Home মহিলাঙ্গন নারীর দায়িত্বশীল ভূমিকা নারী নির্যাতন অনেকটাই কমাতে সক্ষম

নারীর দায়িত্বশীল ভূমিকা নারী নির্যাতন অনেকটাই কমাতে সক্ষম

।। খাতুনে জান্নাত কণা ।।

নারীর সচেতনতা অনেক ক্ষেত্রেই নারী নির্যাতন প্রতিরোধে সহায়ক। যে মা, বোন, ভাবী, কিংবা নানি, দাদি, শাশুড়ি সচেতন তার ঘরে নিজের পরিবারের সদস্য শুধু নয়, কাজের মেয়েরাও অনেকটা নিরাপদ।

আমেনাকে (ছদ্মনাম) ঘরে রেখে তার মা, পাশের দু’টো বাড়ি পার হয়ে পানি আনতে গিয়েছিলেন। গ্রামের বাড়ি। নিজেদের টিউবওয়েল নষ্ট হওয়ায় তাকে অন্য বাড়ি যেতে হয়েছিল। আমেনার চাচাতো বোনের স্বামী প্রায়ই তাদের বাড়িতে স্ত্রীসহ অথবা একাই বেড়াতে আসতো। আজও একাই এসেছিল। পাশে আরেক চাচার ঘরে সে ছিল এতক্ষণ। আমেনার মা ঘরে ফেরার আগেই সে আমেনাদের ঘরে এলো।

আমেনার পরীক্ষা সামনে। তাই টেবিলে বই রেখে মনোযোগ দিয়ে পড়ছিল। চাচাতো দুলাভাই এসেই আমেনার পিঠে হাত দিয়ে মৃদু থাপ্পড় দেওয়ার স্টাইলে আস্তে করে পিঠের ওপর হাত রাখলো। আমেনা চট্ করে উঠে দাঁড়াতে গেলে ওর দুলাভাই তার হাতটাকে ঘুরিয়ে ওর বগল তলা দিয়ে সামনে নেয়ার চেষ্টা করতে গেলে আমেনা চেয়ার সরিয়ে ছিটকে সরে গেল।

ঠিক এ সময়েই ওর মা পানির কলসি নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। বললেন, ‘কি হয়েছে আমেনা? তোর মুখ অত শুকনো কেন? জামাই তোমার কি খবর? কেমন আছো?’ ‘এইতো চাচীমা, ভালো।’

ওদের কথা বলার ফাঁকে আমেনা বাইরে বেরিয়ে চাচাদের ঘরে গেল। আমেনার চাচাতো দুলাভাই চলে গেলে মা একান্তে ডেকে মেয়ের কাছে জানতে চাইলেন, লোকটা কতক্ষণ আগে আমেনাদের ঘরে ঢুকেছিল এবং আপত্তিকর কোনো আচরণ করেছে কিনা। আমেনা গড় গড় করে সব কথা মাকে বলে দিল।

আমানা মায়ের কাছে কিছু বলার সময় কোনো সংকোচবোধ করতো না। কারণ, মায়ের ব্যবহার ছিল অনেকটা বন্ধুর মতো। আমেনার মা বললেন, ‘ছেলেটা যে কোনো সময় আমাদের ঘরে আসতে পারে ভেবে পানি নিয়ে আমি তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরেছি। কখনো ওকে চা নাশতা দেয়ার দরকার হলে আমিই দেব। তোর অত সামনে যাওয়ার দরকার নেই। মেয়েরা বড় হলে সব সময় সাবধানে থাকতে হয়।’

আসিফ যে বাসায় টিউশানি করে, তাদের পুতুলের মতো দেখতে ছোট্ট একটা মেয়ে আছে মিম। আড়াই বছরের মিমকে আসিফ খুব স্নেহ করে। ওর বড় বোন ক্লাস সেভেনে পড়ে। আসিফ ওকে পড়াতে গেলে মিম আসিফের কোলে এসে বসে পড়ে। যখনই মিম আসিফের কাছে আসে, ওর আম্মু এসে ওদের কাছে বসে থাকে। ছোট্ট মেয়েটাকে সামলানোর চেষ্টায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আসিফের কোলে মিমকে বেশিক্ষণ থাকতে দেয় না। বলে, ‘ভাইয়াকে বিরক্ত করো না আম্মু। চলে এসো।’ মিম তেমন একটা দুষ্টুমি করে না। তাই আসিফ একটু অবাক হয়। ভাবে, মিমকে একটু বেশিই আগলে রাখে ওর আম্মু। এখনই শাসনে রাখতে চায় মনে হয়।

কিন্তু, দু‘দিন আগে যখন পত্রিকা খুলে দেখতে পায়, ‘আট মাসের শিশুকে ধর্ষণ করা হয়েছে।’ ওর অন্তরাত্মা তখন কেঁপে ওঠে। হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে যায়। ক্রোধে ঘৃণায় সমস্ত গা রি রি করে ওঠে। ছিঃ! এরা কি মানুষ? পশুরাও তো এত খারাপ হয় না। ওরা উপযুক্ত বয়সের সঙ্গী খোঁজে নেয়। যখন মিমের সাথে ওর মা এসে বসে থাকেন, এখন আর আসিফের খারাপ লাগে না। ওর মনে হয় না মিমের মা কোনো বাড়াবাড়ি করছেন। বরং, মিমের আম্মুর এই সচেতনতা দেখে খুশি হয়। মনে মনে ভাবে, মিম তোমার ভাগ্যটা ভালো। তোমার মা খুব সচেতন। আশা করি তোমার জীবনে বড় ধরনের কোন বিপদ বা সমস্যা তৈরি হবে না। কারণ, তোমার মা ছায়ার মতো তোমার পাশে থাকেন।

এই দু‘টো ঘটনা থেকে দেখা যায়, এখানে দু‘জন মা-ই যথেষ্ট সচেতন। তাদের শিশু কন্যা বা কিশোরী মেয়ের পাশে তারা ছায়ার মতো থাকার চেষ্টা করছেন। শুধু মা কেন? পরিবারের নারী মুরুব্বীরা যদি এমন ভূমিকা পালনে এগিয়ে আসেন, নারী বা কন্যা শিশুদের যৌন হয়রানির ঘটনা অর্ধেকে নেমে আসবে।

পারিবারিক নির্যাতন কমাতেও নারীদের ভূমিকাই মুখ্য। কোন মেয়ে যদি শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়দের সাথে নিজেকে ভালোভাবে মানিয়ে নিতে পারে, উপার্জনকারী স্বামীর, পরিবারের সদস্যদের উটকো ঝামেলা হিসেবে না দেখে, স্বামীর পরিবারের নারী সদস্যরা তাতে অনেকটা স্বস্তিতে থাকতে পারেন। তেমনি অন্য পরিবার থেকে বউ হয়ে আসা মেয়েটিকে তার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা যদি আপন করে নিতে পারেন, তাহলে নারীর প্রতি সহিংসতার পরিমাণ অর্ধেকেরও বেশি কমে যাবে।

নারীর নির্যাতন এদেশে শতকরা আশি ভাগের বেশি বলে যে দাবি করা হয়, তার বেশিরভাগ নির্যাতনের নেপথ্যে থাকে একজন নারী। বাইরের পরিস্থিতি বা কর্মক্ষেত্রের যে দু’একটি ক্ষেত্রে এককভাবে পুরুষ দায়ী থাকে, তার বাইরে নির্যাতক স্বয়ং একজন নারী।

একজন নারী বিয়ের পর সব সময় তার শ্বশুরবাড়ির মানুষের প্রতি দায়িত্ব সচেতন হয় না। স্বামীর ভাই-বোনকে নিজের ভাই-বোনের মতো আপন করে নেয় না। দারিদ্র্যের সাথে সংগ্রাম করে বেড়ে ওঠা ছেলেরা শাশুড়ির ভাত বেড়ে নিয়ে বসে থাকা, চোখের পানি ফেলা দেখে সহজেই মা-বাবাকে ভুলে যায়। বাবার দায়িত্ব ভাগ করে নেয়ার ভীতি তার মাঝে প্রবলভাবে জাগিয়ে দেয় একজন স্ত্রী এবং শাশুড়ি নামধারী নারী। আস্তে আস্তে সংসারের সম্প্রীতির ভাঙন শুরু হয়। সেই স্ত্রী কিন্তু তার ভাই-বোনের দেখভাল ঠিকই করতে থাকে। তার স্বামীকে কেউ ঘর জামাই আখ্যা দিলেও তার কাছে শুনতে মধুর লাগে। বয়স্ক নারীদের নির্যাতকের ভূমিকাও একজন নারীর।

স্বামী বাইরে থাকলে, তার মা অথবা বাবার সাথে দুর্ব্যবহারের পূর্ণ সুযোগ পায় একজন গৃহিণী। তাই মা-বাবারা এখন ছেলের বাসার চাইতে বৃদ্ধাশ্রমকে বেশি নিরাপদ ও স্বস্তির জায়গা ভাবেন। ছেলেমেয়েরা অনেক ক্ষেত্রে চাচা এবং ফুপুর সাথে সম্পর্কই রাখে না। তাদের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে অংশীদারিত্ব থাকে রাঙা আন্টি বা মণি নাম দেয়া অতি পুতুপুতু খালা বা রাঙা মামু কিংবা ছোট বাবা টাইপের মামার। শাশুড়ির প্রতাপে যে নারী নির্যাতিত হয়, তার নির্যাতক তো তাহলে স্পষ্টতই একজন শাশুড়ি বা নারী।

যে মেয়ে অন্য পরিবার থেকে আসে, তাকে আপন করে নেয়ার দায়িত্ব পালন করা বাদ দিয়ে, মেয়েটির একাডেমিক ক্যারিয়ার ভালো থাকলেও, কর্মজীবী হলেও, তার প্রাপ্য সম্মান দেয়া বাদ দিয়ে, তার কাছ থেকে দাসী-বাঁদীর মতো কাজ আদায় করে নেয়, খেদমত খায় শাশুড়ি, জা, ননদ নামধারী নারী। পীড়িত, মুমূর্ষু স্ত্রী ঘরে থাকার পরও যে পুরুষ বাইরে অন্য নারীর সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে যাচ্ছে, বিয়ে পর্যন্ত করে ফেলছে, তার একক দায় কি পুরুষের? কখনই না। এখানেও একজন নারী প্ররোচণার কাজ করছে।

কাজেই, নারী নির্যাতনের দায়ভার শুধু পুরুষের কাঁধে চাপিয়ে দায় মুক্তির সুযোগ নেই। সমাজের সমস্ত ক্ষেত্রে নৈতিকতার চর্চাটা বাধ্যতামূলকভাবে থাকতে হবে। পাশাপাশি নারী এবং পুরুষ সবারই মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে হবে। আত্মসম্মানবোধ বা আত্মমর্যাদাবোধ থাকার পাশাপাশি পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং সম্মানবোধও থাকতে হবে। তাহলে নির্যাতনের ঘটনা এমনিতেই কমে যাবে।

– খাতুনে জান্নাত কণা, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।