Home প্রবন্ধ-নিবন্ধ সামাজিক অবক্ষয়ে ধ্বসে পড়া সভ্যতা: কারণ ও প্রতিকার

সামাজিক অবক্ষয়ে ধ্বসে পড়া সভ্যতা: কারণ ও প্রতিকার

।। কাজী হামদুল্লাহ ।।

সামাজিক অবক্ষয়ের চরমতম একটি মুহূর্তে আমরা অবস্থান করছি। দেশের যে কোন পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্লেষণ করতে গেলেই এ বিষয়টা সামনে আসে। হয়তো শুরুতেই, নয়তো মাঝখানে। অথবা বিশ্লেষণের ফলাফলে সামাজিক অবক্ষয়কেই দায়ী করা হয় উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্য।

রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ স্তর থেকে সমাজের প্রতিটি সেক্টরে এখন ত্রাসের রাজত্ব। খবরের কাগজ, পত্রিকার পাতা আর নিউজ পোর্টালগুলোর হোমপেজে শুধুই মারামারি, খুনো-খুনি, জবরদখল, ধর্ষণ-লুণ্ঠন, প্রেম-পরকীয়া, পারিবারিক দ্বন্দ্ব-কলহ এবং এসিড-ইভটিজিং ইত্যাদির সংবাদ। এগুলো আমাদের সামাজিক ব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ব্যাধিই আমাদের সামাজিক অবক্ষয়ের কারণ।

সামাজিক অবক্ষয় বলতে নৈতিক গুণাবলির ক্ষয়প্রাপ্তি। কর্তব্যবোধ, ন্যায়-নিষ্ঠা, সততা ও কল্যাণবোধ, উদারতা, নিয়মানুবর্তিতা, দেশপ্রেম, পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব আজ আমাদের সমাজে সোনার হরিণ হয়ে গেছে। আমাদের দেশের শহরগুলোতে একটা কথা প্রচলিত অাছে যে, ‘শহরে কেউ কাউকে চেনে না’। বিষয়টা হালকা শোনালেও খুবই মারাত্মক। মানুষ সমাজে বসবাস করতে হলে পারস্পরিক হৃদ্যতা ও আন্তরিকতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু সেটা আজ নেই। তাই একে অপরকে মেরে-কেড়ে খাচ্ছে। দেখারও কেউ নেই। ‘দেখার কেউ নেই’ কথাটা আসলে ভুল হবে। সবাই সবকিছুই দেখে। কিন্তু অন্যের প্রতি মমত্ববোধের অভাবে কেউ কিছুই বলে না, কেউ কিছুই করে না। অথচ একজন মানুষকে রক্ষা করা মানে পুরো মানবজাতিকে রক্ষা করা। তা ছেড়ে দিয়ে আমরা স্বার্থবাদীতার অক্টোপাসে বন্দী হয়ে পড়েছি। এই স্বার্থবাদীতাও অনেক বড় একটা সামাজিক অবক্ষয়, একটা মারাত্মক ব্যাধি।

আমরা অনেক সময় গাড়িতে বা বাসে তুচ্ছ ভাড়াকে কেন্দ্র করে স্টাফদের সাথে বাড়াবাড়ি করি। অনেকে তাদের গায়ে হাত তুলতেও দ্বিধা করি না। অথচ সরকারীভাবে অন্যায্য ভ্যাট বেড়ে গেলেও আমাদের খবর থাকে না। কারণ আমরা দুর্বলের প্রতি কঠোর হতে জানি কিন্তু অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে জানি না। সমাজে ঘটিত অন্যায় যেমন একটা ব্যাধি তেমনি অন্যায়ের প্রতিবাদ না করাও একটা ব্যাধি।

এভাবে সামাজিক ব্যাধির কখা লিখতে গেলে সময় চলে যাবে কিন্তু লেখা শেষ হবে না। তাই আমি শুধু কিছু বিষয় চিহ্নিত করতে চাই এবং সেগুলোর সমাধানটি আপনাদের সামনে উপস্থাপনের আশা রাখি। পূর্বে বলা হয়েছিল অবক্ষয়ের কারণ কিছু ব্যাধি। নৈতিকগুণাবলির অবর্তমানে এই ব্যাধী ছড়ায় এবং সমাজকে গ্রাস করে নেয়। এখন দেখার বিষয় হল, মানুষের মাঝ থেকে এসব নৈতিকতা দূরে চলে যাচ্ছে কেন। কেন মানুষ কদার্যতায় ডুবে যাচ্ছে।

পৃথিবীর ইতিহাসে একটি উজ্জ্বল বাস্তবতা হল, পৃথিবীর এমন কোন সভ্যতা নেই, যা কোন ধর্মের আশ্রয় ছাড়া গড়ে উঠেছে। যারাই ধর্মহীন সমাজ গড়ার চেষ্টা করেছে অজানা আতঙ্কজনক কিছু ব্যাধি তাদের আক্রমণ করেছে। বর্তমান পাশ্চাত্য সভ্যতার কী অধগতি তা আমাদের সামনে একেবারেই স্পষ্ট। পৃথিবীময় যত অশ্লীলতা ও অনাচার এক কথায় তার কেন্দ্রবিন্দু বলা যায় পাশ্চাত্য সভ্যতাকে। বিভিন্ন পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ১৯৭৮ সালে মার্কিন নাগরিকদের শতকরা ৪৯ জনই ছিল মাদকাসক্ত। ১৯৭৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রে দুই লাখ ৫৭ হাজার ১১টা অপরাধ সংঘটিত হয়। ১৯৭৪ সালে নিউ ইয়র্কে এক লাখ ২০ হাজার আটশ ২৯ জন নারীর গর্ভপাতের ঘটনা ঘটে, যার মধ্যে শতকরা ৬৭ জনই অবিবাহিত। এছাড়াও ওই শহরে (নিউ ইয়র্কে) সমকামীর সংখ্যা ১০ লাখ দুই হাজার। ক্যালিফোর্নিয়ার লস এঞ্জেলস বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব পরিসংখ্যান অনুযায়ী তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শতকরা ৮৪ জনই সমকামী। ১৯৬২ সালের আরেক সমীক্ষায় জানা যায় যে, তৎকালীন মার্কিন সেনাবাহিনীতে যেসব যুবকরা সৈনিক হওয়ার জন্য আবেদন করত, তাদের শতকরা ৭.৮৬ জনই সৈনিক হবার উপযুক্ত নয়। কারণ তারা উন্মুক্ত যৌনতায় এতটাই মত্ত ছিল যে, তা তাদের দায়িত্ববোধ কেড়ে নিয়েছিল।

এটা হল আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতার কিছু রুগ্নচিত্র। এটা এজন্যই উল্লেখ করলাম যে, তারা চার্চ নিয়ন্ত্রিত প্রাচীন সভ্যতা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য বিপ্লব করেছিল। স্পেনের চার্চ কর্তৃক পরিচালিত Holy office এর প্রয়োগকৃত বিধান তাদের পছন্দ হত না। তাই তারা চার্চসংস্কৃতিই পরিত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। (চার্চরা Holy office নামক এই তদন্ত-আদালতের মাধ্যমে ধর্মবিরোধীদের শাস্তি প্রয়োগ করত এবং তাদের দমন করত।)

এই ধর্মীয় সভ্যতা থেকে বেরিয়ে আসার পরেই তাদের অধগতি শুরু হয়। ধর্মহীন সংস্কৃতির প্রভাবে তারা এতটাই নিচে নেমে যায় যে, পৃথিবীর আনাচে-কানাকে অসভ্যতার প্রথম সারিতেই পাশ্চাত্য সভ্যতার নাম আসে।

এখন বোঝার বিষয় হল, ধর্মহীন সংস্কৃতি অনৈতিকতার জন্য দায়ী হচ্ছে কেন। কেন ধর্মহীন সভ্যতা সামাজিক অবক্ষয়ের কারণ হচ্ছে।

ধর্ম মানুষকে সুষ্ঠুভাবে জীবন যাপনের জন্য কিছু ছক এঁকে দেয়। এর ভেতরেই মানুষকে চলতে হয়। যখনই মানুষ এর বাইরে যাবে, তাকে ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী শাস্তির মুখোমুখী হতে হবে। এই যে দণ্ডের একটা পিছুটান, এর জন্যই মানুষ অনৈতিক কিছু করবার সাহস করে না। তাছাড়া মানুষ প্রকৃত স্বভাব হল নৈতিকতা। পারিপার্শ্বিক কিছু কারণে অধিকাংশ সময় সেই প্রকৃত স্বভাব পরিবর্তন হয়ে যায়। মানুষ অনৈতিকতায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। ধর্মই এসব পারিপার্শ্বিকতা প্রতিরোধের ব্যবস্থা করে।

পাশ্চাত্য সভ্যতা সেই ধর্মকেই বাদ দিয়ে এখন চরম এক বিপাকে পড়ে গিয়েছে। শহীদ ড. আব্দুল্লাহ আযযামের ভাষায় একে বলা হয়েছে- আত্মিক শূণ্যতা। কারণ ধর্ম মানুষের এমন কিছু আত্মিক ক্ষুধা নিবারণ করে যা অন্য কিছু পারে না। পরবর্তিতে এমনি কিছু ক্ষুধার তাড়নায় পড়ে পাশ্চাত্যের মানুষ সভ্যতার জন্য বস্তুবাদীতার দ্বারস্থ হয়। কিন্তু কিছুই হয়নি তাতে। বরং ক্ষুধা আরও জেঁকে বসেছে। পর্যায়ক্রমে আত্মিক ক্ষুধা তাদেরকে অস্থির করে তুলেছে। এর থেকে পরিত্রান পেতেই তারা মাদকের পথ অবলম্বন করে। নারীর সংস্পর্শে আত্মিক শূণ্যতার বিলুপ্তি খোঁজে। এভাবেই ক্রমান্বয়ে মার্কিন পাশ্চাত্য সভ্যতার আকাশে অনৈতিকতার মেঘ গর্জাতে শুরু করে।

পাশ্চাত্য সমাজব্যবস্থার ভেতরের অবস্থা এখন ভয়ংকর। সামাজিক অবক্ষয়ে ধ্বসে পড়েছে তাদের সভ্যতা। আর এর পেছনে রয়েছে ধর্মহীনতার প্রতি ধাবমান শক্তি।

সভ্যতা ও সামাজিকতা মানেই হল, কিছু রুলস। যা মানুষের মানসকে উৎকর্ষের জন্য প্রয়োগ করা হয়। যারাই এসব রুলসকে অবজ্ঞা করে, তারাই নৈতিক দৈন্যতার শিকার হয়। এর যুক্তিসংগত কারণও আছে। আগেই বলেছিলাম পৃথিবীর কোন সভ্য সমাজ ধর্মহীনতায় গড়ে ওঠেনি। কারণ ধর্ম ছাড়া অন্যকিছুই মানুষের ব্যাপৃত মানস বুঝতে পারে না। ফলে ধর্মহীন মতবাদগুলো কেবল একটি দিক বিবেচনায় জীবনপথ নির্দেশ করে। এতে করে অন্য সকল দিকের ঘাটতি মানুষের মানসে প্রচণ্ড আঘাত হানে। পর্যায়ক্রমে ধ্বসিয়ে দেয় একেকটি সমাজ ও সভ্যতা।

বর্তমানের পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ অর্থনীতিকে সমাজ-সভ্যতার চাবিকাঠি মনে করেছে। ফলে আর্থিক উন্নয়নের কিছু আঁচ পেলেও মানবিক মূল্যবোধের শূণ্যতা আগ্রাসী রূপ পেয়েছে। তাই তো দেখা যায়, ছেলে কোটিপতি হয়েও পিতা-মাতাকে সম্মান করতে পারে না। স্বামী ধনাঢ্য হয়েও পরকীয়া ছাড়তে পারে না। অর্থলোভে পিতাই গোপনে তার সন্তানকে খুন করে দেয়।

বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নিত হয়েছে। কিন্তু দেশের অপরাধ ও অনৈতিকতা কমেনি একটুও। বরং বেড়েছে আর্থিক উন্নতির সাথে পাল্লা দিয়ে। ২০১৫ সালে ধর্ষণের শিকার হয় এক হাজার ৯২ জন নারী ও শিশু। অথচ ২০১৪ সালে এই সংখ্যা ছিল ৬৬৬ জন। অর্থাৎ ৩৫ শতাংশ ধর্ষণ বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি অনৈতিকতার প্রবৃদ্ধিও হচ্ছে সমানতালে। এর একটাই কারণ সমাজ-সভ্যতার চাবিকাঠি ভুলভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে। মানবতাবাদের পরিবর্তে বস্তুবাদকে গ্রহণ করা হচ্ছে।

আমাদের সমাজের অবক্ষয় রোধে নৈতিকতার উৎকর্ষ সাধন একান্ত জরুরী বিষয়। মানুষ মানুষকে ভালবাসবে, সুখে-দুখে তাদের পাশে দাঁড়াবে, প্রত্যেকে একে-অপরের অধিকার নিশ্চিত করবে, কারও উপর অত্যাচার হতে দেখে প্রতিবাদ করবে, অধিনস্তদের ব্যাপারে সচেতন থাকবে; এগুলোই তো মানবতা ও নৈতিকতা!

যদি এ জাতীয় নৈতিক গুণাবলিতে মানুষ সমৃদ্ধ হয়, তবেই কেবল সামাজিক অবক্ষয় রোধ করা সম্ভব। অনৈতিকতার সামাজিক ব্যাধি ছুঁড়ে ফেলতে পারলেই সম্ভব একটি সুশৃঙ্খল সমাজব্যবস্থা। আর এর চেয়েও বড় বিষয় হল, নৈতিকতা কোন মামার বাড়ির কলা-মুড়ি নয় যে, তা এমনি এমনি চলে আসবে। এর জন্য চাই কিছু রুলস, কিছু নীতিমালা এবং একটি আদর্শ জীবনবিধান। পৃথিবীর ইতিহাসে যা দিতে পেরেছে কেবল ধর্ম। আর সঠিকভাবে দিতে পেরেছে কেবল এবং কেবল ইসলাম। সুতরাং সামাজিক অবক্ষয় রোধের একমাত্র সঠিক পথ হল, ধর্মীয় অনুশাসন পরিবার, পরিবেশ ও রাষ্ট্র; তথা সমাজের সর্বক্ষেত্র প্রতিষ্ঠিত করা। এ ছাড়া অন্য কোন পথ ও পন্থা অবক্ষয় বাড়াবে বৈ কমাবে না।

লেখক: শিক্ষার্থী, আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।