Home ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন হিফযকৃত কুরআন ভুলে যাওয়ার উপর হুঁশিয়ারী

হিফযকৃত কুরআন ভুলে যাওয়ার উপর হুঁশিয়ারী

।। মাওলানা মুহাম্মদ ওমর কাসেমী ।।

মহাগ্রন্থ পবিত্র আল কুরআন সংরক্ষণের পূর্ণ দায়িত্ব মহান স্রষ্টা নিজ দায়িত্বে রেখেছেন। তাই তো কালের এত আবর্তন-বিবর্তন, কোন প্রকার ঘটাতে পারেনি পরিবর্তন। ইরশাদ হচ্ছে, আমিই একে অবতীর্ণ করেছি এবং আমিই সংরক্ষণকারী। (সুরা হিজর)।

আল কুরআনই বিশ্বে একমাত্র গ্রন্থ, যাকে লক্ষ লক্ষ মানুষ আদ্যোপান্ত মুখস্থ করে সংরক্ষণ করে আসছে। ছোট-বড় সর্বমোট ১০৪ খানা ঐশীগ্রন্থের মধ্যে একমাত্র কুরআনের বেলায়ই এমনটা হয়েছে। অন্য কোন গ্রন্থই এমন ছিল না, যাকে এভাবে অসংখ্য লোক মুখস্থ করত। বেশি হলে দু চার জন মুখস্থ করত। তেমনি এই বিশ্বেও রচিত কোন গ্রন্থ নেই, যাকে অবিৱত মুখস্থ এবং তেলাওয়াত করে থাকে। আল্লাহ তাআলা একে মুখস্থ করার জন্য সহজ করে দিয়েছেন।

ইরশাদ ফরমান, “আমি কুরআনকে সহজ করে দিয়েছি জিকরের জন্য, অতএব কোন চিন্তাশীল আছে কি?” (সুরা কামার)। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, লক্ষ লক্ষ শিশু-আবাল-বৃদ্ধ নির্বিশেষে কুরআন মুখস্থ করলেও অবহেলা আর অলসতার দরুন ভুলে যাচ্ছে প্রায়ই। এই ভুলে যাওয়ার পরিনাম যে কত ভয়াবহ তা হয়ত একটিবারের জন্যও উপলব্ধি করার প্রয়োজন বোধ করেনি। এই সকল ভুলে যাওয়া হাফেয কারীদের উদ্দেশ্যেই উক্ত শিরোনামের অবতারণা। আশা করব, ভুলে যাওয়া ভাইয়েরা পুনঃহিফযের লক্ষ্যে আত্মনিয়োগ করবেন।

আল্লামা নববী (রহ.) ‘রওজা’ নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেন, কুরআন হিফজ করার পরে তা ভুলে যাওয়া কবীরা গুনাহ।

আবু দাউদ শরীফ’-এ একটি হাদীস বর্ণিত আছে, নবী (সা.) ইরশাদ ফরমান, একবার আমার সম্মুখে আমার সমস্ত উম্মতের সকল প্রকার ছোট-বড় গুনাহ পেশ করা হল। আমি লক্ষ্য করলাম, সর্বোচ্চ গুনাহ এবং অপরাধ হচ্ছে, যাকে মহান আল্লাহ্ পূর্ণ আল কুরআন কিংবা কুরআনের একটি সুরা বা একটি আয়াত দান করেছিলেন, অতঃপর সে ওটা ভুলে গেছে।

অন্য একটি হাদীস এই মর্মে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেন- যে ব্যক্তি পবিত্র কুরআন হিফজ করল, অতঃপর তা বিস্মৃত হয়ে গেল, কেয়ামতের দিবসে মহান বিচারক আল্লাহর দরবারে উক্ত ব্যক্তি আঙ্গুল কর্তিত অবস্থায় উপস্থিত হবে। (মিশকাত)।

প্রিয়পাঠক! বর্ণিত দুটি হাদীসেই গভীরভাবে চিন্তার বিষয় রয়েছে। প্রকৃত বন্ধু মহান অভিভাবক আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎদিবসে হাতের আঙ্গুল কর্তিত এবং সর্ববৃহৎ পাপের বোঝা নিয়ে উপস্থিত হওয়া কতই না লজ্জা আর অপমানের কথা। এর থেকে বড় পরিতাপের বিষয় আর কি-বা হতে পারে?

হযরত আবু মুছা আশআরী (রাযি.) কর্তৃক বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী (সা.) বলেছেন, তোমরা কুরআনের প্রতি সদা লক্ষ্য রাখবে। সেই পবিত্র সত্তার কসম, যার হাতে আমার জীবন, নিশ্চয়ই কুরআন রশিতে বাঁধা উষ্ট্র অপেক্ষা অধিক পলায়নপর। (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত)।

হাদীসের ব্যাখ্যাা: বর্ণিত হাদীসে দুটি অংশ রয়েছে। প্রথমাংশে নবী (সা.) ইরশাদ ফরমান, তোমরা সর্বক্ষণ কুরআন তেলাওয়াত করতে থাক। তিনি এখানে نعاھد শব্দ মাসদার (ক্রিয়ামূল) ব্যবহার করেছেন। যার অর্থ, সংরক্ষণ করা, চুক্তি নবায়ন করা। তাহলে এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে – তোমরা কুরআন তেলাওয়াতের উপর স্থিতিশীল হও। আল কুরআন-এর তেলাওয়াত অনবরত করতে থাক, যেন কুরআনকে বিস্মৃত না হও।

দ্বিতীয়াংশ নবী (সা.) বিশ্ব স্রষ্টা মহান আল্লাহর পবিত্র সত্তার শপথ করে যখন কোনক্রমে কে বন্ধনযুক্ত করতে পারে, তখন যেমন প্রভু থেকে দ্রুত পলায়ন করে এবং পুনঃ মালিকের কাছে স্বেচ্ছায় ফিরে আসা সম্ভাবনা থাকে না বা প্রাপ্তির আশা করা যায় না। তেমনি হিফযকৃত কুরআন অলসতার দরুণ বিস্মৃত হলে পুনঃ তা অস্তরে ফিরে আসা দুঃসাধ্য বটে।

আল্লামা তিবী (রহ.) পবিত্র গ্রন্থ আল কুরআন বন্ধ থেকেও সাথী থেকে দ্রুত পলায়নকারী কেন? এর ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, আল মানবজাতির সত্তাগত বা কৃত্রিম কালাম নয়; বরং কুরআন হচ্ছে বিশ্বস্রষ্টা মহান আল্লাহর নিজস্ব কালাম। খালেক এবং মাখলুক অর্থাৎ স্রষ্টা ও সৃষ্টি উভয়ের মাঝে নেই কোন নিকটতম বা গভীরতম পারস্পরিক সম্পর্ক। কেননা জগত স্রষ্টা হচ্ছেন অনাদি, আর সৃষ্টি হচ্ছে ক্ষণস্থায়ী। অতএব, উভয়ের মাঝে নিকটতম সম্পর্কের কল্পনাও কাণ্ডজ্ঞানহীনতা।

এতদসত্ত্বেও মহান প্রভুর একমাত্র কৃপা আর অনুগ্রহ যে, এত বড় নেয়ামত সর্বোত্তম সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সর্বশেষ ঐশীগ্রন্থ মহাপবিত্র আল কুরআনকে অন্য কোন জাতিকে দান না করে ইনসান জাতিকে দান করেছেন।

অতএব, আমাদের সাধ্যানুযায়ী সকলের উচিত, পবিত্র কুরআনকে ভুলে না গিয়ে অলসতা-উদাসীনতা পরিহার করে কুরআনের সংরক্ষণ এবং তিলাওয়াতের উপর স্থিতিশীল থাকার লক্ষ্যে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া।

মাসআলা : কেউ যদি পবিত্র কুরআনের কোন একটি অংশ, সুরা বা আ বিস্মৃত হয়, তাহলে এ কথা না বলা উচিত- আমি অমুক সুরা বা আয়াতটি ভুলে গেছি। বরং তার উচিত এই বলা, আমাকে ভুলানো হয়েছে।

আরও পড়তে পারেন-

মিরকাত গ্রন্থে এই বিষয়ে আল্লামা নববী (রহ.) এর উক্তি বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লামা নববী বলেন, এরূপ বলা মাকরূহ যে, আমি অমুক সুরা ভুলে গেছি; বরং এরূপ বলবে, আমাকে ভুলানো হয়েছে। (মিরকাত ৫ম খন্ড)। হাদীসেও এ বিষয়ে সুস্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে-

হযরত ইবনে মাসউদ (রাযি.) কর্তৃক বর্ণিত, তিনি বলেন- রাসুল (সা.) ইরশাদ ফরমান, কারো এরূপ বলা কি জঘন্য কথা, আমি কুরআনের অমুক অমুক আয়াত ভুলে গেছি; বরং সে যেন বলে, তাকে ভুলানো হয়েছে। তোমরা পুনঃ পুনঃ কুরআন ইয়াদ করবে। কেননা এটা মানুষের অন্তর হতে চুতষ্পদ জন্ত অপেক্ষাও অধিক পলায়নপর। (মিশকাত)।

উল্লেখিত মাসআলার সমর্থন কুরআনের একটি আয়াত থেকেও বুঝে আসে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ ফরমান, এমনিভাবে তোমার কাছে আমার নির্দেশাবলী (আয়াত সমূহ) এসেছিল। অতঃপর তুমি সেগুলো ভুলে গিয়েছিলে। তেমনিভাবে তোমাকে আজ ভুলে যাওয়া হবে। (সুরা ত্ব-হা)।

জ্ঞাতার্থে এই কথা বলা প্রয়োজন যে, কোন হাফেযে কুরআন হিফয করার পরে তার তেলাওয়াত সর্বদা অব্যাহত রাখার পরেও যদি স্মৃতিশক্তি প্রচন্ডভাবে সংকুচিত হওয়ায় বিস্মৃত হয়, তবে সে বর্ণিত বিধানের আওতাভুক্ত নয়।

উক্ত বিষয়ের স্বপক্ষে সাহাবী হযরত আবু উবাইদা (রাযি.)এর উক্তি পেশ করা যেতে পারে। তিনি বলেন, যে ব্যক্তি পবিত্র কুরআন হিফয করতে আগ্রহী এবং তার তিলাওয়াত অনবরত করতে থাকল, কিন্তু সে স্মৃতিশক্তির কাছে হেরে যায়, তবে উক্ত ব্যক্তি হাদীসে বর্ণিত হুশিয়ারী এবং শাস্তির অন্তর্ভূক্ত হবে না। (মিরকাত ৫ম খন্ড)।

হাদীসের কিতাবসমূহে এর সমর্থনে একটি হাদীস বর্ণিত রয়েছে যে, জনৈক সাহাবী (রাযি.) এক রাত্রিতে কুরআন তিলাওয়াত করছিলেন। ইত্যবসরে নবী (সা.)এর গমন সে পথে হওয়ায় হুযূর (সা.) তার তিলাওয়াত শুনতে পান। অতঃপর হুযূর (সা.) অত্যন্ত হর্ষচিত্তে ইরশাদ ফরমান আল্লাহ তার উপর রহমত বর্ষণ করুন। সে আমাকে বিস্মৃত হওয়া অমুক আয়াতটি স্মরণ করে দিয়েছে। (বুখারী, মিরকাত ৫ম খন্ড)।

সু-প্রিয়পাঠক, এতক্ষণ পর্যন্ত মাসায়েলে নিসয়ান অর্থাৎ কুরআন বিস্মৃত হওয় সম্পর্কে যেসব আলোচনা এবং মাসায়েল তুলে ধরা হল, এসব বিধান শুধু হাফেয কিংবা গায়রে হাফেযের সাথে সম্পৃক্ত নয়, বরং বর্ণিত বিধান সকলের বেলাতেই প্রযোজ্য হবে।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।