Home ওপিনিয়ন উগ্র হিন্দুত্ববাদ এবং মুসলিমবিদ্বেষ ভারত ও বাংলাদেশের জন্য হুমকি

উগ্র হিন্দুত্ববাদ এবং মুসলিমবিদ্বেষ ভারত ও বাংলাদেশের জন্য হুমকি

ভারতের হিন্দুত্ববাদী গেরুয়া সন্ত্রাস শুধু ভারতকেই বিভাজন ও অশান্তির নিগড়ে নিক্ষেপ করছে না, বাংলাদেশসহ প্রতিবেশিদের প্রতিও ক্রমাগত হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

।। জামালউদ্দিন বারী ।।

এশিয়া মহাদেশকে সভ্যতার পাদপীঠ বা সূতিকাগার বলা যায়। অর্থনৈতিকভাবে, জ্ঞানবিজ্ঞানে ও ঐতিহাসিকভাবে এশিয়ায় ভারতের অবস্থান যেখানেই থাক না কেন, চলমান বিশ্বের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক তথা ভূ-রাজনৈতিক মানচিত্রে ভারত গুরুতপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। বিশেষত ভারতের শতকোটি জনসংখ্যা, বিশ্বব্যাপী এর বিশাল ডায়াসপোরা এবং হিন্দুমুসলমান সম্প্রীতি, বৃটিশ ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার ও গণতান্ত্রিক সংবিধানের কারণে বিশ্ব পরিমন্ডলে ভারতের একটা বাড়তি গুরুত্ব রয়েছে। ভারতের শাসকরা কি সে গুরুত্ব এবং ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতন?

স্বাধীনতার সময় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস নেতারা যে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দেশটিকে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সম্পৃক্ত অসাম্প্রদায়িক চেতনায় গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন তা ছিল চিরায়ত ভারতের অনিবার্য বাস্তবতা। হিন্দুত্ববাদীদের চরম মুসলমান বিদ্বেষ এবং রক্তাক্ত দাঙ্গার কারণে ভারত ভেঙ্গে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রের জন্ম হলেও এখনো ভারতে বিশ্বের একক বৃহত্তম মুসলিম জনগোষ্ঠীর বসবাস। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, এই মুসলমানরাই ভারতের স্বাধীনতার জন্য সবচেয়ে বেশি আত্মত্যাগ করেছে এবং জীবন দিয়েছে।

হাজার বছর আগে অবিভক্ত ভারত নামে কোনো একক রাষ্ট্রশক্তির অস্তিত্ব ছিল না। তুরস্ক, আফগানিস্তান ও পারস্য থেকে আসা মুসলমান দিগি¦জয়ী সুলতান ও মুঘল বাদশারাই শতধাবিভক্ত ভারতকে ঐক্যবদ্ধ করে সালতানাত ও মুঘল সা¤্রাজ্যের পত্তন ঘটিয়েছিলেন। মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা ও ইউরোপ-আমেরিকার কাছে ভারত নামক রাষ্ট্র ও তার জনমানুষের পরিচয় গবেষণামূলক তথ্য-উপাত্তসহ যে ব্যক্তি প্রথম তুলে ধরেছিলেন তার নাম আল বেরুনি। তার ভারততত্ত¡ই বিশ্বের দেশে দেশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারত সম্পর্কিত প্রথম পুর্ণাঙ্গ আকর গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হয়।

ভারতের শিল্পায়ন, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি, চিত্রকলা, সঙ্গীত ও চলচ্চিত্র শিল্পের বিকাশে মুসলমানরাই পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছিল। মূলত হিন্দু-মুসলমানের সম্প্রীতি ও সম্মিলন ছাড়া ভারতের অগ্রযাত্রা ও বিকাশ কল্পনা করা যায় না। আজকের ভারতের হিন্দুত্ববাদী মুসলিম বিদ্বেষ ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি ভারতের ঐতিহাসিক অগ্রযাত্রার বিপ্রতীব অবস্থানে ঘুরপাক খাচ্ছে। শত শত বছরের সুলতানি ও মুঘল শাসনের ধারাবাহিকতায় দুইশ বছরের বৃটিশ শাসনে ভারত থেকে ইউরোপে সম্পদের পাচার ও লুন্ঠনের মচ্ছব ঘটলেও ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসির বৃটিশ শাসনও ভারতকে এতটা দেউলিয়া ও অন্ত:সারশূন্য করে দিতে পারেনি, যতটা ঔপনিবেশোত্তর ভারতের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি এবং মাত্র দেড়-দুই দশকের হিন্দুত্ববাদী শাসনে আজ ভারত ভেতর থেকে বিপর্যস্ত ও আক্রান্ত হয়েছে।

আল্লামা ইকবাল লিখেছিলেন, সারা জাঁহাসে আচ্ছা হিন্দুস্তাঁ হামারা। ভারতের প্রতিটি মুসলমান এখনো এভাবেই ভাবতে অভ্যস্থ। ভারত স্বাধীনতা লাভের প্রায় অর্ধ শতাব্দী আগে কবি ইকবাল এই কবিতা লিখেছিলেন। এটি এখনো ভারতের অন্যতম জাতীয় সংগীত হিসেবে স্বীকৃত। ১৯০৪ সালের ১৬ আগস্ট ইত্তেহাদ পত্রিকায় তারানায়ে হিন্দ নামে পরিচিত ‘সারা জাঁহাসে আচ্ছা’ কবিতা প্রকাশিত হওয়ার এক বছর পর ১৯০৫ সালে বৃটিশ সরকার ভারতের পূর্বাংশের যোগাযোগ ও প্রশাসনিক অবকাঠামোগতভাবে অনুন্নত মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ববাংলার উন্নয়ন ও প্রশাসনিক সেবা সহজ করতে ঢাকাকে রাজধানী করে বাংলার পূর্বাংশ ত্রিপুরা ও আসাম প্রদেশ নিয়ে নিয়ে একটা নতুন প্রদেশ সৃষ্টি করেছিল।

এই উদ্যোগের পেছনে একদিকে যেমন পিছিয়ে পড়া বাঙ্গালি মুসলমানের বড় স্বার্থ নিহিত ছিল, সেই সাথে এখানকার অবকাঠামো উন্নয়ন, রেললাইন সম্প্রসারণ, পাটকল স্থাপনসহ অর্থনৈতিক কর্মকান্ড ও শিল্পের কাঁচামাল সংগ্রহের সাথে বৃটিশদের অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণের স্বার্থও জড়িত ছিল। তবে ঢাকায় প্রাদেশিক রাজধানী এবং কোর্ট-কাচারি স্থাপিত হলে কলকাতার গুরুত্ব ও অর্থনৈতিক প্রবাহে ভাটা পড়বে, বেনিয়া আইনজীবী ও জমিদারদের স্বার্থহানি ঘটবে সম্ভবত এমন আশঙ্কাকে সামনে রেখেই কলকাতা কেন্দ্রিক রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, বুদ্ধিজীবী ও কবি-সাহিত্যিকরা একাট্টা হয়ে বাংলাভাগের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। সেই আন্দোলনের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বঙ্গমায়ের অঙ্গচ্ছেদের বিরোধিতা করে ‘আমারা সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ গীতি কবিতাটি রচনা করেছিলেন। পাকিস্তানিদের সাথে যুদ্ধ করে স্বাধীন হওয়ার পর সেই কবিতাকেই আমরা বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে গ্রহণ করেছিলাম।

হিন্দুত্ববাদীদের তীব্র আন্দোলনের মুখে বৃটিশ সরকার ঢাকাকেন্দ্রীক পূর্ববাংলার প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ রদ করে ১৯১১ সালে আবারো কলকাতার সাথে একীভূত করতে বাধ্য হয়েছিল। পূর্ববাংলার মুসলমানদের প্রত্যাশার আলো মাত্র ৫ বছরেই নিভে যায়। হতাশ ও বিক্ষুব্ধ পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক নেতাদের দাবির প্রেক্ষিতে ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবের বিরুদ্ধেও তীব্র প্রতিবাদ ও বিরোধিতা করেছিল কলকাতার বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিকরা। সেই আন্দোলনেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে সম্মুখসারিতে দেখা গেছে। তবে চল্লিশের দশকের নতুন বাস্তবতায় গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে কলকাতায় মুসলমানদের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়া এবং দেশভাগের প্রেক্ষাপটে কলকাতার বাবুদের রূপ আমূল পাল্টে গিয়েছিল।

তাদের অনেকের মূল দাবি ছিল, আর কিছু ভাগ হোক বা না হোক, বাংলা ভাগ হতেই হবে! লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলো গণভোট বা জনমত অনুসারে, স্বাধীন অথবা ভারত ও পাকিস্তানের যেকোনো একটি ইউনিয়নে যোগ দিতে পারবে। সে হিসেবে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশের সুযোগ থাকলেও হিন্দুমুসলমানর ভেদাভেদের কারণে ঐতিহাসিক ও ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা ভুলে দুইভাগে ভাগ হয়ে ভারত ও পাকিস্তানে যুক্ত হয়েছিল। দুই বাংলা একীভূত হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র হলে সেটি হয়তো উপমহাদেশের অন্যতম সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী রাষ্ট্র হয়ে ওঠার সমুহ সম্ভাবনা ছিল।

ঊনবিংশ শতাব্দীর বৃটিশ লেখক-ইতিহাসবিদ লর্ড অ্যাক্টন লিখেছিলেন, ‘পাওয়ার টেন্ডস টু করাপ্ট, অ্যাবসুলিউট পাওয়ার করাপ্টস অ্যাবসুলিউটলি।’ আর অষ্টাদশ শতকের ফরাসি বিপ্লবের প্রেক্ষাপটে দার্শনিক ভলতেয়ার লিখেছিলেন, ‘গ্রেট পাওয়ার কামস গ্রেট রিসপন্সিবিলিটিজ।’ ইতিহাসের বড় বড় ঔপনিবেশিক সা¤্রাজ্যবাদ ও জাতীয়তাবাদী শক্তি তাদের সেই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার কারণে একেকটি সা¤্রাজ্য ও রাষ্ট্রশক্তির পতন ঘটেছিল। উসমানীয় খেলাফত, মুঘল সা¤্রাজ্য, ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তি থেকে শুরু করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের উত্থান-পতনের ধারাবাহিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এই সত্য বেরিয়ে আসে। কট্টর জাতীয়তাবাদী দেশপ্রেমের আস্ফালন একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থাকে ফ্যাসিবাদে পরিনত করতে পারে। গত শতাব্দীর তিরিশের দশকে জার্মানীতে হিটলারের নাজি পার্টির উগ্র জাতীয়তাবাদী উন্মাদনা কিভাবে কোটি কোটি মানুষের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ইউরোপসহ পুরো বিশ্বকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গিয়েছিল, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ তার জ্বলন্ত উদাহরণ। রাষ্ট্রশক্তি যদি জনমতের স্বাধীন ইচ্ছা ও প্রত্যাশাকে হীন রাজনৈতিক স্বার্থে বিভক্ত করে ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখতে চায় তা শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রের সম্ভাবনাকে শেষ করে দেয়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফাউন্ডিং ফাদাররা যেসব রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়গুলোকে সামনে রেখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন, বিংশ শতাব্দীতে এসে সেসব বিষয়গুলো মার্কিন রাষ্ট্রব্যবস্থার মূল ভিত্তির উপর আঘাত হানতে শুরু করেছিল। বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকিং সিস্টেম ও কারেন্সি নিয়ন্ত্রণের মত বিষয়গুলো মার্কিন জনগণ ও জনপ্রতিনিধিদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার যে আশঙ্কা ফাউন্ডিং ফাদাররা করেছিলেন, তা এখন বাস্তব রূপে আবির্ভূত হয়েছে। কর্পোরেট পুঁজিবাদ মার্কিন জনগণকে দেউলিয়া করে গুটি কতেক ব্যক্তি ও পরিবার সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছে। অর্থনৈতিক মহামন্দায় শেয়ার বাজার ও অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে সম্পদ হারিয়ে, বাড়িঘর ও চাকরি হারিয়ে এখন হাজার হাজার মার্কিন নাগরিককে ‘উই আর ৯৯%’ প্ল্যাকার্ড নিয়ে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করতে দেখা যায়।

অর্থনৈতিক কারণে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বঞ্চনার ঢেউ বিশ্বের দেশে দেশে বহুমাত্রিক সংকট সৃষ্টি করেছে। অর্থনীতির উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য বহুজাতিক কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো দেশে দেশে ধর্মীয় ও জাতিগত বিভাজন ও রাজনৈতিক শক্তিগুলোর বিভাজনকে উগ্রতার দিকে উস্কে দিতে নেপথ্য ভূমিকা পালন করে চলেছে। ভারতীয় উপমহাদেশে এর তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে শুরু করেছে। বিশেষত শতকোটি মানুষের বড় দেশ ভারতের হিন্দুত্ববাদীদের উগ্র সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গিকে কাজে লাগিয়ে ভারতের অভ্যন্তরে কমিউনিটিতে ও প্রতিবেশিদের সাথে সম্পর্কের অবনতি ঘটিয়ে শাসকদের দুর্বল অবস্থানে ঠেলে দিয়ে স্বার্থ হাসিলের তৎপরতা চলছে কি না তা রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বিশ্লেষক ও বিশেষজ্ঞরাই ভাল বলতে পারবেন।

সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া স্বাধীন রাষ্ট্র ইউক্রেন এখন রাশিয়ার সাথে ন্যাটোভুক্ত ইউরোপ-আমেরিকার দ্বন্দ্বের ‘অ্যাপল অব ডিসকর্ড’ হয়ে উঠেছে। যেকোনো সময় ভয়াবহ যুদ্ধের আশঙ্কা করা হচ্ছে। ভারতীয় উপমহাদেশে রাশিয়া বা পশ্চিমাদের তেমন কোনো নিবিড় ভূ-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্বার্থ না থাকলেও এখানে ভারত ও চীনের মত পারমানবিক পরাশক্তির যুদ্ধ-সংঘাত এবং নীরব লড়াইয়ের চলমান ইতিহাস রয়েছে। ভূ-রাজনৈতিক কারণে এই দুই শক্তির পশ্চাতে আমেরিকা ও রাশিয়ার নেপথ্য ইন্ধন থাকা খুবই স্বাভাবিক। একই বাস্তবতায় ইউরোপের ইউক্রেনের মত উপমহাদেশের রাজনীতিতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার গুরুত্বপূর্ণ। নিরীহ অসামরিক রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর মিয়ানমার বাহিনীর গণহত্যা ও জাতিগত নির্মূল অভিযান চালিয়ে ইতিহাসের ঘৃণ্যতম মানবাধিকার লঙ্ঘনের পরও ভারত, চীন বা পশ্চিমাদের নীরব ভূমিকার নেপথ্যেও মিয়ানমানের খনিজসম্পদের উপর তাদের লোলুপ দৃষ্টি ও গোপণ সমঝোতার আভাস অনেকটাই স্পষ্ট।

আরও পড়তে পারেন-

এখন বাংলাদেশের ভবিষ্যত রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পরিকল্পনা নিয়ে চীন-মার্কিন কূটনৈতিক রশি টানাটানি তেমন জোরালো হয়ে না উঠলেও গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাবেক ও বর্তমান শীর্ষ ৭ কর্মকর্তার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। তারই ধারাবাহিকতায় ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত গার্মেন্টস ক্রেতারা বাংলাদেশি রফতানিকারকদের ঋণপত্রের উপর নতুন শর্ত আরোপ করতে শুরু করেছে। রাজনৈতিক কারণে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত, মানবাধিকার লঙ্ঘন, অত:পর বহুজাতিক, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক স্বার্থান্বেষী মহলের দাবার গুটি হয়ে নিজেদের অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক অস্তিত্বের সংকট সৃষ্টির ভুরি ভুরি উদাহরণ সাম্প্রতিক ইতিহাসে রয়েছে। মিলিটারি ইন্ডাসট্রিয়াল কমপ্লেক্সের স্বার্থে খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও কর্পোরেট জায়নবাদের ক্রীড়নকে পরিনত হয়ে ওয়ার অন টেররিজমের নামে মধ্যপ্রাচ্যে একের পর এক দেশ দখল ও প্রক্সি ওয়ারের মাধ্যমে মার্কিন জনগণের রাজস্ব থেকে লক্ষ লক্ষ কোটি ডলার লোপাট করা হয়েছে। এসব যুদ্ধে কোনো রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অর্জন ছাড়াই পরাজয়ের গøানি মাথায় নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ইরাক-আফগানিস্তান ও সিরিয়া ছাড়তে হয়েছে।

বাণিজ্য, জ্বালানি ও কৌশলগত অংশীদারিত্বের বোঝাপড়ার নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে রাশিয়া-আমেরিকার মত রাজনৈতিক পরাশক্তি দেশগুলো গত ৭ দশক ধরে পরস্পর মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে। তবে রাশিয়ার পাশের মধ্য এশিয়া বা আমেরিকার পাশে মেক্সিকো বা পানামা বা কানাডার সাথে কোনো উত্তেজনার কথা শোনা যায়না। যতক্ষণ না আরেক পরাশক্তি সেখানে হস্তক্ষেপ করছে ততক্ষণ বড় কোনো উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরী হয় না। দুই পরাশক্তির মাঝখানে জনগণের ঐক্যই কেবল বিজয়ের নিয়ামক হতে পারে। ষাটের দশকে কিউবান মিসাইল ক্রাইসিস, ভিয়েতনাম যুদ্ধ, আফগানিস্তান, সিরিয়া বা ইউক্রেনের চলমান বাস্তবতা থেকে এই সত্য বারবার প্রমানিত। তবে ভারতের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির যে ভূমিকা দেখা যাচ্ছে, তা আমাদের উপমহাদেশকে ইতিহাসের এক ভয়াবহ পরিনতির মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিতে শুরু করেছে। ইতিমধ্যে পশ্চিমা আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক. মানবাধিকার সংস্থা ও জেনোসাইড বিশেষজ্ঞরা ভারতের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

আমেরিকান ইন্ডিয়ান মুসলিম কাউন্সিল আয়োজিত অনলাইন সেমিনারে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বর্ষীয়ান মার্কিন অধ্যাপক ও গবেষক, আন্তর্জাতিক গণহত্যা বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘জেনোসাইড ওয়াচে’র প্রতিষ্ঠাতা ড.গ্রেগরি স্ট্যান্টন ভারতের মুসলমানরা রুয়ান্ডার মত গণহত্যার শিকার হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। নব্বই দশকের মাঝামাঝিতে রুয়ান্ডায় গণহত্যা সংঘটিত হওয়ার কয়েক বছর আগেই প্রফেসর স্ট্যান্টন সেই গণহত্যার ভবিষ্যদ্বানি করেছিলেন। ভারতের মুসলমানদের ভবিষ্যত সম্পর্কে প্রফেসর স্ট্যান্টনের পিলে চমকানো ভবিষ্যদ্বানির পর এবার মার্কিন প্রফেসর এমিরেটাস, বর্তমান বিশ্বের অন্যতম আলোচিত বর্ষীয়ান দার্শনিক, সমাজত্বাত্তি¡ক নোয়ম চমস্কি বলেছেন, ভারত সরকার মুসলমানদেরকে বিশ্বের বৃহত্তম নিপীড়িত জনগোষ্ঠীতে পরিনত করেছে।

তিনি কাশ্মিরের উপর ভারতের নির্মম দখলদারিত্বের ইতিহাস পর্যালোচনা করে এর সাথে ফিলিস্তিনের উপর ইসরাইলের দখলদারিত্বের তুলনা করেছেন। একই অনলাইন সেমিনারে ভারতীয় লেখক ও ওয়েস্টমিনিস্টার ইউনিভার্সিটির লেকচারার অন্নপূর্ণা মেনন বলেছেন, বিজেপি সরকার যেভাবে সাংবাদিক ও সংবাদপত্রের উপর নিয়ন্ত্রণ চালাচ্ছে বিশ্বসম্প্রদায়ের উচিৎ সে দিকে নজর দেয়া। ইন্টারন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া এডভোকেসি ডিরেক্টর জন সিফটনের মতে, ভারতের সংবিধান লঙ্ঘন করে সেখানে সংখ্যালঘুদের দমন করে সংখ্যাগরিষ্ঠদের ধর্মীয় পক্ষপাত অনেক বড় হুমকি। এই হুমকি একদিকে যেমন ভারতের ২৫ কোটির বেশি মুসলমানের প্রতি, ভারতের রাষ্ট্রীয় সংহতির প্রতি, অন্যদিকে প্রতিবেশী দেশগুলোর নাগরিকদের প্রতিও।

হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির হাজার বছরের ঐতিহ্যে লালিত ভারতীয় সংস্কৃতিকে বিজেপি রাতারাতি পাল্টে দিয়ে ভারতের মুসলমানদের উপর হিন্দুত্বের দীক্ষা চাপিয়ে দিতে চাইছে। পশ্চিমাদের উপর জায়নবাদীদের চাপিয়ে দেয়া ইসলামোফোবিয়া ভারতে স্থান পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কারণ, ভারতের মুসলমানরা হাজার বছর ধরে ভারত শাসন করেছে এবং ভারতের জনগণের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই ভারতেই জায়নবাদী প্রপাগান্ডায় ছড়িয়ে দেয়া ইসলামোফোবিয়া সবচেয়ে আক্রমনাত্মক (নোয়ম চমস্কির মতে, ‘মোস্ট লিথ্যাল ফর্ম’) রূপে আর্বিভুত হয়েছে! বিজেপি শাসিত কর্নাটকে শিক্ষাঙ্গনে মুসলমান নারীদের হিজাব পড়া নিষিদ্ধ করে সেখানকার মুসলমান মেয়েদের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করার পন্থা বলে বিবেচিত হচ্ছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশসহ প্রতিবেশি দেশগুলোর উপর নানাভাবে চাপ সৃষ্টি করে চলেছে।

গতবছর ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গেরুয়া মাফলার পড়া একদল যুবক ‘হিন্দু হিন্দু ভাই ভাই’ ‘বাংলাদেশ মুর্দাবাদ’ শ্লোগান দিয়ে বাংলাদেশের পতাকা পায়ের নিচে ফেলে মাড়িয়ে অবমাননা করছে। ভারতের হিন্দুত্ববাদীরা বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ সম্পর্কে আপত্তির-ঔদ্ধত্ব্যপূর্ণ মন্তব্য ও আক্রমণে বিক্ষুব্ধ হলেও বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক বা ধর্মীয় গোষ্ঠী ভারতের পতাকা নিয়ে এমন আচরণ করেনি। প্রতিবেশি বড় দেশের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের উগ্রপন্থী কর্মীদের প্রতিবেশি দেশের প্রতি এমন বিদ্বেষপূর্ণ আচরণ খুব খারাপ বার্তা বহন করছে। আমরা বিশ্বাস করি, ভারত একটি সুসভ্য মহান রাষ্ট্র আর সনাতন ধর্ম বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন-অহিংস ধর্ম। জায়নবাদীদের সাথে যেমন জুদাইজমের পার্থক্য রয়েছে, তেমনি হিন্দুত্ববাদীরাও অহিংস হিন্দু নয়। অতএব হিন্দু বা সনাতন ধর্মাবলম্বী বা ভারত রাষ্ট্রের প্রতি বাংলাদেশের মুসলমানদের কোনো বিরোধ থাকতে পারে না। ভারতের হিন্দুত্ববাদী গেরুয়া সন্ত্রাস শুধু ভারতকেই বিভাজন ও অশান্তির নিগড়ে নিক্ষেপ করছে না, বাংলাদেশসহ প্রতিবেশিদের প্রতিও ক্রমাগত হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

লেখক: সহকারী সম্পাদক, দৈনিক ইনকিলাব।
ইমেইল- bari_zamal@yahoo.com

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।