশ্চিম বঙ্গে মুদ্রিত কপি পাওয়া যায়। দেশ এবং যুগান্তর কখনো কখনো আমার পড়ার সুযোগ হয়। দেখেছি তাতে মুসলমান লেখকের ২/১টির বেশি লেখা থাকে না।

‘দেশ’ এর ৮৪ বর্ষ, ৭ম সংখ্যা, ১৯ মাঘ ১৪২৩/ ২ ফেব্রুয়ারী- ২০১৭ সংখ্যাটি পড়বার সুযোগ হলো। এতে হুমায়ুন কবীর নামের এক মুসলমান লেখকের ধারিবাহিক উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৬ পৃষ্ঠার সংখ্যায় মুসলমান সাহিত্যিকের লেখা ‘অই একটাই’। উপন্যাসটির ৫ম এবং ৬ষ্ঠ অধ্যায় এ সংখ্যায় এসেছে। লেখার শেষে ‘ক্রমশ’ লেখা আছে। তাহলে এ লেখাটা আরো কয়েক সংখ্যায় ছাপা হবে বোঝা গেল।

আর, এর শুরু হয়েছে পূর্ববর্তী সংখ্যাগুলোতে। তাতে ৪টি অধ্যায় ছাপা হয়ে গেছে। আমার তা পড়ার সুযোগ হয়নি। যেখান থেকে পড়া শুরু সেখান থেকে আলোচনা করছি। উপন্যাসের নাম ‘ফাইনাল গাজি’। এ-ধারাবাহিকের পরিসমাপ্তি কোথায় গিয়ে গড়াবে, তা জানি না। তবে ৫এবং ৬এর আলোচ্য বিষয় এরকম ৫ম অধ্যায়ে নজরুলে মুহাম্মদ দুজনে বন্ধুত্ব এবং একই স্কুলে সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ে লেখা-পড়া ছেড়ে দিয়ে দু’বছর পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়ায়। অতঃপর মুহাম্মদ চলে যায় তার বাবার কাপড়ের দোকানে বহরমপুরে। নজরুল যায় তার মামার ফার্ণিচারের দোকানে কলকাতায়। ৭/৮ বছরের বেশি সময় গ্রামের বাইরে থাকলেও খোকন ওদের চেনে। কেননা ঈদ, বকরি-ঈদ এবং ছুটিতে ওরা বাড়ীতে আসে।

নজরুলের বাপ বাড়ীতে থেকে মুদিখানা চালায়। এ-অধ্যায়ে উল্লেখ না থাকলেও বোঝা যায় মুহাম্মদ বিবাহিত। তার বউয়ের নাম সাবিনা। নজরুল বাড়ীত আসলে সাবিনা তাকে চিঠি পাঠায় খোকনের মাধ্যমে। খোকন তা নজরুলকে দিলে তার উত্তর লিখে সাবিনাকে দিতে খোকনের হাতেই দিয়ে দেয়। খোকন তা সাবিনাকে দেয়। সাবিনা চিঠি পড়ে খোকনের সামনেই। চিঠিখানা নিম্নরূপ-

‘চাঁদনি চাঁদসে হোতি হ্যায় সিতারোসে নেহি

মুহাব্বত একসে হোতি হ্যায় হাজারোসে নেহি।

আমি আসছি তোমার সঙ্গে এক বালিশে মাথা দিয়ে শোব। ইতি- নজু’।

চিঠি পড়ে আনন্দে আত্মহারা সাবিনা হাফপ্যান্ট পড়া খোকনকে জড়িয়ে ধরে। খোকন বয়োসন্ধির কিশোর। আস্কারা পেয়ে সে সাবিনার পেটে হাত বুলায়। তারপর তার হাত আরো উপরের দিকে উঠতে উদ্যত হলে সাবিনা বলে, ‘একদিন ডাকবো তোমাকে, দেখবো কতটা পেকেছ, আর কত তোমার দম’ এখানে পরকীয়ার ইঙ্গীত সুস্পষ্ট।

৬নং অধ্যায়ে কলেজ-ছাত্র ইউসুফের কলেজে সেমিনার। সেমিনারের বিষয়ঃ পশ্চিম বঙ্গে মুসলিম সমাজ ও মাদরাসা শিক্ষা। প্রথমে গান, নাচ, বক্তব্য এবং শেষে বিতর্ক। বিতর্ক হবে ‘পশ্চিম বঙ্গে মাদরাসা শিক্ষার প্রাসঙ্গিকতা’ সম্পর্কে। তাই চেষ্টা চলছে বেশি সংখ্যক মুসলমান ছাত্রকে ইনভলভ করার। ইউসুফের ক্লাশ থেকে ইউসুফকেও মনোনীত করা হলো। অথচ সে মাদরাসা শিক্ষা সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ। তার বাবা তাকে আরবী, উর্দূ বা ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত করার চেষ্টা করেনি। তার বাবাও ধর্ম চর্চা করে না। তাই বিতর্কের জন্য ইউসুফ এক মাদরাসায় গেল মাদরাসা শিক্ষা বিষয়ে জানতে।

সেখানে গিয়ে মাদরাসা শিক্ষক মহিউদ্দিনের সঙ্গেই বিতর্ক জুড়ে দিল। দেবেই বা না কেন? সে মুসলমান হয়েও ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে না জানলেও এটা ভালো করেই জানে- “ছোট ছোট শিশু ও কিশোরদের মাদরাসায় ভর্তি করে মৌলানা, হাফিজ (সম্পূর্ণ কুরআন শরীফ মুখস্ত), বা ক্বারী (যিনি শুদ্ধভাবে এবং সুশ্রাব্য উচ্চারণে কুরআন পাঠ করেন) তৈরী করার পাঠ দেওয়া অইসব শিশু বা কিশোরদের কাছে বহির্বিশ্ব সঙ্কুচিত হয়ে আসে; ধর্মের রেশমী সুতো নিজের চারদিকে জড়াতে জড়াতে এক একটি কোকুনে (প্রজাপতি জন্মানোর আগের খোলস অবস্থা) পরিণত হয়। আর অই কোকুন অবস্থায় মৃত্যু। আখেরে তারা জান্নাত বাসের লোভে আর ধর্মীয় নেতাদের চোখ রাঙ্গানিতে কোকুন কেটে বেরিয়ে আসার ইচ্ছা বা সাহস কোনটাই অর্জন করতে পারে না”।

এ ধরনের ইউসুফ বর্তমান যুগে বিরল নয় কোনো দেশেই। এরা চায় আধুনিক ইসলাম। সে কারণেই মাদরাসা শিক্ষকের কাছে ইউসুফের প্রশ্ন, মাদরাসায় টেলিভিশন রাখেন না কেন? তাহলে বোঝা যায় যে, মাদরাসা শিক্ষার সংগে গান, নাচ, অভিনয় ইত্যাদি বিষয় থাকলেই এ শিক্ষা আধুনিক হয় এবং তাহলে আর বহির্বিশ্ব মাদরাসার ছাত্রদের কাছে সঙ্কুচিত থাকে না। আরো প্রশ্ন মাদরাসায় ড্রেস কোড কেন থাকবে? যার যেমন খুশি তেমন পোষাক পড়বে।

ইউসুফ জানে না, মাদরাসায় কোনো ড্রেসকোড নির্ধারণ করার আবশ্যক হয় না। এখানে আসে যারা তারা ইসলাম শিখতে আসে, তাই তারা ইসলামী (মুসলমানী) পোষাক পরেই আসে। স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য ড্রেস কোড লাগলেও, মাদরাসা পড়ুয়াদের জন্য ড্রেসকোড নির্ধারণেরর আবশ্যক হয় না। দ্বীনদার মুসলমানরা সর্বাবস্থায় দ্বীনের পথেই থাকে। যাদের ঈমান নড়বড়ে অথবা ধর্মাচারহীন মুসলমান, তারাও ইসলাম বিরোধিতা করে। হুমায়ুন কবীরের উপন্যাসে ইসলাম বিরোধিতা আছে বলেই তো ‘দেশ’ এর পাতায় স্থান পায়। #

লেখক: প্রবীণ সাহিত্যিক, গবেষক, পত্রপত্রিকার লেখক ও সম্পাদক- মাসিক কালান্তর পত্রিকা।