Home ইসলাম আহলে কুরআন: একটি ভ্রান্ত মতবাদের স্বরূপ

আহলে কুরআন: একটি ভ্রান্ত মতবাদের স্বরূপ

।। কাজী হামদুল্লাহ ।।

ভূমিকাঃ ইতিহাসের প্রথম থেকে এ পর্যন্ত ইসলামকে নিয়ে যত ষড়যন্ত্রের জাল বোনা হয়েছে, অন্য কোন মত ও মতবাদ বা ধর্ম হলে নির্ঘাত শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা পড়ত। পৃথিবীর বুক থেকে চিরতরে মুছে যেত তার নাম ও নিশানা। শুধু মহান আল্লাহর বিশেষ কৃপা আছে বলেই টিকে আছে ইসলাম। আশা করি এবং দৃঢ় বিশ্বাস করি যে, এভাবেই কিয়ামত পর্যন্ত তা টিকে থাকবে।

যত হামলা যতভাবে ইসলাম ও মুসলমানদের উপরে হয়েছে, আল্লাহ তা’লা দয়া করে তার চেয়েও বেশি ও শক্তিশালীভাবে তার মোকাবেলা করায় আমাদের মদদ করেছেন।

পবিত্র কুরআনের শব্দে শব্দে আমরা খুঁজে পেয়েছি তাঁর মদদসিক্ত দিক-নির্দেশিকা। যুগে যুগে এমন কিছু মনীষীও মুসলিম মিল্লাতে এসেছেন যাঁরা ইসলামের যথার্থতা জাতির সামনে তুলে ধরেছেন স্বার্থকতার সাথে। কাউকে কালিমা লেপন করতে দেননি এই দীন ও মিল্লাতে।

যুগ-চাহিদার সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন দল ও মত ইসলামকে প্রশ্নবিদ্ধ করার পাঁয়তারা করে আসছে শুরু থেকেই। এদের মধ্যে বিশেষত দু’টি দল রয়েছে। এক দল নিজেদের মুখোশ খুলে সরাসরি ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, অন্য দল ইসলামেরই মুখোশ পরে নামে-বেনামে কাজ করে যাচ্ছে। সব ফিরকার নাম ম্যানশন করা বা তাদের ব্যাখ্যা এখন দেয়ার ইচ্ছে নেই।

আজকের এই লেখাটি শুধু একটি ফিরকার নাম ম্যানশন করার জন্য। এই ফিরকাটি নিজেদের পরিচয় দেয় ‘আহলে কুরআন’ হিসেবে। কিন্তু এদের মৌলিক কোনকিছুই কুরআনের কথার সাথে মেলে না। কুরআন থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন এদের চিন্তাধারা এবং দাবী-দাওয়াগুলো। এর কিছু কারণও অবশ্য আছে।

আল্লামা তাকী উসমানী হাফিজাহুল্লাহ তাঁর দরসে তিরমিযিতে এর বিশদ আলোচনা করেছেন। এই শ্রেণীর লোকগুলো পাশ্চাত্য সংস্কৃতিতে প্রভাবিত হয়ে তা নিজেদের জীবনে বাস্তবায়িত করতে সচেষ্ট। কিন্তু তাদের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে বিশ্বনবীর জীবনসংশ্লিষ্ট হাদিসগুলো। যদি তারা কোনভাবে এই হাদিসকে পথ থেকে সরাতে পারে, তাহলে নিজেদের মনোবাঞ্ছা পূরণে কোন বাঁধা থাকবে না। তাই বিভিন্ন উদ্ভট যুক্তির মাধ্যমে তারা হাদিসকে নাকচ করে দিতে প্রয়াসী হয়। তাদের এসব যুক্তির পেছনে মৌলিক কয়েকটি দাবীকে তারা ফলোআপ হিসেবে নিয়ে।

তাদের মৌলিক প্রশ্ন তিনটা

আল্লামা তাকী উসমানী হাফিজাহুল্লাহ উল্লেখ করেছেন, তাদের তিনটি মৌলিক নীতিমালা রয়েছে। যার মাধ্যমে তারা হাদিসকে অগ্রহণযোগ্য বলে আখ্যায়িত করে। এ তিনটি বিষয়কে সামনে রেখেই তারা সরলমনা মুসলমানদেরকে বিভ্রান্ত করায় লেগে আছে।

এক. আল্লাহ তা’লা নবীকে পাঠিয়েছেন কুরআন পৌছানোর জন্য এবং কুরআন শেখানোর জন্য। সুতরাং حسبنا كتاب الله  আমাদের জন্য কুরআনই যথেষ্ট। কুরআনের অানুগত্য এবং কুরআনী নির্দেশনার অনুসরণ আমাদের জন্য ওয়াজিব। রাসুলের আনুগত্য ও অনুসরণের কোন দরকার নেই। কুরআন ছাড়া অন্য কিছু মানা যাবে না, অন্য কারো ইত্তেবা ও ইতাআত গ্রহণযোগ্য নয়। আর কুরআনকে আল্লাহ পাক সহজ করে দিয়েছেন। যার ঘোষণা তিনি নিজেই দিয়েছেন যে, ولقد يسرنا القرآن ‘আমি কুরআনকে সহজ করে দিয়েছি।’ এজন্য কুরআনের ব্যাখ্যা হিসেবে হাদিসের কোন প্রয়োজন নেই।

দুই. আমাদের কাছে যে হাদিস এসেছে, তা নির্ভরযোগ্য নয়। এত শত বছর পরে এত বিশাল ভাণ্ডার সংরক্ষণ করা অত সহজ নয়। সুতরাং আমাদের কাছে যেসব হাদিস আছে, সেগুলো যে নবীরই হাদিস, এতে অনেক সন্দেহ আছে। সুতরাং এই সন্দেহপূর্ণ হাদিস কখনো জীবনাদর্শ হতে পারে না।

তিন. হাদিস সাহাবাদের জন্য মেনে চলা জরুরী ছিল। আমাদের জন্য তা অনুসরণ করা জরুরী নয়।

এই হল তাদের যতসব দাবীর মূল সূত্র। তারা যেসব কথা মানুষকে বোঝায়, মোটামুটি এই তিনটা বিষয়কে ভিত্তি করেই বোঝায়। হাটহাজারী মাদরাসায় আমাদের উস্তাযে মুহতারাম, আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী বারাকাল্লাহু ফি হায়াতিহির দরস এবং উম্মতের মুখলিস মনীষীদের কিতাবকে সামনে রেখে কুরআন ও হাদিসের আলোকে আমরা হুজ্জিয়াতে হাদিসের কিছু প্রমাণ ও বিশ্লেষণ এবং মুনকিরীনে হাদিসদের কিছু অসারতা আপনাদের সামনে তুলে ধরব ইনশাআল্লাহ।

প্রথম প্রশ্নের জবাব

তথাকথিত আহলে কুরআনদের প্রথম দাবী ছিল-‘ حسبنا كتاب اللهআমাদের জন্য কুরআনই যথেষ্ট। হাদিস মানার কোন প্রয়োজন ও বাধ্যবাধকতা নেই। আমরা শুধুই কিতাবুল্লাহ তথা কুরআনের কথাই মেনে চলব।’ তাদের এই দাবীর দিকে তাকিয়ে আমরা কিছু জবাব পেশ করছি। তারা যেহেতু শুধু কুরআনই মানে তাই তাদের এই প্রথম প্রশ্নের জবাব কুরআন থেকেই পেশ করা হচ্ছে।

পাকিস্তানের আল্লামা ইউসুফ বান্নুরী রহ. তাঁর দরসে বলেন- শুধু কুরআন মানলেই হবে নাকি এর সাথে সাথে হাদিসও মানতে হবে তা যাচাই করতে গিয়ে তিনি পুরো কুরআন মাজিদকে গভীরভাবে অধ্যয়ন করেছেন এবং এ ব্যাপারে ১১০ টি আয়াত বের করতে সক্ষম হয়েছেন। এসব আয়াতে কুরআনের পাশাপাশি রাসুল তথা রাসুলের হাদিসও মানার কথা বলা হয়েছে। কলেবর সংক্ষিপ্ততার দিকে তাকিয়ে এখানে সবগুলো আয়াত তো উপস্থাপন করা সম্ভব নয়। তবে তিনি এবং অন্যান্য মুফাস্সিরিন ও মুহাক্কিকিনের গবেষণা থেকে অল্প কিছু আয়াত নিচে তুলে ধরা হল-

আয়াত-১
وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانتَهُوا ۚ وَاتَّقُوا اللَّهَ ۖ إِنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ
রাসুল তোমাদেরকে যা দেন,তা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেন,তা থেকে বিরত থাক। আর আল্লাহকে ভয় কর, নিশ্চয় আল্লাহ কঠোর শাস্তিদাতা। { সূরা হাশর-৭}

এই আয়াতে ما একটি শব্দ আছে। একে الما للموصولة বলে। যা আয়াতের ব্যাপক অর্থ বোঝানোর জন্য এসেছে। অর্থাৎ রাসুল যা দেন বা নিষেধ করেন তা ব্যাপক। কুরআন এবং হাদিস দু’টোই এখানে শামিল। কেননা এই ما দ্বারা অহির কথা বলা হয়েছে। আর অহি দুই প্রকার। এক. যে অহির শব্দ এবং অর্থ সবই আল্লাহর নির্ধারণকৃত। রাসুল তা শুধু তিলাওয়াত করে শুনিয়ে দেন এবং বুঝিয়ে দেন। দুই. যে অহির অর্থ ও মর্ম আল্লাহ পাক নির্ধারণ করে দেন। তবে শব্দ নির্ধারণের এখতিয়ার থাকে রাসুলের। এই প্রথম প্রকারকে বলে ‘অহিয়ে মাতলু’ যা কুরআন। দ্বিতীয় প্রকারকে বলে ‘অহিয়ে গাইরে মাতলু’। অন্য ভাষায় একেই বলা হয় হাদিস। উল্লেখিত আয়াতে ما ব্যাপক অর্থে হওয়ায় উভয় অহিই আয়াতের অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং এর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, কুরআনের পাশাপাশি হাদিসকেও মানতে হবে। এটা কুরআনেরই একটি হুকুম।

আয়াত-২
قُلْ إِن كُنتُمْ تُحِبُّونَ اللَّهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللَّهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ ۗ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَّحِيمٌ
হে নবী, বলে দিন- যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাস, তাহলে আমাকে অনুসরণ কর। যাতে আল্লাহও তোমাদেরকে ভালবাসেন এবং তোমাদের পাপ মার্জনা করে দেন। আর আল্লাহ হলেন ক্ষমাকারী দয়ালু। {সূরা আলে ইমরান-৩১}

এই আয়াতে বলা হয়েছে, আল্লাহর ভালবাসা পেতে হলে রাসুলের অনুসরণ করতে হবে। জীবনের পাপ মোচন করতে হলে রাসুলের অনুসরণ করতে হবে। আর এ দু’টি জিনিসের মাধ্যমেই মানুষ মুক্তি পাবে। অর্থাৎ ইহকালীন ও পরকালীন মুক্তির জন্য রাসুলের আনুগত্য করার কথা বলেছে স্বয়ং কুরআন। আর রাসুলের আনুগত্য দুইভাবে হয়ে থাকে। অহিয়ে মাতলু’ এবং অহিয়ে গাইরে মাতলু’ দ্বারা। উল্লেখিত আয়াতের ‘ইত্তিবা’ শব্দটি ব্যাপক অর্থে উভয় অহি তথা কুরআন ও হাদিস দু’টোকেই শামিল করে।

তাফসিরে তাবারীতে বলা হয়ে, রাসুলের যুগে কিছু লোক বলতে লাগলো- نحن نحب ربنا আমরা আমাদের রবকে ভালবাসি। তাফসিরে ওয়াজিয এবং তাফসিরে বাগবীতে বলা হয়েছে যে, এই লোকগুলো ছিল কুরাইশের মূর্তিপুজক। আল্লাহর রাসুল যখন তাদেরকে মূর্তিপূজা করতে নিষেধ করলেন, তখন তারা বলতে লাগলো- আমরা আল্লাহকে পাওয়ার জন্যই মূর্তিপূজা করছি। আল্লাহ তা’লা তাদের উদ্দেশ্যে উল্লেখিত আয়াত নাযিল করে জানিয়ে দিলেন যে, আল্লাহকে ভালবাসার আলামত শুধু আল্লাহ আল্লাহ করা নয়, মূর্তিপূজায় লিপ্ত হওয়া নয়। বরং রাসুলের আনুগত্য করাই আল্লাহকে ভালবাসার নিদর্শন। তাবারী এটাই বলেছেন فجعل إتباع نبيه محمد صلى الله عليه وسلم علما لحبه و عذاب من خالفه এ আয়াতের মাধ্যমে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আনুগত্যকে খোদাপ্রেমের নিদর্শন বানানো হয়েছে এবং তাঁর বিরুদ্ধাচারণকে শাস্তির নিদর্শন করা হয়েছে।

আয়াত-৩
لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِمَنْ كَانَ يَرْجُو اللَّهَ وَالْيَوْمَ الْآخِرَ وَذَكَرَ اللَّهَ كَثِيرًا
নিশ্চয় তোমাদের জন্য রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মধ্যে রয়েছে উত্তম অনুপম আদর্শ, যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের আশা রাখে এবং অধিক পরিমাণ আল্লাহকে স্মরণ করে। {সুরা আহযাব-২১}

এই আয়াতের উসওয়ায়ে হাসানা দ্বারাও ওহিয়ে গাইরে মাতলু’ তথা হাদিস অনুসরণের কথা এসেছে। তাফসিরে ইবনে কাছিরে বলা হয়েছে-
هذه الآية الكريمة أصل كبير في التأسي برسول اللّه صلى اللّه عليه وسلم، في أقواله وأفعاله وأحواله
‘এ আয়াত রাসুল আলাইহিস সালামের সমস্ত কথা, কাজ ও অবস্থা অনুসরণযোগ্য হবার একটি বড় প্রমাণ।’

আয়াত-৪
وَمَا يَنْطِقُ عَنِ الْهَوَى  إِنْ هُوَ إِلَّا وَحْيٌ يُوحَى
তিনি নিজের পক্ষ থেকে কোন কথা বলেন না, বরং তিনি তা’ই বলেন, যা আল্লাহ তা’আলা অহির মাধ্যমে জানাতে বলেন। {সুরা নাজম-৩-৪}

এই আয়াতের মধ্যেও যে অহির কথা এসেছে তার অর্থ ব্যাপক। অর্থাৎ অহিয়ে মাতলু’ ও গাইরে মাতলু’ তথা কুরআন ও হাদিস দু’টোই শামিল। এর অর্থ দাঁড়ায় যে, তিনি যা কিছুই বলেন, আল্লাহর ইচ্ছানুযায়ীই বলেন।

এ আয়াতে অহিয়ে গাইরে মাতলু’ তথা হাদিস সম্পর্কে তাফসিরে রাযিতে এসেছে-
{ هو } ضمير معلوم أو ضمير مذكور ؟. نقول : فيه وجهان : أشهرهما : أنه ضمير معلوم وهو القرآن . كأنه يقول : ما القرآن إلا وحي … والوجه الثاني : أنه عائد إلى مذكور ضمناً وهو قول النبي صلى الله عليه وسلم وكلامه . وذلك لأن قوله تعالى : { وَمَا يَنطِقُ عَنِ الهوى } في ضمنه النطق ، وهو كلام وقول ، فكأنه تعالى يقول : وما كلامه وهو نطقه إلا وحي

তাফসিরের সারাংশ অনুবাদ

এই আয়াতে هو সর্বনামটি যমীরে মা’লুম নাকি যমীরে মাযকুর? (সহজ ভাষায় যমীরে মা’লুম হল, যার মারজা’ পূর্বে উল্লেখ নেই তবে জানা আছে। আর যমীরে মাযকুর হল, যার মারজা’ পূর্বে উল্লেখ আছে।) এখানে দু’টি দিকই নেয়া যায়। প্রসিদ্ধতম দিক হল, এটা যমীনে মা’লুম, অর্থাৎ কুরআনুল কারিম। কেমন যেন আল্লাহ পাক বলেছেন  ما القرآن إلا وحي কুরআন অহি ছাড়া অন্য কিছু নয়। দ্বিতীয় দিক হল, এটা যমীরে মাযকুর অর্থাৎ যার মারজা’ পূর্বে অভ্যন্তরীণভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। আর সেটা হল, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথা তথা হাদিস। আর এটা এজন্যই যে, পূর্বের আয়াত  وَمَا يَنطِقُ عَنِ الهوىএর মধ্যে অভ্যন্তরীণভাবে نطق এসেছে, যা কালাম ও কওলের সাথে সম্পৃক্ত। কেমন যেন আল্লাহ বলেছেন, وما كلامه وهو نطقه إلا وحي  ‘তিনি অহি ছাড়া কথাবার্তা বলেন না।’

আয়াত-৫
هُوَ الَّذِي بَعَثَ فِي الْأُمِّيِّينَ رَسُولًا مِنْهُمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَإِنْ كَانُوا مِنْ قَبْلُ لَفِي ضَلَالٍ مُبِينٍ
তিনিই নিরক্ষরদের মধ্য থেকে একজন রাসুল পাঠিয়েছেন, যিনি তাদের কাছে পাঠ করেন তাঁর আয়াতসমূহ, তাদেরকে পবিত্র করেন এবং শিক্ষা দেন কিতাব ও হিকমাত। বস্তুত পূর্বে তারা ছিল ঘোর পথভ্রষ্টতায় লিপ্ত। {সুরা জুমুআ-২}

এই আয়াতে যে হিকমাতের কথা বলা হয়েছে, তাফসিরে কুরতুবিতে এর ব্যাখ্যা করা হচ্ছে-
ويعلمهم الكتاب يعني القرآن والحكمة السنة

‘তিনি কিতাব শিক্ষা দেন মানে কুরআন শিক্ষা দেন। আর হিকমাত বলতে সুন্নাহ তথা হাদিস।’ তাফসিরে তাবারীতেও হিকমাতের অর্থ সুন্নাহ করা হয়েছে। এ ছাড়া আরো অন্যান্য তাফসিরের যেখানে হিকমাত এর তাফসির করা হয়েছে, সব জায়গায় স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, এখানে হিকমাতের অর্থ সুন্নাহ তথা হাদিস।

আয়াতের দিকে লক্ষ করে দেখুন, এখানে নবীজির চারটি দায়িত্বের কথা বলা হয়েছে। এক. উম্মাতকে কুরআন পড়ে শোনাবেন। দুই. তাদের আত্মশুদ্ধি করবেন। তিন. তাদেরকে কুরআন শেখাবেন এবং চার নাম্বারের নববী দায়িত্ব হল, তিনি উম্মতকে হাদিস শিক্ষা দেবেন। এই চার দায়িত্বের কথা কুরআনের আরো কয়েক স্থানে এসেছে। সুতরাং হাদিস অস্বীকার করার মানে হল, কুরআনে প্রদত্ব নবীর চার যিম্মাদারীর একটিকে অস্বীকার করা। যা স্পষ্টত কুরআনকে অস্বীকার করা।

আয়াত-৬
فَلاَ وَرَبِّكَ لاَ يُؤْمِنُونَ حَتَّىَ يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لاَ يَجِدُواْ فِي أَنفُسِهِمْ حَرَجًا مِّمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُواْ تَسْلِيمًا

অতএব, তোমার পালনকর্তার কসম, সে লোকেরা ঈমানদার হবে না, যতক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে তোমাকে ন্যায়বিচারক বলে মনে না করে। অতঃপর তোমার মীমাংসার ব্যাপারে নিজেদের মনে কোন রকম সংকীর্ণতা পাবে না এবং তা হৃষ্টচিত্তে কবুল করে নেবে। [ সুরা নিসা ৪:৬৫ ]

এই আয়াতের তাফসিরে মুফাসসিরিনে কেরাম যে কঠিন কথাগুলো বলেছেন, তা পড়লে আশা করি কেউ শুধু কুরআনের উপরই ক্ষান্ত দেবার কথা না। অবশ্যই সে হাদিসের পেছনে ঘুরঘুর করবে। এই আয়াতে রাসুলের যে ফায়সালার কথা বলা হয়েছে, তা দুইভাবে হয়ে থাকে।

হিয়ে মাতলু’ তথা কুরআন এবং অহিয়ে গাইরে মাতলু’ তথা হাদিস। আয়াতের ব্যাপকতা এ দু’টি জিনিসকেই অন্তর্ভূক্ত করে নেয়। সুতরাং দীন ও দুনিয়ার যাবতীয় বিষয়ে ফায়সালায়ে নববী তথা কুরআন ও হাদিস উভয়টিই মানতে হবে। যারা তা মানবে না, স্বয়ং কুরআনই তাদেরকে মুমিন নয় বলে ঘোষণা করছে। শুধু তাই নয়, কসম দিয়ে আল্লাহ এ ঘোষণা করছেন। তাফসিরে মাআরিফুল কুরআনে বলা হয়েছে, তারা ইসলামের গণ্ডি থেকেই বেরিয়ে যাবে। তারা কাফির হয়ে যাবে।

আয়াত-৭
مَا قَطَعْتُم مِّن لِّينَةٍ أَوْ تَرَكْتُمُوهَا قَائِمَةً عَلَىٰ أُصُولِهَا فَبِإِذْنِ اللَّهِ وَلِيُخْزِيَ الْفَاسِقِينَ
তোমরা যে সব নতুন খেজুর গাছ কেটে ফেলছ অথবা সেগুলোকে তাদের মূলের ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে দিয়েছ। তা তো ছিল আল্লাহর অনুমতিক্রমে এবং যাতে তিনি ফাসিকদের লাঞ্ছিত করতে পারেন। (সুরা হাশর-৫)।

বনু নযীরের ঘটনা

সমস্ত তাফসিরের কিতাবে এই আয়াতের ব্যাখ্যায় একটি ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে। বনু কুরাইযার সাথে যুদ্ধের ঘটনা। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবাদেরকে নিয়ে তাদের সাথে যুদ্ধ করার জন্য গেলেন। যুদ্ধের কারণ ছিল, মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হওয়া। আল্লাহর রাসুল তাদের গোপন ষড়যন্ত্রের কথা জানতে পেরে যখন সাহাবাদের নিয়ে তাদের দূর্গে পৌঁছেন, তখন বনু কুরাইযার ইয়াহুদিরা মুসলিম সেনাবাহিনীর ভয়ে দূর্গের দরজা বন্ধ করে দেয়। মুসলমানরা তাদের অবরোধ করে রাখে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন নির্দেশ জারি করেন যে, তাদের খেজুর গাছগুলো যেন কেটে ফেলা হয় এবং জ্বালিয়ে দেয়া হয়। তাঁর নির্দেশে সাহাবারা খেজুর গাছ কাটা ও জ্বালানো শুরু করেন।

এখানে একটি কথা বলে রাখা দরকার যে, দীনি কোন বৃহৎ স্বার্থে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বার্থ ত্যাগ করতে হয়। বনু কুরাইযার এ ঘটনা তারই প্রমাণ। অনেক সময় বৃহৎ প্রয়োজনে আন্দোলন করতে গেলে ছোটখাট কিছু ক্ষতি আমাদের দেশেও হয়। তবে এটা নতুন কিছু নয়। ইসলামই আমাদের শিখিয়েছে যে, যেখানে দেশ ও জাতির বড় কোন স্বার্থ পাওয়ার উপকরণ থাকবে, প্রয়োজনে সেখানে ছোট কোন সম্মুখীন হতে হবে।

যাই হোক, সাহাবাদের খেজুর গাছ নিধন দেখে বনু কুরাইযার ইয়াহুদিরা বলতে লাগলো- إنك تنهى عن الفساد ، فما بالك تأمر بقطع الأشجار   ‘আপনিই মানুষকে বিপর্যয় সৃষ্টি থেকে নিষেধ করেন, এখন আবার আপনার কী হল যে, আপনি নিজেই বৃক্ষনিধনের আদেশ দিচ্ছেন?’
তাদের এ কথার পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ তা’লা আয়াত নাযিল করলেন যে,  فَبِإِذْنِ اللَّهِ وَلِيُخْزِيَ الْفَاسِقِينَ’এটা আল্লাহরই আদেশ এবং ফাসিকদেরকে লাঞ্ছিত করার জন্য।’

এখানে স্বাভাবিকভাবে একটি প্রশ্ন দেখা দেয় যে, কুরআনের কোথাও তো আল্লাহ পাক খেজুর গাছ কাটার কোন আদেশ দেননি। তাহলে তা আল্লাহ তা’লার আদেশে কেমনে হল?
আল্লামা ইউসুফ বান্নুরী রহিমাহুল্লাহর রেফারেন্স টেনে আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী হাফিজাহুল্লাহ এ প্রশ্নের জবাবে বলেন- আল্লাহর তা’লার যাবতীয় হুকুম দুইভাবে হয়ে থাকে।

এক. অহিয়ে মাতলু’ তথা কুরআনের মাধ্যমে। এখানে হুকুমও আল্লাহর এবং হুকুম প্রদানের শব্দসমূহও স্বয়ং আল্লাহর। দুই. অহিয়ে গাইরে মাতলু’ তথা হাদিসে রাসুলের মাধ্যমে। এখানে হুকুম আল্লাহর এবং ইচ্ছেও আল্লাহর। তবে হুকুম প্রদান ও ইচ্ছে প্রকাশের শব্দগুলো আল্লাহর নয়। বরং রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের।

উল্লেখিত আয়াতেও ঠিক তা-ই হয়েছে। অাল্লাহ পাক রাসুলের আদেশকে স্বীয় আদেশ বলে ব্যক্ত করেছেন। কারণ যদিও নিজস্ব শব্দের মাধ্যমে রাসুল সাহাবাদের আদেশ করেছেন। কিন্তু অবশ্যই এ আদেশ আল্লাহর ইচ্ছানুযায়ীই হয়েছে। তাই আল্লাহ পাক সরাসরি বলেছেন, খেজুর গাছ কাটা মূলত فبإذن الله আল্লাহর আদেশেই হয়েছে। সুতরাং এ আয়াত দ্বারাও প্রমাণ হল যে, হাদিস মানতে হবে। হাদিসও আল্লাহর হুকুমেরই অন্তর্ভূক্ত।

[চলবে]