Home ওপিনিয়ন ইউক্রেন যুদ্ধ: ভবিষ্যৎ গভীর সংকটের নির্দেশনা দিচ্ছে

ইউক্রেন যুদ্ধ: ভবিষ্যৎ গভীর সংকটের নির্দেশনা দিচ্ছে

।। মনোয়ারুল হক ।।

ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধের দ্বিতীয় মাস অতিবাহিত হওয়ার পর এ পৃথিবীর নতুন বাণিজ্যিক ব্যবস্থা যোগ হচ্ছে। যুদ্ধ শুরুর কিছুদিন পরেই মার্কিন পক্ষ থেকে রাশিয়ার ওপর বিভিন্ন ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয় এবং সেই নিষেধাজ্ঞার সঙ্গে হাত মিলিয়ে পশ্চিম ইউরোপের অনেকগুলো দেশ বিভিন্ন ধরনের নিষেধাজ্ঞা প্রদান করে। পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে এক পর্যায়ে রাশিয়া তার গ্যাস ও তেল সরবরাহের চুক্তিতে নতুন শর্ত আরোপ করে।

পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোতে গ্যাস রপ্তানি হবে কেবল রুশ মুদ্রা রুবলে, অর্থাৎ যদি রুবলে মূল্য পরিশোধ করা হয় তবেই গ্যাস সরবরাহ বহাল থাকবে। শুরুতে জার্মানিরসহ অনেকগুলো দেশ একত্র হয়ে বিরোধিতা করে রাশিয়ার এই সিদ্ধান্তের। বিশ্বের প্রায় সকল অংশের মানুষের ধারণা ছিল ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ স্বল্পস্থায়ী হবে। রাশিয়া নিজেও হয়তো তাই ভেবেছিল। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি। দীর্ঘায়িত হচ্ছে যুদ্ধ এবং যুদ্ধে ইউক্রেনের পক্ষ সরাসরি অবলম্বন না করে অস্ত্র সরবরাহের মাধ্যমে এক প্রক্সি যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার ন্যাটোভুক্ত মিত্র দেশগুলো। গণতন্ত্র, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ইত্যাদির কথা বলে তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ অবলম্বন করেছে। যদিও ইউক্রেন এর আগে রুশ বংশোদ্ভূত মানুষদের সঙ্গে বর্ণবাদী আচরণ করেছে, রুশ ভাষায় শিক্ষা এবং বাণিজ্যিক কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে।

রাশিয়ার আক্রমণের পর অব্যাহতভাবে দেশটির ওপর নানান নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে আমেরিকা ও পশ্চিমা দেশগুলো। রাশিয়াও পাল্টা নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। এ উদ্যোগে রাশিয়ার সর্বশেষ পদক্ষেপ হল, বুলগেরিয়া ও পোল্যান্ডে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া । রাশিয়ার পক্ষ থেকে আগেই বলা হয়েছিল রুবলে গ্যাসের মূল্য পরিশোধ না করলে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হবে। সত্যি সত্যি গ্যাস সরবরাহের চাবি এখন বন্ধ করে দিয়েছে রাশিয়া। এর ফলে এক নতুন মেরুকরণের সৃষ্টি হয়েছে।

আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে চুক্তি ভঙ্গ করেছে রাশিয়া, আন্তর্জাতিক পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো এরকমই প্রচার করছে। কিন্তু বাস্তবতা হল, রাশিয়ার ওপর বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন রাশিয়ার ডলার আটকে দিচ্ছে, তখন রাশিয়া বাধ্য হয়েই তার নিজ মুদ্রায় বাণিজ্য শুরু করেছে। বিশেষ করে প্রাকৃতিক গ্যাস এবং তেল বিক্রি। ইতোপূর্বে রাশিয়া-চীনের সঙ্গে একই ধরনের চুক্তির মাধ্যমে বাণিজ্য করে আসছে দুই দেশের নিজস্ব মুদ্রায়। মজার ব্যাপার হল, রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যের বিষয়ে সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে ভারত। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে রাশিয়ার পক্ষে বিভিন্ন ইস্যুতে জাতিসংঘে ভোটদানে বিরত থাকার মাধ্যমে ভারত রাশিয়ার প্রতি একাত্মতা ঘোষণা করার ভেতর দিয়ে এক ধরনের বাণিজ্যিক সুবিধা অর্জন করেছে। তবে রাশিয়া থেকে ভারত তেল ও গ্যাস ক্রয় করছে কোন মুদ্রায় তা আন্তর্জাতিকভাবে সুস্পষ্ট নয়।

ভারত ব্যাপকহারে রাশিয়ার কাছ থেকে তেল সংগ্রহ করছে। আমেরিকা ভারতের বিরুদ্ধে নানান হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা সত্ত্বেও ভারত তার নিজ স্বার্থে রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য অব্যাহত রেখেছে। দেখা যাচ্ছে, আমেরিকা-ভারতকে হুমকি ধামকি দিলেও এখন পর্যন্ত কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। সেদিক থেকে মনে হচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ব রাজনীতিতে যে একক ক্ষমতা ছিল তা কিছুটা হলেও দুর্বল অবস্থায় পৌঁছেছে। বিশেষ করে, ভারত-চীন-রাশিয়া যদি তাদের মধ্যে নিজস্ব মুদ্রায় বাণিজ্য শুরু করে তাহলে বিশ্বের নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণ সৃষ্টি হবে। কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সক্ষমতা থেকেও অর্থনৈতিক অবরোধ সৃষ্টির সক্ষমতা অনেক বেশি কার্যকর। যার ভেতর থেকেই সে বিশ্ব রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে। বিশ্বের ওপর এক ধরনের কর্তৃত্ববাদীতা করছে তার এই ডলারের শক্তিতে।

বিশ্বের প্রধান অর্থনীতি চীন, ভারত, রাশিয়া যদি কোন যৌথ মুদ্রা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে তাহলে মার্কিনীদের এই কর্তৃত্ববাদীতা চিরদিনের জন্য স্তব্ধ হবে। হিটলারের কর্তৃত্ববাদীতার ফলেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বের রাজনৈতিক অঙ্গনে এক ধরনের কর্তৃত্ববাদীতার সৃষ্টি হয়। ব্রিকস (BRICS) গঠন করার সময় থেকেই ধারণা করা হচ্ছিল, আগামীতে চীন, রাশিয়া, ভারত নতুন বাণিজ্যিক মুদ্রা ব্যবস্থা সৃষ্টি করবে। কিন্তু চীন এবং ভারতের মধ্যে রয়েছে সীমান্ত বিরোধ। এ কারণে প্রায়শই সীমান্ত যুদ্ধে লিপ্ত হয় দুইদেশ। ফলে আপাতদৃষ্টিতে যৌথ মুদ্রাব্যবস্থার বিষয়টি পিছিয়ে গেছে। চীন ভারতকে দ্বিপাক্ষিক পারস্পরিক মুদ্রায় বাণিজ্য করার প্রস্তাব দিলেও ভারত তা গ্রহণ করেনি। কিন্তু ভারত ঠিক এই মুহূর্তে তার সর্বোচ্চ সুযোগ গ্রহণ করছে; একদিকে ভারতের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে দলীয় সাম্প্রদায়িকতার ভেতর থেকে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ওপর যে ধরনের নিপীড়ন চালাচ্ছে, কাশ্মীরসহ অন্যান্য রাজ্যগুলোতে তাতে আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিবাদের মুখোমুখি হওয়ার কথা। কিন্তু ভারতের এই রাজনৈতিক অবস্থানের ফলে কোনো আন্তর্জাতিক শক্তি তার বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ তো দূরের কথা কোন সমালোচনাও করছে না।

আরও পড়তে পারেন-

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে ভারতের বর্তমান বৈদেশিক নীতিতে বিশ্ব বাণিজ্যে অর্থনৈতিক সুবিধার সৃষ্টি হয়েছে। কী দামে তেল, গ্যাস কিনছে রাশিয়ার কাছ থেকে তাও যেমন অস্পষ্ট তেমনি মূল্য কীভাবে পরিশোধ করা হবে তাও স্পষ্ট নয়। বুলগেরিয়া, পোল্যান্ডের গ্যাস সঞ্চালন বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে ইউরোপের ঐক্যর ভাঙার পথ সৃষ্টি হয়েছে। বেশকিছু ইউরোপীয় দেশ ইতোমধ্যেই রুবলে গ্যাসের মূল্য পরিশোধ করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। ইউক্রেন রাশিয়ার যুদ্ধ পরিসমাপ্তি হতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হবে। ফলে বিশ্ব বাণিজ্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়বে। স্বল্পোন্নত ও উন্নত দেশগুলো হবে এর প্রধান শিকার। আমাদেরও সেই ঝুঁকির সম্মুখীন হতে হবে যদি না আমরা সঠিক বৈদেশিক নীতি গ্রহণ করতে পারি। একদিকে, পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের পোশাক শিল্পের গভীর সংযোগ এবং মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজারে আমাদের উপস্থিতি কিংবা মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার- সবই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন দেশগুলোর সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত। সেই বিবেচনায় আমাদের বৈদেশিক নীতি একটি সংকটজনক অবস্থায় পার করছে।

মার্কিনীরা ইউক্রেন যুদ্ধের প্রস্তুতির সময় থেকেই বাংলাদেশের র‍্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক চাপে ফেলেছে। অন্যদিকে, দ্রব্যমূল্য বিশেষ করে কৃষিজাত পণ্যের মূল্য দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে, এসব কিছুই আমাদের আগামী ভবিষ্যৎ ও গভীর সংকটের দিক নির্দেশনা দিচ্ছে। দেশে আগামী বছর সাধারণ নির্বাচন হওয়ার সময়সূচি ঘনিয়ে আসছে। এমন এক পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলা করার জন্য দেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে এক ধরনের সমঝোতা প্রয়োজন। যদি ২০১৩ বা ১৪ সালের মতো কোনো অবস্থার সৃষ্টি হয়, তাহলে দেশের সাধারন মানুষ এক মর্মান্তিক সংকটের মুখোমুখি হবে।

উম্মাহ২৪ডটকম: এসএএম

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।