Home লাইফ স্টাইল পাশ্চাত্যের বৃদ্ধাশ্রম এবং আমাদের প্রিয় মা-বাবা

পাশ্চাত্যের বৃদ্ধাশ্রম এবং আমাদের প্রিয় মা-বাবা

।। কাজী হারুন ।।

যুক্তরাষ্ট্র কানাডাসহ বিশ্বের শিল্পোন্নত দেশসমূহে সন্তানদের বয়স ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার পর মা-বাবা তাদের আর দায়িত্ব নিতে চাননা। তেমনি সন্তানরাও মা-বাবাকে ভুলে থেকে পুরোপুরি স্বাধীন জীবন যাপন করে । এসব সন্তানদের মা-বাবা বৃদ্ধাবস্থায় ( বিশেষ করে ৬৫ হতে ৭০ বছর বয়স পর্যন্ত নিজেরা কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন ) থাকেন old home বা বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রে !

এসব কেন্দ্র কিন্তু যেমন তেমন নয় ! তাঁদের জন্য রয়েছে অত্যন্ত উন্নত মানের আবাসন, পরিপুর্ণ খাবার ও সার্বক্ষণিক Medical ও nursing ব্যবস্থা ! রাষ্ট্রীয় ভাবে এঁদের জন্য জীবনযাপনের সবকিছুই ফ্রী ! ! সাথে হাত খরচার জন্য নির্দিষ্ট মাসিক ভাতা আর পেনশন তো আছেই ! চলাচলের জন্য গাড়ীও ! তাই বৃদ্ধাবস্থায় এঁরা old হোমে থাকতেই বেশি স্বাচ্ছন্দবোধ করেন ।

কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, বছর জুড়ে এঁরা যেমন সন্তান’দের খোঁজখবর তেমন নেন না, তেমনি সন্তান’রাও তাঁদের খোঁজখবর নেয় না বললেই চলে ! ১৩ই মে “মা” দিবসে এসব সন্তান’রা একগুচ্ছ ফুল নিয়ে old হোমে যাবে এবং বলবে “I love you mom”! and “Happy Mother’S day”। অনুরূপ প্রতিবছর জুন মাসের তৃতীয় রবিবারে ওল্ড হোমে একগুচ্ছ ফুল নিয়ে বাবার কাছে গিয়ে বলবে, I love you papa! Happy Father’s Day!

এখানে (আমেরিকায়) ফুলের দোকানসমূহে এসব দিবস কেন্দ্রিক সর্বোচ্চ ব্যবসা হয় ! বছরের দুই-তিন দিন ফুলের ব্যবসা চাঙ্গা ! মা দিবস, বাবা দিবস এবং ভালোবাসা দিবস ! এই দুই/তিন সময়ে থাকে ফুলের চাহিদা তুঙ্গে !

মা ও বাবা’র জন্য নেয়া এই ফুলগুলো যতটুকু সময় তাজা থাকবে ততটুকু সময়ই মা-বাবা’র জন্য ভালবাসা ! আবারো অপেক্ষা, কবে আসবে ১৩ই মে! কবে আসবে জুনের তৃতীয় রবিবার। ফুল নিয়ে যাবে দেখা করতে নিজের গর্ভধারিনী মা এবং জন্মদাতা বাবা’র সাথে !

এখন আসি আমাদের কথায় ! আমরা যাঁরা সারাদিন মা মা করি, বাবা বাবা করি, উঠতে বসতে মা কে ডাকি, বাবাকে ডাকি। সামান্য হোঁচট খেলে অবলীলায় মা’গো বলে চেঁচিয়ে উঠি, স্কূল কলেজ মাদ্রাসা চাকুরী অথবা ঘর থেকে বের হতে বা ব্যাবসার কাজে যেতে মা-বাবার কাছ থেকে দোয়া নিই, একান্তই তাঁদের কথা । আমাদের কি আসলেই আলাদা করে মা দিবস বাবা দিবস পালন করা দরকার?

একটু মাথাব্যথা হলে মায়ের কোলে মাথা রেখে বলি, মা একটা ফুঁ দিয়ে দিন । আহ কি যাদু ! এক ফুঁ’তেই রাজ্যের প্রশান্তি ! ঘরে আসতে সামান্য দেরি হলে মা দোয়া দরুদ পড়তে শুরু করেন, যেন তাঁর প্রাণাধিক প্রিয় সন্তানটির কোন বিপদ আপদ না হয় । মাথাব্যথা বা সামান্য অসুস্থ্য বোধ করলে মা চরম অস্থির হয়ে পড়েন এবং দোয়া-দরূদ যা জানেন তা পড়ে সন্তানের কপালে-শরীরে ফুঁ দিতে থাকেন! তাতে সন্তানের মাথাব্যথা পালিয়ে যায় ।

সন্তানের অসুস্থতায় নিজের অসুস্থতার কথা বেমালুম ভুলে যান যিনি, তিনিই তো আমাদের মা, আমাদের বাবা । দূরে কোথাও সন্তান দুর্ঘটনা বা সমস্যায় পড়লে মা-বাবার মনে জানা হয়ে যায় ! কারণ, সন্তান তাঁদেরই শরীরের অংশ । আমাদের জন্য মা-বাবার মতো দরদমাখা নিঃস্বার্থ ভালবাসা তো আর কারো নেই ! সন্তানের জন্ম হতে নিজের মৃত্যু অবধি মা-বাবা আমাদের জন্যই তাঁদের সকল ত্যাগ স্বীকার করেন ।

সুতরাং জগতের আর কিছু বা কারো ভালবাসার সাথেই মা-বাবার ভালবাসার তুলনা করা যাবে না । মহান সৃষ্টি কর্তার পরেই তো মা-বাবার স্থান, তাঁর উপরে কেউ না ।

ইদানিং শোনা যায়, আমাদের বাংলাদেশেও অনেক বৃদ্ধাশ্রম গড়ে উঠেছে এবং উঠছে ! এগুলো কি আমরা উন্নত হওয়ার কারণে সন্তানদের সময়ের অভাবে, নাকি মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে? অবশ্য যেসব মা-বাবা ঘুষ দুর্নীতি ও বাটপারির টাকায় সন্তানের ভরণ-পোষণ করেন সেসব মা’বাবা রা বৃদ্ধাশ্রমে শেষের দিনগুলো কাটানোর জন্য প্রস্তুত থাকাই উত্তম!

খোঁজ-খবর নিয়ে যে পরিসংখ্যান মিলে, তাতে দেখা যায়- বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় নেয়া মা বাবা’দের বেশিরভাগই অতীতে হয় ঘুষ দুর্নীতি বা যেকোন সামাজিক অন্যায়ের সাথে জড়িত ছিল, না হয় তারা নিজেরাই তাদের মা’বাবার প্রতি যত্নবান হতে পারেননি ! যেসব সন্তান’রা মায়ের সেবা বা খোঁজখবর নেন না, তারা কি মানুষ, না পশু ? আমার চোখে তারা বন্য পশুর চাইতেও নিকৃষ্ট জানোয়ার ! তাদের উপর আল্লাহর গজব অবশ্যম্ভাবী যাদের কারণে তাদের মা বাবা বৃদ্ধাশ্রমে !

যারা মা-বাবাকে হৃদয় থেকে ভালোবাসতে পারে না, তাদের কাছে কিছুই প্রকৃত ভালোবাসার নয়। যাস্ট ভোগের মোহেই তারা বিভোর থাকে। কোথাও তাদের স্বস্তি মিলে না । জীবনটা কাটে দৌড়ের উপর।

শুধু একবার ভাবুন যাঁর উচিলায় আমি এ জগতের সবকিছু উপভোগ করছি তাঁকে কিভাবে দূরে রাখি! এ শিক্ষাই মা বাবার প্রতি সন্তানের পুর্ণ আনুগত্য দিতে পারে ।

দুঃখিত, আমার জন্য আলাদা কোন মা দিবস বা বাবা দিবস বলে কিছু নাই। আমার মা, আমার বাবা প্রতিদিনই প্রতিটিক্ষণে আমার কাছে সমান গুরুত্বের, সমান মর্যাদার। এই মা বাবার সন্তুষ্টি ও সেবাছাড়া তো একজন সন্তান জান্নাতের আশাও করতে পারে না।  আল্লাহ যেন আমাকে এবং আমাদের সবাইকে আমৃত্যু মা ও বাবার সর্বোচ্চ সেবা করার শক্তি ও সামর্থ দান করেন, সেটাই হোক আমাদের একমাত্র চাওয়া ।

আমার মা ও বাবাসহ দুনিয়ার সকল মা-বাবাকে আমার বিনম্র সালাম ও সুভেচ্ছা । সব মায়ের শেষ জীবনের দিনগুলো কাটুক তাঁদের পরম আদরের সন্তানদের নিষ্কন্টক ও নির্মোহ ভালোবাসায়। আর এতে করে আমরা সন্তানরাও আমাদের শেষ বয়সের দিনগুলো এমন ভালবাসায় কাটানোর নৈতিক আশা নিয়ে চলতে পারব। পরম করুণাময় আল্লাহ আমাদের সকলের অন্তরে মা-বাবা’র প্রকৃত ভালবাসা ও গুরুত্ব উপলব্ধিতে নেওয়ার তাওফীক দান করুন। আমীন।।

-কাজী হারুন, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র থেকে।