Home জাতীয় বিভিন্ন শীর্ষস্থানীয় মাদ্রাসায় বুখারী শরীফের উদ্বোধনী দরস এবং দিক-নির্দেশনামূলক বক্তব্য দিয়েছেন আল্লামা...

বিভিন্ন শীর্ষস্থানীয় মাদ্রাসায় বুখারী শরীফের উদ্বোধনী দরস এবং দিক-নির্দেশনামূলক বক্তব্য দিয়েছেন আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী

গত সোমবার থেকে বিভিন্ন কাওমী মাদ্রাসায় উদ্বোধনী দরস পরিচালনার মাধ্যমে ব্যস্ত সময় পার করছেন জামিয়া মাদানিয়া ঢাকা ও জামিয়া সোবহানিয়া মাহমূদ নগর-এর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় প্রবীণ আলেম ও শায়খুল হাদীস আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী। এসব উদ্বোধনী দরসে তিনি বুখারী শরীফের সবক দেয়া ছাড়াও মাদ্রাসাসমূহের শিক্ষক এবং ছাত্রদের উদ্দেশ্যে পৃথক পৃথক জমায়েতে দিক-নিদের্শনামূলক হিদায়াতী বয়ান পেশ করেন।

শায়খুল হাদীস আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী এসকল মাদ্রাসার উদ্বোধনী দরসে নতুন শিক্ষাবর্ষের ছাত্রদের উদ্দেশ্যে হিদায়াতী বয়ানে বলেন, আপনারা দুনিয়ার সকল লোভলালসা ত্যাগ করে এখানে এসেছেন দ্বীনি ইলম অর্জন করার জন্য। সুতরাং নিয়্যাতকে খালেস করে এবং অন্তরে তাকওয়া ও আল্লাহর ভয় নিয়ে নিজেরা পড়ালেখায় আত্মনিয়োগ করবেন। বক্তব্যে তিনি উলূমে নবুওয়াতের ফযীলত, গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেন।

বয়ানে তিনি ছাত্রদের প্রশংসা করে বলেন, আপনারা দ্বীনের বৃহৎ পরিসরে খেদমত করার মহান লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নিয়েই দুনিয়াবী শিক্ষা ও খ্যাতির মোহকে পরিত্যাগ করে মাদ্রাসা শিক্ষাকে বেছে নিয়েছেন। কিন্তু এই উদ্দেশ্যেকে সফল করতে হলে অবশ্যই আপনাদেরকে পূর্ণ মনোযোগ ও কঠোর অধ্যাবসায়ের সাথে দরসে নিয়মিত হাজির থাকতে হবে এবং দরসের বাইরের সময়গুলোতে গভীর মনোযোগ সহকারে কিতাব মুতালাআ করতে হবে।

তিনি আরও বলেন, মুসলমানদেরকে বিভিন্ন দলে বিভক্ত করার জন্য এবং দ্বীনি বিষয়ে সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরির জন্য ইসলাম নির্মূলবাদি চক্র বহুমুখী ষড়যন্ত্র ও অপতৎপরতায় লিপ্ত রয়েছে। নতুন নতুন নানা ফেরকার উদ্ভব ঘটানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। এসব ফেরকা ও ষড়যন্ত্রের মোকাবেলা করে সফল হতে হলে যোগ্য আলেম হয়ে আপনাদেরকে গড়ে ওঠতে হবে। এই জন্য পবিত্র কুরআন-হাদীস ও ইলমে ফিক্বাহর মৌলিক জ্ঞানসহ অন্যান্য সকল বিষয়েও পারদর্শিতা অর্জন করতে হবে। ইলমে দুর্বলতা থেকে গেলে এটা উপকারের চেয়েও অনেক ক্ষেত্রে ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সুতরাং এ বিষয়ে সকলকে যত্নবান ও সতর্ক থাকতে হবে।

আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী আরো বলেন, সকল তালেবে ইলমকে মাদ্রাসার আভ্যন্তরীণ সকল আইন ও নিয়ম-শৃঙ্খলা কঠোরভাবে মেনে চলতে হবে। এ ব্যাপারে কোন শিথিলতা করা যাবে না। যথারীতি দরসে সকল ছাত্রকে হাজির থাকতে হবে।

আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী ছাত্রদের উদ্দেশ্যে নির্দেশনামূলক বয়ানে আরো বলেন, প্রতিষ্ঠানের উস্তাদ, কর্মকর্তাসহ যিম্মাদারগণের প্রতি সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা ও সম্মান বজায় রেখে আপনাদেরকে চলতে হবে। আপনাদেরকে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা ও চলাফেরায় পারস্পরিক সম্মান ও সৌহার্দ্য বজায় রাখতে হবে। দোকানপাট ও বাজারে ঘোরাফেরা করবেন না এবং কোথাও আড্ডা দেবেন না।

তিনি আরো বলেন, মনে রাখবেন, কুরআন-হাদীস ও ইসলামের মৌলিক ইলম হাসিল করার জন্য আমাদের আকাবির ও পূর্বসূরীগণ সীমাহীন মেহনত-পরিশ্রম ও সাধনা করে গেছেন। নানা বিভ্রান্তি, অপব্যাখ্যা নির্ণয় ও বুঝার যোগ্যতা অর্জন করতে সহীহ ইলমে দ্বীন হাসিল করার জন্য অক্লান্ত মেহনত- পরিশ্রম ও সাধনা করতে হবে। আর ইলম অর্জনের পাশাপাশি এখন থেকেই নিজেদের আমল-আখলাককে সংশোধন করার অনুশীলন শুরু করে দিতে হবে। নিয়মিত জামাতে নামায আদায় করবেন। প্রতিদিন কুরআন তিলাওয়াত করবেন। রাত ১০টার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ে গভীর রাতে ওঠে তাহাজ্জুদ পড়ে ফজরের আগে ১-২ ঘণ্টা কিতাব পড়বেন। চলাফেরার সকল পর্যায়ে সুন্নাতের পাবন্দীর উপর গুরুত্ব দিয়ে চলবেন। এভাবে যদি মেহনত-সাধনা করে এবং মাদরাসার সকল আইন-কানুন মেনে নিজের আদর্শ ও পরিশুদ্ধতা নিয়ে চলতে পারেন, ইনশাআল্লাহ আপনারা পড়াশোনা শেষ করে কওম-মিল্লাতের যোগ্য রাহবার ও খাদেম হয়ে সম্মান-শ্রদ্ধার্জনের সাথে দ্বীনের বহুমুখী কাজ আঞ্জাম দিতে পারবেন।

গত ৪ দিন যেসকল মাদ্রাসায় উদ্বোধনী দরস পরিচালনা করেছেন?

গত ২৫ জুন (সোমবার) শরীয়তপুর কাঠালবাড়ী হক্কানী মাদ্রাসায় নতুন শিক্ষাবর্ষের উদ্বোধনী দরস পরিচালনা করেন। তিনি অন্যান্য কিতাবসহ বুখারী শরীফের দরসদান করেন। এ সময় মাদ্রাসার পরিচালক ও শিক্ষকবৃন্দসহ সকল ছাত্র উপস্থিত ছিলেন।

২৬ জুন (মঙ্গলবার) সকাল ১০টায় নারায়ণগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী জামিয়া আরাবিয়া দারুল উলূম দেওভোগ মাদ্রাসায় বুখারী শরীফের উদ্বোধনী দরস পরিচালনা করেন এবং জামিয়া শিক্ষক ও ছাত্রদের উদ্দেশ্যে পৃথক পৃথকভাবে দিক-নির্দেশনামূলক হিদায়াতী বয়ান পেশ করেন।

একই দিন বাদ মাগরীব নবাবগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী জামিয়া মাহমূদিয়া মাহমূদনগর (টিকরপুর) মাদ্রাসায় বুখারী শরীফের উদ্বোধনী দরস ও হিদায়াতী বয়ান পেশ করেন। এখানে বাদ আছর উলামা সম্মেলনে দিক-নির্দেশনামূলক বয়ান পেশ করেন এবং বাদ মাগরীব জামিয়ার ছাত্রদের উদ্দেশ্যে বিশেষ হিদায়াতী বয়ান পেশ করেন এবং বুখারী শরীফের দরসদান করেন।

২৭ জুন (বুধবার) বাদ ফজর রাজধানী ঐতিহ্যবাহী দারুল কুরআন চৌধুরীপাড়া মাদ্রাসা-ঢাকা’য় নতুন শিক্ষাবর্ষের প্রথম সবক হিসাবে বুখারী শরীফের দরস পরিচালনা করেন এবং বিশেষ হিদায়াতী বয়ান পেশ করেন। এ সময় জামিয়ার পরিচালক মুফতী আবু মূসাসহ অন্যান্য সকল শিক্ষক উপস্থিত ছিলেন।

একই দিন বেলা সাড়ে ১১টায় গাজীপুর জামিয়া রশীদিয়া আরাবিয়া (বিএমটিএফ) মাদ্রাসায় নতুন শিক্ষাবর্ষের উদ্বোধনী দরস হিসেবে বুখারী শরীফের সবক দেন।  এসময় জামিয়ার পরিচালক মাওলানা গোলাম মাওলানা, সহকারী পরিচালক মাওলানা আবু হানীফসহ স্থানীয় উলামায়ে কেরাম ও গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। দরসদান শেষে ছাত্র-শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে তিনি হিদায়াতী বয়ানে বলেন, ছাত্রদেরকে তিনটি কাজের প্রতি বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখতে হবে। এক. কিতাবের ইবারত ভালভাবে পড়তে পারা। দুই. ইবারতের সঠিক অনুবাদ আয়ত্ব করা। তিন. কিতাবের ইবারতের সঠিক মর্মার্থ আত্মস্থ করা। আর উস্তাদগণ ছাত্রদের শুদ্ধ/অশুদ্ধকে সঠিকভাবে তুলে ধরবেন। এছাড়াও উস্তাদগণের কাজ হবে, ছাত্রদেরকে মায়া-মুহাব্বত আর স্নেহ দিয়ে দরসদান করা, কিতাব বুঝতে মনপ্রাণ দিয়ে সাহায্য করা এবং উস্তাদগণের পূর্ণ শিক্ষা ও মেধাকে আন্তরিকভাবে ছাত্রদের পেছনে ব্যয় করা।

এরপর একই দিন বিকেল সাড়ে ৩টায় ঢাকা বসুন্ধরা উম্মাহাতুল মু’মিনীন মহিলা মাদ্রাসায় উদ্বোধনী দরস পরিচালনা ও হিদায়াতী বয়ান পেশ করেন। দরসদান অনুষ্ঠানে মাদ্রাসার মুহতামিম মাওলানা আনোয়ার’সহ সকল উস্তাদবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।

পর্দার আড়ালে থাকা ছাত্রীদেরকে আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী মাইকে বুখারী শরীফের উদ্বোধনী দরস দেন। এরপর ছাত্রীদের উদ্দেশ্যে বিশেষ হিদায়াতী বয়ানে তিনি বলেন, নারীগণ হলেন মায়ের জাতি। একমাত্র ইসলাম ধর্মেই নারীদেরকে সর্বোচ্চ মর্যাদা দেয়া হয়েছে। একটা পরিবারে নারীদের গুরুত্ব অপরিসীম। একটা পরিবারের সুখ-শান্তি অনেকাংশে নারীদের উপর নির্ভর করে। নারী যদি সৎ ও আদর্শবান হয়, সেই পরিবারে আল্লাহর রহমত ও বরকত জারি থাকে এবং সন্তানরা আদর্শবান হয়ে গড়ে ওঠে। তাই নারীদের জন্য দ্বীনি ইলম, উন্নত আখলাক ও সঠিক পারিবারিক জ্ঞান আয়ত্ব করার গুরুত্ব অপরিসীম।

তিনি বলেন, যতদিন ইলমে ওহীর শিক্ষা পৃথিবীতে জারি থাকবে, ততদিন আল্লাহ তাআলা আসমান-যমীনের নেজাম-শৃঙ্খলা ঠিক রাখবেন। সুতরাং ইলমে ওহীর শিক্ষা’র গুরুত্ব ও মর্যাদা অতুলনীয়। নারী-পুরুষ সকলের মধ্যে এই শিক্ষা জারি রাখতে হবে।

২৮ জুন (বৃহস্পতিবার) বাদ ফজর ঢাকা মুগদা’র জামিয়া মাহমূদিয়া ইছহাকিয়া মানিকনগর মাদরাসায় ১৪৩৯/৪০হিজরী নতুন শিক্ষাবর্ষের বুখারী শরীফের উদ্বোধনী দরসদান করেন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম হাদীস বিশারদ, বাংলার মাদানীখ্যাত শায়খুল হাদীস আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী। এ সময় জামিয়ার পরিচালক মাওলানা ইসহাক’সহ অন্যান্য সকল আসাতিজায়ে কেরাম উপস্থিত ছিলেন।

দরসদান শেষে ছাত্রদের উদ্দেশ্যে বিশেষ হিদায়াতী বয়ানে তিনি বলেন, একজন ছাত্রের জন্য ৪টি বিষয় আয়ত্ব করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এক. ইলমে-দ্বীন অর্জন করতে হবে একমাত্র আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির নিয়্যাতে। দুই. ইলম মুতাবেক আমল করার দৃঢ় নিয়্যাত এবং তার বাস্তবায়ন থাকতে হবে। তিন. যেটা শিখবে এবং আত্মস্থ করবে, সেটাকে যার যার সর্বোচ্চ সাধ্য ও সুযোগ মতো দুনিয়ার আনাচে-কানাচে উম্মতের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। চার. যদি আল্লাহ লিখনী শক্তির তাওফীক দান করেন, তাহলে অর্জিত ইলম ও অভিজ্ঞতাকে লিখনীর মাধ্যমে প্রচার-প্রসার করতে হবে।

দরস পরিচালনা ও হিদায়াতী বয়ান শেষে আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী জামিয়া শিক্ষক ও ছাত্রদের নিয়ে বিশেষ দোয়া-মুনাজাত পরিচালনা করেন।