Home ইসলাম ইসলামের ইতিহাসে শিল্প বিপ্লব

ইসলামের ইতিহাসে শিল্প বিপ্লব

প্রাচীন বাগদাদের একটি বাজার

।। আতাউর রহমান খসরু ।।

বর্তমান সময়ের শিক্ষার্থীরা এই চিন্তা ও বিশ্বাস নিয়ে বড় হয় যে শিল্পের উদ্ভাবন ও উৎপাদন পশ্চিমা সভ্যতার একক দান, যা আঠারো শতকের শিল্প বিপ্লবের পর সূচিত হয়েছিল। তাদের এই বোধ ও বিশ্বাস এত প্রবল যে কারো ধারণা জন্মাতে পারে, আঠারো থেকে উনিশ শতকে সম্পন্ন ইউরোপীয় শিল্প বিপ্লবের আগে পৃথিবীতে কোনো শিল্প-কারখানা ছিল না।

মূলত ফ্রান্স, জার্মানি, আমেরিকা ও জাপান পৃথিবীতে শিল্প ও উৎপাদনে নতুন যুগের সূচনা করেছে এবং এই খাতে ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করেছে। পশ্চিমা বিশ্বের ইতিহাস ও প্রকৌশল বিভাগগুলোতে শিক্ষার্থীদের এমনই ধারণা দেওয়া হয়।

তারা এটাও বোঝাতে চায় যে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো পিছিয়ে থাকার কারণ হলো শিল্পে তাদের কোনো ঐতিহ্য নেই এবং অনগ্রসর হওয়ার কারণে তারা ঔপনিবেশিক ইউরোপীয় শাসন মেনে নিতে পারেনি। অথচ পৃথিবীতে এর আগেও শিল্প-কারখানা ছিল এবং তার ক্রমবিকাশের ধারাও অব্যাহত ছিল।

বিশেষত মুসলিম ইতিহাসের সোনালি অধ্যায়ে শিল্প, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নয়ন হয়; বরং মুসলিম আমলে সাধিত শিল্প বিপ্লবই পরবর্তী সময়ে শিল্পোন্নয়নের মূলভিত হিসেবে কাজ করেছিল।

শিল্প বিপ্লবের আগের শিল্প : গবেষকরা জানান, শিল্পের উন্নয়নে ইউরোপীয় ভাষ্যের বিপরীতে সত্যগুলো হচ্ছে—

১. শহর অঞ্চলে শিল্প উদ্ভাবন ও রপ্তানিমুখী বাণিজ্যিক উৎপাদন শিল্প বিপ্লবের ১০ শতাব্দীকাল আগে থেকেই ছিল। মুসলিম বিজ্ঞানীরা এমন সব অভিনব আধুনিক মেশিনারিজ উদ্ভাবন করেছিলেন যেগুলো পানি ও বাতাসের সাহায্যে পরিচালিত হতো।

২. মুসলিম বিশ্বে প্রচুর পরিমাণ খনিজ পদার্থ পরিশোধন করা হতো এবং স্থানীয় বাজারের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারেও তোলা হতো।

৩. চীন থেকে মুসলিম স্পেন পর্যন্ত সর্বত্র কাপড় উৎপাদন করা হতো এবং উৎপাদন পদ্ধতি খুব ভিন্ন ছিল না।

৪. আধুনিক ব্যাংক চেকের মতো কিছু নথি মুদ্রার পরিবর্তে হস্তান্তর করা হতো। যেগুলোকে এশিয়া, আফ্রিকা ও দক্ষিণ ইউরোপে মূল্যায়ন করা হতো।

৫. আধুনিক শেয়ারব্যবস্থার মতো শিল্পপ্রতিষ্ঠানের আর্থিক মূল্য নির্ণয় করে মূলধন বিনিয়োগ করা হতো।

আরও পড়তে পারেন-

ইসলামের ইতিহাসে শিল্প বিপ্লব : ইসলামের ইতিহাসে আব্বাসীয় যুগকেই পার্থিব জ্ঞান-বিজ্ঞানের সোনালি অধ্যায় বিবেচনা করা হয়। এই সময়ে মুসলিম বিজ্ঞানের নানা শাখায় অনন্য সাধারণ অবদান রাখে এবং আব্বাসীয় খলিফাদের পৃষ্ঠাপোষকতায় শিল্প-সভ্যতায় বিপ্লব সাধিত হয়। যা মুসলিম বণিক, ধর্মপ্রচারক, বিদেশি পর্যটক ও শিক্ষার্থী নানা শ্রেণির মাধ্যমে সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। সমগ্র মানবসভ্যতা তা দ্বারা উপকৃত হয়।

শিল্পের প্রধান কেন্দ্রগুলো : আব্বাসীয় খেলাফতের সময় ইরাক ও ইরাকের বাইরে সব ধরনের পণ্য উৎপাদনে উৎসাহ ও প্রণোদনা দেওয়া হতো। বসরায় কাচ ও সাবান কারখানা গড়ে ওঠে। এই সময় কাগজশিল্পে বিশেষ উন্নয়ন ঘটে। মুসলিম বিশ্বে শিল্পের এই বিকাশ বিশ্বের অন্যান্য দেশ ও অঞ্চলকে প্রভাবিত করে। ইরাক, পারস্য, শাম ও খোরাসানের মতো মিসরেও শিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটে।

শিল্প বিকাশের নানা দিক: পারস্য (বর্তমান ইরান) স্বর্ণশিল্প ও সূচিকর্মের জন্য বিশেষভাবে স্মরণীয়। পারস্য থেকে তা পৃথিবীর প্রায় সব বড় শহরে যেত। সাটিন, সিল্ক, কার্পেট ও জরিযুক্ত কাপড় মুসলিম বিশ্বে উৎপাদিত হতো এবং সারা পৃথিবীতে তার ব্যাপাক চাহিদা ছিল। কুফা সিল্ক ও সিল্কের কাপড়ে সূচিকর্মের (যাকে কুফিয়েহ বলা হয়) জন্য বিখ্যাত ছিল। খুজিস্তানও অত্যন্ত উন্নতমানের কাপড় উৎপাদন করত।

জুনদিশাপুরে (বর্তমান ইরানে) স্থাপিত হয়েছিল প্রাচীনতম মহাকাশ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র ও প্রাকৃতিক বিজ্ঞান বিষয়ক গবেষণাগার। এই গবেষণাগার থেকেই চিনি পরিশোধনের নিয়ম উদ্ভাবন করা হয়, যা পরবর্তী সময়ে খুজিস্তান ও স্পেনের চিনি উৎপাদন কেন্দ্রে প্রয়োগ করা হয়।

দামেস্ক ছিল স্টিলের তরবারির জন্য এবং সিরিয়া কাচশিল্পের জন্য খ্যাতি অর্জন করেছিল। খ্রিস্টীয় নবম শতকের আগেই এখানে আংশিক রঙিন ও এনামেলযুক্ত কাচ উৎপাদন শুরু হয়।

প্রধান প্রধান রপ্তানি পণ্য : আব্বাসীয় আমলে রপ্তানি পণ্যের শীর্ষে ছিল কৃষিপণ্য, কাচ, যন্ত্রপাতি, সিল্ক, কাপড়, সব ধরনের সুগন্ধি, গোলাপজল, জাফরান, সিরাপ ও তেল। যদিও মুসলিম বিশ্বের প্রতিটি শহরেই স্থানীয় প্রয়োজন পূরণের মতো বিভিন্ন প্রকার পদার্থ, কাচ, সুতা ও কাপড় উৎপাদনের ব্যবস্থা ছিল।

পতনের কারণ : এক কথায় বলা যায়, আব্বাসীয় আমলে মুসলিম বিশ্বে এক অনন্য শিল্প বিপ্লব সাধিত হয়। যা সমগ্র মুসলিম বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে এবং কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত মুসলিমরা সেই বিপ্লবের নেতৃত্ব দেয়। সেই বিপ্লবের সুফল ভোগ করেছিল আধুনিক ইউরোপও। কিন্তু বাগদাদের পতনের পর মুসলিম বিশ্বে জ্ঞানচর্চায় যে স্থবিরতা তৈরি হয় এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেয়, তা মুসলিম বিশ্বকে শিল্প-সভ্যতার নেতৃত্ব থেকে ছিটকে ফেলে। তাদের শূন্যস্থান পূরণ করে ইউরোপ। যদিও তাদের শিল্প বিপ্লব ও আধুনিক সভ্যতার পেছনে ঔপনিবেশিক শাসনের দীর্ঘ কান্না লুকিয়ে আছে।

মুসলিম হেরিটেজ

ডটকম অবলম্বনে

উম্মাহ২৪ডটকম: এসএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।