Home ইসলাম যেভাবে বিশ্বে খ্যাতি লাভ করলেন ভারতীয় নওমুসলিম আলেম

যেভাবে বিশ্বে খ্যাতি লাভ করলেন ভারতীয় নওমুসলিম আলেম

সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ পরিবার থেকে ইসলাম গ্রহণ করে হাদিসশাস্ত্রের গবেষণায় বিশ্বে খ্যাতি লাভ করেন ড. মুহাম্মাদ জিয়াউর রহমান আজমি। ভারতীয় বংশোদ্ভূত বিশ্ববিখ্যাত হাদিস গবেষক সৌদি আরবের মদিনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন। তিনি ছিলেন এক বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনের অধিকারী।

গত বছরের ৩০ জুলাই (৯ জিলহজ) আরাফার দিনে মদিনায় মৃত্যুবরণ করেন এ মহান মনীষী। তাঁর মৃত্যুতে বিশ্বের ইসলামী স্কলাররা গভীর শোক প্রকাশ করেন। হাদিস বিষয়ে তাঁর অবদান অসামান্য। বিশ্বব্যাপী সমাদৃত তাঁর লিখিত গ্রন্থাবলি ইসলামী রচনাসম্ভারে অনবদ্য কর্ম হিসেবে চিরভাস্বর হয়ে থাকবে। 

শৈশবকাল : প্রফেসর ড. জ়িয়াউর রহমান আজ়মি একজন ভারতীয় বংশোদ্ভূত বিশ্ববিখ্যাত পণ্ডিত। ১৯৪৩ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশের আজমগড় জেলার বালরিয়াগঞ্জ গ্রামে এক বিত্তবান হিন্দু ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাঙ্কালাল নাম ছিল তাঁর। তাঁর পিতা ছিলেন আজমগড়ের বিত্তবান ব্যবসায়ী। আজমগড় থেকে কলকাতা পর্যন্ত পৈতৃক ব্যবসা ছড়িয়ে ছিল।

প্রবল ধর্মীয় অনুশাসনের বেড়ে ওঠায় শৈশব থেকেই ধর্ম বিষয়ে খুবই আগ্রহী হন। তাই নিজ উদ্যোগে শুরু করেন ধর্মবিষয়ক পাঠ ও গবেষণা । শায়খ আবুল আলা রচিত ‘দ্বিনে হাকিকত’-এর হিন্দি অনুবাদ পড়ে খুবই প্রভাবিত হন তিন। অতঃপর খাজা হাসান নিজামির হিন্দি ভাষায় রচিত কোরআনের অনুবাদ পাঠ করে মাত্র ১৬ বছর বয়সে ইসলাম গ্রহণ করেন।

ব্রাহ্মণ পরিবার হওয়ায় পরিবার তাঁর মুসলিম হওয়া মেনে নিতে পারেনি। নানা উপায়ে তাঁকে হিন্দু ধর্মে ফিরে আসার আহ্বান জানায়। তাঁকে ফিরিয়ে নিতে তাঁর পিতার সর্বাত্মক চেষ্টা ছিল। কিন্তু সবাই ব্যর্থ হয়। এ সময় তাঁকে নানা রকম সমস্যায় পড়তে হয়।

Renowned Hadith Scholar & Muslim Convert From Hinduism Shaykh Dhiya  Ur-Rahman Azmi Passes Away In Madinah

শিক্ষাজীবন : নিজ বাড়ি ত্যাগ করে বাদায়ুনের একটি মাদরাসায় ভর্তি হয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। অতঃপর উমরাবাদের প্রসিদ্ধ দারুস সালাম মাদরাসায় একাধারে পাঁচ বছর অধ্যয়ন করেন। এখান থেকে আলামিয়্যত ও ফাজ়িলত ডিগ্রি অর্জন করেন।

পড়াশোনার সময় তিনি নিজ বাড়িতে যান। এ সময় অনেক হিন্দু তাঁকে দেখতে আসে। ইসলামের ওপর তাঁর দৃঢ়তা দেখে অনেকে বেশ অবাক হয়। বাড়িতে থাকাকালে ঈদুল ফিতরের নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে শাইখ জিয়াউর রহমান ঈদের নামাজে ইমামতি করেন। ঈদের জামাতে তাঁর কথা শুনতে অনেক হিন্দুও ঈদগাহে সমবেত হয়। একজন নওমুসলিম কিভাবে ঈদের নামাজের ইমাম হলো, তা নিয়েও হিন্দু পড়শিদের বিস্ময়ের সীমা ছিল না। অল্প বয়সে অভূতপূর্ব অগ্রগতি দেখে তাঁর প্রতি নমনীয় হন তাঁর পিতা।

আজমগড়ের শিবলী কলেজ ও উমরাবাদের দারুস সালাম মাদরাসায় পাঠ সম্পন্ন করে উচ্চশিক্ষার জন্য চলে যান সৌদি আরব। ১৯৬৬ সালে সৌদি আরবের ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় মদিনায় স্নাতক সম্পন্ন করেন। মদিনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন তিনি। এ ছাড়া একজন নওমুসলিম হিসেবেও তিনি ছিলেন প্রথম শিক্ষার্থী। স্নাতকেও প্রথম স্থান অধিকার করেন তিনি। পড়াশোনা ও জ্ঞান-গবেষণায় তখন সবার মধ্যে পরিচিত হয়ে ওঠেন তিনি। 

১৯৭০ সালে মক্কার আবদুল আজিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে (বর্তমান উম্মুল কুরা বিশ্ববিদ্যালয়) স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। তাঁর মাস্টার্সের থিসিসের বিষয় ছিল : Abu Huraira in the Light of His Narrations তথা ‘আবু হুরায়রা (রা.)-এর জীবনী ও তাঁর বর্ণিত হাদিস’। এতে তিনি আবু হুরায়রা (রা.) সম্পর্কে প্রাচ্যবিদদের উত্থাপিত নানা প্রশ্নের উত্তর লেখেন। এ সময় তিনি মুসলিম ওয়ার্ল্ড লিগের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। অতঃপর মিসরের বিশ্ববিখ্যাত আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। তাঁর পিএইচডি ডিগ্রির বিষয় ছিল : In Defense of Abu Huraira তথা আবু হুরায়রা (রা)-এর সমর্থনে। 

Shaikh Zia ur Rahman Dies. Born Hindu Brahman, Death as Great Scholar of  Islam | MWJ

কর্মজীবন : বিশ্ব বিখ্যাত মহান এ মনীষীর কর্মজীবন খুবই বর্ণাঢ্য। মক্কায় অবস্থিত রাবেত়া আলম আল ইসলামীর (মুসলিম ওয়ার্ল্ড লিগ) বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। অবশেষে ১৯৭৯ সালে (১৩৯৯ হি.) মদিনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের হাদিস বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে অধ্যাপনার জীবন শুরু করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টরেট থিসিসের নিরীক্ষণ এবং খসড়া তৈরির গুরুত্বপূর্ণ কাজও তিনি সম্পাদন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনা করতে গিয়ে রাষ্ট্রীয় অনুমোদনে সৌদি আরবের নাগরিকত্ব লাভ করেন। 

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি তিনি প্রাচীন পদ্ধতিতেও বিভিন্ন শায়খের সান্নিধ্যে থেকে হাদিস ও শরিয়ার গভীর জ্ঞানার্জন করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য শায়খদের মধ্যে আছেন, সৌদি আরবের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি শায়খ আবদুল্লাহ বিন হামিদ (রহ.), সৌদি আরবের গ্র্যান্ড মুফতি মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শায়খ আবদুল আজিজ বিন বাজ (রহ.) দক্ষিণ ভারতের শায়খুল হাদিস মাওলানা আব্দুল ওয়াজিদ উমরি রহমানি, মাওলানা আবুল বায়ান হাম্মাদ উমরি প্রমুখ।

তিনি নিয়মিত মসজিদে নববিতে সহিহ বোখারি ও স়হিহ় মুসলিমের পাঠদান করতেন। হিন্দি ও আরবি ভাষায় বহু গ্রন্থ রচনা ও সংকলন করেন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণের পর তিনি একাগ্রতার সঙ্গে অধ্যয়ন ও গবেষণাকর্মে যুক্ত থাকেন।

গ্রন্থাবলি : হাদিস বিষয়ে তিনি রচনা করেন অনবদ্য গ্রন্থ। হাদিস বিষয়ে রচিত তাঁর প্রশিদ্ধ গ্রন্থ হলো : ‘জামিউল কামিল ফিল হাদিসিস সহিহ শামিল’। ২০ ভলিউমের এ বিশাল গ্রন্থে তিনি ১৬ হাজার হাদিস সংকলন করেন। এ ছাড়া বিশ্বব্যাপী সমাদৃত গ্রন্থ ‘Quran Encyclopedia’ বা কোরআন বিশ্বকোষ রচনায়ও তাঁর অসামান্য অবদান আছে। এ ছাড়া তাঁর আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ আছে। 

মৃত্যু : গত বৃহস্পতিবার (৩০ জুলাই ৯ জিলহজ) আরাফার দিনে মদিনায় মৃত্যুবরণ করেন বিশ্ববিখ্যাত এ মহান মনীষী। মসজিদে নববিতে জানাজার সমাপ্ত করে তাঁকে জান্নাতুল বাকিতে দাফন করা হয়। সূত্র : মুসলিম ওয়ার্ল্ড জার্নাল।