Home ইসলাম বিপন্ন প্রাণী সংরক্ষণে ইসলাম যে নির্দেশনা দেয়

বিপন্ন প্রাণী সংরক্ষণে ইসলাম যে নির্দেশনা দেয়

জলবায়ুর পরিবর্তন, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ও মানুষের বিবেকহীন কর্মকাণ্ড পৃথিবীর জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে ফেলেছে। নিকট অতীতের বহু প্রাণী কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে এবং বহু প্রাণী আছে বিপন্ন হওয়ার পথে। ইসলাম সৃষ্টিজগেক ‘আল্লাহর পরিবারভুক্ত’ আখ্যা দিয়ে সবার প্রতি সহানুভূতিশীল আচরণ করার নির্দেশ দিয়েছে। ইসলাম প্রাণী ও প্রকৃতির ক্ষতি হয় এমন সব কাজ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘শান্তি স্থাপনের পর তোমরা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি কোরো না।’ (সুরা আরাফ, আয়াত : ৫৬)

প্রাণী সংরক্ষণে ইসলামের সর্বজনীন দুই নীতি 

প্রাণিজগতের সুরক্ষায় ইসলাম সবর্জনীন দুটি নীতি অবলম্বন করে, যা প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় জীবনের সব ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। তা হলো—

এক. সৃষ্টিজগতের প্রতি মমত্ব : ইসলাম সাধারণভাবে সব সৃষ্টির প্রতি ভালোবাসা ও মমত্ব প্রদর্শনের নির্দেশ দিয়েছে। বিশেষত জীবের প্রতি। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ দয়ালুদের প্রতি দয়া করেন। তোমরা জমিনবাসীর প্রতি অনুগ্রহ কোরো, আসমানবাসী (আল্লাহ) তোমাদের প্রতি অনুগ্রহ করবেন। দয়া-অনুগ্রহ আল্লাহ থেকে উদগত। যে ব্যক্তি দয়ার সম্পর্ক বজায় রাখে, আল্লাহও তার সঙ্গে নিজ সম্পর্ক বজায় রাখেন। যে ব্যক্তি দয়ার সম্পর্ক ছিন্ন করে, আল্লাহ তার সঙ্গে দয়ার সম্পর্ক ছিন্ন করেন।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ১৯২৪)

আরও পড়তে পারেন-

দুই. বিপর্যয় সষ্টিকারী সব কিছু নিষিদ্ধ : প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করে, মানব সমাজ ও সভ্যতার জন্য ক্ষতিকর ও বিপর্যয় ডেকে আনে—এমন সব কিছু নিষিদ্ধ করেছে ইসলাম। কেননা পবিত্র কোরআনের নির্দেশ হলো, ‘শান্তি স্থাপনের পর তোমরা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি কোরো না।’ (সুরা আরাফ, আয়াত : ৫৬)

উল্লিখিত আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা ইবনে কাসির (রহ.) বলেন, ‘পৃথিবীর (মানব, প্রাণী ও প্রকৃতির) জন্য ক্ষতিকর—এমন সব কাজ থেকে আল্লাহ বিরত থাকতে বলেছেন। এমনকি সেসব কাজ থেকেও, যার সূচনা হয় ভালো হিসেবে কিন্তু তার ফলাফল বিপর্যয় ডেকে আনে। বস্তুত এমন কাজই বেশি ক্ষতির কারণ হয়।’ (তাফসিরে ইবনে কাসির)

উল্লিখিত আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় শুধু বিপন্ন করে এমন বিষয় নয়, বরং প্রাণী, প্রকৃতি ও সৃষ্টিজগেক হুমকির মুখে ফেলে দেয়—এমন যেকোনো কাজই নিষিদ্ধ।

সংরক্ষণের অধিকার আছে প্রাণিকুলের :

ইসলাম মানুষের মতো প্রাণিকুলেরও যৌক্তিক অধিকার সংরক্ষণ করে। এ ক্ষেত্রে পবিত্র কোরআনের একটি আয়াত বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। আল্লাহ বলেন, ‘ভূ-পৃষ্ঠে বিচরণশীল এমন জীবন নেই বা নিজ ডানার সাহায্যে এমন কোনো পাখি ওড়ে না কিন্তু তারা তোমাদের মতো একটি জাতি।’ (সুরা আনআম, আয়াত : ৩৮)

উল্লিখিত আয়াতের ‘তোমাদের মতো একটি জাতি’ বাক্যটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা তা দ্বারা যেমন প্রাণিকুলের শ্রেণিবদ্ধতা, সমাজবদ্ধতা বোঝানো সম্ভব, তেমনি তাদের অধিকার ও সংরক্ষণের নির্দেশনাও লাভ করা যায়। আল্লামা ইবনে কুতাইবা (রহ.) আয়াতের ব্যাখ্যায় যেমনটি বলেছেন, ‘তারা খাদ্য গ্রহণ, জীবিকার অনুসন্ধান ও ধ্বংস থেকে রক্ষার দিক থেকে তোমাদের মতো।’ (তাফসিরে বাগাবি)

অর্থাৎ প্রাণিকুলের অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িত জীবন, জীবিকা ও বিচরণক্ষেত্র সংরক্ষণ করা ইসলামের দাবি।

জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কেন প্রয়োজন : 

প্রাণী-অধিকার বিষয়ক আয়াত ও হাদিস বিশ্লেষণ করলে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জোর তাগিদ পাওয়া যায়। বিশেষত কোরআনের একাধিক স্থানে প্রাণিকুলকে উপকারী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বিভিন্ন প্রাণীর উপমা পেশ করে, সৃষ্টিগত বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করে তার গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে। যেমন মহান আল্লাহ বলেন, ‘তিনি চতুষ্পদ জন্তু সৃষ্টি করেছেন; তোমাদের জন্য তাতে শীত নিবারক উপকরণ ও বহু উপকার আছে। এবং তা থেকে তোমরা আহার করে থাকো। এবং তোমরা যখন গোধূলি লগ্নে তাদের চারণভূমি থেকে ঘরে নিয়ে আসো এবং প্রভাতে যখন তাদের চারণভূমিতে নিয়ে যাও, তখন তোমরা তার সৌন্দর্য উপভোগ কোরো। তারা তোমাদের ভার বহন করে নিয়ে যায় এমন দেশে, যেখানে প্রাণান্ত কষ্ট ছাড়া তোমরা পৌঁছতে পারতে না। তোমাদের প্রতিপালক অবশ্যই দয়ার্দ্র, পরম দয়ালু। তোমাদের আরোহণের জন্য ও শোভার জন্য তিনি সৃষ্টি করেছেন ঘোড়া, খচ্চর ও গাধা এবং তিনি সৃষ্টি করেছেন এমন অনেক কিছু, যা তোমরা অবগত নও।’ (সুরা নাহল, আয়াত : ৫-৮)

উল্লিখিত আয়াতে আল্লাহ প্রাণিজগতের বহুমুখী উপকার ও সৌন্দর্য, মানবজাতির জন্য তাদের অস্তিত্বের গুরুত্ব ও প্রাণিজগতের বিস্তৃতি সম্পর্কে ধারণা দিয়েছেন। শেষোক্ত আয়াতে ‘শোভার জন্য সৃষ্টি করেছেন’ বাক্যটি বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। কেননা শোভা শব্দের মধ্যে আল্লাহর অনুগ্রহ হওয়ার অর্থ এবং তা সংরক্ষণের দাবি আছে।

বিপন্ন প্রাণী সংরক্ষণে নির্দেশনা : 

কোনো প্রাণী যদি বিপন্ন হয় এবং তার অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ে, তবে তা সংরক্ষণে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে, যেন তার অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে না যায়। কেননা নুহ (আ.)-এর মহাপ্লাবনের সময় আল্লাহ তাআলা প্রাণিকুলের অস্তিত্ব রক্ষায় নির্দেশ দিয়েছিলেন—‘অবশেষে যখন আমার আদেশ এলো এবং চুলা উথলিয়ে উঠল; আমি বললাম, তাতে উঠিয়ে নাও প্রতিটি শ্রেণির যুগলের দুটি করে।’ (সুরা হুদ, আয়াত : ৪০)

উল্লিখিত আয়াত থেকে যেসব শিক্ষা লাভ করা সম্ভব, তা হলো—প্রাণিকুলের অস্তিত্ব মানবজাতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ, তাদের সংরক্ষণে মনোযোগী হতে হবে এবং প্রয়োজনে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে যে তাদের অস্তিত্ব রক্ষা পায়।

বিপন্ন প্রাণী সংরক্ষণে যা করা যেতে পারে : ফিকহশাস্ত্রের বেশির ভাগ ইমামের মতে, ঘোড়ার গোশত খাওয়া বৈধ। তবে হানাফি মাজহাবের ইমামরা ঘোড়ার গোশত খাওয়া মাকরুহ মনে করেন এবং মালেকি মাজহাবের একদল ইমাম তা হারাম বলে মত দিয়েছেন। যাঁরা ঘোড়ার গোশত মাকরুহ বা হারাম বলে মত দিয়েছেন, তাঁরা সুনানে নাসায়ির একটি হাদিস (নম্বর ৪৩৩২) দ্বারা দলিল পেশ করার পাশাপাশি দুটি যুক্তি পেশ করেন। তা হলো—এক. আল্লাহ তাআলা সুরা নাহলের ৮ নম্বর আয়াতে ঘোড়ার বাহন ও শোভা হওয়ার দিককে প্রাধান্য দিয়েছেন; দুই. যুদ্ধের প্রয়োজনে ঘোড়ার সংরক্ষণ অপরিহার্য। (আল-ফিকহু আলা মাজাহিবিল আরবাআ, পৃষ্ঠা ৬৫৮; ইসলামিক কোয়েশ্চেন.ইনফো, প্রশ্ন নম্বর ৭০৩২০)

উল্লিখিত দুটি যুক্তি সামনে রেখে বলা যায়—যেহেতু সন্দেহাতীতভাবে প্রাণিবৈচিত্র্য পৃথিবীর শোভা এবং ইসলামে তা রক্ষার সাধারণ তাগিদও রয়েছে, তাই কোনো প্রাণীর অস্তিত্ব বিপন্ন হলে তা সংরক্ষণে সময়ের ফকিহ ও মুজতাহিদ আলেমরা প্রয়োজনে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন। এর মধ্যে বিপন্ন প্রাণী শিকারে সাময়িক নিষেধাজ্ঞা আরোপ, তার জন্য বিচরণভূমি সংরক্ষণ, প্রজনন বৃদ্ধির উদ্যোগ ইত্যাদি থাকতে পারে।

উম্মাহ২৪ডটকম: এসএএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।