Home ফিকহ ও মাসায়েল দারুল উলূম হাটহাজারীতে জামাতের পর সম্মিলিতভাবে হাত তুলে কেন মুনাজাত করা হয়...

দারুল উলূম হাটহাজারীতে জামাতের পর সম্মিলিতভাবে হাত তুলে কেন মুনাজাত করা হয় না?

।। মুফতি ফরীদুল হক ।।

[সোমবার (১৫ নভেম্বর) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সর্ববৃহৎ ইসলামী বিদ্যাপীঠ আল-জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী’র কেন্দ্রীয় মসজিদ জামে বায়তুল কারীমে সাপ্তাহিক তারবিয়তী মজলিসে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে জামিয়ার মুফতি ও মুফাসসির মুফতি ফরীদুল হক (হাফি.) “দারুল উলূম হাটহাজারীতে ফরজ নামাজের পর সম্মিলিতভাবে হাত তুলে কেন দুআ-মুনাজাত করা হয় না” শীর্ষক গুরুত্বপূর্ণ বয়ান পেশ করেন। বয়ানের সারসংক্ষেপ পাঠকদের উদ্দেশ্যে নিম্নে উপস্থাপন করা হলো]

“জামিয়ার পক্ষ থেকে আজ আমাকে আপনারা তালিবানে উলূমে নবুওয়াতের উদ্দেশ্যে কিছু কথা বলার জন্য হুকুম করা হয়েছে। বিষয়বস্তু দেওয়া হয়েছে “দারুল উলূম হাটহাজারী ফরজ নামাযের পর সম্মিলিতভাবে কেন দুআ-মুনাজাত করা হয় না?” আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার তাওফীক শামিলে হাল হলে এ বিষয়ের উপর সংক্ষিপ্তাকারে কিছু বলার চেষ্টা করব, ইন শা আল্লাহ।

প্রিয় তালিবানে উলূমে নবুওয়াত!
মানুষ জীবনের ক্ষণে ক্ষণে, পরতে পরতে আল্লাহর সাহায্য ও অনুগ্রহের মুখাপেক্ষী। আল্লাহর সাহায্য ব্যতীত মানবজীবন যেন একেবারেই অচল। আর আল্লাহর সাহায্য লাভের অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে দুআ। তাই মানবজীবনে দুআর গুরুত্ব অপরিসীম। হাদীস শরীফে এসেছে-

الدعاء سلاح المؤمن অর্থাৎ- “দুআ মূমিনের হাতিয়ার”। (মুসতাদরক- ১৮৫৫)।

الدعاء هو العبادة অর্থাৎ- “দুআ-ই ইবাদত”। (আবূ দাঊদ- ১৪৭৯)।

আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন-

وَإِذَا سَأَلَكَ عِبَادِي عَنِّي فَإِنِّي قَرِيبٌ أُجِيبُ دَعْوَةَ الدَّاعِ إِذَا دَعَانِ অর্থাৎ- (হে নবী!) আমার বান্দাগণ যখন আপনার কাছে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে, তখন (আপনি তাদেরকে বলুন,) আমি এত নিকটবর্তী যে, কেউ যখন আমাকে ডাকে তখন আমি তার ডাক শুনি। (সূরা-বাকারা- ১৮৬)।

অন্যত্রে ইরশাদ করেছেন- أدعوني أستجب لكم অর্থাৎ- “তোমরা আমার কাছে প্রার্থনা কর, আমি তোমাদের প্রার্থনা কবূল করব।” (সূরা মূমিন, আয়াত- ৬০)।

দুআর এত গুরুত্ব থাকা সত্ত্বেও দারুল উলূম হাটহাজারীতে ফরজ নামাযের পর সম্মিলিতভাবে দুআ-মুনাজাত কেন করা হয় না? স্বাভাবিকভাবেই এটি সকলের বড় প্রশ্ন।

প্রিয় তালিবানে উলূমে নবুওয়াত!
ফরজ নামাযের পর সম্মিলিতভাবে দুআ-মুনাজাত করার হুকুম নিয়ে আহলে হক উলামায়ে কেরামের মাঝে দুই পক্ষ রয়েছে। এক পক্ষের উলামায়ে কেরাম বলেন, এটি মুস্তাহাব। অন্য পক্ষের উলামায়ে কেরাম বলেন, এটি মাকরূহ ও বিদআত।

যেসব উলামায়ে কেরাম এটিকে মুস্তাহাব বলেন, তাঁরা কয়েকটি হাদীসকে একত্র করে প্রমাণ হিসেবে পেশ করেন। তাঁরা বলেন, হাদীস শরীফে এসেছে- সালাতুল ইস্তিছকা ও সালাতুল কুছূফে রাসূল (সা.) সম্মিলিতভাবে হাত উঠিয়ে দুআ করেছেন, ফরজ নামাযের পর দুআ কবূল হয় এবং ফরজ নামাযের পর রসূল (সা.) বিভিন্ন দুআ করেছেন। অতএব, ফরজ নামাযের পর সম্মিলিতভাবে দুআ করা মুস্তাহাব। তাঁরা এটি প্রমাণ করার জন্য এমন কোনো হাদীস পেশ করতে অক্ষম, যার মধ্যে রাসূল (সা.) ফরজ নামাযের পর সম্মিলিত ভাবে দুআ করেছেন বলে স্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে।

আরও পড়তে পারেন-

যেসব উলামায়ে কেরাম ফরজ নামাযের পর দুআ করাকে মাকরূহ ও বিদআত বলেন, তাঁরা প্রমাণ হিসেবে পেশ করেন আদমে নকল (عدم نقل)অর্থাৎ, এটি রসূল (স.), সাহাবায়ে কেরাম (রযি.) এবং তাবেয়ীন (রহ.) থেকে প্রমাণিত নয়। তাঁরা বলেন যে, ফরজ নামায দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত। রাসূল (সা.) হিজরতের পূর্বে মক্কায় নামায পড়েছেন। হিজরতের পর মদীনায় ১০ বছর ইমামতী করেছেন। যদি রাসূল (সা.) ফরয নামাযের পর সম্মিলিতভাবে দুআ করতেন , তাহলে তা সহীহ ও মাশহূর-বর্ণনা সূত্রে বর্ণিত হত। অথচ সহীহ ও মাশহূর-বর্ণনা তো দূরের কথা, একটি যয়ীফ বর্ণনায়ও তা উল্লিখিত হয় নি। সাহাবায়ে কেরাম (রযি.) যেখানে রাসূল (সা.)এর শুধু ইবাদত নয়; আদতগুলোও পুঙ্খানুপুঙ্খ সংরক্ষণ করে বর্ণনা করেছেন, সেখানে এত সুস্পষ্ট ও গুরুত্বপূর্ণ আমল তাঁরা বর্ণনা না করে এড়িয়ে যাবেন- এমন ধারণা কস্মিনকালেও সঠিক নয়। এটি যেভাবে রাসূল (সা.) থেকে প্রমাণিত নয়, তদ্রূপ সাহাবায়ে কেরাম এবং তাবেয়ীন থেকেও প্রমাণিত নয়। অতএব, এটি মাকরূহ ও বিদআত। আল্লামা শাহ ইসহাক মুহাদ্দিসে দেহলভী (রহ.) বলেন-

عدم نقل از حضرت صلی اللہ علیہ وسلم وصحابہ وتابعین دلالت بر بدعت وکراہت فعل دارد، واصرار بر بدعت مکروہ وگناہ کبیرہ است۔ (ماٴۃ مسائل : ৮৩)

এ বিষয়টি সর্বদা স্বরণ রাখতে হবে যে, শুধু ইবাদত করলে হবে না; বরং ইবাদত রাসূল (সা.)এর তরীকা অনুযায়ী হতে হবে; রাসূল (সা.)-এর সুন্নাহর রঙে রঙিন হতে হবে। অন্যথায় তা নিষ্ফল বরং ক্ষতিকর হবে। উদাহরণস্বরূপ- নামায সবচেয়ে বড় ইবাদত। তবে যে তিন ওয়াক্তে রাসূল (সা.) নামায পড়তে নিষেধ করেছেন তাতে নামায পড়া যাবে না। রোযা রাখা বড় ইবাদত, তবে যে পাঁচ দিন রোযা রাখতে রাসূল (সা.) নিষেধ করেছেন, সে পাঁচ দিন রোযা রাখা যাবে না। রাসূল (সা.) ঘরে প্রবেশের সময়, ঘর থেকে বের হওয়ার সময়, শৌচাগারে প্রবেশের পূর্বে এবং শৌচাগার থেকে বের হওয়ার পর প্রভৃতি বিভিন্ন সময় ও স্থানে বিভিন্ন দুআ পড়েছেন, তবে তাতে হাত উঠান নি। তদ্রূপ এসব দুআ পড়ার সময় হাত উঠানো যাবে না। হাত না উঠানোই সুন্নাত ও ইবাদত।

ফরজ নামাযের পর সম্মিলিতভাবে দুআ করার বিষয়টিও অনুরূপ। রসূল (স.) এমনটি করেন নি বিধায় এটি করা যাবে না। তবে যেহেতু হাদীস শরীফে এসেছে, ফরজ নামাযের পর দুআ কবূল হয় এবং রাসূল (সা.)-ও ফরজ নামাযের পর বিভিন্ন দুআ পড়েছেন- এজন্য একাকী দুআ করা যাবে। এতে শরয়ী দৃষ্টিকোণ থেকে কোনো বাধা নেই।

ফরজ নামাযের পর সম্মিলিতভাবে দুআ করাকে যদি মুস্তাহাব মেনেও নেওয়া হয়, তবুও বর্তমান মানুষ এটিকে অত্যাধিক গুরুত্ব দেওয়া, এমনকি অনেকে এটিকে নামাযের সাথে সম্পৃক্ত বিষয় মনে করার দরুন তা পরিত্যাজ্য।

من أصر على أمر مندوب وجعله عزما ولم يعمل بالرخصة فقد أصاب منه الشيطان من الإضلال، فكيف من أصر على أمر بدعة أو منكر. (مرقاة المفاتيح، كتاب الصلاة : ৩/৩১)

মুফতিয়ে আযম মুফতী ফয়যুল্লাহ (রহ.) এক সময় ফরজ নামাযের পর সম্মিলিতভাবে দুআ করার পক্ষে ছিলেন এবং নিজেও আমল করতেন। পরবর্তীতে তিনি যখন এ বিষয়ে তাহকীক করলেন, তখন জানতে পারলেন যে, এটি রাসূল (সা.), সাহাবায়ে কেরাম (রযি.) এবং তাবেয়ীন (রহ.) থেকে প্রমাণিত নয়। তারপর থেকে তিনি এটিকে মাকরূহ ও বিদআত বলে ফাতওয়া দেন। এটি শুধু মুফতী ফয়জুল্লাহ (রহ.)-এর তাহকীক- বিষয়টি এমন নয় ; বরং এর বহুপূর্বে আল্লামা ইবনে তাইমিয়া, আল্লামা ইবনুল কইয়ূম, আল্লামা আনওয়ার শাহ কাশমীরী এবং আল্লামা ইউসূফ বানূরী (রহ.) প্রমুখ জগদ্বিখ্যাত ফকীহগণ এটি রসূল (স.) এবং সাহাবায়ে কেরাম থেকে প্রমাণিত নয় বলে উল্লেখ করেছেন।

এজন্য দারুল উলূম হাটহাজারীতে ফরজ নামাযের পর সম্মিলিতভাবে দুআ-মুনাজাত করা হয় না।

প্রিয় ছাত্র ভাইয়েরা!
ফরজ নামাযের পর সম্মিলিতভাবে দুআ করার হুকুম নিয়ে যদিও আহলে হক উলামায়ে কেরামের মাঝে দুই পক্ষ হয়েছে, তবে এক পক্ষ অপর পক্ষকে কোনো প্রকার তিরস্কার-ভর্ৎসনা করতে পারবে না। কোনো পক্ষ এ কথা বলতে পারবে না যে, আমরা নিশ্চিতরূপে সঠিক-এর উপর রয়েছি; অপর পক্ষ নিশ্চিতরূপে ভুলের মধ্যে রয়েছে। কেননা, যেসব বিষয় সরাসরি কুরআন-হাদীসের নুসূস দ্বারা প্রমাণিত নয়, সেসব বিষয়ে ইজতিহাদের যোগ্য ব্যক্তিদেরকে শরীয়ত ইজতিহাদের অনুমতি প্রদান করেছে। ইজতিহাদ করে যে ফলাফল বের হবে, তার উপর তাঁরা আমল করবে। আর এটি সর্বস্বীকৃত বিষয় যে, সর্বদা সব মুজতাহিদের ইজতিহাদের ফলাফল এক হয় না। যেমন ইমাম আবূ হানীফা, ইমাম মালেক, ইমাম শাফেয়ী এবং ইমাম আহমদ (রহ.)-এর ক্ষেত্রে হয়েছে। তাঁদের ইজতিহাদের ফলাফল এক না হওয়ার কারণেই তো চার মাযহাবের অস্তিত্ব। তবে সব-ই নাজাতপ্রাপ্ত। যদিও প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর নিকট ‘হক’ হল একটি।

আল্লামা হাসকফী (রহ.) বলেন-

إذا سئلنا عن مذهبنا و مذهب مخالفنا، قلنا وجوبا : مذهبنا صواب يحتمل الخطأ، ومذهب مخالفنا خطأ يحتمل الصواب.

“আমাদেরকে আমাদের মাযহাব এবং আমাদের বিপক্ষ-মাযহাব সম্পর্কে যখন প্রশ্ন করা হবে, তখন আমরা অবশ্যই বলব যে, আমাদের মাযহাব সঠিক, তবে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আর আমাদের বিপক্ষ-মাযহাব ভুল, তবে সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা আছে।” (দুররে মুখতার, ভূমিকা- ১/১৮৮-১৯৯)।

এটি হচ্ছে ফিকহী-ফুরূয়ী মাসায়িলের ক্ষেত্রে। আকায়িদের মাসায়িলের ক্ষেত্রে কিন্তু আমরা বলব, আমরা নিশ্চিতরূপে ‘হকের’ উপর রয়েছি । আর আমাদের বিপক্ষরা নিশ্চিতরূপে ভ্রষ্টতার মধ্যে রয়েছে। যেমনটি আল্লামা হাসকফী (রহ.) বলেছেন-

إذا سئلنا عن معتقدنا ومعتقد خصومنا، قلنا وجوبا : الحق ما نحن عليه، والباطل ما عليه خصومنا. (الدر المختار : ১/১৯৯)

আজ এতটুকুতেই আলোচনা সমাপ্ত করলাম। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে সঠিক পথে পরিচালনা করুন, দীনের সহীহ বুঝ দান করুন, বিদআত থেকে দূরে রাখুন, সর্বক্ষেত্রে রাসূল (সা.) এবং খুলাফায়ে রাশেদীনের পদাঙ্ক অনুসরণ করার তাওফীক দান করুন। আমীন।”

অনুলিখন- ইয়াছিন আরাফাত রাফি

শিক্ষার্থী- ইসলামী আইন ও গবেষণা বিভাগ, আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।