Home প্রবন্ধ-নিবন্ধ ইউক্রেন যুদ্ধ: পৃথিবী যেভাবে নতুন আকার নিচ্ছে

ইউক্রেন যুদ্ধ: পৃথিবী যেভাবে নতুন আকার নিচ্ছে

রাশিয়া ইউক্রেনকে পুরোপুরি পরাস্ত করতে পারে; দ্রুত পিছিয়ে আসতে পারে; রাশিয়ার প্রস্থানের জন্য একটি আপসের রাস্তা খুঁজে বের করা হতে পারে; ন্যাটো আরও বৃহৎ পরিসরে সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে পারে; অথবা চলমান যুদ্ধ ইউরোপের কেন্দ্রে আরেক আফগানিস্তান সৃষ্টি করতে পারে।

ইউক্রেন যুদ্ধের ফলাফল যা-ই হোক না কেন, পৃথিবী যে আর কখনো আগের মতো হবে না—এ ব্যাপারে নিশ্চিত থাকুন।

ভূরাজনীতি থেকে সামরিকীকরণ, বাণিজ্য থেকে অর্থনীতি, এবং জ্বালানি নিরাপত্তা কীভাবে নিশ্চিত করা হবে—এই সবকিছুই বদলে যাবে। এর মধ্যে কিছু জিনিস মারাত্মকভাবে বদলাবে। অত্যন্ত দ্রুতগতিতে ইতিহাস তৈরি হচ্ছে, বিশেষ করে ইউরোপে।

আইএমএফ পূর্বাভাস দিয়েছে, যুদ্ধ বিশ্বের অর্থনৈতিক এবং ভূরাজনৈতিক শৃঙ্খলাকে আমূল বদলে দিতে পারে। বদলে দিতে পারে জ্বালানি বাণিজ্য। সরবরাহ চেইনকে নতুন করে সাজাতে হতে পারে। ভেঙে যেতে পারে পেমেন্ট নেটওয়ার্ক। এবং দেশগুলো রিজার্ভ মুদ্রার হোল্ডিং নিয়ে নতুন করে ভাববে।

নতুন ভূরাজনৈতিক বিভাজনরেখা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে:

ইউক্রেন হামলার সঙ্গে সঙ্গে একটি নতুন ভূরাজনৈতিক বিভাজনরেখা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা ইউরোপে তাদের সাধারণ শত্রু হিসেবে রাশিয়ার বিরুদ্ধে একাট্টা হয়েছে। স্নায়ুযুদ্ধ যুগের সোভিয়েত ইউনিয়ন আর নেই, কিন্তু রাশিয়া—যা ইউএসএসআর-এর একটা বড় অংশ ছিল—এখনো পশ্চিমাদের জন্য বড় হুমকি।

যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ, যুক্তরাজ্য, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া একজোট হয়ে রাশিয়ার উপর অভূতপূর্ব নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। সংঘাত আরও রক্তক্ষয়ী হয়ে উঠতে পারে, এই ভয়ে—এবং ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য নয় বলে—দেশগুলো ইউক্রেন যুদ্ধে সরাসরি অংশ নিতে পারছে না। এ কারণে তারা এখন রাশিয়াকে অর্থনৈতিকভাবে চেপে ধরতে চাইছে।

অন্যদিকে, চীন চলমান সংঘাতে নিরপেক্ষতা বজায় রেখে কোনো নিষেধাজ্ঞা দেয়নি। ভারতও চীনের পথেই হেঁটেছে। ব্রাজিল, মেক্সিকো এবং দক্ষিণ আফ্রিকাও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে রাজি হয়নি।

আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকায় চীনের যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। তাই এই অঞ্চলের দেশগুলো সম্ভবত চীনের পথে হাঁটবে।

আর সৌদি আরবও তেল সরবরাহ বাড়ানোর বিষয়ে বাইডেনের সঙ্গে আলোচনা করতে অস্বীকার করেছে। এর মাধ্যমে সম্ভবত জামাল খাশোগি হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে আমেরিকার কঠোর অবস্থানকে একহাত নিয়ে নিল সৌদি আরব।

সুতরাং, যুদ্ধের ফলাফল যা-ই হোক না কেন, এই বিভাজনরেখা আরও গভীর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। নতুন ব্লকগুলো ভূরাজনৈতিক বিষয়ে ঘনিষ্ঠভাবে জোটবদ্ধ হয়ে কাজ করবে।

অনন্য ভৌগোলিক অবস্থানের কল্যাণে যুক্তরাষ্ট্র সবসময়ই নিরাপদ দূরত্বে বসে খবরদারি করতে পারে। এই দেশটির মূল ভূখণ্ডে কোনো যুদ্ধই সরাসরি আঁচড় কাটতে পারে না। প্রত্যক্ষ আক্রমণ থেকে এভাবে বেঁচে যাওয়ার কারণে যুক্তরাষ্ট্র ব্যাপক সুবিধা পায়। আর বিশাল সফট পাওয়ারের কল্যাণে দেশটি অন্যান্য দেশের ওপর ছড়ি ঘোরাতে পারে।

এদিকে চলমান যুদ্ধ পশ্চিমা ধাঁচের উদার গণতন্ত্রকে কঠিন পরীক্ষায় ফেলে দিয়েছে। মানবাধিকারের ধারণাও মৌলিক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবে এ যুদ্ধের ফলে। চীন সম্প্রতি তার নিজস্ব মানবাধিকার প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে এবং সেখানে যুক্তরাষ্ট্রকে সবচেয়ে জঘন্য মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী হিসেবে অভিযুক্ত করেছে।

নতুন সামরিকীকরণ বাড়ছে:

কেউই ভাবতে পারেনি, রাশিয়া এত নির্লজ্জভাবে ইউক্রেনে আক্রমণ চালাবে। আবার দুর্বল ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে রাশিয়া যে এতটা খারাপ পারফরম্যান্স করবে, তা-ও কেউ আশা করেনি।

এর ফলে নতুন বিভাজনরেখার উভয় পক্ষের সামনেই নতুন বাস্তবতা উন্মোচিত হয়ে গেছে।

ইউরোপ মনে করছে, তার নিরাপত্তার নিশ্চয়তা আর নেই। ন্যাটোর যেসব সদস্যের সম্পদ ও জনসংখ্যা সীমিত, সেসব দেশ এই হুমকি আরও তীব্রভাবে অনুভব করছে।উদাহরণস্বরূপ, লিথুয়ানিয়ার জনসংখ্যা মাত্র ২৮ লাখ, অর্থাৎ ঢাকা শহরের চেয়েও কম। দেশটির জিডিপির আকার মাত্র ৫৬ বিলিয়ন ডলার। তাইওয়ানের ডি-ফ্যাক্টো দূতাবাসকে অনুমোদন দিয়ে চীনের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ার পরই দেশটির দুর্বলতা প্রকাশ্যে চলে আসে। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে রাশিয়ান গ্যাস ও তেল ব্যবহার বন্ধ করে দেওয়ার হুমকিও দিয়েছে দেশটি।

তাই লিথুয়ানিয়া এখন যেকোনো সামরিক আগ্রাসনের মধ্যে পড়ে গেলে ন্যাটো দেশটিকে সাহায্য করতে বাধ্য।

এই বাস্তবতা এবং নিজস্ব নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগের কারণে ইউরোপ তার প্রতিরক্ষা কৌশল পুনর্বিবেচনা করতে এবং সামরিক ব্যয় বাড়াতে বাধ্য হয়েছে। এমনকি সবসময় শান্তির নীতির পক্ষে থাকা জার্মানিও তার সামরিক ব্যয় নাটকীয়ভাবে বাড়িয়েছে। দেশটি প্রতিরক্ষা খাতে প্রাথমিকভাবে ১০০ বিলিয়ন ইউরো বরাদ্দ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেইসঙ্গে এখন থেকে প্রত্যেক বাজেটে জিডিপির অন্তত ২ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হবে প্রতিরক্ষা খাতে।

যুদ্ধাঞ্চলে অস্ত্র না বিক্রির দীর্ঘদিনের নীতিকে পাশ কাটিয়ে ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তার ঘোষণাও দিয়েছে জার্মানি। সেনা পাঠাচ্ছে লিথুনিয়া ও লাটভিয়ায়। অন্যদিকে, রোমানিয়া, বাল্টিক ও ভুমধ্যসাগরে মোতায়েন করছে নৌ ও বিমানশক্তি। এস্তোনিয়ায় ন্যাটো জোটের সৈন্যরাও পদার্পণ করেছে।

রাশিয়াকে মোকাবিলায় ন্যাটোর রণকৌশলের সম্মুখভাগ হয়ে উঠেছে বাল্টিক রাষ্ট্রগুলো।

সামরিক ব্যয় বাড়াচ্ছে সুইডেন, রোমানিয়া, ডেনমার্ক ও পোল্যান্ড। প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দ আরও বৃদ্ধির পথে এগোচ্ছে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও কানাডা।

ইউক্রেনে বড় পরিসরে অস্ত্র পাঠাতে এগিয়ে এসেছে পশ্চিম ইউরোপের অন্যান্য দেশও। সাবেক ওয়ারশ জোটভুক্ত দেশ পোল্যান্ড, স্লোভাকিয়া ও বুলগেরিয়া তো দেশটিকে যুদ্ধবিমান দিতেও প্রস্তুত।

ন্যাটোতে স্থান পাওয়ার সুযোগ খুঁজছে জর্জিয়া, মলদোভা, কসোভো ও বসনিয়া-হার্জোগোভিনা।

এভাবে সামরিক বিভাজনের রেখা এরমধ্যেই সুষ্পষ্ট রূপ নিয়েছে। স্নায়ুযুদ্ধের সময়েও আমেরিকা ও তার মিত্রদের চেয়ে অপেক্ষাকৃত কম শক্তি ছিল রাশিয়ার (সোভিয়েত ইউনিয়নের)।

তবে রাশিয়া ও চীন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের নতুন মেলবন্ধন স্থাপনে কাজ করছে। চীন ২০২২ সালে তার সামরিক ব্যয় ৭.১% বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পিপিপি (পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটি) ভিত্তিতে যার অর্থ পশ্চিমা দুনিয়ার তুলনায় উল্লেখযোগ্য ব্যয় বৃদ্ধি।

তাই রাশিয়া ও চীন একত্রিত হয়ে একটি উল্লেখযোগ্য সামরিক শক্তি তৈরি করবে।

ইউরোপের দুয়ারে অবস্থান করা তুরস্ককে এখন রাশিয়া ও ন্যাটোর মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার এক অদ্ভুত ভূমিকা পালন করতে হবে।

বদলে যাবে জ্বালানির ভবিষ্যৎ:

সম্পূর্ণরুপে জলবায়ু বিপর্যয়ের পরিণতি এড়াতে এবং একইসাথে দুনিয়ার মূল জ্বালানি উৎসের জায়গা যখন সবে তেল দখল করে নেয় তখনই নবায়নযোগ্য উৎসের দিকে ঝুঁকে পড়ার বড় পদক্ষেপে এগিয়ে চলছিল বিশ্ব।

কিন্তু, এখন জ্বালানি নিয়ে রাশিয়া-নির্ভরশীল হওয়ার দুর্বলতার বাস্তবতা সম্পর্কে সজাগ হয়েছে ইউরোপ। তারা দেখছে, রাশিয়ার গ্যাস ছাড়া শীতে কাঁপবে তাদের নাগরিকরা। তেল ছাড়া সড়ক হবে বাহনহীন।

আরও পড়তে পারেন-

এই দুর্বল দিকটি এখন কমাতে চায় ইউরোপ এবং একইসাথে নিজেদের কয়লা ও গ্যাস উৎপাদনকে পুনরায় বাড়াতে চায়। এক সময় বাতিলের খাতায় ফেলা পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো নতুন বাস্তবতায় গুরুত্ব পাচ্ছে।

এসব কিছুর অর্থ, নবায়নযোগ্য শক্তিকে এখন কম গুরুত্ব দেওয়া হবে।

নিত্যপণ্য ও কাঁচামালের অস্ত্রীকরণ:

এই যুদ্ধ তার নিজের এবং ভবিষ্যতের রণকৌশলের সীমা নির্ধারণ করেছে। এখন নিত্যপণ্য আর কাঁচামালও লড়াইয়ের অস্ত্র।

বিপুল তেল ও গ্যাসের রিজার্ভ নিয়ে এই অস্ত্রসজ্জা সবচেয়ে বড় রাশিয়ার। ইউরোপ নিজের ৪০ শতাংশ গ্যাসের জন্যই রাশিয়া-নির্ভর, রুশ ভূখণ্ড প্রাকৃতিক খনিজেও ভরপুর-যার জন্য পশ্চিমা দুনিয়ার সার্বক্ষণিক ক্ষুধা।

ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের পর নর্ড স্ট্রিম- ২ পাইপলাইন চালুর পথ থেকে সরে দাঁড়িয়েছে জার্মানি। রাশিয়াও পাল্টা পদক্ষেপ নিয়ে যেকোনো মুহূর্তে ইউরোপে নিজের গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দিতে পারে।

ইউক্রেন যুদ্ধের অনেক আগেই চীনের কাছে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির সেমিকনডাক্টর বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা দেয় পশ্চিমারা। এখন চীন স্থানীয় চিপস শিল্প গড়ে তোলায় মনোনিবেশ করেছে।

বাণিজ্যের নিত্যনতুন পন্থা:

সুইফট লেনদেনে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার প্রেক্ষিতে জোর সম্ভাবনা রয়েছে যে রাশিয়া ও চীন তাদের নিজস্ব আন্তঃসীমান্ত পেমেন্ট ব্যবস্থা চালু করবে।

চীনের নিজস্ব লেনদেন ব্যবস্থাটির নাম সিআইপিএস বা ক্রস-বর্ডার ইন্টারব্যাংক পেমেন্ট সিস্টেম, তবে এটির পরিসর এখনও বেশ সীমিত। এতে যুক্ত মাত্র ৪০টি প্রতিষ্ঠান, সে তুলনায় সুইফটের সদস্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান ১০ হাজারের বেশি। আর রাশিয়ার এসপিএফএস একেবারেই প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে।

তবে এই সংঘাত মস্কো ও বেইজিংকে তাদের লেনদেন ব্যবস্থাগুলোকে আরও উন্নত ও বিস্তৃত করতে উৎসাহী করবে। সুতীব্র হবে মার্কিন ডলার-নির্ভর লেনদেন থেকে সরে যাওয়ার প্রচেষ্টা।

এই গ্রহের বাইরে:

ইউক্রেন যুদ্ধ কেবল পৃথিবীর ভূ-রাজনৈতিক রেখাকে বদলাচ্ছে তাই-ই নয়, প্রভাব ফেলছে মহাকাশেও।

পৃথিবীর কক্ষপথে ঘুরছে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন (আইএসএস)। মহাকাশে মানুষের এই গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় বর্তমানে আছেন দুজন রুশ, চারজন আমেরিকান এবং একজন ইউরোপীয় নভোচারী। মহাকাশে বহুজাতিক এ সহায়তার কেন্দ্রটি এখন অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে।

আইএসএস পরিচালনায় এর সদস্য ১৪টি জাতির সাথে রাশিয়ার বাঁধাহীন কাজের সম্পর্ক দরকার। স্পেস স্টেশনটির অংশবিশেষ রাশিয়ার নির্মিত ও পরিচালিত; অন্যান্য অংশ নির্মাণ ও পরিচালনাকারী হলো- আমেরিকা, ইউরোপ, জাপান ও কানাডার মহাকাশ সংস্থা।

অপরিহার্য সেবাগুলোর জন্য প্রতিটি অংশই অন্যটির ওপর নির্ভরশীল। যেমন নাসা পরিচালিত অংশ রুশ অংশকে বৈদ্যুতিক শক্তির যোগান দেয়। অন্যদিকে রাশিয়ার অংশ আইএসএসকে কক্ষপথে ধরে রাখার জন্য মাঝেমধ্যে যে দরকারি রকেট বুস্টিং দরকার-তা সরবরাহ করে। নাহলে মধ্যাকর্ষণ টানে ধীরে ধীরে আরও নিম্ন কক্ষপথে নেমে আসবে স্পেশ স্টেশন এবং এক পর্যায়ে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে ধবংসপ্রাপ্ত হবে।

সূত্র- দ্য বিজনেস স্টান্ডার্ড।

উম্মাহ২৪ডটকম: এসএএম

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।