Home ফিকহ ও মাসায়েল প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষের বিবাহ্ সম্পর্কে শরয়ী বিধান

প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষের বিবাহ্ সম্পর্কে শরয়ী বিধান

।। মুফতিয়ে আযম আল্লামা আবদুচ্ছালাম চাটগামী ।।

দ্বীনের অতন্দ্র প্রহরী সম্মানিত উলামা সমাজ নিম্নের মাসআলাটির ব্যাপারে শরীয়তের দৃষ্টিভঙ্গি জানতে চাচ্ছি!

মাসআলাঃ আপনারা হয়তো অবগত আছেন যে, অতি সাম্প্রতিক কালে লাহোর হাইকোর্ট, জনৈকা প্রাপ্ত বয়স্কার নিজ সম্মতিতে অনুষ্ঠেয় বিবাহকে অবৈধ ঘোষণা দিয়েছে। এবং কোর্ট ব্যাঞ্চ এ-মর্মে ফায়সালা দিয়েছে যে, কোন মহিলা সুস্থ জ্ঞান সম্পন্ন ও প্রাপ্তবয়স্কা হলেও স্বীয় অভিভাবকের অনুমতি ব্যতিত নিজেকে পাত্রস্ত করতে পারবে না। যদি কেউ এমনটি করে, তাহলে ঐ বিয়ে অবৈধ এবং বাতিল বলে বিবেচিত হবে।

প্রশ্ন হল- কিছু কিছু ছেলে-মেয়ে মাতা-পিতার অসম্মতি ক্রমে সগোত্রীয় অপর ছেলে ও মেয়ের সাথে কোর্ট ম্যারেজ করে দাম্পত্য জীবন-যাপন করছে। আর কারো কারো এমনটি করার ইচ্ছা এখনো আছে। অথচ বংশের কলংকের কারণে মাতা-পিতা চায় না এমন ভাবে তাদের ছেলে-মেয়ের মাঝে বিয়ে সংঘটিত হোক। তবে সে দম্পতি জুটির মাঝে দ্বন্ধ কলহ বা মনোমালিন্য থাকে না। তারা একে অপরকে চায়। কিন্তু লাহোর কোর্ট কর্তৃক সাম্প্রতিক কালে দেয়া ফায়সালার পরে এসব দম্পতি কিংকর্তব্য বিমূঢ়তার শিকার।

আমাদের কিছু শিক্ষিত বন্ধু-বান্ধব, যারা দ্বীনের কাজে ব্রত আছেন তাদের ধারণা হল যে, এ মাসআলাটি কুরআন হাদীস সম্পর্কিত বিধায় এ ব্যাপারে আলেম-উলামা ও মুফ্তীয়ানের কেরামের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। তাই আমরা হযরতের দ্বারস্থ হলাম। এ ব্যাপারে আমরা ধারাবাহিক কিছু প্রশ্নের অবতারণা করে এগুলোর উত্তর কামনা করছি। এর আগে যারা মাতা-পিতার অনুমতি ব্যতীত সগোত্রে অথবা অপর গোত্রে বিবাহের সম্পর্ক স্থাপন করেছে এবং তাদের সন্তানাদি নাতী-নাতনী ইত্যাদিও হতে চলেছে, তাদের ব্যাপারেই বা শরীয়তের হুকুম কী হবে? তারও বিশ্লেষণ কামনা করছি।

(ক) সুস্থ জ্ঞান সম্পন্ন প্রাপ্ত বয়স্কা যদি স্বীয় অভিভাবকের অনুমতি ব্যতিত কোথাও বিয়ে করে, তাহলে সেটা বৈধ হবে কি না? এ ব্যাপারে কুরআন, হাদীস এবং ফিক্হে ইসলামীর আলোকে নির্দেশনা জানিয়ে বাধিত করবেন।

(খ) অনেক সময় দেখা যায় যে, অনেক প্রাপ্ত বয়স্ক এবং শিক্ষিত মহিলা, যাদের বয়স বিশ-ত্রিশের কোটা অতিক্রম করতে চলছে। উপযুক্ত পাত্র না পাওয়ার কারণে অথবা পাত্র মাতা-পিতার মনমত না হওয়ার কারণে বিয়ে দেয়া ছাড়াই তাদের ঘরে ফেলে রাখা হয় এবং এ ভাবেই তাদের যৌবন কাল অতিবাহিত হয়ে যায়। এ-ধরণের মহিলারা কি স্বীয় অভিভাবকের অনুমতি ব্যতিত নিজ গোত্রে বা অন্য গোত্রে অথবা সহকর্মী কিংবা স্বধর্মী এবং অর্থ-সম্পদের সামঞ্জশ্যশীল কিংবা সাধারণ ঊনিশ-বিশ পরিবারের কোন ছেলের সাথে বিয়েতে আবদ্ধ হতে পারবে? যদি না পারে তাহলে তাদের ব্যাপারে শরীয়তের দৃষ্টিভঙ্গি কি হবে- জানালে কৃতার্থ হব।

(গ) কোন কোন সময় সর্বদিক বিবেচনায় উপযুক্ত পাত্র পাওয়া যায় না বরং কিছু ক্ষেত্রে বরাবর আর কিছু কিছু ক্ষেত্রে ঊনিশ-বিশ হয়ে থাকে। তবে খাটি মুসলমান নামায-রোযার পাবন্দ হয়ে মধ্যম ও সম্ভ্রান্ত্র পরিবারের শিক্ষিত পাত্র হয়। এ পরিস্থিতিতে উঁচু বংশের কোন মেয়ে কি স্বেচ্ছায় এ ধরণের কোন পাত্রকে বিয়ে করতে পারবে? আর যদি না পারে, তাহলে কি সে গোটা জীবন এ-ভাবেই কাটিয়ে দিবে। এ-ব্যাপারে শরীয়তের দৃষ্টিভঙ্গি কি- জানিয়ে কৃতার্থ করবেন।

(ঘ) আমাদের দেশে বিভিন্ন গোত্রের লোক বাস করে। যেমন পাঠান, পাঞ্জাবী, হিন্দুস্তানী, সিন্ধী, বেলোচী প্রভৃতি। এসব গোত্রের মাঝে আবার ব্যবসা-বাণিজ্য, কাজ-কারবার, ধর্ম-বর্ণ, রাজনীতি, সামাজিক আচার-আচরণ ইত্যাদি বিষয়ে সমঝোতাও রয়েছে। এসব গোত্রের ছেলে মেয়েরা কি পরস্পর স্বেচ্ছায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে? যদি তাদের অভিভাবকগণ এতে সম্মত না থাকেন।

(ঙ) শরীয়তে বিয়ের জন্যে সমকক্ষতাকে আবশ্যকীয় গণ্য করা হয়। এ ব্যাপারে শরয়ী সীমারেখা কতটুকু জানালে উপকৃত হব।

(চ) যে সব মেয়ের বিশেষ কোন অভিভাবক নেই অথবা অভিভাবক বদদ্বীন বা মেয়ের বিয়ের প্রতি অসচেতন। মেয়েরা প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার পরেও ব্যক্তিগত স্বার্থের দরুন তাদের বিয়ে শুধু পিছিয়েই চলছে। শরীয়তে এর সমাধান কী হবে? উক্ত মেয়েরা কি স্বেচ্ছায় স্বধর্মী, সহকর্মী এবং সাধারণ কোন পাত্রের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে? আশা করি উক্ত সমস্যা সমূহের সমাধান কুরআন হাদীসের আলোকে জানিয়ে কৃতার্থ করবেন। যাতে করে আমরা সঠিক পদক্ষেপ নিতে সক্ষম হই।

বিনীত- কতিপয় গুণগ্রাহি
সীপারী পার্কের সন্নিকট, পাকিস্তান। ৫ জানুয়ারি ১৯৯৭।

সমাধানঃ হামদ ও সালাতের পর জনাব সমাধান প্রার্থী প্রশ্ন-পত্রে এমন কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সমাধান চেয়েছেন, যেগুলো ব্যাখ্যা সাপেক্ষ। তদুপরি যে অবস্থায় এবং আদালত কর্তৃক প্রদত্ত যে ফায়সালার বরাত দিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়েছে। এর দিকে লক্ষ্য করলে এসব মাসআলার সঠিক সমাধান কুরআন হাদীসের আলোকে তুলে ধরা প্রত্যেক কুরআন-হাদীস ও ফিকাহ শাস্ত্রের বুৎপত্তিশীল ব্যক্তিদের জন্যে একান্ত জরুরী হয়ে পড়ে। এতে সমাজ ও আদালতের প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে কোন শরয়ী ফায়সালা থেকে সাধারণ মুসলমানদেরকে বঞ্চিত করা প্রথমতঃ দ্বীনের ব্যাপারে চরম উদাসিনতার বহিঃপ্রকাশ।

দ্বিতীয়তঃ তা হককে গোপন করার নামান্তর। তাছাড়া আদালতের পরস্পর বিরোধী ফায়সালার কারণে সাধারণ এবং কোন কোন বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের মাঝেও অস্থিরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সুতরাং এ পরিস্থিতিটাও দূর করা একান্ত জরুরী। যাতে করে অত্যন্ত প্রাঞ্জল ও সহজ সরল ভাষায় এসব প্রশ্নের সমাধান বিশদ ও প্রামাণ্য করে তুলে ধরা যায়। যেহেতু সমাধান প্রার্থীরা সে আদালত কর্তৃক প্রদত্ত রায়ের কোন অনুলিপি অথবা সংবাদপত্রের কোন কার্টিং ইত্যাদি কিছুই পাঠাননি, এজন্যে আদালতের রায়ের ব্যাপারে কোন মন্তব্য করা থেকে আমরা বিরত থাকব। কেবল মূল মাসআলার সঠিক সমাধান পেশ করা হবে। আশা করি গবেষণা মূলক বিশদ আলোচনার মাধ্যমে অনেক সন্দেহ সংশয়ের নিরসন হয়ে যাবে। আর তা মাসআলার সমাধানের জন্যে যথেষ্ট প্রমাণিত হবে।

প্রকাশ থাকে যে, ইসলাম আগমনের পূর্বে মহিলাদের কোন মর্যাদাই ছিল না। গৃহের সামগ্রীর মত তাদের ব্যবহার করা হতো। বিয়ে-শাদীতে তাদের কোন স্বাধীনতা ছিল না। মাতা-পিতার ভূ-সম্পত্তিতে ও অন্যান্য আসবাবপত্রে তাদের কোন অধিকার ছিল না (হতে পারে তার কল্পনাও করা হতো না) অন্য সব মাল-সম্পদের ন্যায় মহিলাদেরকেও উত্তরাধিকারী সূত্রে বন্টন করা হতো। বিভিন্ন ধরণের জুলুম, অত্যাচার আর নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হতো তারা। মোট কথা, তাদের সাথে মানব সূলভ কোন আচরণ (প্রদর্শন) করা হতো না।

যখন ইসলাম নামের স্বর্ণযুগের প্রভাত রবি উদিত হল, তখন আল্লাহ তা’আলা ওহী তথা কুরআন হাদীসের মাধ্যমে তাদেরকে তাদের সেই মানব মর্যাদা ফিরিয়ে দিলেন, যা তাদেরকে সৃষ্টির প্রথম দিন থেকেই দান করা হয়ে ছিল।

আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন- “যিনি তা থেকে তার স্ত্রী সৃষ্ট করেন- “হে মানব! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় কর, যিনি তোমাদেরকে এক ব্যক্তি হতেই সৃষ্টি করেছেন ও যিনি তা হতে তার সংগিনী সৃষ্টি করেন, যিনি তাদের দুই জন হতে বহু নর-নারী ছড়িয়ে দেন”। (সূরা নিসা-১ আয়াত)।

এবং গোটা কুরআন হাদীসে দ্বীনের সব হুকুম আহকাম যেমন- ঈমান, আকিদা, ইবাদত, জিহাদ, লেন-দেন, আচার-আচরণ এবং বিচার আচারের সমস্ত বিধি-বর্ণনায় পুরুষদের যেভাবে সম্বোধন করা হয়েছে, তেমনি ভাবে মুসলিম রমণীদেরকেও করা হয়েছে।

সূরা নিসা, সূরা আহযাব, সূরা বাক্বারা, সূরা মু’মিনুন, সূরা তালাক্ব প্রভৃতি সূরার আয়াত সমূহ এ ব্যপারে সুস্পষ্ট প্রমাণ বহন করে।

মোট কথা, দ্বীন ইসলামে তথা কুরআন হাদীসে যেভাবে পুরুষদের জন্যে হুকুম আহকাম প্রদান করা হয়েছে অনুরূপ মহিলাদের জন্যেও প্রদান করা হয়েছে। যেভাবে মহিলাদের উপর পুরুষদের অধিকারের কথা বর্ণনা করা হয়েছে অনুরূপ পুরুষদের উপরও মহিলাদের কিছু অধিকারের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে- “নারীদের তেমন তেমনিই ন্যায় সংগত অধিকার আছে। যেমন তাদের উপর পুরুষদের মার্যাদা আছে, আল্লাহ্ মহাপরক্রমশালী প্রজ্ঞাময়।”

ব্যাখ্যাঃ অর্থাৎ একথা চিরন্তন সত্য যে, মহিলাদের উপর যেমন পুরুষদের অধিকার রয়েছে তেমনি তাদের উপরও মহিলাদের ন্যায়সংগত অধিকার রয়েছে, যা আদায় করা প্রত্যেকের উপর জরুরী। সুতরাং মহিলাদের সাথে সব ধরণের অনাকাংখিত আচরণ এবং অধিকার হরণ পুরুষদের জন্য নিষিদ্ধ। কিন্তু এ বাস্তবতার পরও পুরুষরা মহিলাদের উপর শ্রেষ্ঠতের অধিকারী। এ জন্যেই ইদ্দত পালনের অন্তর্বর্তীকালে বিবাহকে পুনর্বহাল করার অধিকার একমাত্র পুরুষদের দেয়া হয়েছে। কিছু কিছু সৃষ্টিগত বিষয়ে আল্লাহ তা’আলা মহিলাদেরকে দুর্বল বানিয়েছেন এবং পুরুষদেরকে তাদের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। সুতরাং এ-সব দৃষ্টে আল্লাহ তা’আলা পুরুষদেরকে মহিলাদের উপর অভিভাবক এবং পৃষ্ঠপোষক হিসেবে নির্ধারণ করে দিয়েছেন।

আরও পড়তে পারেন-

যেমন এ-ব্যাপারে তিনি ইরশাদ করেন- “পুরুষ নারীর কর্তা, কারণ আল্লাহ্ তাদের এককে অপরের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন এবং এ জন্য যে, পুরুষ তাদের ধন-সম্পদ ব্যায় করে”।

পুরুষদেরকে মহিলাদের উপর কর্তৃত্বশীল বানানোর অর্থ কখনোই এ-নয় যে, মহিলাদের উপর অহেতুক জুলুম নির্যাতন বৈধ করা হয়েছে এবং তাদের ন্যায্য অধিকার ও কর্ম স্বাধীনতার লাগামকে একেবারেই টেনে ধরা হয়েছে, বরং এ কর্তৃত্বের একমাত্র উদ্দেশ্য হল মহিলাদের অধিকারের পূর্ণ সংরক্ষণ করা এবং তাদের বৈধ কোন অধিকার যেন ভন্ডুল হতে না পারে সেদিকে বিশেষ ভাবে লক্ষ্য রাখা এবং মহিলাদের সৃষ্টিগত ও অভ্যাসগত দুর্বলতাগুলো প্রতিকার করা।

আর তারা যেন তাদের শারীরিক কাঠামোগত দুর্বলতার কারণে এবং দুর্বল সামর্থের ভিত্তিতে কোন শরীয়ত পরিপন্থী ও ন্যায় বিরোধী কর্মে লিপ্ত হয়ে তাদের শারীরিক ও মানবীয় অধিকারকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে না পারে।

এ জন্যেই কোন ব্যক্তি, চাই তিনি বাপ-দাদাই হোন না কেন, তার আওতাধীন কোন প্রাপ্তবয়স্কা মহিলাকে কারো সাথে বিয়ে বসতে বাধ্য করতে পারবে না। তার স্বাধীন সত্তায় অবৈধ হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। যদি কোন অভিভাবক স্বীয় কোন সুস্থজ্ঞান সম্পন্ন ও প্রাপ্তবয়স্ক মেয়েকে কারো সাথে জোরপূর্বক বিয়ে দিয়ে দেয়, তাহলে সে বিয়ের বৈধতা উক্ত মেয়ের অনুমতির উপর নির্ভর করবে। বিবাহের মজলিশে যদি মেয়ে অনুমোদন প্রদান করে, তাহলে উক্ত বিয়ে শরীয়তের দৃষ্টিতে বৈধ বলে বিবেচিত হবে। অন্যথায় তা অবৈধ বলে পরিগণিত হবে।

তেমনিভাবে যদি কোন অভিভাবক স্বীয় কোন প্রাপ্ত বয়স্ক মেয়ের ব্যক্তিগত সহায়-সম্পত্তিতে বিশেষ প্রয়োজন ব্যতিত, অবৈধ হস্তক্ষেপ করে, তাহলে সে অপরাধী এবং গুনাহগার সাব্যস্ত হবে।

অনুরূপ ভাবে স্বামীকর্তৃক তালাক প্রাপ্ত হয়ে কোন মেয়ে-লোক যখন ইদ্দত সমাপ্ত করে নেয়, তখন সে আর পরাধীন থাকে না, বরং সে তখন নিজের ব্যাপারে স্বাধীন সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার লাভ করে। সে চাইলে তখন কারো সাথে বিয়ে বসতে পারে, আর চাইলে নাও বসতে পারে। এটা নিতান্তই তার ইচ্ছাধীন ব্যাপার। তার অভিভাবকের কোন অধিকার নেই যে, তাকে জোরপূর্বক কারো সাথে বিয়ে দিয়ে দিবে বা কোথাও বিয়ে বসতে চাইলে তাকে সে বারণ করবে। অনুরূপ ভাবে তারা উত্তরাধিকারের বিষয়ে একচ্ছত্র ইচ্ছা ও স্বাধীনতার অধিকারী। তারা চাইলে তাদের অংশ সংগ্রহ করে বিক্রিও করে দিতে পারে অথবা কাউকে হেবাও করে দিতে পারে। আর ইচ্ছা করলে তা দান-সদকা করে দিতে পারে অথবা তা সংগ্রহ না করে অপর কোন ওয়ারিশকে দিয়ে দিতে পারে।

মোট কথা, সুস্থ জ্ঞান সম্পন্ন ও প্রাপ্ত বয়স্কা মহিলা স্বীয় সত্ত্বা ও সম্পদের ব্যাপারে সম্পূর্ণ ভাবে স্বাধীন ও সয়ং সম্পূর্ণ। মহিলাদেরকে তাদের অভিভাবকরা কেবল যে সব দিকে তাদের লাভ-ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে সেদিকে পথ-নির্দেশনা করতে পারবে। কিন্তু কোন ব্যাপারে জোর জবরদস্তি করা সম্পূর্ণ রূপে নিষিদ্ধ। মানবসভ্যতাও তাই দাবি করে। কারণ পুরুষদের ন্যায় মহিলারাও মানব। এবং মানবাধিকারের মাঝে উভয় শ্রেণীই বরাবর।

কিন্তু এতদসত্ত্বেও একটি বাস্তব সম্মত কথা, যা আমাদেরকে স্বীকার করতেই হবে এবং যাকে কুরআন হাদীস, এমনকি জ্ঞান-বিজ্ঞানও সমর্থন করে, তাহল এই যে, মহিলারা পুরুষদের মোকাবিলায় দূর্বল এবং অপরিপক্ক বুদ্ধি সম্পন্ন। তাই মহান রাব্বুল আ’লামিন তাদের এ দুর্বলতা ও অপরিপক্কতাকে কাটিয়ে উঠার জন্যে পুরুষদেরকে তাদের উপর তত্ত্বাবধায়ক নির্ধারণ করে দিয়েছেন। যদি পুরুষদের তত্ত্বাবধান থেকে তাদেরকে সম্পূর্ণ স্বাধীন করে দেয়া হয়, তাহলে চাক্ষুষ প্রমাণাদিও অভিজ্ঞতার আলোকে এ-কথা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট যে, তা মানব সমাজের জন্য মারাত্মক একটি ব্যাধি ছাড়া আর কিছু হবে না। যাতে নানাবিধ বিপর্যয়, খুনাখুনি আর বিচিত্র ফিতনা-ফ্যাসাদের দার উন্মুক্ত হওয়া ছাড়া আর কিছুই হবে না। এজন্যে আল্লাহ তা’আলা তার অপার অনুগ্রহে মহিলাদের যাবতীয় অধিকার বর্ণনা দেয়ার পর তাদেরকে একেবারে বল্গাহীন ছেড়ে দেননি বরং তাদের উপর পুরুষদেরকে কর্তা ও তত্ত্বাবধায়ক করে দিয়েছেন। যাতে করে তাদেরকে সম্ভাব্য অনিয়ম তাšিকতা ও বিশৃংখলা থেকে বিরত রাখা যায় এবং তাদের দ্বারা সংঘটিত নানাবিধ সম্ভাব্য ক্ষতি থেকে তাদেরকে এবং গোটা সমাজকে হেফাজত করা যায়। সংক্ষিপ্ত এ-মুখবন্ধের পর এবার আসুন আমরা মাসআলা সমূহের সমাধানে ব্রতী হই।

সামাধান-১: প্রথম প্রশ্ন এবং তার অংশ চতুষ্টয়ের সারমর্ম হল এই যে, সুস্থজ্ঞান সম্পন্ন ও প্রাপ্তবয়স্কা মহিলা সেচ্ছা প্রণোদিত হয়ে সমকক্ষ কোন পরিবারে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে কিনা? এ-ব্যাপারটি কুরআন হাদীসের আলোকে কিছুটা বিশদ ব্যাখ্যার দাবি রাখে। যার বিস্তারিত বর্ণনা ইনশাআল্লাহ সামনে আসছে। এখানে ইসলামের সোনালী তিন যুগের আইনজ্ঞদের মতবাদ ও গবেষণা তুলে ধরে তার দলিল প্রমাণ সমূহকে কুরআন-হাদীস থেকে তুলে ধরার প্রয়াস পাচ্ছি। এতে আলোচ্য মাসআলা সম্পর্কে একটি সুস্পষ্ট ও পরিপূর্ণ ধারণা লাভ হবে।

ইমাম চতুষ্টয়ের মাযহাব

ক) ইমাম মালেক, ইমাম শাফেয়ী এবং ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.) বলেন: মহিলারা যদিও পূর্ণ বয়স্কা ও সুস্থজ্ঞান সম্পন্না হয়, তবুও তারা কাউকে বিয়ে দিতে বা নিজে কোথাও বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে না। বরং তাদের বিয়ের অধিকার অভিভাবকের উপর ন্যাস্ত: অভিভাবক বলতে এখানে বাপ-দাদা বা অন্যান্য নিকটাÍীয়দেরকে বুঝানো হয়েছে। যাদের আলোচনা ফিক্বাহ গ্রন্থাদিতে করা হয়েছে। তবে প্রাপ্তবয়স্কা ও সুস্থ জ্ঞান সম্পন্না কোন পাত্রীর পূর্ণ সম্মতিও এ ক্ষেত্রে অপরিহার্য; যদিও বিবাহদাতা পাত্রীর বাপ-দাদা হয়।

উদাহারণ স্বরূপ কোন অভিভাবক কোন প্রাপ্তবয়স্কা ও সুস্থ জ্ঞান সম্পন্না মেয়েকে তার সম্মতি ব্যতিত বিয়ে দিয়ে দিল, তাহলে এ-বিয়ে তার অনুমতির উপর নির্ভরশীল থাকবে। বিয়ের সংবাদ পাওয়ার পর যদি পাত্রী পূর্ণ সম্মতি প্রকাশ করে, তাহলে সে বিয়ে বৈধ বলে বিবেচিত হবে। আর যদি সে তা প্রত্যাখ্যান করে, তাহলে সে বিয়ে অবৈধ বলে পরিগণিত হবে।

খ) ইমাম আবু হানিফা, সুফিয়ান সাওরী, ইমাম আবু ইউসুফ এবং ইমাম মুহাম্মদ (রাহ্.) প্রমুখের মতে স্বাধীন ও সুস্থ জ্ঞান-বুদ্ধি সম্পন্ন কোন প্রাপ্ত বয়স্কা মহিলা স্বীয় অভিভাবকের অনুমতি ব্যতিত তার সমকক্ষ কোন পরিবারে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারেব। চাই সে বিবাহিতা হোক কিংবা কুমারী, তালাক প্রাপ্তা হোক বা বিধবা। তবে অভিভাবককের পূর্ণ তত্ত্বাবধানেও মধ্যস্থতায় এবং তার পূর্ণ সম্মতিতে কোথাও বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া উত্তম এবং তা সুন্নাত সম্মত পদ্ধতি। কিন্তু যদি কোন কারণ বশতঃ এমনটি সম্ভব না হয় এবং কোন প্রাপ্তবয়স্কা ও সুস্থ জ্ঞান সম্পন্না মহিলা অভিভাবকের অনুমতি ব্যতিত নিজের সমকক্ষ কোন পরিবারে বিশেষ কোন দুনিয়াবী বা আধ্যাত্মিক কারণে বিয়ে করে নেয়, তাহলে সেই বিয়ে শরীয়তের দৃষ্টিতে বৈধ বলে বিবেচিত হবে।

এ সময় অভিভাবকের উচিত হল, উক্ত বিয়ের ব্যাপারে বিরোধিতা না করে একাত্মতা ঘোষণা করা এবং বিয়ের অনুমোদন দিয়ে দেয়া। মেয়ের ভুলের কারণে বিষয়টিকে ঘোলাটে করা আদৌ সমিচীন হবে না। কারণ শরীয়তের দৃষ্টিতে এসব ক্ষেত্রে মূলতঃ অভিভাবকের আপত্তির কিছু থাকে না। সুতরাং এ রকম করার দ্বারা কোন ফায়দা তো নেই-ই বরং এ-বিয়েকে রফা দফা করতে গেলে অনেক সময় দেখা যায় যে, দু’পরিবারের মাঝে যে বৈবাহিক সম্পর্কটি গড়ে উঠেছে, তাতে শরীয়ত সম্মত কোন কারণ ছাড়া অহেতুক বৈরিতা সৃষ্টি হয়। নানাবিধ বিপর্যয়ও অনাকাংখিত ঘটনার উদ্ভব হয়।

আর এ ধরণের বিয়ে সম্পন্ন হয়ে যাওয়ার কারণ এটাই যে, বিবাহ শাদীর প্রকৃত অধিকারী মহিলারাই, সে হিসেবে ধরে নিতে হবে যে, উক্ত মহিলা কোন বিশেষ কারণে নিজের বৈধ অধিকার প্রয়োগ করেছে মাত্র। আর অভিভাবকের যে অভিভাবকত্ব রয়েছে তা অপেক্ষাকৃত দূর্বল থাকে বলেই এমন হয়। সুতরাং কোন নারী সমকক্ষ পরিবারে বিয়ে করলে তাতে অভিভাবকের আপত্তি উত্থাপন বা বিয়ে ভেঙ্গে দেয়ার কোন অধিকার থাকে না।

তবে উক্ত মহিলা যেহেতু একটি মুস্তাহাব কাজ অর্থাৎ স্বীয় অভিভাবকের অভিভাবকত্বের প্রতি কোন ভ্রূক্ষেপই করেনি, এজন্য এধরণের বিয়েকে সমাজ ও শরীয়তে একটি অপছন্দনীয় কাজ বলে অভিহিত করা হয়েছে এবং এটাকে লজ্জাও শালীনতা বিবর্জিত কাজ বলে গণ্য করা হয়েছে। এতদ্ সত্ত্বেও এ-ধরণের বিয়েতে পাত্র-পাত্রীর উপর বৈবাহিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে এবং তাদের উপর বিবাহের হুকুম আহ্কাম বাস্তবায়ন করা জরুরী হবে। অতঃপর যদি তাদের (স্বামী-স্ত্রীর) কেউ এ-বিয়ে ভেঙ্গে দিতে চায়, তাহলে ছেলে হলে স্ত্রীকে তালাক দিতে হবে। আর মেয়ে হলে স্বামী থেকে খুলা’ এর মাধ্যমে ছাড়া-ছাড়ির ব্যবস্থা করতে হবে। এ-তে স্বামী যদি তালাক বা খুলা কোনটাতেই সম্মত না হয়, তাহলে আদালতে বিয়ে ভঙ্গের যুক্তি সঙ্গত কারণ দর্শীয়ে তা দলিল প্রমাণের মাধ্যমে সমাধান করতে হবে। এছাড়া বিবাহ বিচ্ছেদ সম্ভব হবে না। [চলবে]

– আল্লামা মুফতি আব্দুচ্ছালাম চাটগামী, মুফতিয়ে আযম বাংলাদেশ এবং পরিচালনা পরিষদের প্রধান, জামিয়া আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম-হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।