Home ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন ‘আত্মার পরিচয় এবং ঈমানের গুরুত্ব ও তাৎপর্য’

‘আত্মার পরিচয় এবং ঈমানের গুরুত্ব ও তাৎপর্য’

।। আল্লামা হাফেজ নাজমুল হাসান কাসেমী ।।

[রাজধানীর অন্যতম বিখ্যাত দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা’র সাবেক ভারপ্রাপ্ত পরিচালক, উত্তরা জামেয়াতুন নূর আল-কাসেমিয়ার প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ও উত্তরা ১২নং সেক্টর বায়তুন নূর জামে মসজিদের খতীব আল্লামা হাফেজ নাজমুল হাসান কাসেমী শুক্রবার (১৪ নভেম্বর) জুমায় মুসল্লীদের উদ্দেশ্যে যে গুরুত্বপূর্ণ বয়ান করেছেন, বিষয়বস্তুর গুরুত্ব বিবেচনা করে বয়ানের হুবহু অনুলিপি উম্মাহ পাঠক সমীপে উপস্থাপন করা হল -সম্পাদক]

বয়ানে বায়তুন নূর জামে মসজিদের সম্মানিত খতিব আল্লামা নাজমুল হাসান কাসেমী জুমার বয়ানে বলেন, “মুআয্যায মুহতারাম উলামায়ে কেরাম, মুসল্লিয়ানে ই’যাম, মহান রবের দরবারে লাখো কোটি শোকরিয়া যে, তিনি আমাদেরকে পূর্ণ সুস্থতার সাথে জুমুআর নামায আদায় করতে মসজিদে আসার তাওফীক দান করেছেন। আসুন, রবের এই দয়ার কৃতজ্ঞতাস্বরূপ আমরা সকলেই হৃদয়ের গহীন থেকে বলি- ‘আলহামদুলিল্লাহ!

আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন তাঁর ইবাদত করার জন্য। কেবলই ইবাদত। সুতরাং কে ইবাদত করল আর কে করল না তার হিসেব পুরোটাই নিবেন আল্লাহ তায়ালা। পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবেই নিবেন এবং প্রত্যেকের প্রাপ্যটা কড়ায় গন্ডায় বুঝিয়ে দিবেন তিনি। মনে রাখবেন, আমাদের সৃষ্টির সূচনা যেভাবে রুহের জগৎ থেকে হয়েছে ঠিক সেভাবেই জীবন-হিসেবের সূচনাটাও রুহের জগৎ থেকে হবে।

বিষয়টা আপনাদের বা আমাদের বোধগম্য না হলেও বাস্তবতা এটাই। বিষয়টি আল্লাহ তায়ালা নিজেও পবিত্র কুরআনে স্পষ্ট করেছেন। অর্থাৎ- “তারা আপনাকে রূহ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবে। আপনি বলুন তা আমার রবের আদেশ।” (সূরা- আল-ইসরা, ১৭ আয়াত)।

অর্থাৎ রবের আদেশেই এর সঞ্চালন বা সূচনা হয় আবার তাঁর আদেশেই এর পরিসমাপ্তি ঘটে। মানুষের জ্ঞান খুবই স্বল্প, যার দরুন মানুষ সেটা উপলব্ধি করতে পারে না। ইরশাদ হয়েছে, “মানুষকে অতি সামান্য পরিমাণ জ্ঞান দান করা হয়েছে”। (সূরা- বনী ইসরাইল, ১৭ আয়াত)।

অর্থাৎ- আল্লাহর জ্ঞানের তুলনায় মানুষের জ্ঞান হচ্ছে অনুপরিমাণ বা সুঁইয়ের মাথা পরিমাণ। আল্লাহর জ্ঞান সর্বদা অতুলনীয়। তারপরেও যদি তুলনা করতে বলা হয়, তাহলে বলব দুনিয়ার সব জ্ঞান যদি একত্র করা হয়, তাহলে আল্লাহর জ্ঞান হবে সীমাহীন এক সমুদ্র আর মানুষের জ্ঞান নিতান্তই সুঁইয়ের মাথা সমপরিমাণ। এর চেয়ে কিঞ্চিত পরিমাণও বেশি হবে না। তো এখন আপনারাই বলুন! এই জ্ঞানে কীভাবে মানুষ এতকিছু বুঝতে সক্ষম হবে? বিশেষ করে রুহের জগৎ সম্পর্কে।

তবে এটা সুনিশ্চিত, আমাদেরকে রূহের জগতে আবার ফিরতে হবে, যতটা সুনিশ্চিত ছিল রূহের জগতে আমাদের একত্ববাদের স্বীকারোক্তি। ইরশাদ হয়েছে, “আমি কি তোমাদের রব নয়? তারা (আমরা প্রত্যেকেই) বলেছিল, হ্যাঁ অবশ্যই।” (আয়াত ১৭২, সূরা- আলআ’রাফ)।

আবারও বলছি, আমরা সেই একই রূহের জগতে ফিরে যাব এবং আল্লাহর কাছেই প্রত্যাবর্তিত হবো, যেমনটা আল্লাহ কুরআনে বলেছেন- ” মানুষ কি মনে করে, আমি তাদের হাড়গুলোকে একত্রিত করতে পারব না? অবশ্যই, আমি সবাইকে একত্রিত করব।” (আয়াত ৩, সূরা- আলকিয়ামাহ)।

সুতরাং এতে কোন সন্দেহ নেই যে, আমরা তাঁর কাছে ফিরে যাবো। সেটা খুব শীঘ্রই হবে। তবে ফিরে গিয়ে যেই পরীক্ষার সম্মুখীন হবো তার প্রস্তুতি আছে কী আমাদের? নিশ্চয় না। ভেবেছি কি কখনো বিষয়টা নিয়ে!

আমাদের জন্মই তো হয়েছিল একথা বলার জন্য- “আমি আল্লাহর উপর, ফেরেশতাদের উপর, আসমানী কিতাব সমূহের উপর, তাঁর প্রেরিত সকল রাসূলের উপর, কিয়ামত দিবসের উপর, ভাল মন্দ তকদির আল্লাহর পক্ষ হতে এবং পুনরুত্থিত দিবসের উপর ঈমান এনেছি।” একথা বলা এবং তাঁর হক আদায় করার উচিত ছিল। কিন্তু আমরা তা করি না বা করতে পারি না।

ঈমান তিনটি বিষয়ের সমষ্টির নাম- ১. অন্তরে বিশ্বাস করা, ২. মুখে স্বীকার করা এবং ৩. অঙ্গ প্রত্যঙ্গ দ্বারা বাস্তবে রূপ দেওয়া। যে কারো ক্ষেত্রে এই তিনটি বিষযয়ের উপস্থিতি থাকলেই মানুষ মুসলিম হতে পারে, অন্যথায় কখনোই পারে না।

উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দিই চলুন! পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে, “তারা তাদের সন্তানদের মতই তাঁকে (মুহাম্মদকে) চিনে।” (আয়াত ১৪৬, সূরা- আলবাকারাহ)।

আবু তালেব তো স্পষ্টই জানতেন মুহাম্মদের ধর্ম সত্য। এবং আলী (রাযি.)কেও ঈমান আনার ব্যাপারে বলেছিলেন, তুমি নির্দ্বিধায় তাঁর ধর্ম গ্রহণ করতে পারো। কিন্তু দেখেন তিনি মুখে স্বীকার করতেন না বলে কাফের।

মক্কার তৎকালীন অনেক কাফেররাও আল্লাহকে বিশ্বাস করতো এবং বিপদে পড়লে তারা আল্লাহকে ডাকতো যেমনটা আল্লাহ তায়ালা কুরআনে বলেছেন- “যখন কোন বিপদ তাদেরকে আচ্ছন্ন করতো তখন তারা একনিষ্ঠ ভাবেই আল্লাহকে ডাকতে থাকতো।” (আয়াত ৩২, সূরা- লোকমান)।

আরও পড়তে পারেন-

কিন্তু তারা সেটাকে মুখে স্বীকার ও আমল বিল আরকান না করার কারণে কাফেরই থেকে গেল। এমনকি আবু জাহেলও আল্লাহর কাছে দুয়া করেছিলেন যারা হক তাদেরকে যেন আল্লাহ বিজয় দান করেন, অতঃপর আল্লাহ তায়ালা আবু জাহেলের দুয়া কবুল করেছেন আর কাফেরদেরকে বদরে পরাজিত করে নাযিল করেছেন, “সত্য এসেছে, মিথ্যা দূরীভূত হয়েছে, নিশ্চয় মিথ্যা দূরীভূত হওয়ারই ছিল।” (আয়াত ৮১, সূরা- ইসরা)।

রাসূলুল্লাহ (সা.)এর আনীত ধর্ম এতটাই সত্য ছিল যে, তৎকালীন খ্রিস্টান পাদ্রীরাও তাঁকে দেখে বলে দিত, “আল্লাহর কসম! এটা মিথ্যাবাদীর চেহারা নয়। এতকিছুর পরেও তাদের জন্য আফসোস যে, তারা ঈমানই আনতে পারেনি। এখন আপনারাই বলুন, ঈমান আল্লাহ প্রদত্ত নিয়ামত বৈ আর কি হতে পারে?

আমি যদি নিজেকেও প্রশ্ন করি, শতভাগ ঈমানের সংজ্ঞা অনুযায়ী আমি পূর্ণ মুমিন হতে পেরেছি কি না? অর্থাৎ যা কিছু বলি তা কি আমি সব মানি? তাহলে আমি নাজমুল আটকে যাব। আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাই।

সুতরাং ঈমানের সংজ্ঞা অনুযায়ী উপরোক্ত তিনের সমষ্টি পাওয়া গেলেই আমি ও আপনি পূর্ণ মুমিন। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে পূর্ণ মুমিন হওয়ার তাওফীক দান করুন, আমীন।

নয়তো মুনাফিকদেরকেও মুমিন বলতে হবে। তারা তো মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতেন, “আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, নিশ্চয় আপনি আল্লাহর রাসূল। অথচ আল্লাহ বলছেন যে, নিশ্চয় মুনাফিকরা মিথ্যুক।”

আর তাদের শাস্তি হল- “জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে তাদের বাসস্থান হবে” (আয়াত ১৪৫, সূরা- নিসা)।

এবার আসুন আমলের বাস্তবায়ন নিয়ে একটু কথা বলি, যেখানে আমার ও আপনার অবক্ষয় আছে পর্যাপ্ত পরিমাণ। অথচ সাহাবায়ে কেরাম ছিলেন আমলে অনন্য, তিনের সমষ্টিগত ভাবেই ছিলেন অনন্য। সেজন্যেই কুরআনের আয়াত সত্য। “আল্লাহ তায়ালা সেসকল অন্তরের পরীক্ষা নিয়েছেন যেগুলো ভয়ে টইটুম্বুর।” (আয়াত ৩, সূরা- হুজুরাত)।

যদি আমার ও আপনার পরীক্ষা নিতেন, তাহলে আমরা নিশ্চিত আটকে যেতাম এবং নিজেদের অক্ষমতা এবং ঈমানের দুর্বলতা স্পষ্ট হয়ে যেত। খুব তাড়াতাড়িই নাস্তিক ও মুর্তাদে পরিণত হয়ে যেতাম আমরা, যেমনটা অনেক মানুষ হয়। আল্লাহ মাফ করুন।”

অতঃপর আল্লামা হাফেজ নাজমুল হাসান কাসেমী জান্নাতের অনাবিল সুখ শান্তি এবং জাহান্নামের শাস্তি নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে সুন্দর ও সুবিন্যস্ত বয়ানের ইতি টানেন।

আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে উপরোক্ত বয়ানের আলোকে বেশি বেশি আমল করার তাওফীক দান করুন। আমীন।

অনুলিখন, মুহাম্মদ সাইফুল ইসলাম

শিক্ষার্থী, জামিয়াতুন নূর আল কাসেমিয়া উত্তরা, ঢাকা।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।