Home ওপিনিয়ন দ্য কাশ্মীর ফাইলস: ঘৃণা ছড়ানোর ন্যাক্কারজনক কৌশল

দ্য কাশ্মীর ফাইলস: ঘৃণা ছড়ানোর ন্যাক্কারজনক কৌশল

।। মুফতি এনায়েতুল্লাহ ।।

২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ভারতের রাজস্থানের জয়পুরে অনুষ্ঠিত হয় আন্তর্জাতিক সাহিত্য উৎসব। উৎসবে অংশ নেয়া আমেরিকার প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী ও ভাষাতত্ত্বের অধ্যাপক শেলডন পোলকের একটি বক্তব্যে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়। তিনি বলেন, ‘মুসলমান শাসকরা জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করালে বর্তমান ভারতে একজনও হিন্দু থাকত না’। কারণ হিসেবে মুসলমান শাসকদের প্রায় ১২০০ বছর ভারত শাসনের ইতিহাস তুলে ধরেন তিনি। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ের এই অধ্যাপক নিজেকে ‘ইহুদি ব্রাহ্মণ’ বলে পরিচয় দেন। সংস্কৃত পারদর্শী এই অধ্যাপক হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসিকাল লাইব্রেরি ইন্ডিয়া প্রকল্পের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক।

অধ্যাপক শেলডনের বক্তব্য উদ্ধৃতির কারণ হলো, তিনি ভিনদেশী ও ভিনধর্মী। তিনি গবেষণা করে তথ্য-উপাত্ত হাতে নিয়ে কথাগুলো বলেছেন। আর বাস্তবতাও তাই। আসলে ভারতের মুসলমানদের দুর্দশাকালের সূচনা ঘটে বৃটিশ শাসন শুরুর মাধ্যমে। ভারত ছাড়ার আগে চতুর বৃটিশরা সমাজে ধর্ম, সম্প্রদায় ও নানা ইস্যুতে বিভিন্ন বিভেদ সৃষ্টির বিভিন্ন উপকরণ পুঁতে যায়। তার একটি হলো- আরএসএস অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ প্রতিষ্ঠা।

বর্তমান ভারতের বিজেপিকে চিনতে হলে ‘সংঘ পরিবার’-এর অন্তর্গত হিন্দু জাতীয়তাবাদী সংগঠনগুলোর উৎস আরএসএস অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘকে জানা দরকার। কেশব হেডগেওয়ার ১৯২৫ সালে সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেন। ভারতকে ‘হিন্দুত্ববাদের’ চিন্তাধারায় গড়ে তোলাই আরএসএসের প্রধান উদ্দেশ্য। এ লক্ষ্যে তারা মুসলিম নেতৃত্ব সম্পৃক্ত কংগ্রেসের নেতৃত্বে চলা বৃটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে দূরে থাকে। ১৯৪০ সালে এই সংগঠনের অন্য নেতা এমএস গোলওয়ালকর হিন্দু রাষ্ট্র গড়তে বৃটিশ বিরোধিতার বদলে ধর্ম ও সংস্কৃতি রক্ষার ডাক দেয়। এর মাধ্যমেই বোঝা যায়, সংগঠনটির লক্ষ্যমাত্রা। ভারতের স্বাধীনতার পর কংগ্রেসকে ঠেকাতে ১৯৫১ সালে জনসংঘ প্রতিষ্ঠা করেন আরেক আরএসএস নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। এই জনসংঘই বিজেপি অর্থাৎ ভারতীয় জনতা পার্টি। এক কথায়, ‘যাহা বিজেপি, তাহাই আরএসএস’।

২০১৪ সাল থেকে এককালের আরএসএস কর্মী ও বিজেপি নেতা নরেন্দ্র মোদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী। তিনি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। তার শাসনামলে ২০০২ সালে গুজরাটে ভয়াবহ এক দাঙ্গা হয়। তখন হাজার হাজার মুসলমান ঘরবাড়ি হারান, আহত-নিহতের সঠিক কোনো পরিসংখ্যান আজও প্রকাশিত হয়নি। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ওই সময় দুই হাজারের বেশি মুসলমান নিহত হন। এর আগে ১৯৭৯ সালের এই গুজরাটে আরেক দাঙ্গায় এক হাজারের মতো মানুষের মৃত্যু হয়। যার বেশির ভাগই ছিলেন মুসলমান। ১৯৮৯ সালে বিহারের ভাগলপুর দাঙ্গায় ১০০০ জন মানুষের মৃত্যু হয়, তার মধ্যে প্রায় ৯০০ জন ছিলেন মুসলমান। ১৯৮৮ সালের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদের কাটরা মসজিদের দাঙ্গায় ২১ জন মুসলমান মারা যান। ১৯৯২ সালে ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ভাঙার পর দাঙ্গায় দুই হাজারের বেশি মানুষ মারা যায়। যার প্রায় সবাই ছিলেন মুসলমান। ২০০০ সালের ২৭ জুলাই বীরভূমের নানুরে ১০ জন মুসলমানকে হত্যা করা হয়। এভাবে তারিখ ধরে ধরে হিসাব করলে আরও অন্তত কয়েকশ’ সহিংসতার ঘটনা বলা যাবে। যেসব ঘটনায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন মুসলমানরা।

হাল সময়ে গো-মাংস বহনের কল্পিত অভিযোগ এবং কথিত লাভ জেহাদসহ নানা অজুহাতে পিটিয়ে মুসলমানদের মারার নতুন প্রবণতা দেখা দিয়েছে ভারতে। বিদ্বেষপূর্ণ বক্তৃতা তো নৈমিত্তিক ব্যাপার। বিশেষ করে হাজার হাজার মানুষকে প্রভাবিত করার মতো ক্ষমতাধর ধর্মীয়, জাতিগত ও রাজনৈতিক নেতারা ঘৃণা ছড়ানো কথাবার্তা নিয়মিতই বলেন। ২০১৯ সালে এনডিটিভির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মোদি সরকারের আমলে ভারতে ভিআইপিদের ঘৃণা ছড়ানো কথার পরিমাণ আকাশচুম্বী হয়েছে। এমন বিদ্বেষমূলক বক্তব্যের হার বেড়েছে ৫০০ শতাংশ। বিজেপির সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন দলের প্রভাবশালী নেতা এবং খোদ বিজেপি নেতারাও ভোটারদের ধর্মীয় অনুভূতিতে উসকে দেয়ার জন্য ঘৃণামূলক কথা বলেন। আশ্চর্যের বিষয়, এ কারণে কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আনা হয় না, কেউ গ্রেপ্তার হয় না। উল্টো রাজনৈতিকভাবে তারা প্রমোশন পান। বিভিন্ন প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গত এক দশকে ভারতে সংঘটিত সমস্ত ঘৃণামূলক অপরাধের প্রায় ৯০ শতাংশ ঘটেছে নরেন্দ্র মোদির শাসনামলে।

ভারতে ধর্মীয় বিদ্বেষের চর্চা নতুন বিষয় নয়। এই ঘৃণার জন্ম দেয়ার জন্য দায়ী বৃটিশরা। তাদের ‘ভাগ করো, শাসন করো’ নীতিই বর্তমানে বিজেপি গ্রহণ করেছে। তারা ভারতের ৮০ শতাংশ হিন্দু ভোট একাট্টা করতে মুসলিমবিরোধী অবস্থান নিয়ে থাকে। ফলে ভারতের মাটিতে রক্তাক্ত বিভাজন, ধর্মীয় বিদ্বেষ, জাতিগত সহিংসতা, ধর্ষণ, দাঙ্গা হয় অনেকটা প্রকাশ্যে, ঘোষণা দিয়ে। এ কাজে ভারতের গণমাধ্যম এবং বলিউডের সিনেমা-নাটক বিশেষ ভূমিকা রাখে। এমনই একটি সিনেমা ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস।’ চলচ্চিত্রটি ঘিরে চলছে তীব্র উত্তেজনা। সিনেমাটি পুরোপুরি মুসলিম বিরোধী এক উপাখ্যান।

আরও পড়তে পারেন-

কাশ্মীর ফাইলসে এমন অনেক দৃশ্য রয়েছে, যেখানে মুসলমানদের দ্ব্যর্থহীনভাবে বর্বর হিসেবে দেখানো হয়েছে। পুরো ছবিজুড়ে বিবেকবর্জিত নানা প্রসঙ্গ, ঝুলন্ত লাশ, নৃশংসতা, গুলি, রক্ত, কাশ্মীরি নারী পন্ডিতদের কাপড় খুলে লাঞ্ছনা এবং নির্দয় মৃত্যু দেখানো হয়। সিনেমায় পরিচালক ইচ্ছাকৃতভাবে ভিন্নমতের সঙ্গে সন্ত্রাসকে মিশ্রিত করেছেন। পরিচালক কোটি কোটি কাশ্মীরি মুসলমানদের ভুলে গেছেন, যারা স্বাধীন ভারতে পরাধীন, যারা এখনও ভারত সরকার দ্বারা নির্যাতিত, তাদের কোনো মৌলিক অধিকার স্বীকার করা হয় না।

ভারতজুড়ে কাশ্মীরের মুসলমানদের ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখা হয়। কথায় কথায় গুলি করে মেরে জঙ্গি তকমা দিয়ে মূল বিষয় ভিন্নখাতে প্রবাহিত করা হয়। পরিচালক তার সিনেমায় ইতিহাসের এই ফাইলগুলো উল্টে দেখার চেষ্টা করেননি, তিনি এটা করবেনও না। কারণ, বিকৃত ও অর্ধসত্য ঘটনা নির্ভর এই সিনেমার পরিচালক বিবেক অগ্নিহোত্রী আরএসএস মানসিকতার লোক। সিনেমার কলা-কুশলীদের অন্যতম অনুপম খের (তার স্ত্রী কিরন খের বিজেপির মনোনয়নে ২০১৪ সালে লোকসভার সদস্য নির্বাচিত হন) ও মিঠুন চক্রবর্তী বিজেপির ঘরের লোক। তাই তো এই ছবি নিয়ে স্বয়ং মোদি বেজায় উৎসাহী। বিজেপি শাসিত বহু রাজ্যে ছবিটি শুল্কমুক্ত করে দেয়া হয়েছে। ব্যাপকহারে প্রচার মাধ্যমকে কাজে লাগানো হচ্ছে। এর মাধ্যমে চেপে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে কাশ্মীরি আম জনতার ওপর অত্যাচারের নিদারুণ কাহিনী, গলা টিপে ধরা হয়েছে কাশ্মীরিদের যন্ত্রণার কথাগুলোকে।

সেই কাশ্মীরে এখনও হাজার হাজার মুসলিম যুবক নিখোঁজ। তাদের মা, বোন ও স্ত্রীরা জানতে চান, তাদের সন্তান কিংবা স্বামী বেঁচে আছে না নিহত হয়েছে। হিউম্যান রাইটস অর্গানাইজেশনগুলো এই প্রশ্নে বার বার কাশ্মীর প্রশাসন ও ভারত সরকারকে অনুরোধ করেছে, সঠিক জবাব তুলে ধরতে। কিন্তু সরকার এই বিষয়ে চুপ।

বলা হয়, মগজ ধোলাইয়ের স্বার্থে তথ্য বিকৃত করা হয়। কথাটি বলিউডের সিনেমার ক্ষেত্রে পুরোপুরি খাটে। শুধু কাশ্মীর ফাইলস নয়, বলিউডের একাধিক ছবিতে মুসলিম বিদ্বেষী, অসত্য ও বিকৃত ইতিহাস নির্ভর উদ্দেশ্যপ্রণোদিত একপাক্ষিক দৃষ্টিভঙ্গি দেখে এটা বলা যায়। বেশ কয়েক বছর ধরে বলিউডের বেশ কিছু সিনেমায় ইসলাম বিদ্বেষের ছাপ স্পষ্ট। উগ্র হিন্দুত্ববাদকে জাগ্রত করতে অন্য জাতিকে কোণঠাসা করার অভিপ্রায়ে নির্মিত একচোখা সিনেমাগুলো বিজেপির রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করছে। আতঙ্কের বিষয় হলো, একপক্ষকে বড় করে উপস্থাপন করতে গিয়ে অন্যপক্ষকে টার্গেট করা হচ্ছে, ছোট করা হচ্ছে। ফলে নতুন প্রজন্ম প্রকৃত সত্যটা জানার সুযোগ পাচ্ছে না।

কাশ্মীর ফাইলস সিনেমার প্রেক্ষিতে বলিউডের নামকরা পরিচালক বিনোদ কাপ্রি ঘোষণা করেছেন, ‘তিনি গুজরাট দাঙ্গার ওপর ‘গুজরাট ফাইলস’ নামে একটি ছবি বানাবেন। টুইট করে এই খবর দেয়ার পাশাপাশি তিনি প্রধানমন্ত্রী মোদির কাছে কিছু প্রশ্ন রেখেছেন। ‘গুজরাট ফাইলস নামে, আমি তথ্য ও শিল্পের ওপর ভিত্তি করে একটি চলচ্চিত্র তৈরি করতে প্রস্তুত। সেখানে আপনার ভূমিকাও বিশদভাবে বলা হবে। সেটা যেন সেন্সর বোর্ডের পক্ষ থেকে ছাড় পায়। দাঙ্গা লাগাতে পারে এমন যুক্তি দিয়ে যেন ছবির মুক্তি আটকে দেয়া না হয়’।

ভারতে মুসলমানরা সংখ্যালঘু। আর সংখ্যালঘু মানেই দুর্বল। তাই সব ব্যর্থতা ঢাকার বলিও তারাই। ক্ষমতাসীনদের নানাবিধ ব্যর্থতা থেকে সাধারণ মানুষের নজর সরাতে তাই বারবার মুসলমানদের ‘বলির পাঁঠা’ বানানো হয়। সাম্প্রদায়িকতার আগুনে ঘি ঢেলে সংখ্যাগুরু ভোটারের সমর্থন আদায়ে এটা ভারতীয় সাম্প্রদায়িক রাজনীতিবিদদের মোক্ষম কৌশল। কিন্তু বিষয়টি রাজনীতির ময়দান ছাড়িয়ে শিল্প-সাহিত্য, সিনেমা-নাটকে যেভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে, তা প্রত্যাশিত নয়।

সব ধর্মকে সম্মান জানানো ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতের কথা ভারতের সংবিধানে বলা আছে। সাংবিধানিকভাবে ভারত একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। সেখানে এ জাতীয় মনোভাব সুদূরপ্রসারী কোনো ফলাফল বয়ে আনবে না। হয়ত এর দ্বারা ক্ষমতায় আসার পথ তৈরি করা সম্ভব, কিন্তু আখেরে তাতে খুব ফায়দা হয় না। আমরা জানি, জাতীয় ঐক্য ভেঙে শাসন করতে ভারতীয় উপমহাদেশে চিরকালই শাসন ব্যবস্থার এক শক্তিশালী ও ন্যাক্কারজনক অস্ত্র ছিল সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ। ঘৃণার সেই বীজ আজ জনতার মনে মহীরূহে রূপ নিয়েছে, সেই বিষবৃক্ষকে আরও পুষ্টকারী সর্বশেষ শাসকদল হলো মোদির সরকার। কারণ বৃটিশ রাজের মতোই তারাও জনতার ঐক্যকে ভয় পায়। তাদের জানা আছে, তাদের ব্যর্থতাগুলো কী কী? সেটা ঢেকে রাখতে একেক সময় একেক ইস্যু সামনে আনে। এরই প্রেক্ষিতে কর্ণাটকে নিষিদ্ধ হয় হিজাব, আর মুম্বাইয়ে বানানো হয় মিথ্যার বেসাতি দিয়ে সাজানো কাশ্মীর ফাইলস। ভবিষ্যতে আর কী কী আসবে তা হয়তো সময়ই বলবে! সেই সঙ্গে এসব ঘটনার পরিণতিও লেখা হবে ইতিহাসের পাতায়, ইনশাআল্লাহ।

লেখক: সাংবাদিক।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।