Home ইসলাম ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ নামাযের গুরুত্ব ও তাৎপর্য

ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ নামাযের গুরুত্ব ও তাৎপর্য

- ফাইল ছবি।

।। শায়খুল হাদীস আল্লামা শেখ আহমদ ।।

আল্লাহ তাআলা ও তাঁর রাসূল (সা.)এর উপর বিশ্বাস স্থাপন এবং তাওহীদ ও রিসালাতের উপর সাক্ষ্যদানের পর একজন মুসলমানের অন্যতম প্রধান কর্তব্য হলো নামায পড়া। নামায আল্লাহ তাআলার একটি বিশেষ ইবাদত। দৈনিক পাঁচ বার এ নামায আদায় করতে হয়। পবিত্র কুরআনের অসংখ্য আয়াত এবং মহানবী (সা.)এর অগণিত হাদীসে নামায সম্পর্কে গভীরভাবে তাকীদ ও গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।

নামায ইসলামের মূল স্তম্ভ ও বুনিয়াদ রূপে বিবেচিত। কিন্তু আমরা যদি আমাদের সমাজের দিকে দৃষ্টি প্রদান করি, তাহলে দেখতে পাব, আমাদের সমাজ এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ উদাসীন। অমুসলিমদের কথা বাদই দিলাম, যারা মুসলমান, যারা ঈমান এনেছে মহান আল্লাহ তাআলার প্রতি, যারা পড়েছে কালেমায়ে তাওহীদ- লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্, যারা নিজেদেরকে দাবী করে ঈমানদার বা মুসলমান বলে; তাদেরই একটি বিরাট অংশে নামাযের ব্যাপারে সীমাহীন অলসতা, অবহেলা, উদাসীনতা ও গুরুত্বহীনতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে প্রকটভাবে। মনে হয় যেন নামায একটি ঐচ্ছিক বিষয়। মনে চাইলে পড়ব, আর না চাইলে পড়ব না।

অনেকে শুধু বছরে দুই ঈদের নামায পড়ে থাকেন। অনেকে শুধু সপ্তাহে একদিন জুম্আর নামায আদায় করেন। আবার অনেকে দৈনিক পড়লেও এক ওয়াক্ত পড়লে আরেক ওয়াক্ত পড়েন না।

আর যারা নিয়মিত নামায পড়েন, তাদেরও অনেকের নামাযের মধ্যে একনিষ্ঠতা, একাগ্রতা ও খুশুখুযু নেই।

আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের খাস রহ্মত শামিলে-হাল হলে বক্ষমান নিবন্ধে নামাযের গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কে সংক্ষিপ্তভাবে আলোকপাত করতে প্রয়াস পাবো ইনশাআল্লাহ।

নামাযের অর্থ

নামাযকে আরবীতে সালাত বলা হয়। শব্দ বিশ্লেষণে ‘সালাত’কে যদি ‘সাল্লা’ ধাতু থেকে নির্গত ধরা হয়, তাহলে অর্থ হবে কোন বাঁকা কাঠকে আগুনের তাপ বা সেঁকা দিয়ে সোজা করা।

আর যেহেতু নফ্সে আম্মারা’র কারণে মানুষের মনেও বক্রতা, গোয়ার্তুমি ও টেড়্যাপনি সৃষ্টি হয় এবং নামায দ্বারা আল্লাহর বড়ত্ব ও ভয় সৃষ্টি হয়ে তার তাপ বা উষ্ণতায় সে বক্রতা দর হয়ে যায় এবং আগুনের তাপে সোজা হওয়া কাঠের মতই সোজা হয়ে যায়, তাই নামাযকে সালাত বা নামায বলা হয়।

যেমন পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, “নিশ্চয় নামায সর্বপ্রকার অশ্লীল ও গর্হিত কাজ থেকে বিরত রাখে।” (সূরা আনকাবূত, ৪৫ আয়াত)।

অর্থাৎ, নামায সকল অন্যায়, মন্দ বা পাপাচার থেকে ফিরিয়ে রেখে মানুষকে মনুষ্যত্বের গণ্ডির ভিতর প্রবেশ করায় এবং তাকে ঐ কাঠের মত সোজা করে দেয়।

আর সালাতকে যদি ‘সিলাতুন’ ধাতু থেকে নির্গত ধরা হয়, তাহলে অর্থ হবে সম্পর্ক স্থাপন করা। এক্ষেত্রে নামাযকে সালাত এই জন্য বলা হয় যে, এই ইবাদত দ্বারা মাওলায়ে কারীম এবং বান্দার মাঝে একটি বিশেষ ধরনের সম্পর্ক স্থাপিত হয়, যে সম্পর্ক অন্য কোন ইবাদত দ্বারা অর্জিত হয় না।

যেমন, প্রিয়নবী হযরত রাসূলে কারীম (সা.) ইরশাদ করেছেন- “নামায হলো মু’মিনদের জন্য মি’রাজ স্বরূপ।”

আর যে ব্যক্তি মাওলার সাথে সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমকেই অবলম্বন না করবে, সে মুসলমান হবে কি করে?

রাসূলুল্লাহ্ (সা.) ইরশাদ করেছেন- “ইসলাম ও কুফ্রের মাঝে পার্থক্য হলো নামায।” অন্যত্র ইরশাদ করেনঃ “প্রতিটি জিনিসেরই একটি চিহ্ন থাকে। আর ঈমানের একটি বিশেষ চিহ্ন হলো নামায।”

নামায এত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত কেন?

প্রথম কারণঃ ইসলামের অন্যান্য সকল ফরয বিষয় যেমন, হজ্ব, যাকাত, রোযা ইত্যাদি ফরয করা হয়েছে এই যমীনে। আর নামায শুধু আসমানেই ফরয হয়নি বরং আরশে ইলাহীতে রাব্বুল আলামীনের বিশেষ উপস্থিতিতে তাঁর সামনে ফরয করা হয়েছে। এজন্যই নামাযের উপর যতটুকু গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, ততটুকু গুরুত্ব অন্য কোন ইবাদতের বেলায় দেওয়া হয়নি এবং কুরআন ও হাদীস নামাযের জন্য যত তাকীদ দেওয়া হয়েছে অন্য কোন ইবাদত সম্পর্কে তত তাকীদ দেওয়া হয়নি।

দ্বিতীয় কারণঃ বান্দা যখন নামাযের নিয়্যাত বেঁধে নামাযে দাঁড়িয়ে যায়, তখন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর সামনে উপস্থিত হয়ে যান। কোন অভাগা নামাযী যদি নামাযের মধ্যে তার খেয়াল অন্য দিকে ফিরিয়ে রাখে, তাহলে মাওলায়ে কারীম বলেনঃ হে বান্দা! আমি তোমার সামনে উপস্থিত। অথচ তুমি আমার দিকে খেয়াল করছ না। আমার চেয়ে কোন উত্তম জিনিস তোমার দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না-কি? যার কারণে আমাকে ছেড়ে সেদিকেই মনোনিবেশ করেছো?

তৃতীয় কারণঃ (ক) বান্দা নামাযে দাঁড়িয়ে “আল্লাহু আকবার” বলে যখন নিয়্যাত বাঁধে, তখন অবস্থা এমন হয় যে, একদিকে তাকবীর শেষ হয়, অন্যদিকে নামাযীর সকল পাপ মোচন হয়ে সে সদ্যপ্রসূত সন্তানের মত নিস্পাপ ও পবিত্র হয়ে যায়। (খ) নামাযী “সুবহানাকাল্লাহুম্মা” পড়ে যখন “আঊযুবিল্লাহ্” পড়ে, তখন তার প্রতিটি পশমের পরিবর্তে একটি করে সাওয়াব লেখা হয়। (গ) “আলহামদু” পড়ার কারণে একটি হজ্ব ও একটি উমরার সাওয়াব তাঁকে দেওয়া হয়। (ঘ) সকল আসমানী গ্রন্থ পাঠ করলে যে পরিমাণ সাওয়াব পাওয়া যায়, নামাযী রুকু এবং “সুবহানা রাব্বিয়াল আযীম” পড়ার দ্বারা সে পরিমাণ সাওয়াব প্রাপ্ত হয়। (ঙ) “সামিআল্লাহু লিমান হামিদাহ্” পড়লে আল্লাহ বান্দার প্রতি রহ্মতের দৃষ্টিতে তাকান। (চ) সিজদা করার কারণে বান্দাকে সমস্ত মানব-দানবের সংখ্যা পরিমাণ সাওয়াব দেওয়া হয়। (ছ) সিজদায় গিয়ে “সুবহানা রাব্বিয়াল আ’লা” পড়লে একজন গোলাম আযাদ করার সাওয়াব পাওয়া যায়। (জ) বান্দা নামায শেষে যখন সালাম ফেরায়, তখন তার জন্য জান্নাতের আটটি দরজাই খুলে দেওয়া হয়। যে দরজা দিয়ে ইচ্ছা সে দরজা দিয়েই প্রবেশ করতে পারবে।

চতুর্থ কারণঃ হযরত হাসান বসরী (রাহ্.) বলেনঃ নামাযীকে তিনটি বিশেষ সম্মানে ভূষিত করা হয়। একঃ বান্দা যখন নামাযে দাঁড়ায়, তখন তার মাথা থেকে নিয়ে আসমান পর্যন্ত একটি পথ সৃষ্টি হয় এবং সে পথে বৃষ্টির মত অবিরত তার উপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হতে থাকে। দুইঃ ফেরেশ্তারা নামাযীর চতুর্পার্শ্বে একত্রিত হয়ে তাকে তাঁদের পরিবেষ্টনে নিয়ে নেয়। তিনঃ নামাযীকে উদ্দেশ্য করে একজন ফেরেশ্তা ডেকে ডেকে বলেন- হে নামাযী! তুমি যদি জান যে, তুমি কার সামনে দাঁড়িয়েছ এবং কার সাথে কথা বলছ, আল্লাহর ক্বসম! তাহলে তুমি ক্বিয়ামত পর্যন্ত হলেও নামাযের সালাম ফেরাতে না। নামাযরত অবস্থাতেই তুমি মরে যেতে। তোমার এ নামায কখনও শেষ হত না।

পঞ্চম কারণঃ ক্বিয়ামতের দিন নামাযীদেরকে যখন জান্নাতে প্রবেশের নির্দেশ দেওয়া হবে, তখন সর্বপ্রথম এমন একটি দল জান্নাতে প্রবেশ করবে যাদের চেহারা সূর্যের মত উজ্জ্বল হবে। ফেরেশ্তারা তাদের জিজ্ঞেস করবেন, তোমরা কারা এবং দুনিয়াতে তোমরা কি আমল করতে? জবাবে তারা বলবে, আমরা সর্বদা পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের সময় হওয়ার পূর্বেই মসজিদে এসে বসে থাকতাম।

অতঃপর অপর একটি দল পুলসিরাত পার হয়ে জান্নাতে প্রবেশ করবে। তাঁদের চেহারা পূর্ণিমার চাঁদের মত জ্যোতির্ময় হবে। ফেরেশ্তারা জিজ্ঞেস করবেন, তোমরা কারা এবং দুনিয়াতে তোমরা কি আমল করতে? জবাবে তারা বলবে, আমরা নামাযের হিফাযতকারী মুসলমান। ফেরেশ্তারা আবার জিজ্ঞেস করবেন, তোমরা কিভাবে নামাযের হিফাযত করতে? তারা বলবে, আমরা আযানের পূর্বেই অযূ করে বসে থাকতাম। আযান হলেই মসজিদে গিয়ে নামায পড়তাম।

আরও পড়তে পারেন-

অতঃপর অন্য একটি দল জান্নাতে প্রবেশ করবে, যাদের চেহারা হবে তারকার মত উজ্জ্বল। তাদেরকেও ফেরেশ্তারা জিজ্ঞেস করবেন, তোমরা কারা এবং দুনিয়াতে কি আমল ছিল তোমাদের? তারা বলবে, আমরা আযান শুনে অযূ করতাম এবং সাথে সাথেই মসজিদে চলে যেতাম। আর আমরা তাকবীরে উলার প্রতি বিশেষ যত্নবান ছিলাম।

ষষ্ঠ কারণঃ হযরত আলী (রাযি.) বলেন, (১) নামায আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জনের সবচেয়ে বড় মাধ্যম। (২) নামায ফেরেশ্তাদের ভালবাসার উসীলা। (৩) নামায পূর্ববর্তী নবীগণের তরীকা। (৪) নামায মা’রিফাতে ইলাহীর মশাল। (৫) নামায হলো ইসলামের ভিত্তি। (৬) নামায দোয়া কবুল হওয়ার কারণ। (৭) নামায ছাড়া কোন ভাল কাজ কবুল হয় না। (৮) নামায দ্বারা জীবিকায় বরকত হয়। (৯) নামায নফ্স ও শয়তানের সাথে মুকাবেলা করার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। (১০) মৃত্যুর সময় নামায ফেরেশ্তাদের কাছে নামাযীর জান আসানীর সাথে কব্জ করার জন্য সুপারিশ করবে। (১১) নামায মু’মিনের অন্তরের নর। (১২) নামায কবর আলোকিত হওয়ার কারণ। (১৩) কবরে মৃত ব্যক্তির পক্ষ হয়ে মুনকার-নাকীরের প্রশ্নের জবাব দেবে নামায। (১৪) নামায কবরে ক্বিয়ামত পর্যন্ত মৃত ব্যক্তির প্রতি সহানুভূতিশীল ও তার সাথী হয়ে থাকবে। (১৫) ক্বিয়ামতের দিন নামায নামাযীকে ছায়া দান করবে। (১৬) নামায নামাযীর মাথার মুকুট ও গায়ের পোশাক হবে। (১৭) ক্বিয়ামতের অন্ধকারে নামায মশাল হয়ে নামাযীর আগে আগে চলবে। (১৮) হিসাব কিতাবের সময় নামায জাহান্নামের দেয়াল হয়ে দাঁড়াবে। (১৯) আল্লাহর সামনে নামায বান্দাকে ক্ষমা করে দেওয়ার জন্য ঝগড়া করবে। (২০) নামাযের ওজন সমস্ত গুনাহ্ থেকে বেশী হয়ে যাবে। (২১) পুলসিরাতে নামায পাসপোর্টের কাজ করবে। (২২) নামায জান্নাতের চাবি হয়ে তার বন্ধ দরজাকে খুলে নামাযীকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে।

নামায পরিত্যাগ করার পরিণাম

পবিত্র হাদীসের আলোকে জানা যায় যে, মহানবী (সা.) নামায না পড়াকে কুফরী এবং কাফিরদের নীতি বলে আখ্যা দিয়েছেন। তিনি ইরশাদ করেন, “যে ব্যক্তি নামায পড়েনা, দ্বীন ইসলামে তার কোন অংশ নেই।”

সহীহ্ মুসলিম শরীফের হাদীসে বর্ণিত আছে যে, ইসলাম ও কুফরীর মাঝে ব্যবধান হল নামায। অর্থাৎ কোন মানুষ যদি নামায পরিত্যাগ করে তাহলে কার্যতঃ সে কাফির দলের সঙ্গে মিশে গেল এবং তার এ কাজটি কাফিরদের কাজের মতই হল। অপর একটি হাদীসে আছে- “ইসলামে সে ব্যক্তির জন্য কোন অংশ নেই যে নামায পড়ে না।”

নামায যে কত বড় সম্পদ এবং কত বড় সৌভাগ্যের বিষয়, আর নামায না পড়া যে কত বড় ক্ষতি ও দুর্ভাগ্যের বিষয়; তা ভালভাবে অনুধাবন করার জন্য প্রিয়নবী (সা.)এর নিুোক্ত হাদীসটির প্রতি লক্ষ্য করুন।

একদা রাসূল (সা.) নামায পড়ার প্রতি গুরুত্বারোপ করে ইরশাদ করেনঃ “যে ব্যক্তি যথাযথভাবে নিয়মিত নামায আদায় করবে, ক্বিয়ামত দিবসে তার জন্য এ নামায একটি নরের আকার ধারণ করবে, তার পক্ষে দলীলের কাজ দেবে এবং তার নাযাতের উসীলা হবে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি যথাযথভাবে মনোযোগ সহকারে নিয়মিত নামায পড়বে না, ক্বিয়ামত দিবসে তার জন্য নূরের কোন ব্যবস্থা থাকবে না, তার পক্ষ সমর্থনে কোন দলীল থাকবে না। তার নাযাতের কোন উসীলাও থাকবে না। অধিকন্তু পরকালে কারুন, হামান, ফিরআঊন, উবাই ইব্নে খাল্ফ প্রমুখের সঙ্গে তার হাশর হবে।”

সুতরাং আমাদের গভীরভাবে চিন্তা করে দেখা দরকার, যদি আমরা ভালভাবে নিয়মিত নামায পড়ার অভ্যাস না করি, তাহলে আমাদের আখিরাত, আমাদের হাশর শেষ পরিণাম কি হবে।

বেনামাযী লোকেরা ক্বিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম যে কঠিন শাস্তি ও অপমানের সম্মুখীন হবে, তা পবিত্র কুরআনের নিুোক্ত আয়াতে আল্লাহ তাআলা সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন। ইরশাদ হচ্ছে-

“গোছা পর্যন্ত পা খোলার দিনের কথা স্মরণ কর, সেদিন তাদেরকে সিজদা করতে আহ্বান জানানো হবে, অতঃপর তারা সক্ষম হবে না। তাদের দৃষ্টি অবনত থাকবে। তারা লাঞ্ছনাগ্রস্ত হবে। অথচ যখন তারা সুস্থ ও স্বাভাবিক অবস্থায় ছিল, তখন তাদেরকে সিজদা করতে আহ্বান জানানো হতো।” (সূরা ক্বলম, ৪২, ৪৩)।

আলোচ্য আয়াতের সারকথা হল, ক্বিয়ামতের সে কঠিন দিনে যখন জগতের সর্বকালের সকল মানুষ একই মুহূর্তে একই ময়দানে সমবেত থাকবে, তখন আল্লাহ তাআলার একটি বিশেষ তাজাল্লী প্রকাশিত হবে। আর সে সময় উচ্চ স্বরে ঘোষণা দেওয়া হবে যে, তোমরা সকলে আল্লাহ তাআলার সামনে সরাসরি সিজদায় লুটিয়ে পড়। তখন যেসব ভাগ্যবান মুসলমান দুনিয়ায় নামায আদায়ে অভ্যস্ত ছিলেন এবং আল্লাহ্কে সিজদা করতেন, তারা অদৃশ্যের এ ঘোষণা মতে আল্লাহর কুদরতী পায়ের উপর সিজদা দিবেন।

পক্ষান্তরে যারা সুস্থ, সবল ও হৃষ্টপুষ্ট দেহের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও দুনিয়ায় নামায পড়তো না, সে দিন তাদের কোমরগুলো সোজা কাঠ খণ্ডের মত শক্ত ও কঠিন করে দেওয়া হবে। ফলতঃ এদেরকে কাফিরদেরই ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। সেদিন তারা মহান আল্লাহর কুদরতী পায়ের উপর সিজদা দানের নিয়ামত থেকে বঞ্চিত থাকবে। ইত্যবসরে কঠিন অপমান ও মারাÍক লাঞ্ছনাজনক আযাব তাদেরকে ঘিরে নিবে। সেদিন তাদের দৃষ্টি নুইয়ে পড়বে এবং চোখ তুলে কোন কিছু দেখার মত শক্তি থাকবে না। দোযখের আযাব শুরু হওয়ার পূর্বে লাঞ্ছনা-গঞ্জনার এ আযাব ময়দানে হাশরের সূচনা লগ্নেই আপতিত হবে।

বস্তুতঃ বেনামাযী মানুষ আল্লাহ্দ্রোহী শয়তানের পতাকা উত্তোলনকারী। কাজেই এহেন বিদ্রোহজনিত অপরাধে তাকে যতই অপমানিত ও লাঞ্চিত করা হোক না কেন আর যতই কঠিন শাস্তিতে তাকে নিক্ষেপ করা হোক না কেন, নিঃসন্দেহে বেনামাযী এসবের পুরো হকদার এবং উপযুক্ত।

মুজতাহিদ আলেমগণের কতিপয়ের মতানুসারে বেনামাযী লোকেরা দ্বীনের গণ্ডিবহির্ভত। তারা ধর্মত্যাগীরই ন্যায় মৃত্যুদণ্ড পাওয়ার উপযুক্ত। সুতরাং আমাদের সকলকে গভীরভাবে উপলব্ধি করা দরকার যে, নামায পড়া ব্যতিরেকে নিজেকে মুসলিম বলে দাবী করা একটি মিথ্যা, ভিত্তিহীন ও যুক্তিহীন কথা বৈ কিছু নয়।

বস্তুতঃ নামাযের মাধ্যমেই আল্লাহর সাথে বান্দার নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠে। ফলে সে আল্লাহর রহ্মত, বরকত ও কল্যাণ লাভে ধন্য হয়।

জামাআতে নামায পড়ার তাকীদ ও এর ফযীলত

হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)এর হাদীস থেকে বোঝা যায় যে, নামাযের প্রকৃত ফযীলত ও বরকত অর্জন করার পূর্ব শর্ত হল নামায জামাআতের সাথে আদায় করা। জামাআতে নামায পড়ার বিষয়টি শরীয়তে এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, যারা অলসতা বা উদাসীনতার কারণে জামাআতে এসে শরীক হয় না, তাদের ব্যাপারে একবার প্রিয়নবী (সা.) বলেন, “আমার মন চায় এসব লোকদের বাড়ী ঘর জ্বালিয়ে দিই।”

বর্ণিত হাদীস থেকে সহজেই অনুমান করা যায় যে, জামাআত পরিত্যাগ করা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দৃষ্টিতে কতটা অপছন্দনীয়।

অপর এক সহীহ্ হাদীসে বলা হয়েছে, জামাআতের সাথে নামায পড়ার সাওয়াব একাকী নামায পড়া অপেক্ষা ২৭ গুণ বেশী। নিয়মিত জামাআতের সাথে নামায আদায় করার ফলে পারলৌকিক কল্যাণ ও সাওয়াব অর্জন ছাড়াও আরো অনেক উপকার এতে বিদ্যমান।

যেমন, নিয়মিত জামাআতের সাথে নামায আদায় করার ফলে নামাযী ব্যক্তির মধ্যে সময়ের নিয়মানুবর্তিতা রক্ষার সুন্দর এক যোগ্যতা গড়ে উঠে। জামাআতের পাবন্দী করার দ্বারা নামাযের উপর দৃঢ়তা ও পাবন্দী লাভ করতে সক্ষম হয়। পক্ষান্তরে যারা জামাআতের প্রতি তোয়াক্কা করে না, তাদের অধিকাংশকে দেখা যায় যে, তাদের অনেক নামায ছুটে যায় কিংবা ক্বাযা হয়ে যায়।

জামাআতের সাথে নামায আদায়ের সবচেয়ে বড় ফযীলত হল, জামাআতের সাথে নামায আদায়কারীদের প্রত্যেকের নামায সে জামাআতের একটি অংশ বলে পরিগণিত হয়। আর একথা নিশ্চিত যে, জামাআতের মধ্যে সৎ, ন্যায়পরায়ণ ও ভাল মানুষ উপস্থিত থাকেন, যার নামায উন্নত মানের ‘খুশুখুযূ’ সমৃদ্ধ, তার নামায আল্লাহর কাছে গৃহিত হয় এবং নিষ্ফল হয় না। তাই আল্লাহ তাআলার করুণাময়তার শান থেকে এ আশা মোটেই অবান্তর নয় যে, তিনি যখন জামাআতের কতিপয় মানুষের নামাযকে কবুল করবেন, তখন তাদের সাথে সাথে অন্যদের নামাযও কবুল করে নিবেন। অতএব আমাদের প্রত্যেকের একটু ভেবে দেখা উচিৎ যে, নামাযের জামাআত পরিত্যাগ করতঃ আমরা কতখানি বরকত থেকে বঞ্চিত হচ্ছি।

জামাআতে নামায ও সামাজিক সংহতি

একাকিত্ব মানব জীবনের জন্য মৃত্যু তুল্য। যে ব্যক্তি একাকী জীবন যাপন করে, সে ইসলামী সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে এবং কারো নসীহত শ্রবণ করার সুযোগ তার হয় না। যার কারণে শয়তান তার উপর প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়। সুযোগ পাওয়ার সাথে সাথেই তাকে গোমরাহ্ করে ফেলে।

মহানবী (সা.) ইরশাদ করেছেন, শয়তান মানুষের জন্য বাঘ সমতুল্য। বাঘ ঐসকল ছাগল ও ভেড়াকে পাল থেকে ছিনিয়ে নেয়, যারা পাল থেকে দূরে থাকে। এমনিভাবে শয়তান ঐসকল লোকদেরকে সৎপথ থেকে সরিয়ে নেয়, যারা জামাআত বহির্ভূত থাকে। এজন্য তোমরা মুসলমানদের বড় জামাআতের সংগে থাকবে এবং নিয়মিত মসজিদে উপস্থিত থাকবে।

নামাযের দ্বারা আল্লাহ তাআলা মুসলিম জাতির সকল শ্রেণীর লোকদের একে অপরের সাথে জুড়ে দিয়েছেন। শাসককে শাসিতের সাথে, ধনীকে গরীবের সাথে, ছোটকে বড়র সাথে, বিদেশীকে দেশীর সাথে।

মসজিদে নামায পড়ার দ্বারা মুসলমানদের মাঝে ঐক্য ও সংহতি সৃষ্টি হয়। প্রত্যেক মুসলমান তার পাড়া-প্রতিবেশীর সাথে আলাপ করে বা সাক্ষাত করে তার অবস্থা ও সমস্যা সম্পর্কে জানতে পারে এবং তাকে সাহায্য-সহযোগিতা ও সমবেদনা প্রকাশ করতে পারে।

ইসলাম বিশ্ব ধর্ম। আল্লাহ তাআলা মানব কল্যাণের উপর এর ভিত্তি রেখেছেন। যাতে এর অনুসারীরা শৃংখলতার সাথে সংঘবদ্ধ হয় এবং প্রশস্ত অন্তর, উদার মানসিকতা ও ধৈর্য-সহিষ্ণুতার গুণে গুণান্বিত হতে পারে। মুসলিম জাতির মাঝে এসকল গুণাবলী সৃষ্টি করা এবং স্থায়ী রাখার জন্য এমনভাবে জামাআতের সাথে নামায আদায় করা হয়, যাতে ধনী-গরীব, ছোট-বড় সকল শ্রেণী এক ইমামের পিছনে কাতারবন্দী হয়ে তার নেতৃত্বে নামায আদায় করে থাকে।

এভাবে জামাআতে নামায আদায়ের দ্বারা একদিকে যেমন ঐক্য ও সংঘবদ্ধ জীবন স্পন্দন সৃষ্টি হয়, অপরদিকে তেমনিভাবে ফুটে উঠে ইসলামী ভ্রাতৃত্ব ও সমতার সহজ সরল ও চিত্তাকর্ষক দৃশ্য- এক কাতারে শামিল শাসক-শাসিত, ধনী-দরিদ্র, বৃদ্ধ-যুবক, শেখ-সৈয়দ ও পাঠান সকলেই দাঁড়িয়ে আল্লাহর দরবারে!

এর দ্বারা নিজের বড়ত্ব নিঃশেষ হয়ে একমাত্র আল্লাহ তাআলার বড়ত্ব প্রকাশ পায় এবং তাঁর ঘোষণা “সকল মু’মিন ভাই ভাই”-এর বাস্তব রূপের চূড়ান্ত বিকাশ ঘটে। অনেক নিষ্ঠাবান ও নিরপেক্ষ মানসিকতার অধিকারী অমুসলিমও জামাআতের সাথে নামায আদায়ের জীবন্ত চিত্র দেখে ইসলামের সত্যতাকে স্বীকার করে নেয়।

নামাযে খুশুখুযূর গুরুত্ব

নামাযের প্রকৃত স্বাদ, মজা ও ফযীলত পেতে হলে খুশুখুযূ খুবই জরুরী। খুশুখুযর সাথে নামায পড়ার অর্থ হল, নামাযী ব্যক্তি নিজের সম্মুখে মহান আল্লাহ্কে হাযির নাযির কল্পনা করে এভাবে নামায আদায় করবে যে, তার হৃদয় থাকবে আল্লাহর প্রেম ও ভালবাসায় ভরপুর এবং তাঁর প্রতি ভয়, তাঁর বড়ত্বের চিন্তায় বিগলিত। কোন অপরাধী আসামী বিজ্ঞ কোন বিচারক বা সম্রাটের সামনে যেভাবে দাঁড়ায়, নামাযী ব্যক্তি তার নামাযে ঠিক এভাবেই দাঁড়াবে।

দাঁড়ানো অবস্থায় নামাযী মনে মনে ভাববে যে, আমি আল্লাহর সম্মুখে দণ্ডায়মান এবং আমি তাঁরই প্রতি সম্মান প্রদর্শন করছি। এভাবে রুকুতে গিয়ে সে চিন্তা করবে যে, আমি কেবল আল্লাহ তাআলার সম্মুখেই আমার মস্তক ঝুঁকিয়ে দিচ্ছি। এমনিভাবে সিজদায় সে ভাববে যে, আমি আল্লাহর সামনেই সিজদাবনত হচ্ছি, তাঁরই সামনে নিজের সকল অনুনয় বিনয় প্রকাশ করছি। উত্তম হল, নামাযে যেসব সূরা ক্বিরাত ও তাসবীহ্ পাঠ করা হয়, তার অর্থ বুঝে পাঠ করা।

বস্তুতঃ নামাযের প্রকৃত স্বাদ তখনই পুরোপুরিভাবে লাভ করা যায়, যখন নামাযী নিজের  পঠিত কথাগুলো ও বাক্যগুলোর অর্থ বুঝে বুঝে পাঠ করে। নামাযের মধ্যে খুশুখুযূ রক্ষা করা এবং আল্লাহর দিকে অন্তর্দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে একাগ্রচিত্তে মনোযোগী হওয়াই নামাযের প্রাণ এবং নামাযের মূল রূহ্। আল্লাহর যে বান্দা এ রূহ্ সমৃদ্ধ নামায পড়তে সচেষ্ট থাকেন, পারলৌকিক জীবনে তার নাযাত ও সমূহ সফলতা অর্জন অবশ্যম্ভাবী।

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, “সফল ও স্বার্থক সে সকল মু’মিন বান্দারা যারা নিজেদের নামাযগুলোতে খুশুখুযূ রক্ষা করে আদায় করে।” (সূরা মু’মিনূন- ১০২)।

একটি হাদীসে প্রিয়নবী (সা.) বলেন, “আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের উপর পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয করেছেন। যে ব্যক্তি এ নামায আদায়ের লক্ষ্যে ভালভাবে অয করে, যথাসময়ে নামায পড়ার জন্য দাঁড়ায়, রুকু, সিজদা যথাযথভাবে আদায় করে, তার জন্য আল্লাহ তাআলা অঙ্গিকার করেন যে, তিনি তাকে ক্ষমা করে দিবেন। আর যে ব্যক্তির নামায এই মানের হয় না, তার জন্য আল্লাহর কোন অঙ্গিকার নেই। ইচ্ছে করলে ক্ষমা করতে পারেন এবং ইচ্ছে করলে ক্ষমা না করে তাকে শাস্তিও দিতে পারেন।”

পরকালের আযাব ও শাস্তি থেকে মুক্তি ও নিরাপত্তা পেতে হলে বর্ণিত হাদীসের মর্মার্থ অনুযায়ী পাঁচ ওয়াক্ত নামায ভালভাবে খুশুখুযূ’র সাথে সুন্নাত তরীকায় আদায় করা আমাদের একান্ত কর্তব্য।

বেনামাযীদের কতিপয় অজুহাত

অনেক মুসলমান নামায পড়েন না। কারণ জিজ্ঞেস করলে বিভিন্ন ধরনের অজুহাত, উযর-আপত্তি দেখিয়ে থাকেন। যেমন, সমাজের নেতৃত্ব, ব্যবসা-বাণিজ্য, অসুখ-বিসুখ ইত্যাদি।

যারা সমাজের নেতৃত্ব বা সাম্রাজ্যের কারণে নামাযে অলসতা করেছেন, ক্বিয়ামত দিবসে আল্লাহ তাআলার সামনে তারা উযর পেশ করে বলবেন, হে আল্লাহ! তুমি আমাকে নেতৃত্ব বা হুকুমত দিয়েছিলে। সে কাজে এতই ব্যস্ত ছিলাম যে মাথা হেলানোরও সময় পাইনি। আবার নামায পড়ব কিভাবে?

তখন আল্লাহ তাআলা হযরত দাঊদ ও হযরত সুলাইমান (আ.)কে ডেকে পাঠাবেন। তাঁরা দরবারে উপস্থিত হলে বেনামাযীকে বলবেন, দেখ, এঁরা দু’জন বাদশাহ্ ছিলেন। এঁদের সাম্রাজ্য তোমা হতে বেশী বিস্তৃত ছিল। কিন্তু এতদসত্ত্বেও এঁরা কখনও নামায পরিত্যাগ করেন নি। সুতরাং তুমি মিথ্যা বলছ। নেতৃত্ব আর সাম্রাজ্যই যদি নামায পড়ায় বাঁধা হয়ে দাঁড়াত, তাহলে এঁরাও নামায পড়তে পারতেন না। তুমি বরং গাফলতী, অলসতা ও উদাসীনতার কারণে নামায পড়নি। হে ফেরেশতারা! যাও, তাকে নিয়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ কর।

আরেকজন আসবেন অসুস্থতার উযর নিয়ে। বলবেন, হে খোদা! আমি অসুস্থ ছিলাম। কষ্টের কারণে নামায পড়তে পারিনি। তখন আল্লাহ তাআলা হযরত আইয়ুব (আ.)কে উপস্থিত করে উক্ত বেনামাযীকে বলবেনঃ বলতো! তুমি বেশী অসুস্থ ছিলে, না আমার আইয়ুব বেশী অসুস্থ ছিল?

বছরের পর বছর ধরে তাঁর পুরো শরীরে কিড়া লেগেছিল। সারা শরীর ঘায়ে দগদগ করত। কিন্তু তিনি তো এক মুহর্তের জন্যও আমার স্মরণ থেকে গাফেল হন নি। অসুস্থতাই যদি আমার স্মরণ থেকে বাঁধা হয়ে দাঁড়াত, তাহলে আমার আইয়ুবের জন্যও বাঁধা হয়ে দাঁড়াত। সুতরাং তুমি মিথ্যা বলছ। তুমি বরং অলসতা ও উদাসীনতার কারণে নামায পড়নি। ফেরেশতারা! যাও, তাকে নিয়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ কর।

অন্য একজনকে জিজ্ঞেস করা হবে, তুমি নামায পড়নি কেন? উত্তরে তিনি বলবেন, হে আল্লাহ! আমার সন্তান-সন্ততি ছিল অনেক। তাদের খেদমত ও জীবিকা নির্বাহের জন্য ব্যবসা-বাণিজ্য করতে করতে দিন কেটে যেত। নামাযের সময় পেলাম কোথায়? তখন আল্লাহ তাআলা হযরত ইয়াকূব (আ.)কে ডেকে পাঠাবেন। তিনি দরবারে উপস্থিত হলে তাঁকে দেখিয়ে আল্লাহ বললেন- তোমার সন্তান-সন্ততি বেশী ছিল, না আমার ইয়াকূবের বেশী ছিল? তুমি সন্তানের চিন্তায় চিন্তিত ছিলে আর আমার ইয়াকূব ইউসূফ (আ.)-এর বিরহে বছরের পর বছর কেঁদে কেঁদে দৃষ্টি শক্তি হারিয়েছেন। বার্ধক্যের কারণে কোমর বাঁকা হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যও নামায থেকে গাফেল হন নি। হে ফেরেশ্তারা! যাও, তাকেও নিয়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ কর।

একজন বেনামাযী মহিলা আদালতে ইলাহীতে উপস্থিত হবেন। তাকে জিজ্ঞেস করা হবে, তুমি নামায পড়নি কেন? জবাবে মহিলা বলবেন, হে খোদা! আমার স্বামীর কাজ করতে করতে নামাযের সুযোগ পাইনি এবং তার ভয়ে এই ফরয দায়িত্ব আদায় করতে পারিনি। তখন হযরত আসিয়াকে ডেকে পাঠানো হবে। হযরত আসিয়া দরবারে উপস্থিত হলে আল্লাহ তাআলা ঐ বেনামাযী মহিলাকে বলবেন, তোমার স্বামী বেশী যালিম ছিল, না আসিয়ার স্বামী ফিরআঊন বেশী যালিম ছিল? মহিলা বলবেন, হে আল্লাহ, ফিরআঊন বেশী যালিম ছিল। অতঃপর আল্লাহ বলবেন, দেখ, আসিয়া এমন যালিম, অত্যাচারী নরাধমের স্ত্রী হয়েও কেমন ইবাদতকারীনী ছিলেন।! কোন স্বামীর অত্যাচারই যদি নামাযের জন্য বাঁধা হয়ে দাঁড়াত, তাহলে হযরত আসিয়ার জন্য অবশ্যই বাঁধা হয়ে দাঁড়াত।

হে বেনামাযী! স্বামীর যুলুম- এটা তোমার মিথ্যা বাহানা। আসলে তুমি নিজেই ছিলে গাফেল। তোমার গাফলতী আর অসলতার কারণে তুমি নামায পড়নি। ফেরেশ্তারা! যাও, তাকে নিয়েও জাহান্নামে নিক্ষেপ কর। সুতরাং কোন অজুহাত বা বাহানায় নামায পরিত্যাগ করার অবকাশ নেই।

উপসংহার

নামাযের মধ্যে একটি ব্যতিক্রমধর্মী প্রভাব ও কার্যকারিতা বিদ্যমান। কেউ যদি যথাযথভাবে নামায আদায় করে এবং আল্লাহ্কে হাজির নাজির জেনে পূর্ণ ধ্যান ও বিনয় সহকারে নামায পড়ে, তাহলে এ নামাযের ফলে তাঁর অন্তরাত্মা পরিচ্ছন্ন হতে থাকে। তার অন্তর ইলাহী নূরের উজ্জ্বল আলোয় উদ্ভাসিত হতে থাকে ক্রমান্বয়ে। তার জীবনযাত্রা হতে থাকে সঠিক ও মার্জিত। যাবতীয় দোষত্র€টি তার জীবন থেকে বিদূরিত হতে থাকে। অন্তরে সততা ও সদাচারের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি হতে থাকে, জন্ম নিতে থাকে আল্লাহর ভয় ও তাক্বওয়া। এক সময় তার গোটা জীবন ধারা সকল পাপাচার ও অবাধ্যতার ময়লা থেকে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে নির্মল-নিষ্কলুষ হয়ে যায়।

হযরত রাসূলে কারীম (সা.) একটি সুন্দর উপমা দ্বারা বিষয়টি বুঝিয়ে বলেন, “আচ্ছা বল তো! তোমাদের কারো বাড়ীর পাশে যদি কোন নদী থাকে আর তাতে সেই ব্যক্তি দৈনিক পাঁচবার গোসল করে, তাহলে তার দেহে কোন প্রকার ময়লা থাকবে কি? লোকজন উত্তরে বললেন, কোন রকম ময়লাই থাকতে পারে না। তখন প্রিয়নবী (সা.) বললেন, পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের উদাহরণ এরূপই। আল্লাহ তাআলা এই নামাযসমূহের বরকতে মানুষের গুনাহ্সমূহকে এভাবেই মিটিয়ে দেন।”

একারণেই ইসলামে যাবতীয় ফরয ইবাদতগুলোর মধ্যে নামাযের প্রতিই অধিক তাকীদ করা হয়েছে। যখনই কোন ব্যক্তি মহানবী (সা.)এর কাছে এসে ইসলাম কবুল করত, তখনই তিনি তাকে একত্ববাদের শিক্ষাদানের পর সর্বপ্রথম নামায আদায় করার উপর অঙ্গিকার গ্রহণ করতেন।

এ পৃথিবীতে আগমনের পূর্বে রূহের জগতে মানুষ স্বীয় স্রষ্টা ও মালিকের কাছে একথার অঙ্গিকার করেছিল যে, আপনিই আমার প্রভু। আর মৃত্যুর পর কবরেও তাকে প্রশ্ন করা হবে যে, বল, কে ছিলো তোমার প্রভু? নামায এই অঙ্গিকার ও বিশ্বাসকে জীবন্ত রাখে এবং দুনিয়াতে খোদা প্রদত্ত বিধানাবলীর প্রতি লক্ষ্য রেখে জীবন যাপন করার শক্তি যোগায়।

নামাযই একমাত্র এমন প্রিয় ও নরানী ইবাদত, যা তাকে দুনিয়া ও আখেরাতে প্রকৃত সফলতার অধিকারী বানায়, জাহান্নাম থেকে মুক্তি প্রদান করে এবং জান্নাতে প্রবেশ করায়।

বস্তুতঃ যাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেওয়া হবে এবং জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে, সে-ই প্রকৃত সফলকাম। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, “প্রত্যেক প্রাণীকে আস্বাদন করতে হবে মৃত্যুর স্বাদ। আর তোমরা ক্বিয়ামতের দিন পরিপূর্ণ বদলা প্রাপ্ত হবে। তারপর যাকে জাহান্নাম থেকে দূরে রাখা হবে এবং জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে, সেই হবে সফলকাম। আর পার্থিব জীবন ধোঁকার সামগ্রী বৈ কিছু নয়।” (সূরা আল্-ইমরান, ১৮৫)।

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে প্রকৃত সফলতা অর্জন করার তাওফীক দান করুন। আমীন॥

লেখক পরিচিতিঃ বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ, গবেষক, পুস্তক প্রণেতা ও শায়খুল হাদীস- আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।