Home বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কম্পিউটার চিপ শিল্প: জলবায়ুর উপর ফেলছে ভয়ঙ্কর প্রভাব

কম্পিউটার চিপ শিল্প: জলবায়ুর উপর ফেলছে ভয়ঙ্কর প্রভাব

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নের বর্তমান যুগে সেমিকন্ডাক্টর বা অর্ধপরিবাহী শিল্পের পরিধি দিন দিন বেড়ে চলেছে। তবে এই শিল্পের ক্রমবর্ধমান বিকাশ আমাদের পরিবেশের জন্য বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। স্মার্টফোন এবং টেলিভিশন থেকে শুরু করে উইন্ড টারবাইন পর্যন্ত প্রায় সব ধরনের বৈদ্যুতিক ডিভাইসেই এখন ব্যবহৃত হচ্ছে সিলিকন চিপ। কিন্তু ব্যাপক হারে সিলিকন চিপের এই ব্যবহারের ফলে নিরবে এক বিরাট মূল্য চুকাতে হচ্ছে আমাদের। বায়ুমণ্ডলে মিশে যাচ্ছে সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদন শিল্প থেকে নির্গত কার্বন।
 
এ শিল্পটি এক ধরনের প্যারাডক্স বা বৈপরীত্য উপস্থাপন করে। বৈশ্বিক জলবায়ুর যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, তা পূরণ, আংশিকভাবে অর্ধপরিবাহীর ব্যবহাররের উপর নির্ভর করছে। বৈদ্যুতিক যানবাহন, সোলার অ্যারে এবং উইন্ড টারবাইন, এই সবকিছুর অবিচ্ছেদ্য অংশ হল অর্ধপরিবাহী। কিন্তু এই চিপ উৎপাদন জলবায়ু সংকটেও যথেষ্ট অবদান রাখছে। এর জন্য প্রয়োজন হয় প্রচুর পরিমাণ শক্তি এবং পানি; একটি চিপ ফ্যাব্রিকেশন প্ল্যান্ট একদিনে কয়েক লক্ষ গ্যালন পানি ব্যবহার করার সঙ্গে সঙ্গে বিপজ্জনক বর্জ্যও উৎপাদন করে থাকে।
 
যেহেতু সেমিকন্ডাক্টর শিল্পের ক্রমবর্ধমান বিকাশের ফলে জলবায়ুর উপর ক্ষতিকারক প্রভাব পড়ার প্রমাণ মিলেছে, তাই অনেক কোম্পানিই এখন এ ঝুঁকি মোকাবেলায় নানা ধরনের পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে। গত সপ্তাহে বিশ্বের সবচেয়ে বড় চিপ প্রস্তুতকারক তাইওয়ান সেমিকন্ডাক্টর ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি (টিএসএমসি) ২০৫০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ শূন্যে পৌঁছানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

টিএসএমসি-এর চেয়ারম্যান মার্ক লুই জানিয়েছেন, “কোম্পানির লক্ষ্য ছিল, আমাদের সবুজ প্রভাব আরো বিস্তৃত করা এবং শিল্পকে স্বল্প কার্বন স্থায়ীত্বের দিকে নিয়ে যাওয়া।”

কিন্তু এই শিল্পকে কার্বনবিহীন করাই হবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

গ্রিনপিসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, টিএসএমসি একাই তাইওয়ানে উৎপাদিত সমস্ত বিদ্যুতের প্রায় ৫ শতাংশ ব্যবহার করে এবং পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে, ২০২২ সাল নাগাদ বিদ্যুৎ ব্যবহারের পরিমাণ দাঁড়াবে ৭.২ শতাংশে। এছাড়া, ২০১৯ সালে প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ৬৩ মিলিয়ন টন পানি ব্যবহার করেছে।

এ বছর তাইওয়ানের খরার সময় কোম্পানির এই পরিমাণ পানি ব্যবহার বেশ বিতর্কের সৃষ্টি করেছিল। বিগত পঞ্চাশ বছরের সবচেয়ে কঠিন খরার মাঝে, যেখানে দেশের কৃষকেরা পড়েছিল বিপাকে, সেখানে চিপ নির্মাতা কোম্পানি মিলিয়ন মিলিয়ন টন পানি ব্যবহার করেছে।
 
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, অ্যারিজোনার ওকোটিল্লোতে ইন্টেলের ৭০০ একরের ক্যাম্পাস এই বছরের শুধু প্রথম তিন মাসেই প্রায় ১৫ হাজার টন বর্জ্য উৎপাদন করেছে, যার প্রায় ৬০ শতাংশ বিপজ্জনক। এছাড়া, ৯২৭ মিলিয়ন গ্যালন বিশুদ্ধ পানিও ব্যবহার করেছে প্রতিষ্ঠানটি, যা মোটামুটি ১ হাজার ৪০০ টি অলিম্পিক সুইমিং পুল ভরাট করার জন্য যথেষ্ট; সেই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটি শক্তি ব্যবহার করেছে ঘণ্টা প্রতি ৫৬১ কিলোওয়াট।
 
চাহিদার সঙ্গে উৎপাদন বৃদ্ধির তাল মেলানোর প্রচেষ্টায়, অনেক দেশ সেমিকন্ডাক্টর শিল্পকে বাড়ানোর জন্য বড় বড় কর্মসূচি গ্রহণ করছে।
 
চিপস ফর আমেরিকা অ্যাক্ট মার্কিন সেমিকন্ডাক্টর শিল্প বর্ধনে পাঁচ বছরে ৫২ বিলিয়ন ডলার তহবিলের প্রস্তাব করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নও ২০৩০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক চিপ মার্কেটে তার শেয়ার ২০ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে।

গত সপ্তাহে ইউরোপীয় কমিশনের সভাপতি উরসুলা ভন ডার লেয়েন ইউরোপীয় ইউনিয়ন অঞ্চলের এই পদক্ষেপকে “প্রযুক্তিগত সার্বভৌমত্বের বিষয়” বলে উল্লেখ করেছেন।

তবে, এই উচ্চাকাঙ্ক্ষা আন্তর্জাতিক জলবায়ু সংক্রান্ত লক্ষ্যসমূহের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ইইউ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয়ই ২০৩০ সালের মধ্যে শূন্য কার্বন নিঃসরণ পরিকল্পনার অর্ধেক পথ এবং ২০৫০ সালের মধ্যে সম্পূর্ণ পথ পাড়ি দেওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে।

তো যাহোক, বিনিয়োগকারীদের এবং ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী প্রস্তুতকারকদের চাপের মধ্যেও গ্রাহকদের চাহিদা মেটাতে, সেমিকন্ডাক্টর ব্যবসায় জলবায়ু বিপর্যয় মোকাবেলার দিকেও নজর দিতে শুরু করেছে।
 
ওএন সেমিকন্ডাক্টরের প্রধান প্রকৌশলী সোহিনী দাশগুপ্ত বলেন, “সম্প্রতি, আমি পরিবেশের উপর ক্ষতিকারক প্রভাবগুলোকে সম্পূর্ণরূপে সামনে আসতে দেখেছি।”
 
দুই বছর আগে তিনি বলেছিলেন, “হ্যাঁ, স্থায়িত্ব গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু আমরা জানি না এটা দিয়ে আমাদের কী করতে হবে”।

আরও পড়তে পারেন-

কিন্তু এখন তিনি বলছেন, “প্রতিদিন আমাদের ইমেইলবক্সে প্রশ্ন আসে, আমাদের প্রতিষ্ঠান কী করছে; এবং সেইসঙ্গে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলো কী করছে।”

বিনিয়োগ সংস্থা বার্নস্টেইনের অর্ধপরিবাহী বিষয়ক বিশ্লেষক মার্ক লি -এর মতে, বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নৈতিকতা বেশ সহায়ক হয়েছে। তহবিল পরিচালকরা “সবুজ অর্থায়ন” বৃদ্ধি করছে এবং বিনিয়োগকারীরা কোম্পানির পরিবেশগত, সামাজিক এবং গভার্নেন্স বা পরিচালনার (ইএসজি) প্রভাব সম্পর্কে আরও জানার আগ্রহ দেখিয়েছে।

তিনি বলেন, “গত তিন বছরে, ইএসজি বিনিয়োগের কর্মতৎপরতা আগের তুলনায় অনেক বেশি বেড়েছে। মোটকথা, এটি কোম্পানিগুলোর আচরণ পরিবর্তনে সহায়ক হবে।”
 
নবায়নযোগ্য শক্তির সহজলভ্যতা চিপ প্রস্তুতকারকদের কার্বন নিঃসরণ কমাতে সাহায্য করছে। ইন্টেল প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে তারা সম্পূর্ণভাবে নবায়নযোগ্য শক্তির উপর নির্ভরশীল প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠবে; এবং টিএসএমসি এই একই লক্ষ্যে পৌঁছানোর সময়সীমা নির্ধারণ করেছে ২০৫০ সালের মধ্যে।

কোম্পানির মুখপাত্র নিনা কাও জানিয়েছেন, গত বছর টিএসএমসি ডেনিশ এনার্জি ফার্ম অর্স্টেডের সঙ্গে ২০ বছরের চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। তাইওয়ান প্রণালীতে অবস্থিত ৯২০ মেগাওয়াটের অফশোর উইন্ডফর্ম অর্স্টেডের কাছ থেকেই কোম্পানিটি সমস্ত শক্তি কিনছে।

এনার্জি কনসালটেন্সি উড ম্যাকেনজির নবায়নযোগ্য শক্তি বিশ্লেষক শশী বারলা বলেন, বিশ্বের সবচেয়ে বড় কর্পোরেট নবায়নযোগ্য শক্তি ক্রয়ের চুক্তি হিসেবে এই চুক্তিতে টিএসএমসি’র জন্য অনেক সুবিধা রয়েছে। এটি কম খরচে ক্লিন এনার্জি সরবরাহ করে থাকে, যা “এক ঢিলে দুই পাখি শিকার” করার মতোই কাজ করছে।

টিএসএমসি’র পরিবেশ রক্ষার এই পদক্ষেপ বাকি শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকেও প্রভাবিত করবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন, এমআইটি-এর ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কম্পিউটার সায়েন্সের অধ্যাপক ক্লিফটন ফনস্ট্যাড। তিনি বলেন, “অন্যান্য নির্মাতারা টিএসএমসি’র নেতৃত্ব অনুসরণ করতে পারে”।
 
সেমিকন্ডাক্টর তৈরিতে ব্যবহৃত সবচেয়ে দূষিত উপকরণগুলো মোকাবেলায় উদ্ভাবনেরও পরিকল্পনা রয়েছে। চিপ শিল্প উৎপাদন প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন ধরনের গ্যাস ব্যবহার করা হয়, যেগুলোর অধিকাংশই জলবায়ুর উপর ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলে।

টিএসএমসি বলছে, তারা গ্যাস নির্গমন নিরাময়ে স্ক্রাবার এবং অন্যান্য উপায় প্রয়োগ করেছে।
 
তবে, ক্ষতিকারক গ্যাস প্রতিস্থাপন করা একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। অর্ধপরিবাহী উৎপাদক বিশ্লেষক পিটার হ্যানবারি বলেন, চিপ উৎপাদনে যে গ্যাস একবার ব্যবহার করা হয়, পরবর্তীতে তা পরিবর্তন করা বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এই প্রক্রিয়া খুব সুক্ষ্মভাবে সম্পাদিত হয়। চিপ কোম্পানিগুলোকে একটি ডাক-স্ট্যাম্প আকারের ওয়েফারে ১০০ মিলিয়ন ট্রানজিস্টর খুবই সুক্ষ্মভাবে বসাতে হয়।

হ্যানবারি আরো বলেন, প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য একটি উৎপাদন কাঠামো তৈরি করতে চার থেকে পাঁচ বছর সময় লাগে এবং “একবার আপনি এটি সেট করে ফেললে, আপনি মূলত এটি আর কখনই পরিবর্তন করতে চাইবেন না”।
 
তবে কিছু বিশেষজ্ঞ বিশ্বাস করেন, চিপ প্রস্তুতকারীরা পরিবেশের উপর প্রভাবের কথা চিন্তা করে তাদের উৎপাদন প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনতে শুরু করবে, বিশেষ করে যদি বড় কোম্পানিগুলো এ পদক্ষেপ নেয়া শুরু করে।

ফনস্ট্যাড বলেছেন, “যদি টিএসএমসি পরিবর্তন আনতে শুরু করে, তবে আমি নিশ্চিত অন্যরাও করবে। আর যদি টিএসএমসি না করে, তাহলে অন্যান্য নির্মাতারা নিজেদেরকে টিএসএমসি’র চেয়ে ভালো হয়েও দেখাতে পারে।”

চিপ ব্যবসায়ের কিছু পর্যবেক্ষক বিশ্বাস করেন, এই শিল্পকে পরিবেশের জন্য ঝুঁকিহীন হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব।

লি-এর মতে, বর্তমান বিশ্বে চিপের বিপুল চাহিদা অর্ধপরিবাহী শিল্পকে টেকসই লক্ষ্য নির্ধারণ ও অর্জনে সাহায্য করবে।

তিনি বলেন, “এখান থেকে তারা প্রচুর অর্থ উপার্জন করে। সুতরাং পরিবেশবান্ধব পদক্ষেপ নিতে বড় অংকের তহবিল খরচ হলেও, তা বহন করার সামর্থ তাদের রয়েছে। এবং ক্রমবর্ধমানভাবে, পরিবেশবান্ধব ডিভাইস পেতে গ্রাহকরাও  অর্থ খরচ করতে ইচ্ছুক হবে।”
 
সূত্রঃ দ্য গার্ডিয়ান।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।