Home ওপিনিয়ন অন্যায়ের বিরুদ্ধে নিষ্ক্রিয় থাকার বিপদ এবং ম্যারিনা আব্রানোভিচিতের বিচিত্র পরীক্ষা

অন্যায়ের বিরুদ্ধে নিষ্ক্রিয় থাকার বিপদ এবং ম্যারিনা আব্রানোভিচিতের বিচিত্র পরীক্ষা

।। হেলাল মহিউদ্দীন ।।

ম্যারিনা আব্রানোভিচ একজন বিশ্ববিখ্যাত সার্বিয়ান পারফর্মিং আর্টিস্ট। পারফর্মি আর্টকে সম্পূর্ণ নতুন মাত্রা দেওয়ার জন্য তিনিও মানব চরিত্র পাঠে গভীর মনোযোগ দেন। সে জন্য নতুন ও বিচিত্র ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেন ২৮ বছর বয়সে। ১৯৭৪ সালে একটি পরীক্ষণের জন্য তিনি টানা ছয় ঘণ্টা একটি চেয়ারে বসে থাকেন। নিয়ম লিখে দেন, কোনো অবস্থাতেই তিনি নড়াচড়া করবেন না বা কথা বলবেন না। যাঁর যেমন ইচ্ছা তেমন আচরণ তাঁর সঙ্গে করা যাবে, তিনি বাধা দেবেন না। পাশে টেবিলে নানা রকম নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্র রাখা ছিল। উপস্থিত দর্শক–জনতার ধর্ষকামী রূপটি দ্রুতই প্রকাশ্য হয়ে গেল। ছয় ঘণ্টা পর যখন ম্যারিনা উঠে দাঁড়ালেন তখন তিনি উন্মুক্তবক্ষা, জামা কাটাছেঁড়া, শরীরে অসংখ্য দাগ, ক্ষতও রয়েছে।

ম্যারিনা যখন ওই দর্শকদের মধ্যে দিয়ে হাঁটা শুরু করলেন তখন ঘটল উল্টো ঘটনা। এতক্ষণের বীরপুঙ্গবেরা ভয়ে মিইয়ে গেল—এই বুঝি ম্যারিনা ঝাঁপিয়ে পড়ল নিবর্তনের শোধ নিতে। তাঁর চোখের দিকে তাকানোরও সাহস হলো না কারও। তাঁকে নির্যাতনকারী আর দর্শক সবাই অপরাধী চোখে নিচে তাকিয়ে থাকল।

পরীক্ষণটি পৃথিবীর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে নানা তাত্ত্বিক ধারণার জন্ম দিয়েছে। তবে চারটি সিদ্ধান্তে সবাই একমত। এক. ‘প্রতিরোধে’র বিকল্প হয় না। দুই. (দ্বিপক্ষীয়) যোগাযোগের বিকল্প হয় না। তিন. মানবিক যোগাযোগের চর্চা বন্ধ রাখা যাবে না। যোগাযোগের ক্ষমতা অন্যদের হাতে তুলে দিয়ে নিজেকে সম্পূর্ণ ক্ষমতাহীন করে ফেলা খুবই বিপজ্জনক, পরিণাম ভয়াবহ। চার. নির্যাতকের নির্যাতন-পরবর্তী ভীতির চেয়ে বড় কোনো ভীতি হতে পারে না।

কীভাবে? কেউ যখন কুদৃষ্টিতে তাকাল, ম্যারিনা আগুনচোখে তাকালে সেই লোকটি হয়তো ভয়ে পালাত। কেউ একজন গায়ে হাত লাগানো মাত্র জবাবে যদি ঠেসে চড় লাগাত, তাহলে ছয় ঘণ্টায় হয়তো কেউ কাছেই ঘেঁষত না। মোদ্দা কথা— ছাড় দিলে, সুযোগ দিলে; যোগাযোগটিকে একতরফা করার ক্ষমতা কারও হাতে তুলে দিলে তথাকথিত সভ্য মানুষেরই অসভ্য হয়ে উঠতে মোটেই সময় লাগে না। যোগাযোগের অনেকগুলো শর্তের মূল শর্ত এই যে, এটি একটি দ্বিমুখী প্রক্রিয়া। মনোবিজ্ঞান যাকে স্টিমুলাস–রেস্পন্স বা উদ্দীপক ও সাড়া হিসেবে ব্যাখ্যা করে। ম্যারিনাকে নির্যাতনের উদ্দীপকগুলো সচল ছিল। তবুও তাঁর কোনো সাড়া ছিল না। ফলে নির্যাতন জোরদার হয়েছে।

উইলিয়াম গোল্ডিংয়ের ‘লর্ড অব দ্য ফ্লাইজ’–এর (১৯৫৪) উপন্যাসটির একটি ভাষ্য এ রকম—মানুষ তো বটেই, আপাত নিষ্পাপ মানবশিশুও যখন ক্ষমতার মর্ম বুঝে ফেলে; হিংস্র ও মন্দ পথই লাভজনক ও সুবিধাজনক জেনে ফেলে—তখন ক্ষমতা কুক্ষিগত করার যুদ্ধে মন্দ থেকে মন্দতর বা হিংস্র হয়ে উঠতেও সে পিছ পা হয় না। ভয় দেখানো, অন্যদের ভীতসন্ত্রস্ত করে রাখাই হয়ে উঠে ক্ষমতা কুক্ষিগতকারীর মূল কৌশল।

গল্পটি এ রকম—সভ্য জগতের একদল শিশু-কিশোর এক নির্জন দ্বীপে আটকা পড়ে গেল। প্রথমে তারা টিকে থাকার জন্য; ফের সভ্য জগতে ফিরতে পারার প্রত্যাশায় নিজেদের মধ্যে দায়িত্ব, ক্ষমতা, কাজ, নেতৃত্ব—সবই ভাগাভাগি করে নিল। এ যেন হবস, লক, রুশো, অগাস্তিন বা অ্যাক্যুইনাসদের বলা ‘সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট’ বা ‘সামাজিক চুক্তি’। তারপর যখনই মনে হওয়া শুরু হলো যে, এই দ্বীপেই অনন্তকাল থাকতে হতে পারে, তখন তারা হিংস্র হয়ে উঠতে থাকল। স্বার্থ, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, ষড়যন্ত্র, কূটিলতা, নৃশংসতা—সবই সক্রিয় হয়ে উঠল আপাত নিষ্পাপ-নিরীহ কিশোরদের চিন্তায় এবং আচরণে ও ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায়।

উপন্যাসের জ্যাক চরিত্রটি বুঝে ফেলল ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে হলে সবাইকে যারপরনাই ভীতসন্ত্রস্ত রাখতে হবে। সে একটি কল্পিত জানোয়ার চরিত্রের আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয় সবার মধ্যে। জ্যাক সবাইকে বিশ্বাস করতে বাধ্য করে চলল যে, তার নেতৃত্ব ও ক্ষমতার একচেটিয়াকরণ অন্যদের মেনে নিতেই হবে। কারণ, একমাত্র সে-ই জানোয়ারটিকে প্রতিরোধ করার সক্ষমতা রাখে, অন্য কেউ নয়। জ্যাক ‘বিস্ট’ চরিত্র নির্মাণসহ জানোয়ার–সংক্রান্ত সব তথ্য নির্মাণের নিয়ন্ত্রণও নিয়ে নিল। অরওয়েলিয় ‘বিগ ব্রাদার ইজ ওয়াচিং’ আদলে ‘কে কি করছ, কী ভাবছ সবকিছুই আমার নজরদারিতে আছে’ ধরনের একটি ভীতিকর অবদমনও ছড়িয়ে দিয়েছিল সবার মাঝে।

উইলিয়াম গোল্ডিংয়ের এই ডিসটোপিয় উপন্যাসটি ছিল পঞ্চাশ দশকের নীতিবাগীশ ও রক্ষণশীল সমাজচিন্তায় একটা বড়সড় ঝাঁকুনি। বিশ্বসাহিত্যের পাঠকসহ সমাজবিজ্ঞানী ও নৃবিজ্ঞানীরা স্বীকার করে চলেছেন যে গোল্ডিংয়ের দেখানো নেতিমানবীয়তা দিয়ে সমাজ-সম্পর্ক ও ক্ষমতা-সম্পর্ককে চেনা বেশি সহজ। ‘লর্ড অব দ্য ফ্লাইজ’–এর অভিজ্ঞান দিয়ে অনায়াসে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছিল হিটলার, মুসোলিনি, ফ্রাঙ্কোদের একনায়ক হয়ে ওঠার রসায়ন। ‘লর্ড অব দ্য ফ্লাইজ’ এবং জর্জ অরওয়েলের বিশ্বখ্যাত ডিসটোপিয় উপন্যাস ‘নাইন্টিন এইটি ফোর’ পাশাপাশি রেখে পাঠ করে পঞ্চাশ-ষাট দশকেই সমাজবিজ্ঞানীরা অনুধাবন করছিলেন যে টোটালিট্যারিয়ান বা সর্বাত্মকবাদী রাষ্ট্রের উত্থান ঘটার সম্ভাবনা আসলেই বেড়ে চলেছে।

অরওয়েলের ১৯৮৪ উপন্যাসটি গোল্ডিংয়ের উপন্যাসের পাঁচ বছর আগে প্রকাশ পায়। তখন দুই পরাশক্তির শীতলযুদ্ধ-স্নায়ুযুদ্ধ চলছিল। দলীয় আনুগত্যের মোড়কে সমাজতন্ত্রবাদী রাষ্ট্রগুলো সর্বাত্মকবাদী রাষ্ট্রের রূপ নিচ্ছিল অতি দ্রুততায়। অরওয়েলের মূল বক্তব্য ছিল ‘দ্য বিগ ব্রাদার ইজ ওয়াচিং’ [বড়ভাই সবকিছু দেখছেন, সবই তাঁর নজরে-নখদর্পণে]। অরওয়েলের কল্পিত রাষ্ট্রটির শাসক দল স্তরে স্তরে চিন্তাপুলিশ বসিয়েছিল। গুপ্তচরের ভেতর গুপ্তচর। জায়গায় জায়গায় স্পাই ক্যামেরা আর নজরদারির জাল বিছানো। যাকে বিশ্বাস করার সে-ই হয়তো চিন্তাপুলিশের কেউ একজন। দলে ভিন্নমতাবলম্বী প্রেমিকযুগল উইনস্টন ও জুলিয়ার সুগভীর বিশ্বাস ছিল যে আরেক ভিন্নমতাবলম্বী ঘনিষ্ঠজন ও সহায়তাকারী ও’ব্রায়েনই তাঁদের একমাত্র আস্থাভাজন মানুষ। আসলে ও’ব্রায়েনও ছিল আরেক গুপ্ত চিন্তাপুলিশ। সে পাকড়াও করল উইনস্টনকে। অত্যাচারের মুখে উইনস্টন নিজে মুক্তি পেতে ধরিয়ে দিল প্রেমিকা জুলিয়াকে।

ভীতি প্রদর্শন কখনোই, কোনো কালেই কার্যকর পদ্ধতি নয়। এ যুগেও নয়। নজরদারিও খুবই বিপজ্জনক পদ্ধতি। মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার খরচ করে ইসরায়েলের তৈরি পেগাসাস সফটওয়্যার ছাড়াও আরও কয়েকটি স্পাই সফটওয়্যার কিনে নাগরিকদের চলাচলে নজরদারি, ফোনালাপ, গতিবিধি সবকিছুই রেকর্ড করে সৌদি আরবের চিন্তাপুলিশ। খাসোগি হত্যাকাণ্ডের পর দেখা যাচ্ছে, তুরস্ক তার চেয়েও বড় নজরদারির জাল ফেলে বসে আছে। বাঘের ওপর ঘোগ। সৌদি রাজরাজড়ারা হয়তো ভেবেছে তাঁরাই শুধু চালাক। তাঁদের ওপরেও যে বড় চালাক বসে আছে সেটি তো এখন দিবালোকের মতো স্পষ্ট।

আসলে এখন শুধু ‘বিগ ব্রাদার ইজ ওয়াচিং’ই নয়, সবাই সবাইকে নজরদারিতে রেখেছে। নজরদারির জাল এমনই শাখায়-প্রশাখায় জড়াজড়ি করে বিস্তৃত হয়ে রয়েছে যে নজরদারদেরও যে কে কে বা কারা কারা নজরদারিতে রেখেছে, বোঝা দুঃসাধ্য কাজ। কূটনৈতিক সম্পর্ক থাকুক না থাকুক, বিশ্বের অনেক দেশই ইসরায়েলের স্পাই সফটওয়্যারের অন্যতম বড় ক্রেতা। যার মূল উদ্দেশ্য ভিন্নমতাবলম্বী নাগরিকদের চলাচল, ফোনালাপ, চিন্তা, রাজনীতি-ভাবনাসহ সব গতিবিধির ওপর নজরদারি এবং বিরুদ্ধমতকে দমন করা।

গণতন্ত্র শুধুই ভোটের বেশ-কম ফলাফল নয়, বরং সব মত, পথের প্রতি সম্মান ও সহনশীলতার চর্চাকে বোঝায়। গণতন্ত্রকে একধরনের গভীর পারস্পরিক যোগাযোগ-প্রক্রিয়া বা সমাজ-সম্পর্ক হতে হয়। পারস্পরিক সম্মান, শ্রদ্ধাবোধের উদ্দীপনা ও সাড়া থাকতে হয়; অন্যায্য দমন-পীড়নের জবরদস্তি গণতান্ত্রিক সমাজ-সম্পর্ক নয়। ‘দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে’ মূলমন্ত্র কিংবা মাইকেল ব্যালিন্টাইনের ‘দ্য কোর‍্যাল আইল্যান্ড’-এ দেখানো সমাজ-সংহতির ভাবনা-তাড়িত বা মূল্যবোধসম্পন্ন না হোক, কিছুটা কাছাকাছি আদর্শে চালিত হতে হয়। জনগণের করের সুবিশাল অঙ্ক জনগণকেই নিবর্তনের কাজে ব্যবহারের জন্য আড়ি পাতায় মত্ত অনৈতিক রাষ্ট্রগুলোর কাউকেই আর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ধরা হয় না। বৈশ্বিক পলিটি ইনডেক্স অনুযায়ী বাংলাদেশও গণতন্ত্রের মোড়কে স্বৈরতন্ত্র অভিমুখী শাসনব্যবস্থা।

২০১০ সালে ম্যারিনা আরেকটি বিচিত্র পরীক্ষণে নামেন। এবার ছয় ঘণ্টা নয়, টানা তিন মাস প্রতিদিন ১০ ঘণ্টা করে একটি জাদুঘরে বসলেন। তাঁর মুখোমুখি আরেকটি চেয়ার। মাঝে একটি টেবিল। নিয়ম হলো মুখোমুখি চেয়ারটিতে দু-তিন মিনিটের জন্য যে কেউ এসে বসবেন। ম্যারিনা মুখোমুখি মানুষটির সঙ্গে শুধুই দৃষ্টি সংযোগ করবেন।

পরীক্ষণটির ফলাফল অভূতপূর্ব। মুখোমুখি চোখগুলোর নীরব ভাষায় ভালোবাসা, আনন্দ, বেদনা, বিষাদ, কৃতজ্ঞতা—মানবসম্পর্কের কোনো কিছুই অধরা থাকেনি। একটি অপ্রীতিকর আচরণও মেলেনি। কেউ চোখে চোখ রেখে কাঁদল, কেউ যেন ম্যারিনার চোখে চোখ রেখে পৌঁছে যেতে চাইল তাঁর অন্তরের গভীরে। ক্ষমতা ভাগাভাগির, সমতা ভারসাম্যের পরিবেশটি পারস্পরিক সম্মানের ও মমত্ববোধের বিচ্ছুরণ ঘটিয়েছিল ২০১০ সালের পরীক্ষণটি। অথচ একপক্ষের হাতে নির্বিবাদে ক্ষমতা তুলে দেওয়া ১৯৭৪ সালের পরীক্ষণটির ফলাফল ছিল সম্পূর্ণ উল্টো। ক্ষমতাপ্রাপ্ত একই মানুষগুলোই সুযোগ পেয়ে হয়ে উঠেছিল ঘৃণ্য নিপীড়ক।

সত্যিকার গণতন্ত্র মানে একপক্ষের হাতে সকল ক্ষমতা পুঞ্জীভূত হওয়া নয়, ক্ষমতার ভারসাম্যপূর্ণ পরিবেশ। যাতে করে সরকার ও বিরোধী দল উভয়ই বাঁচতে পারে এবং উভয়ের ভারসাম্যের মধ্যে দিয়ে জনগণ শান্তিতে শ্বাস ফেলতে পারে।

লেখক: নৃবিজ্ঞানী, কানাডার মানিটোবা বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ ফেলো।