Home ইসলাম পরিবারের দ্বিনি সুরক্ষায় করণীয়

পরিবারের দ্বিনি সুরক্ষায় করণীয়

আল্লামা তাকি উসমানি: সময় খুব দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে। যে পরিবর্তন দেখার জন্য আগে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতো, এখন সামান্য কিছুদিনের মধ্যেই তা দেখা যায়। বর্তমান যে পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে, তাকে ১৫ থেকে ২০ বছর আগের অবস্থার সঙ্গে তুলনা করে দেখুন। জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে কত পরিবর্তন চোখে পড়বে। মানুষের চিন্তা-ভাবনা, আচার-আচরণ, সহনশীলতা, পারস্পরিক সম্পর্কসহ সব কিছুতে এত বেশি পরিবর্তন এসেছে যে ভাবলে অবাক হয়ে যেতে হয়। আফসোস! এই বিদ্যুদ্গতির পরিবর্তন যদি সঠিক পথে হতো, তবে আমাদের জাতির ভাগ্য পাল্টে যেত। দুঃখজনক ব্যাপার হলো, পরিবর্তনটা এসেছে উল্টো পথে। পশ্চিমা সমাজকে লক্ষ্য করে কোনো একজন কবি লিখেছিলেন—কিন্তু তা আজ আমাদের জন্যই সত্যে পরিণত হয়েছে। তা হলো, ‘দ্রুতগতিতে এগোচ্ছে, কিন্তু ঘরের দিকে নয়।’

আমাদের যাত্রা সত্যি উল্টো দিকে। যে ঘর থেকে একসময় কোরআন তিলাওয়াতের শব্দ আসত, এখন সেখান থেকে শুধু নাচ-গানের শব্দ আসে। যেখানে আল্লাহ, রাসুল ও পূর্বসূরি আলেমদের আলোচনা হতো, সেখানে বাবা-মেয়ের মধ্যে সিনেমার বিশ্লেষণ হয়। যে ঘরে কখনো অপরিচিত কোনো নারী প্রবেশ করত না, সেখানে মা-ছেলে, বাবা-মেয়ে একত্রে বসে উলঙ্গপ্রায় নারীর নাচ দেখে। যে পরিবার আগুনের মতো হারাম জিনিস থেকে বিরত থাকত, সে পরিবারের অধস্তন ও বংশধররা সুদ, ঘুষ ও জুয়ার সঙ্গে জড়িত। যেসব নারী আগে শরয়ি পর্দাকে জীবনের অপরিহার্য অংশ মনে করত, তারাই এখন গায়ে ওড়না রাখতে চায় না। অর্থাৎ পুরো মুসলিম সমাজ এখন ইসলামের বিধান পালন থেকে দ্রুত বিমুখ হয়ে যাচ্ছে। ইসলামবিমুখতার গতি দেখলে ভবিষ্যতের কথা ভেবে শিউরে উঠতে হয়।

আরও পড়তে পারেন-

মুসলিম সমাজের দ্বিনি অধঃপতনের বহু কারণ আছে। আমি শুধু এখানে একটি কারণের দিকে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করব। তা হলো আমাদের সমাজে যারা ধার্মিক হিসেবে পরিচিত, তারা পারিবারিক জীবনে ইসলাম পরিপালনে যত্নশীল নয়। পরিবারের ধর্মীয় ও নৈতিক উন্নয়নে তাদের কোনো মনোযোগ নেই। আপনারা অনুসন্ধান করলে অন্তত ২০ জন এমন ব্যক্তির সন্ধান পাবেন, যারা ব্যক্তিগতভাবে ভালো পরিবারের সন্তান ও ধার্মিক। যারা ঠিকমতো নামাজ, রোজা পালন করে, সুদ-ঘুষসহ অন্যান্য পাপ কাজ পরিহার করে চলে, তাদের ধর্মীয় জ্ঞানের পরিধিও মন্দ নয়, তার পরও তারা দ্বিনি জ্ঞান চর্চা করে না। কিন্তু এই মানুষগুলোর পরিবারে দৃষ্টি দিলে দুরবিন লাগিয়েও এসব বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাবেন না। তারা দ্বিন-ধর্ম, আল্লাহ-রাসুল, কিয়ামত-পরকাল সব কিছুকে বাজারের আর দশটা জিনিসের মতোই মনে করে। তাদের সর্বোচ্চ সহনশীলতা হলো মা-বাবার দ্বিনদারি ও ধর্মপালনকে তারা সহ্য করে নেয়, তার প্রতি ঘৃণা পোষণ করে না। এর চেয়ে বেশি কিছু তারা চিন্তা করতে পারে না এবং চিন্তা করতে চায়ও না। এটা সত্য, প্রত্যেক মানুষ তার ব্যক্তিগত জীবনের জন্য আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করবে এবং সন্তানের পূর্ণাঙ্গ হিদায়াত মা-বাবার হাতে নেই। যেমন নুহ (আ.)-এর ঘরে কেনানের জন্ম। তার পরও প্রত্যেক মুসলমানের দায়িত্ব হলো, পরিবারের দ্বিনি ও নৈতিক শিক্ষার ব্যাপারে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে। চেষ্টার পরও যদি পরিবারের সদস্যরা সঠিক পথে না আসে, তবে সে অবশ্যই দায়মুক্ত হয়ে যাবে। কিন্তু কেউ যদি চেষ্টাটুকুই না করে? নিজের দ্বিন পালনকে যথেষ্ট মনে করে? পরিবারের ব্যাপারে উদাসীন থাকে? তবে সে অবশ্যই দায়মুক্ত হবে না। এটা সন্তানকে আত্মহত্যা করতে দেখেও তাকে তা করার সুযোগ দেওয়ার মতো।

কেনান অবশ্যই নুহ (আ.)-এর সন্তান ছিল এবং শেষ পর্যন্ত ঈমান গ্রহণ করেনি। কিন্তু এটাও দেখতে হবে যে বাবা হিসেবে নুহ (আ.) সন্তানকে দ্বিনের পথে ফিরিয়ে আনতে কত চেষ্টা করেছেন। কত ধৈর্যের সঙ্গে তাকে দ্বিনের দাওয়াত দিয়ে গেছেন। বাবার চেষ্টা-প্রচেষ্টা ও দোয়ার পরও সে নিজের জন্য বিভ্রান্তির পথই বেছে নিয়েছে। নিজের সর্বাত্মক চেষ্টার মাধ্যমে নুহ (আ.) তাঁর দায় থেকে মুক্ত হয়ে গেছেন। বর্তমান সময়ের বাবারা কি সন্তানের দ্বিনি উন্নতির জন্য এভাবে কখনো চেষ্টা করেন? চিন্তা, ভাবনা ও পরিকল্পনা করেন?

পবিত্র কোরআন শুধু মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের পরিশুদ্ধির জন্য অবতীর্ণ হয়নি, বরং নিজের পরিবার, সন্তান, আপনজন ও আত্মীয়-স্বজনকেও দ্বিনের ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে অবতীর্ণ হয়েছে। মহানবী (সা.) থেকে বেশি দ্বিনদার ব্যক্তি আর কে আছে? একজন নবী হওয়ার পরও তাঁর প্রতি নির্দেশনা ছিল, ‘আপনি আপনার নিকটাত্মীয়দের সতর্ক করুন।’ আল্লাহর এই নির্দেশ পালনের জন্য তিনি নিজ পরিবার ও খান্দানের লোকদের একত্র করে দ্বিনের দাওয়াত দেন। তিনি বলেন, ‘হে মুহাম্মদের কন্যা ফাতেমা! হে সাফিয়্যা বিনতে আবদুল মুত্তালিব! তোমাদের ব্যাপারে আল্লাহ আমাকে কোনো ইচ্ছাধিকার দেননি। হে বনু আবদুল মুত্তালিব! আল্লাহর শপথ তোমাদের কাছে আমি যা নিয়ে এসেছি, কোনো আরব যুবক তার স্বগোত্রের কাছে এর চেয়ে উত্তম কোনো কিছু নিয়ে আসতে পারেনি। আমি তোমাদের কাছে দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ নিয়ে এসেছি। আমাকে আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন আমি যেন তোমাদের তাঁর পথে আহ্বান করি। তোমাদের মধ্যে কে কে এই কাজে আমার হাতকে শক্তিশালী করবে এবং বিনিময়ে আমার ভাইয়ে পরিণত হবে।’ (তাফসিরে ইবনে কাসির : ৩/২৩৫)

যেসব স্থানে আল্লাহ তাআলা মানুষকে তাঁর শাস্তি থেকে বেঁচে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন, সেখানে পরিবারকেও তা থেকে রক্ষা করার নির্দেশ দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনরা! তোমরা নিজেকে এবং নিজ পরিবারকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা কোরো।’ (সুরা : তাহরিম, আয়াত : ৬)

অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘আপনি আপনার পরিবারকে নামাজের নির্দেশ দিন এবং নিজেও তার ওপর অটল থাকুন।’ (সুরা : ত্বহা, আয়াত : ১৩২)

সুতরাং কোরআন, হাদিস ও নবীদের সুন্নত (অনুসৃত পদ্ধতি) দ্বারা প্রমাণিত হলো, মুমিন শুধু নিজের দ্বিনি কল্যাণ চিন্তা করবে না, বরং পরিবারের দ্বিনি কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তির জন্য চেষ্টা করবে। আল্লাহ তাআলা সবাইকে পরিবারের দ্বিনি কল্যাণের ব্যাপারে সচেষ্ট হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।

তামিরে হায়াত থেকে, মো. আবদুল মজিদ মোল্লার ভাষান্তর

উম্মাহ২৪ডটকম: এসএএম

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।