Home ইসলাম বরকতময় রজনী শবে বরাত

বরকতময় রজনী শবে বরাত

।। আল্লামা মুহাম্মদ ইয়াহইয়া (দা.বা.) ।।

পবিত্র ইসলাম ধর্মে বছর, মাস ও দিনের বিশেষ বিশেষ কিছু মর্যাদাকর সময়ে বান্দার আমলের প্রতিদান ও সাওয়াব ভিন্ন রকম হয়ে যায়। ‘শবে বরাত’ তার মধ্যে অন্যতম। একাধিক সহীহ হাদীস দ্বারা এ রজনীর গুরুত্ব অনুধাবন করা যায়। তাই নবী যুগ থেকে অদ্যাবধি গোটা মুসলিম উম্মাহ এ রজনীতে এক নবচেতনা নিয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় ইবাদতে আত্মনিয়োগ ও তাওবা, ইস্তিগফার করে তাদের প্রেমাস্পদকেই পেতে চায়। তার মাঝে নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে ধন্য হতে চায়। সেই রাতে এক জান্নাতী পরিবেশে রূপান্তরিত হয় এই অবিনশ্বর পৃথিবী।

হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, শাবানের ১৫তম রাত যখন তোমাদের সম্মুখে এসে যায়। তাতে তোমরা ইবাদত বন্দেগীর মাধ্যমে রাতটি জাগ্রত রাখ এবং পরবর্তী দিনে রোযা রাখ। কারণ সূর্যাস্তের সাথে সাথে আল্লাহ পাক প্রথম আকাশে অবতরণ করেন এবং বান্দাদেরকে লক্ষ্য করে বলেন, আছো কি কোন ক্ষমাপ্রার্থী, আমি ক্ষমা করে দেই? আছো কোন রিযিক অন্বেষণকারী, যাকে রিযিকের ব্যবস্থা করে দেই? আছো কি কেউ বিপদগ্রস্ত, যাকে আমি বিপদমুক্ত করে দিই? এভাবে সুবহে সাদিক পর্যন্ত ডাকতে থাকেন। (ইবনে মাজাহ, ১৩৮৪)।

উল্লিখিত হাদীস দ্বারা দু’টি জিনিস প্রমাণিত হলো। প্রথমতঃ রাত্রি জাগরণ ইবাদতের মাধ্যমে হতে হবে। দ্বিতীয়তঃ পরবর্তি দিনে রোযা রাখা।

তাছাড়া উল্লিখিত হাদীসের মধ্যে একজন বর্ণনাকারী ইবনে আবী সাবরার স্মৃতিশক্তির দুর্বলতার কারণে কেউ কেউ হাদীসটি দুর্বল হাদীস বলে গণ্য করে থাকেন। কিন্তু কোন অবস্থাতেই হাদীসটি মাওযু বা জাল হাদীস নয়। তাই কোন ইমাম বা মুহাদ্দিসীনে কেরাম হাদীসটিকে জাল হাদীস বলে উল্লেখ করেননি।

এ প্রসঙ্গে হযরত মুফতি মুহাম্মদ আলী ইবনে তোফায়ে আল-আযহারি লিখেন, বিভিন্ন মুহাদ্দিসীনে কেরামের বর্ণনার আলোকে এ কথা সুস্পষ্ট হয়ে গেছে যে, ১৫ই শাবান রাতের বিশেষ ফযীলত সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। এছাড়াও বিভিন্ন মুহাদ্দিসে কেরাম এই হাদীসকে সহীহ, অথবা হাসান বলেছেন। সুতরাং যে বা যারা বলে থাকেন যে, ১৫ই শাবান রাতের বিশেষ ফযীলত সম্পর্কে কোন সহীহ হাদীস নেই, তারা শুধু তাকলীদের ভিত্তির উপর নির্ভর করেই এমন বলে থাকেন। শরীয়তে যার বাস্তব কোন ভিত্তি নেই। (আওয়াম মে রায়েজ বিদআত আওর শরয়ী নকতায়ে নযর, মুফতি মুহিউদ্দীন নদভী)।

যয়ীফ বা দুর্বল হাদীসের উপর আমল করা শরীয়তের দৃষ্টিতে কিরূপ, তা নিয়ে ওলামায়ে কেরামের মধ্যে মতানৈক্য পরিলক্ষিত হয়। কেউ বলেছেন তা দ্বারা কোন আমল মুস্তাহাব প্রমাণ হতে পারে না। কিন্তু মুহাক্কিক ওরামায়ে কেরাম যাদের মধ্যে আল্লামা ইমাম নববী (রাহ.) (কিতাবুল আযকার লিন্নববী পৃঃ ৭), আল্লামা ইবনে হুমাম (রাহ.) (ফাতহুল ক্বাদীর ১/৪৬৭), আল্লামা ইবনে হাজার মক্কী (রাহ.) (ফাতহুল মুবীন পৃঃ ৩২) এবং আল্লামা আব্দুল হাই লাক্ষেৗভী (রাহ.) (আল আজ-বিবাতুল ফাযিলাহ ..পৃঃ ৫৭) গ্রন্থসমূহে বলেন, দুর্বল হাদীস দ্বারা অবশ্যই মুস্তাহাব প্রমাণিত হবে। সুতরাং তাদের মতে শবে বরাতে ইবাদতের মাধ্যমে রাত্রী জাগরণ ও রোযা রাখা সুন্নাত ও মুস্তাহাব।

শবে বরাত যেহেতু বরকতপূর্ণ রাত্রি, ক্ষমা ও চাহিদা মিটানোর ঘোষণার রাত্রি, তাই এ রাতে বিনিদ্র থেকে নফল নামায, যিকির আযকার, দোয়া ইস্তেগফারের, ক্ষমা প্রার্থনা, ইহলৌকিক ও পারলৌকিক সফলতার জন্যে কেঁদে কেঁদে আল্লাহ তায়ালার সাথে স¤žর্ক স্থাপন করা উচিত।

শবে-বরাতে সারা রাত ইবাদতের মাধ্যমে কাটিয়ে পরবর্তী দিন একটি রোযা রাখা ফযীলতপূর্ণ আমল। হাকীমুল উম্মত মুজাদ্দিদে মিল্লাত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রাহ.) বলেন, শাবান মাসের ১৫তম দিনে রোযা রাখা মুস্তাহাব। (যাওয়ালুসসিনাহ, ১০ পৃষ্ঠা)। মুফতীয়ে আযম মুফতী শফী (রাহ.) বলেন- ১৫ শাবানের সুন্নাত আমল সমূহের মধ্যে রোযাও অন্তর্ভুক্ত আছে।

তবে এ ব্যাপারে আল্লামা মুফতী তকী ওসমানী (দা.বা.) লিখেন, হাদীস শরীফের বিশাল ভান্ডারে একটি মাত্র দুর্বল হাদীসে এই রোযার কথা পাওয়া যায়। তাই অনেক ওলামায়ে কেরামের মতে সুন্নাত বা মুস্তাহাব বলে দেওয়া উচিত নয়। তবে হ্যাঁ ! গোটা শাবান মাস রোযা রাখার কথা বহু হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। আবার হুযূর (সা.) আইয়্যামে বীযের (মাসের ১৪, ১৫ ও ১৬ তারিখ) রোযা রাখতেন। সুতরাং কোন ব্যক্তি এই দুটি কারণকে সামনে রেখে ১৫ শাবান রোযা রাখলে, তবে সে প্রতিদান পাবে বলে আশা করা যায়, ইনশাআল্লাহ। তবে শুধু ১৫ই শাবানের কারণে রোযাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে সুন্নাত বলে দেওয়া অনেক ওলামায়ে কেরামের মতে ঠিক নয়। শরীয়তের প্রত্যেক বিষয়কে তার আপন গন্ডিতে সীমাবদ্ধ রাখা উচিৎ। দ্বীন হচ্ছে সীমারেখা সংরক্ষণ রাখার নাম। নিজের জ্ঞান খাটিয়ে কোন কিছুকে কম বেশী, আগে পিছে করার নাম দ্বীন নয়।

শবে বরাতের রাতে কবরস্থানে গিয়ে যিয়ারতের কথা হাদীস শরীফে পাওয়া যায়। যেমন- হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, “আমি এক রাতে হুযূর (সা.)কে (শয্যা পার্শ্বে) না পেয়ে খুঁজতে বের হয়ে জান্নাতুল বাক্বীতে পেলাম। তিনি আমাকে দেখে বললেন, আয়শা, তুমি কি আশংকা করেছো আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা.) তোমার সাথে খিয়ানত করেছেন। আমি বললাম, হে আল্লাহর রসূল (সা.)! আমি ভেবে ছিলাম আপনি অন্য কোন স্ত্রীর ঘরে গমন করেছেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ্ (সা.) ইরশাদ ফরমান- ১৫ শাবানের রাত্রে আল্লাহ পাক প্রথম আকাশে অবতরণ করেন এবং “বনু ক্বালব” গোত্রের পালিত ছাগল পালের শরীরের পশমের চেয়েও অধিক সংখ্যক বান্দাদের তিনি ক্ষমা করে দেন”। (তিরমিযী শরীফ-৭৩৯, ইবনে মাযাহ-১৩৮৫ পৃষ্ঠা)।

হযরত আশরাফ আলী থানভী (রাহ.) যাওয়ালুস সিনাহ গ্রন্থের ১০ম পৃষ্ঠায় বলেন- এ রাতে কবর যিয়ারত করা মুস্তাহাব। অতএব, নিকটতম কবরস্থানে যিয়ারতে যাওয়া (জরুরী মনে না করে) দোষনীয় নয়। তবে বাধ্যতামূলক বা আনুষ্ঠানিকতা বা রসুম হিসেবে যাওয়া মোটেই জায়েয হবে না।

আরও পড়তে পারেন-

বিভিন্ন বর্ণনায় পাওয়া যায়, এই ফযীলত ও বরকতপূর্ণ রাত্রীতেও যারা আল্লাহর রহমত হতে বঞ্চিত, তারা হলো- (১) আল্লাহ তায়ালার সাথে (যাতে বা গুণাবলীতে ) শরিককারী, (২) অপরের সাথে বিদ্বেষভাব পোষণকারী, (৩) অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যাকারী, (৪) হিংসুক, (৫) আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নকারী, (৬) মাটিতে কাপড় হেঁচড়িয়ে বিচরণকারী, (৭) মদ্যপান কারী, (৮) পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান, (৯) আত্মহত্যাকারী, (১০) যাদুকর, (১১) গণক, (১২) জোর-জুলুম করে টেক্স উছুলকারী, (১৩) হাতের রেখা দেখে বা বানর দ্বারা গনায়ে ভবিষ্যতের ভাগ্য নির্ধারণকারী এবং (১৪) ঢোল, তবলা, হারমুনিয়াম, গানবাদ্য, নৃত্য নিয়ে মত্ত এবং জুয়া খেলোয়াড় প্রমুখ। (মা সাবাতা বিসসুন্নাহ)।

শবে বরাতে বর্জনীয় কাজসমূহ
দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্নজনকে শবে বরাতে ইবাদত-বন্দেগী ও গুরুত্ব দিতে গিয়ে বাড়াবাড়ি করতে দেখা যায়। ফযীলতপূর্ণ রাতটিতে তাদের বাড়াবাড়ির কারণে সাওয়াব ও বরকতের পরিবর্তে তাদের আমলনামায় গোনাহ জমে। বর্তমানে শবে বরাতের রাতে প্রচলিত কিছু বিদআত ও বর্জনীয় কাজের উল্লেখ করছি। এসব কর্মকাণ্ড থেকে প্রতিটি মুমিন মুসলমানের দূরে থাকা একান্ত অপরিহার্য। যথা-

(১) শবে বরাতকে উপলক্ষ করে ডাকাডাকি করে আনুষ্ঠানিকভাবে মসজিদে বিপুল পরিমাণ কোনো জনসমাগমের আয়োজন করা যাবে না। (২) শুধু শবে বরাতকে কেন্দ্র করে মসজিদে বা ঘরে প্রয়োজনের অতিরিক্ত লাইটিং বা আলোকসজ্জা করা যাবে না। (৩) এই রাতে ইবাদত মনে করে হালুয়া-রুটি তৈরি ও ভোজনের আয়োজন করা যাবে না। (৪) ইবাদত মনে করে গরু-ছাগল যবেহ করা যাবে না। (৫) আতশবাজি, পটকা ফোটানো যাবে না।

(৬) ইবাদত-বন্দেগি বাদ দিয়ে অযথা ঘোরাফেরা করা যাবে না। (৭) গর্হিত ও অশ্লীল কোনো কাজ করা যাবে না। ( ৮) অন্য কারও ইবাদতের বা ঘুমের বিঘ্ন ঘটানো যাবে না। (৯) এবং দলবেঁধে আয়োজন করে কবরস্থানেও যাওয়া যাবে না। (১০) মাজারে গিয়ে মেলা বসানো ও কথিত মীলাদ-কিয়ামের আয়োজন করা যাবে না। এই রাতে মাজারে মাজারে গিয়ে ঘোরা ফিরা করা, খানা-পিনা, তাবারুক বিতরণ, শিরণী ইত্যাদী সম্পূর্ণরূপে বর্জনীয়।

মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের সকলকে বরকতময় রজনীয় শবে বরাতে সকল গর্হিত কর্মকাণ্ড পরিহার করে শরীয়তের সীমারেখার মধ্যে থেকে আমল করার তাওফীক দান করুন। আমিন।

লেখক: প্রখ্যাত মুহাদ্দিস, মহাপরিচালক- জামিয়া আহলিয়া দারুল উলূম হাটহাজারী, চট্টগ্রাম, সহসভাপতি- বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ, সভাপতি- আন্তর্জাতিক মজলিসে তাহাফফুজে খতমে নবুওয়াত বাংলাদেশ, চেয়ারম্যান- নূরানী তালিমুল কুরআন বোর্ড চট্টগ্রাম বাংলাদেশ এবং সম্পাদক- মাসিক মুঈনুল ইসলাম।

উম্মাহ২৪ডটকম: এসএএম

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।