Home ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন যায়েদ বিন সাবেত (রাযি.)এর কুরআন সংকলন পদ্ধতি এবং অতুলনীয় সতর্কতা!

যায়েদ বিন সাবেত (রাযি.)এর কুরআন সংকলন পদ্ধতি এবং অতুলনীয় সতর্কতা!

।। মুফতি আবু সাঈদ ।।

ওহী লেখক হযরত যায়েদ বিন সাবেত (রাযি.), তিনি হলেন ওহী লিখনীতে প্রথম সারির একজন বিচক্ষণ ব্যক্তি, প্রবল ধী-শক্তির অধিকারী একজন হাফেজে কুরআন।

তাঁর পক্ষে নিজের মুখস্থ থেকে কুরআন লেখা মোটেও অসম্ভব ছিলো না। তা ছাড়া শত সহস্র কুরআনের হাফেজদের ঐক্যবদ্ধে কুরআন সংকলন করা তেমন কঠিন বিষয় ছিল না। কিংবা নববী যুগের প্রস্তুতকৃত সেই পাণ্ডুলিপি সামনে রেখে তার অনুলিপি প্রস্তুত করে নেওয়াও সহজসাধ্য বিষয় ছিল। কিন্তু না! তিনি তাঁর দায়িত্ববোধে আস্থা ও সতর্কতার সীমাহীন প্রজ্ঞার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। সতর্কতা ও ধৈর্যের পরীক্ষায় তিনি সফলতার সাথে উত্তীর্ণ হয়েছেন।

কুরআনের কোন আয়াত লেখার পূর্বে সেটি মুতাওয়াতির অর্থাৎ ধারাবাহিক শুদ্ধসূত্রে বর্ণিত কি না, এটি যাচাইয়ের জন্য লিখিত ও মৌখিক প্রমাণ তালাশ করতেন। আর আয়াতটি মুতাওয়াতির হওয়ার ওপর মৌখিক ও লিখিত প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত সেটিকে ঐ পাণ্ডুলিপিতে লিখতেন না।

এছাড়াও কুরআনের যে সকল আয়াত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ তত্ত্বাবধানে লিখিয়ে ছিলেন, সেগুলো বিভিন্ন সাহাবাদের নিকট সংরক্ষিত ছিল। হযরত যায়েদ সেগুলোও একত্র করলেন। যাতে নতুন সংকলন তৈরিতে সাহায্য পাওয়া যায়।

ব্যাপক ঘোষণা করা হলো- “যার কাছে কুরআনের যে অংশ সংগৃহীত রয়েছে, তা হযরত যায়েদের নিকট পৌঁছে দিবেন।”

ঘোষণা শুনে সাহাবায়ে কেরাম নিজেদের সংগৃহীত অংশগুলো হযরত যায়েদের কাছে নিয়ে আসতে আরম্ভ করলেন। তিনি সেগুলোকে চার পদ্ধতিতে যাচাই করতেন-

এক. প্রথমধাপে আপন স্মৃতিশক্তি ও ধী-শক্তির রশ্মিতে আনীত অংশটির সত্যায়ন করতেন।

দুই. হযরত উমর রাযিয়াল্লাহু আনহুও কুরআনকে বক্ষে ধারণ করে হাফেজে কুরআনের সম্মান অর্জন করেছিলেন। বর্ণনাতে পাওয়া যায়, ইসলামের প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর রাযি. হযরত উমর রাযি.-কেও হযরত যায়েদের সাথে কুরআন সংকলনের কাজে তার অনুসন্ধান-সঙ্গী বানিয়েছিলেন। যার ফলে কেউ কোন আয়াত নিয়ে আসলে এই দুই মহান ব্যক্তি যৌথভাবে তা উসূল করতেন এবং নিরিক্ষণ করতেন।

তিন. সাথে সাথে সাক্ষী হিসেবে দুই ন্যায়বান ব্যক্তির পক্ষ থেকে এ কথার স্বীকারোক্তি অপরিহার্য ছিল যে, “এই আয়াত নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল।” (ফাতহুল বারী- ৯/১৯ পৃষ্ঠা)।

আরও পড়তে পারেন-

চার. সবশেষে তাদের সংকলিত অংশগুলোকে একাধিক সাহাবা কর্তৃক তৈরিকৃত ছোট ছোট পাণ্ডুলিপির সাথে সাথে মিলিয়েও দেখা হত। (মাআরিফুল কুরআন- ১/৩৯)।

সারকথা, ইসলামী ভূখণ্ডের প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর (রাযি.)এর জীবদ্দশাতেই হযরত যায়েদ বিন সাবেত অত্যন্ত সতর্কতা ও বিচক্ষণতার সাথে, সুবিন্যস্ত আকারে কুরআনের এক পাণ্ডুলিপিটি তৈরি করেন।

চতুর্দিকে দৃষ্টি রেখে চূড়ান্ত সাবধানতা অবলম্বন করে কুরআন একত্রীকরণের কাজ বাস্তবায়ন হয়। তবে তা ছিল কাগজের ছোট ছোট পুস্তিকাকারে। প্রত্যেকটি সূরা পৃথক পাণ্ডুলিপিতে লিপিবদ্ধ ছিল। ফলশ্রুতিতে দেখা গেছে, কুরআনের সেই পাণ্ডুলিপিটি বহু পুস্তিকার আকার ধারণ করেছে। পরিভাষায় এই কপিকে ‘উম্ম’ (মূল) বলা হয়ে থাকে।

কুরআনের উক্ত কপির কতিপয় বৈশিষ্ট্য

১. কুরআনের সেই পা-ুলিপিতে আয়াতের বিন্যাস নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাতানো বিন্যাসে বিন্যস্ত ছিল। কিন্তু সূরাগুলো বিন্যস্ত ছিল না। সেখানে প্রত্যেক সূরা পৃথক পৃথক লিখিত ছিল।

২. সেই পাণ্ডুলিপিটি সাত হরফের কেরাতবিশিষ্ট ছিল।

৩. তাতে সেই আয়াতগুলোও লেখা হয়েছিল, যেগুলোর পাঠ মানসুখ তথা রহিত হয়ে গেছে।

৪. ঐ পাণ্ডুলিপি প্রস্তুতকরণের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল, যাতে একটি সুবিন্যস্ত ‘নুসখা’ (কপি) সমস্ত উম্মতের সত্যায়নের ভিত্তিতে তৈরি হয়ে যায় এবং প্রয়োজনের সময় মানুষ তার শরণাপন্ন হতে পারে।

হযরত আবু বকর (রাযি.)এর নির্দেশে তৈরিকৃত কুরআনের পাণ্ডুলিপিটি তাঁর জীবদ্দশায় নিজের কাছেই রেখেছিলেন। তার পরপারে পাড়ি জমানোর পর থেকে সেটি হযরত উমর রাযি. এর নিকট ছিল। তিনি শাহাদাতের অমৃত সুধাপানের পর সেই পাণ্ডুপিটি উম্মুল মু’মিনীন হযরত হাফসা রাযি. এর নিকট হস্তান্তর করা হয়।

আম্মাজান হযরত হাফসা (রাযি.)এর ইন্তেকালের পর সেই পাণ্ডুলিপিটি মারওয়ান ইবনে হাকামের হস্তগত হলে তিনি তা জ্বালিয়ে দিলেন। কারণ, এতদিনের অবসরে হযরত উসমান রাযি. এর কুরআনের ঐতিহাসিক সেই পাণ্ডুলিপিটি প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিল। (এর আলোচনা সামনে আসবে)।

উম্মত এ কথার ওপর একতাবদ্ধ হয়ে গিয়েছিল যে, লেখার পদ্ধতি এবং সূরাগুলোর বিন্যাসের ক্ষেত্রে একমাত্র উসমানী কপিগুলোর অনুসরণ জরুরি ও অত্যাবশ্যক।
তাই মারওয়ান ইবনে হাকাম ভাবলেন, হযরত উসমানের সংকলিত পাণ্ডুলিপির বর্তমানে অন্যকোন পাণ্ডুলিপি না থাকা চাই। (মাআরিফুল কুরআন- ১/৪০)।

– মুফতি আবু সাঈদ, সিনিয়র শিক্ষক- আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম। খতীব- বারীয়া জামে মসজিদ, চট্টগ্রাম।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।