Home ইসলাম আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ওয়াকফের ভূমিকা

আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ওয়াকফের ভূমিকা

।। মো. হাবিবুর রহমান খান ।।

ওয়াকফ আরবি শব্দ। এর অর্থ আবদ্ধ বা বন্দিত্ব। আক্ষরিক অর্থ বন্দিত্ব, কোনো জিনিসকে থামানো বা স্থির করা। যিনি ওয়াকফ করেন তাকে ওয়াকিফ বা দাতা বলা হয়।

ইসলামী আইনশাস্ত্রে ওয়াকফ হলো একটি ভূমি, ভবন বা যেকোনো সম্পদ ধর্মীয় বিষয়ের প্রতি লক্ষ রেখে দাতব্য প্রতিষ্ঠান তৈরি বা মানবকল্যাণে দান করা।

ইমাম আবু হানিফা (রহ.) বলেন, ‘ওয়াকফের বৈধ অর্থ হলো ওয়াকফের মালিকানাধীন একটি নির্দিষ্ট জিনিস এবং তার সম্পদকে দরিদ্রতা বা অন্যান্য ভালো বস্তুর দাতব্যতায় নিবেদিত করা। ’

ইমাম ইউসুফ ও ইমাম মোহাম্মদ (রহ.) বলেন, ‘নিজের মালিকানাধীন সম্পদকে আল্লাহর মালিকানায় নিবেদিত করাই হলো ওয়াকফ। ’

ইমাম ইবনে কুদামা বলেন, ‘কোনো বস্তু এভাবে দান করা যে এর মূল সব সময় বহাল থাকবে। তবে এর উপযোগ ও উপকারিতা আল্লাহর পথে ব্যয় হবে। ’ (আল মুগনি : ৮/১৮)

সুতরাং ওয়াকফের সংজ্ঞায় আমরা বলতে পারি, কোনো ব্যক্তির কাছ থেকে তার সম্পদের মালিকানা তুলে নিয়ে তা একমাত্র আল্লাহর মালিকানায় ছেড়ে দেওয়া এবং এর উপযোগ ও উপকারিতা আল্লাহর বান্দাদের কল্যাণে ব্যয় করা।

ওয়াকফের পটভূমি

ইসলামের ইতিহাসে প্রথম ওয়াকফকৃত সম্পত্তি হলো মসজিদে কুবা। আর দ্বিতীয়টি হলো মসজিদ-ই-নববী। রাসুল (সা.) একখণ্ড জমি ক্রয় করে তা ওয়াকফ করে দেন। সেই ওয়াকফকৃত জমিতে তৈরি করেন মসজিদ-ই-নববী। এ ছাড়া যখন কোরআনের আয়াত নাজিল হয়, ‘তোমরা কিছুতেই পুণ্যের নাগাল পাবে না, যতক্ষণ না তোমরা তোমাদের প্রিয় বস্তু থেকে আল্লাহর জন্য ব্যয় করবে। ’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ৯২)

তখন সাহাবায়ে কিরাম তাঁদের প্রিয় বস্তু আল্লাহর নামে ওয়াকফ করার জন্য এক ধরনের প্রতিযোগিতা শুরু করে দেন। আনাস (রা.) বলেন, উপরোক্ত আয়াত নাজিল হওয়ার পর আবু তালহা (রা.) বলেন, ‘আমাদের রব আমাদের প্রিয় সম্পদ ব্যয় করতে বলেছেন। হে আল্লাহর রাসুল! আপনি সাক্ষী থাকুন, আমি আমার প্রিয় জমি আল্লাহর জন্য (ওয়াকফ করে) দিলাম। ’ তখন রাসুল (সা.) বলেন, ‘এটিকে তোমার আত্মীয় উবাই ইবনে কাব ও হাসান ইবনে সাবেতের জন্য (ওয়াকফ) করো। ’ (তাফসিরে কুরতুবি : ৪/১৩২)

মুসলিম সভ্যতায় ওয়াকফ

সাহাবিদের ওয়াকফ : মদিনায় ‘বিরে রুমা’ নামে ইহুদির একটি কূপ ছিল। মুসলমানরা যখন দলে দলে মদিনায় হিজরত করতে লাগল তখন ইহুদিরা এই সুযোগে কূপের পানি মুসলমানদের কাছে চড়া দামে বিক্রি করতে শুরু করল। সাহাবায়ে কিরাম রাসুল (সা.)-কে এ বিষয়ে অবগত করলে তিনি বলেন, তোমাদের মধ্যে কে আছ, যে এই কূপ মুসলমানদের জন্য ক্রয় করে দেবে। মুসলমানদের এই কূপ যে খরিদ করে দেবে আল্লাহ তাকে জান্নাতে ঝরনা দান করবেন। ওসমান (রা.) ৩৫ হাজার রৌপ্যমুদ্রায় কূপটি কিনে মুসলমানদের জন্য ওয়াকফ করে দেন। যে কূপের পানি এখনো পর্যন্ত বহমান।

উমাইয়া শাসনামলে শিক্ষাব্যবস্থা ও ওয়াকফ : উমাইয়াদের শাসনামলে পুরো মুসলিম দুনিয়ায় প্রাথমিক শিক্ষার জন্য মক্তব প্রতিষ্ঠা করা হয়। বিখ্যাত মুসলিম পর্যটক ইবনে হাওকাল (রহ.) একটি মফস্বল এলাকায় মক্তবের হিসাব করেছিলেন, যার সংখ্যা ছিল ৩০০। মক্তবগুলো ছিল অনেক প্রশস্ত। কোনো কোনো মক্তবে কয়েক শ থেকে কয়েক হাজার পর্যন্ত ছাত্র-ছাত্রী পড়াশোনা করত। যেমন—আবুল কাসেম বালখি (রহ.)-এর একটি মক্তব ছিল, যেখানে তিন হাজার ছাত্র-ছাত্রী পড়াশোনা করত। মক্তবের আয়তন এত বিশাল ছিল যে গাধার পিঠে চড়ে ছাত্রদের তদারক করতে হতো। (মিন রওয়াই হাজারাতিনা, পৃষ্ঠা : ২০৫-২০৬)

আব্বাসি শাসনামলে শিক্ষা খাতে ওয়াকফ : আব্বাসীয়রা ইসলামী শিক্ষা-সংস্কৃতিকে নিয়ে গিয়েছিল সমৃদ্ধির উচ্চ শিখরে। ফাখরুদ দওলা ইবনে মুত্তালিব ওয়াকফ করেছিলেন ‘দারুয জাহাব’ নামের প্রসিদ্ধ একটি মাদরাসা। তার জন্য আরো বহু ভূমি-সম্পত্তি ওয়াকফ করেছিলেন, যা থেকে মাদরাসার জন্য বার্ষিক আয় ছিল এক হাজার ৫০০ দিনার। (রওয়াইউল আওকাফ ফিল হাজারাতিল ইসলামিয়্যা, পৃষ্ঠা : ৯০)

ইরাকের মসুল নগরীতে আবুল কাসেম জাফর ইবনে মুহাম্মদ ইবনে হামদান একটি বিশাল লাইব্রেরি ওয়াকফ করেছিলেন, যার নাম দিয়েছিলেন ‘দারুল ইলম’।

এজাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোই পরবর্তী সময়ে ইসলামী তাহজিব তামাদ্দুন ও জ্ঞান-বিজ্ঞানকে সাফল্যের উচ্চ শিখরে পৌঁছে দেয়।

বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ওয়াকফ : রিচার্ড ইটন বাঙালি মুসলমানদের নিয়ে একটি গবেষণাগ্রন্থ রচনা করেছেন। সেখানে তিনি তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে দেখিয়েছেন যে বাংলাদেশের বেশির ভাগ গ্রামাঞ্চল ছিল দুর্গম ও জঙ্গলাকীর্ণ এলাকা। যার বেশির ভাগ জমিই ছিল বসবাস ও চাষাবাদের অযোগ্য। পরবর্তী সময়ে যখন মুসলিম শাসকরা এ অঞ্চলের ক্ষমতায় আসেন, তখন ব্যাপক হারে জমি দান (ওয়াকফ) শুরু হয়।

আরও পড়তে পারেন-

কিছু মুসলিম একত্র হয়ে কোনো একটা গ্রামে গিয়ে সেখানকার জঙ্গল পরিষ্কার করে সেখানে স্থায়ী বসবাস ও চাষাবাদ শুরু করে দেন। আর এসব কার্যক্রম মসজিদ, মক্তব ও খানকাকে কেন্দ্র করে শুরু হয়। সরকার এসব প্রতিষ্ঠান এবং এর আশপাশের সব এলাকা ওই প্রতিষ্ঠান বা তার পরিচালকের নামে ওয়াকফ করে দিত। উদ্দেশ্য ছিল, সেখান থেকে প্রাপ্ত আয় দিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনা করা হবে এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার ভরণপোষণের ব্যবস্থা হবে।

এভাবেই বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের বেশির ভাগ অনুর্বর ও জঙ্গলাকীর্ণ এলাকা উর্বর ভূমিতে পরিণত হয়। দুর্গম এলাকাগুলো লোকে লোকারণ্য হয়ে ওঠে। সে সময়কার এসব ওয়াকফের অসংখ্য সরকারি নথি রিচার্ড ইটন উদ্ধার করেন। শুধু চট্টগ্রামেরই ২৮৮টি সরকারি নথি তিনি খুঁজে পেয়েছেন। (বাঙালি মুসলমান প্রশ্ন, পৃষ্ঠা ১২৩)

শুধু বাংলাদেশ নয়, রাসুল (সা.)-এর জন্মের পর থেকে পৃথিবীতে এ পর্যন্ত যতগুলো দেশে মুসলিম সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা হয়েছিল সবগুলো দেশের আর্থ-সামাজিক, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করেছে ওয়াকফ।

মুসলমানদের যতগুলো জ্ঞান-বিজ্ঞানের মারকাজ পৃথিবীতে ছিল এবং বর্তমানে আছে তার বেশির ভাগ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ওয়াকফকৃত সম্পত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। এমনকি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও নবাব সলিমুল্লাহ ও নোয়াব আলী চৌধুরীদের ওয়াকফকৃত সম্পত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত।

বর্তমান পৃথিবীতে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন, শিক্ষা ও সংস্কৃতি এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের সম্প্রসারণে ওয়াকফ হতে পারে একটা ঐতিহাসিক মাইলফলক।

উম্মাহ২৪ডটকম:আইএএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।