Home ইসলাম সাতশ বছর আগে সোনারগাঁয়ে যেভাবে হাদিসের পাঠ শুরু হয়েছিল

সাতশ বছর আগে সোনারগাঁয়ে যেভাবে হাদিসের পাঠ শুরু হয়েছিল

আতাউর রহমান খসরু: বাংলাদেশের জ্ঞানচর্চার ইতিহাসে এক গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনা করেছিলেন শায়খ শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা আল-বুখারি আদ-দেহলভি আল-হানাফি (রহ.)। তাঁর হাতেই বাংলার জমিনে স্থাপিত হয় উপমহাদেশের প্রথম হাদিসচর্চা কেন্দ্র। ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলায় শিক্ষাকেন্দ্রটি গড়ে উঠেছিল আনুমানিক ১২৭৮ খ্রিস্টাব্দে। তিনি খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতকে ইন্তেকাল করেন। তাঁর মৃত্যুর পর ধীরে ধীরে জ্ঞানকেন্দ্রটিও বন্ধ হয়ে যায়। ধারণা করা হয়, এরপর দীর্ঘ ৬৫০ বছর সোনারগাঁয় হাদিসের দরস হয়নি। কিন্তু বাঙালি মুসলমানের এই গৌরবময় জ্ঞানপ্রদীপ পুনরায় প্রজ্বলিত করেন শায়খুল হাদিস মাওলানা হাতেম আলী ঢাকুবী। ২০০৬ সালে তিনি সোনারগাঁয় হাদিসের দরস দান শুরু করেন।

শায়খ আবু তাওয়ামা ও তাঁর মাদরাসা : শায়খ আবু তাওয়ামা (রহ.)-এর জন্ম সুদূর আরবভূমিতে। হাদিস, ফিকহসহ অন্যান্য ইসলামী জ্ঞানের পাশাপাশি ভূগোল, গণিত, রসায়ন, যুক্তিবিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন। দিল্লির সুলতান গিয়াসুদ্দিন বলবনের অনুরোধে ১২৭০ খ্রিস্টাব্দ মোতাবেক ৬৬৮ হিজরিতে ইসলাম ও ইসলামী শিক্ষার প্রচার-প্রসারে দিল্লি আগমন করেন তিনি। অতঃপর সুলতান গিয়াসুদ্দিন আজম শাহর অনুরোধে বাংলায় আসেন।

গিয়াসুদ্দিন আজম শাহর সহযোগিতায় তিনি রাজধানী সোনাগাঁয় একটি বৃহৎ মাদরাসা ও সমৃদ্ধ পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করেন। উপমহাদেশের দূর-দূরান্ত থেকে শিক্ষার্থীরা এখানে জ্ঞানার্জনের জন্য ছুটে আসত। একসময় মাদরাসার শিক্ষার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১০ হাজারে। শায়খ শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা দীর্ঘ ২৩ বছর এই সোনারগাঁ মাদরাসায় অধ্যাপনা করেন। শায়খ আবু তাওয়ামা (রহ.) ৭০০ হিজরি মোতাবেক ১৩০০ খ্রিস্টাব্দে সোনারগাঁয় ইন্তেকাল করেন এবং বাংলার মাটিতেই তাঁকে দাফন করা হয়। ধারণা করা হয়, শায়খ শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামার মৃত্যুর পর ক্ষমতার পালাবদল, রাজধানী স্থানান্তর এবং যোগ্য উত্তরসূরির অভাবসহ নানা কারণে তাঁর প্রতিষ্ঠিত জ্ঞানকেন্দ্রের প্রদীপ নিভে যায়।

আরও পড়তে পারেন-

যাঁর উদ্যোগে ৬৫০ বছর পর হাদিসের পাঠদান : মাওলানা হাতেম আলী সোনারগাঁরই একজন কৃতী সন্তান। উপজেলার পরমেশ্বরদী গ্রামে তাঁর জন্ম। তিনি নোয়াখালীর উত্তর হাতিয়ায় অবস্থিত জামিয়া ইসলামিয়া চরকলাকোপায় মেশকাত পর্যন্ত পড়েন। এরপর হাদিসের উচ্চতর পাঠ গ্রহণের জন্য ভারতের বিখ্যাত ইসলামী বিদ্যাপীঠ দারুল উলুম দেওবন্দে যান। সেখানে তিনি শায়খুল ইসলাম আল্লামা সাইয়েদ হুসাইন আহমদ মাদানি (রহ.), মাওলানা ইবরাহিম বেলিয়াভি (রহ.), মাওলানা বশির খান (রহ.), শায়খুল আদব আল্লামা ইজাজ আলী (রহ.)-এর মতো জগদ্বিখ্যাত আলেমের কাছে পাঠ গ্রহণ করেন এবং তাঁদের সান্নিধ্য লাভ করেন। দেওবন্দে তিনি আল্লামা শাহ আহমদ শফী (রহ.)-এর সহপাঠী ছিলেন। আধ্যাত্মিকতার রাস্তায় বরেণ্য মুসলিম মনীষী মোহাম্মদ উল্লাহ হাফেজ্জি হুজুর (রহ.)-এর খিলাফত লাভ করেছেন।

যেভাবে যাত্রা শুরু : মাওলানা হাতেম আলী দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে ফিরে বাংলা ১৩৬৫ হিজরি সনে মায়ের নির্দেশে নিজ গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেন জামিয়া আরাবিয়া ইসলামিয়া (পরমেশ্বরদী মাদরাসা)। এটি শায়খ আবু তাওয়ামা (রহ.)-এর প্রতিষ্ঠিত মাদরাসা থেকে চার মাইল দূরে অবস্থিত। দেশে ফেরার পর মাওলানা হাতেম আলীকে বিভিন্ন স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যোগদানের প্রস্তাব দেওয়া হলেও তিনি নিজ এলাকার দ্বিনি কল্যাণের কথা চিন্তা করে এখানে থেকে গেছেন। এমনকি মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী (রহ.) পরমেশ্বরদীতে উপস্থিত হয়ে তাঁকে জামিয়া কোরআনিয়া লালবাগে হাদিসের দরস প্রদানের প্রস্তাব দেন। এ সময় তিনি বায়তুল মোকাররমে সম্মানজনক পদ প্রদানের ব্যাপারেও আশ্বস্ত করেন। পরমেশ্বরদী মাদরাসা প্রতিষ্ঠার অর্ধশতাব্দীকাল পর ২০০৬ সালে তিনি সেখানে হাদিসের দরস দান শুরু করেন। বর্তমানে মাদরাসাটিতে ৩৫০ জন শিক্ষার্থী এবং ২৪ জন শিক্ষক ও কর্মচারী রয়েছেন।

স্বপ্নে পাওয়া নির্দেশনা : প্রবীণ এই আলেম জানান, মাদরাসা শুরু করার পর একাধিক শিক্ষক তাঁকে মাদরাসায় হাদিসের দরস শুরু করার নির্দেশ দেন। ইচ্ছা থাকার পরও আর্থিক সামর্থ্যের কথা চিন্তা করে তিনি পিছিয়ে আসেন। কিন্তু বারবার নির্দেশনা পাওয়ায় ২০০৬ সালে ‘দাওরায়ে হাদিস’ বা তাকমিল খোলার সিদ্ধান্ত নেন।

হাদিসের পাঠ শুরু করার পর মাওলানা হাতেম আলী আরো বিস্ময়কর এক স্বপ্ন দেখেন। তিনি দেখেন, মাদরাসার মাঠে তাঁর সব শিক্ষক উপস্থিত এবং অসংখ্য সাহাবায়ে কিরাম (রা.)-ও সেখানে এসেছেন। মাঠের এক পাশে এক ব্যক্তিকে দেখে তিনি বললেন, এই ব্যক্তি কি উসমান গনি (রা.)? তাঁকে বলা হলো—হ্যাঁ, তিনি উসমান গনি (রা.)। মাওলানা হাতেম আলীর দাবি, এই স্বপ্নের পর মাদরাসার আর্থিক অবস্থার উন্নতি হয়েছে। সে সময় থেকে ভবন নির্মাণ শুরু হয় এবং মাদরাসা শিক্ষকদের বেতনাদি পরিশোধেও এখন আর বেগ পেতে হয় না। তিনি মনে করেন, এটা হাদিসের পাঠদানেরই বরকত।

শায়খুল হাদিস মাওলানা হাতেম আলী ঢাকুবীর বয়স এখন ৯২ বছর। আল্লাহর কাছে তাঁর প্রার্থনা, সোনারগাঁয় আর কখনো যেন হাদিসের পাঠ বন্ধ না হয়। একইভাবে পুরো পৃথিবীর হাদিসের দরসগুলো যেন কিয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।

উম্মাহ২৪ডটকম: আইএএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।