Home ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন চির সুখের ঠিকানা জান্নাত: জুমার বয়ানে আল্লামা নাজমুল হাসান কাসেমী

চির সুখের ঠিকানা জান্নাত: জুমার বয়ানে আল্লামা নাজমুল হাসান কাসেমী

[রাজধানীর অন্যতম বিখ্যাত দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা’র সাবেক ভারপ্রাপ্ত পরিচালক, উত্তরা জামেয়াতুন নূর আল-কাসেমিয়ার প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ও উত্তরা ১২নং সেক্টর বায়তুন নূর জামে মসজিদের খতীব আল্লামা হাফেজ নাজমুল হাসান কাসেমী শুক্রবার (১০ সেপ্টেম্বর) জুমায় মুসল্লীদের উদ্দেশ্যে যে গুরুত্বপূর্ণ বয়ান করেছেন, বিষয়বস্তুর গুরুত্ব বিবেচনা করে বয়ানের হুবহু অনুলিপি উম্মাহ পাঠক সমীপে উপস্থাপন করা হল -সম্পাদক]

মুআয্যায মুহতারাম উলামায়ে কেরাম, মুসল্লিয়ানে ই’যাম। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার অশেষ মেহেরবানি, তিনি আমাদেরকে তাঁর মহান হুকুম জুমআর নামাযের জন্য তাঁর ঘরে সমবিত হওয়ার তৌফিক দান করেছেন। আলহামদুলিল্লাহ!

মহান আল্লাহ তায়ালা বান্দার কাছ থেকে বন্দেগি চান। গত জুমার বয়ানে আমরা শুনেছি যে, মানুষের কাছ থেকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া-তাআলা পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র জিন্দেগী চান। যেই জীবন হবে পবিত্র। যেই জীবন হবে পরিচ্ছন্ন। কারণ, হাদীসে পাকে এসেছে, ‘اللهُ جميل و يحب الجمال’ আল্লাহ বড় সুন্দর, এবং সৌন্দর্যকে তিনি পছন্দ করেন।

জান্নাতবাসিকে সব নেয়ামত দেয়ার পরে আল্লাহ পাক যখন তাদেরকে জিজ্ঞাসা করবেন- ওহে জান্নাতিরা, বল দেখি আর কী প্রয়োজন আছে তোমাদের?  সমস্ত পৃথিবীর এই লক্ষ-কোটি জান্নাতি তালাশ করে এমন একটা বিষয় খোঁজে পাবে না যেটা ইতিপূর্বে জান্নাতে তার জন্য প্রস্তুত করা হয়নি। সুবহানাল্লাহ !

সোজা কথায়, আজকে আমরা এখানে বসা আছি, মুসল্লিদেরকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, বলুন তো মসজিদ সংক্রান্তে আপনাদের আর কি কি প্রয়োজন আছে ? তাহলে সর্বাত্মক চেষ্টা ও নিবেদিতপ্রাণ হয়ে একঝাঁক চৌকস পরিচালনা পরিষদের মেম্বারগণ চেষ্টা করবেন, যাতে করে আরামদায়ক ও সুন্দরভাবে মানুষ এখানে নামায পড়তে পারেন। কিন্তু শেষে দেখা যাবে, মুসল্লীদের আরো নানা চাহিদা রয়ে গেছে।

অনুরূপ সুরম্য অট্টালিকাসম এক মসজিদেও যদি এখন মুসল্লিদেরকে জিজ্ঞাসা করা হয়, ‘কী প্রয়োজন আছে আপনাদের?’ তাহলে হাজারো প্রয়োজন চলে আসবে।

এটা তো গেলো মসজিদের কথা!  আপনার ঘরেও যদি আপনি আপনার বিবিকে বলেন, বলো তো কিসের প্রয়োজন? তাহলে এত বড় লিষ্ট আপনার সামনে আসবে যে, আপনি ১০ বছরেও এটা ফুলফিল করতে পারবেন না। এটাই দুনিয়ার রীতি। মালিক যদি শ্রমিকদেরকে জিজ্ঞেস করে যে, কার কিসের প্রয়োজন, সরকার যদি জনগণকে জিজ্ঞেস করে কার কিসের প্রয়োজন, তাহলে প্রয়োজনের কোন শেষ নাই।

ও বান্দা, এটাই হল আল্লাহর রহমতি জান্নাত আর দুনিয়ার মধ্যে পার্থক্য। যেই আল্লাহ পাক জান্নাতকে এমনভাবে সাজালেন, সেই আল্লাহ চাইলে দুনিয়াকেও এমনভাবে সাজাতে পারতেন। কিন্তু কেন করেননি?  এটা তো দুই দিনের খন্ডকালীন সময়ের জন্য। এটা ক্ষণস্থায়ী। ক্ষণস্থায়ী ব্যবস্থা তো এরকমই হয়। যখন নাকি হাই-রাইজ বিল্ডিং করতে হয়, তখন পাইলিং করতে হয়। বহু পয়সা-পাতি খরচ করতে হয়।  ওয়াজের প্যান্ডেল কি হয় পাইলিং করে ? না। কেন করে না? কারণ, এটা তো এক রাত্রের ব্যবস্থা!  কোনো রকম খালি রোদ-বৃষ্টি থেকে বেঁচে শ্রোতারা বসে  শুনতে পারলেই হয়। মুষলধারে বৃষ্টি যদি হয় তাহলে যেন একেবারে সব ভিজে না যায়, সর্বোচ্চ এই ধরনের একটা ব্যবস্থা। ওখানে কেউ টাইলস্ করে না, গ্রাম দেশে খরকুটা বিছায়া দেয়। আর একটু ভাল এলাকা যদি হয় তাহলে ডেকোরেটর থেকে কার্পেট এনে বিছিয়ে দেয়।

কেন এটাকে স্থায়ী ব্যবস্থা করে না? কেন এটাকে স্প্যানিশ টাইলস ৭০০ টাকা স্কয়ার ফিটের লাগায় না? অথচ এত বড় মোবারক কাজ! এত বড় মাহফিল, যেই মাহফিলে আল্লাহর রহমতের ফেরেশতারা পরিবেষ্টন করে আরশে আ’জীম পর্যন্ত নিয়ে যায়! এজন্য যে, এই আয়োজন একদিনের ক্ষণস্থায়ী সময়ের জন্য।

ওখানে মানুষ কোনো রকম শুধু প্রয়োজন মিটায়। দুরদুরান্ত থেকে যে শ্রোতারা আসে এদের খাবার-দাবারের জন্য অস্থায়ী কিছু মার্কেট বসে। এইতো আমাদের দেশের সংস্কৃতি। পরদিন সকালবেলা দেখা যায় সব বিরান পড়ে আছে।

ওহে আল্লাহর বান্দারা! আল্লাহ পাক পরওয়ারদিগারে আলম আমার আপনার জন্য যে দুনিয়াটা সাজিয়েছেন, যেটাকে আমি আসল মনে করে নিচ্ছি, সেই দুনিয়াটা এরকম চোখের পলকে শেষ হয়ে যাওয়ার জিনিস। হাজার হাজার বছর পূর্ব থেকে আল্লাহ পাক মানুষকে পরীক্ষা করার জন্য কাউকে ধনী আর কাউকে গরীব করে আসছেন । কারূণকে আল্লাহ পাক ৭০ উটের বোঝা শুধু মাত্র খাজানার চাবি বহনের জন্য দিয়েছিলেন।

إِنَّ قَارُونَ كَانَ مِنْ قَوْمِ مُوسَى فَبَغَى عَلَيْهِمْ وَآتَيْنَاهُ مِنَ الْكُنُوزِ مَا إِنَّ مَفَاتِحَهُ لَتَنُوءُ بِالْعُصْبَةِ أُولِي الْقُوَّةِ إِذْ قَالَ لَهُ قَوْمُهُ لَا تَفْرَحْ إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ الْفَرِحِينَ

কারূনকে যখন আল্লাহ ৭০ উটের বোঝা দিয়েছিলেন শুধু চাবি বহনের জন্য , তাহলে সম্পদ কত ছিলো? ভেবে কুলকিনারা করা যাবে?

তখন আল্লাহর বান্দারা তাকে বলেছিল لَا تَفْرَحْ এটা দেখে বেশি আনন্দিত হয়ো না।

إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ الْفَرِحِين

কেননা আল্লাহ তাআলা অধিক আত্মম্ভরিতাকে পছন্দ করেন না।  কিন্তু সে বলে আরে এটা কি বল! উপার্জন আমার, সম্পদ আমার, চাবির গোছা আমার হাতে, ব্যবহারের যোগ্যতা আমার। দেওয়া না দেওয়ার ক্ষমতাও আমার।

মুসা (আ:) বলেন, আল্লাহ তোমাকে সম্পদ দিয়েছেন, এখন যাকাত দাও। বলে যাকাত কি? যাকাত হল, তোমার অস্থাবর মালের ১/১০ ভাগ। মুসা (আ:) এর শরীয়তে এমনটাই ছিল। আল্লাহর রাস্তায় দিয়ে দিবা। আগামী বছর আবার ১/১০ ভাগ এরপরের বছর আরও ১/১০ ভাগ।

কারূণ তখন হিসাব করে বলে, ভালোই তো ফন্দি বাঁধছো!  তাহলে এভাবে ১০ বছর পরে তুমি যেন কারুণ হয়ে যাও আর আমি তোমার মত ফকির মুসা হয়ে যাই। নাউজুবিল্লাহ!

বুঝে নাই, ক্যালকুলেটর নিয়ে বসে গেছে। আল্লাহর হিসাব বুঝে নাই। 

জান্নাতিদেরকে  আল্লাহ পাক জান্নাতে বলবেন ,আর কী লাগবে? যত জান্নাতী সকলে চিন্তা ভাবনা করে বলবেন, আল্লাহ, চাওয়ার মতো কিছু নাই । যেটা চিন্তা করি সেটাই দেখি সামনে। যেটা চাইবো, সেটাই  দেখি উপস্থিত আছে । তখন আল্লাহ পাক বলবেন, ও আমার বান্দারা আমি তোমাদের এমন একটা নেয়ামত দান করবো যেটা জান্নাতে ইতিপূর্বে তোমরা ভোগ করো নাই । সুবহানাল্লাহ।

তখন আল্লাহ পাক হিজাবে কিবরিয়া উঠাবেন। আস্তে করে ৩ বার। যখন ৭০ হাজার নূরের পর্দা উঠে যাবে । তখন আল্লাহ পাকের দীদার ও সৌন্দর্য জান্নাতীরা উপভোগ করতে থাকবেন। এক চাহনিতে ৭০ হাজার বছর পার হয়ে যাবে। অথচ বলতেই  পারবে না এত লম্বা সময় কীভাবে পার হয়ে গেল। সুবহানাল্লাহ।

আরও পড়তে পারেন-

সুপ্রিয় মুসল্লিয়ানে কেরাম, আল্লাহর শুকরিয়া করতে হবে এই যে, আল্লাহ ৫ ওয়াক্ত নামাজের তাওফীক দিয়েছেন।

কত বড় নেয়ামত! তিনবার এই ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়ার কারণে আমাদের শরীর পাক থাকে। আমাদের  কাপড় চোপড় পাক থাকে। আমাদের অযু ইস্তেঞ্জাও ঠিক থাকে। এটা আল্লাহ তায়ালার কত বড় রহমত! এই পবিত্রতার দ্বারা আল্লাহ জীব জন্তুর মত জীবন থেকে আমাদের রক্ষা করেছেন।  রাস্তার দ্বারে দেওয়ালের মধ্যে দাঁড়িয়ে পেশাব করে, আবার দৌড়ায়। যার সকাল নাই, দুপুর নাই, রাত নাই।  জিজ্ঞেসা করলে নির্লজ্জের মত বলে আমার কাপড় ঠিক নাই। শরীর ঠিক নাই। তুমি কি জীব জন্তু?  তোমাকে আল্লাহ তায়ালা আশরাফুল মাখলুকাত বানালেন, তুমি গরু ছাগল? তুমি যে , নির্লজ্জের মত বলছো আমার কাপড় ঠিক নাই! শরীর ঠিক নাই!

আল্লাহ পাক তোমাকে জান্নাতের বাসিন্দা হতে উপযোগী হওয়ার জন্য দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন। আল্লাহ পাক তোমার আদি পিতাকে ফেরেশতা দিয়ে সিজদা করিয়ে মর্যাাদাবান করিয়েছেন। আর তুমি ২৪ ঘণ্টা নাপাক হয়ে থাকো। নাপাক ভক্ষণ করো।  নাপাক দান করো! আফসোস!!

এক মণ পবিত্র দুধের মধ্যে যদি ১ ফোটা মদ যায়, তাহলে ৪০ কেজি দুধ পুরোটা নাপাক হয়ে যায়। আর সেই নাপাক মদ তুমি কি করে পান করো?  অথচ আল্লাহ পাক তোমাকে পবিত্র ইসলাম ধর্মাবলম্বী হওয়ার নিয়ামত দিয়েছেন। আল্লাহ পাক তোমাকে সম্মানিত করার জন্য  ফেরেশতাদের সামনে দাঁড় করিয়ে তাদেরকে দিয়ে সিজদা করিয়েছেন।তোমাকে সিজদা না করার কারণে ইবলিসকে আল্লাহ শয়তানকে বানিয়েছেন।  তোমাকে শুধু সিজদা না করার কারণে। কেন সিজদা করলে না? আমি হুকুম করলাম আমার আদমকে সম্মান প্রদর্শনের জন্য। কিন্তু দাম্ভিকতা করে সে তা করেনি। আমার মহাব্বাতের বান্দাকে সিজদা না করার কারণে তুমি কেয়ামত পর্যন্ত অভিসম্পাত নিয়ে আমার এই রহমতের এরিয়া হতে বের হয়ে যাও।

এতবড়  অভিসম্পাত আসলো মানুষকে সম্মান করে নাই এই জন্য। ওহে আল্লাহর বান্দারা, সেই মানুষ যদি নিজেকে সম্মান না করে, সেই মানুষ আমি যদি আমার সম্মান বঞ্চিত করে দেই, তাহলে আল্লাহ পাক কাল কেয়ামতের ময়দানে যখন জিজ্ঞাস করবেন যে, আরে আমি তোরে  সম্মান না করার কারণে, তোর আব্বাজানকে সম্মান না করার কারণে, শয়তানকে যদি আমি চির বেইজ্জতি করে থাকি তাহলে তুই নিজে যে সম্মান বঞ্চিত করলি, তোর ইনসাফে বল যে, তোর  কি বিচার হওয়া উচিত!

তুই যে নাপাক থাকলি, তুই যে নাপাক চিন্তা করলি, তোর চিন্তার মধ্যে যে পবিত্রতা ছিলো না, তোর বক্তব্যের মাঝে পবিত্রতা ছিলো না, তুই আল্লাহ পাকের মোকাবেলার চ্যালেঞ্জ দিতি! আরে তোরে তো সৃষ্টি করেছি এক ফোটা নাপাক পানি থেকে। আমার কুদরত দ্বারা কুদরতি হাতে বানিয়েছি। পৃথিবীর অন্য কোন জাতিকে, অন্য কোন প্রাণীকে এমনটি করি নাই।  আমি পৃথিবীতে হাজার হাজার কোটি মানুষ তৈরী করেছি,তাদের সকলের সামান্য আঙ্গুলের মাঝেও আমি পার্থক্য রেখে দিয়েছি। চোখের মাঝে আমি পার্থক্য রেখে দিযেছি।  আওয়াজের মাঝেও আমি পার্থক্য রেখে দিয়েছি। আমি বিশেষভাবে অনুদানগুলো দিয়েছি। অগণিত নেয়ামত দান করেছি। তবুও তোমরা আমার শুকরিয়া আদায় করলা না।  করলা বিদ্রোহ। তোমরা আমাকে অস্বীকার করলা। আমার কুদরতকে আস্বীকার করলা, গুরুত্বহীন করে দিলা। তোমার চিন্তা-চেতনা নাপাক, তোমার শরীর নাপাক, তোমার কাপড় নাপাক, তোমার জবানে মিথ্যা, তোমার দিলের ভিতর কূটিলতা-জটিলতা, হিংসা, তাকাব্বুর, যার কারণে ফেরেশতারা তোমার থেকে মাইলকে মাইল দূরে চলে যায়।

তোমাকে বানিয়েছিলাম শ্রেষ্ঠ মাখলুক। তোমাকে বানিয়েছিলাম সবচেয়ে সুন্দর অবয়বে। তাই তোমাকে শ্রেষ্ঠ কাজ করতে আদেশ করেছি। তুমি আমার প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করবে, আমি আল্লাহ তোমাকে প্রতিনিধিত্ব দান করে ছিলাম। কিন্তু তুমি হয়ে গেলা নিকৃষ্ট, দাম্ভিক, সীমালঙ্ঘনকারী, অকৃতজ্ঞ এবং বিপদগামী।

ফিরে এসো হকের পথে, সীরাতুল মুস্তাকিমের পথে। চিন্তা করো। চোখ বুজে একটু ভাবো। কী করার ছিলো। আর করছো কী!

আল্লাহ আমাদের সবাইকে সহিহ সমঝ দান করুন। একজন আশরাফুল মাখলুকাত হিসেবে নিজের মর্যাদা নিজেকে বুঝার তৌফিক দান করুন। আমাদের সবাইকে চির সুখের জান্নাতের জন্য মনোনীত করুন। এবং জীবনের সকল পর্যায়ে আল্লাহর শোকরিয়া আদায়, আদেশ পালন এবং সুন্নাহ অনুযায়ী জীবন গড়ার তাওফীক দান করুন। আমীন।

অনুলিখন- মাওলানা আতাউর রহমান

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।