Home লাইফ স্টাইল মোবাইল ফোনআসক্তি থেকে শিশুদের বাঁচাতে হবে

মোবাইল ফোনআসক্তি থেকে শিশুদের বাঁচাতে হবে

।। মো. মনির হোসেন ।।

বিংশ শতাব্দীতে একটি শিশু যখন জন্মগ্রহণ করতো, প্রাকৃতিক পরিবেশে তার লালন-পালন করা হতো এবং সে বড় হতো এক অনবদ্য পরিবেশের নিবিড় যত্নে। শিশুকালে তাকে শুনানো হতো ঘুমপাড়ানির গান, রূপকথার গল্প, বিভিন্ন প্রকারের কেচ্ছা-কাহিনী ও নীতিকথা। একটি শিশুর যত্নের মধ্যে খাবার খাওয়ানোটা বরাবরের জন্যই অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার। আগের দিনে মায়েরা এ ব্যাপারটি অনায়াসেই সামাল দিতেন। শিশুকে নিয়ে বাড়ির আঙ্গিনায় ঘুরে ঘুরে পাখি, ফুল, ফলসহ প্রকৃতির সকল অপরূপ সৃষ্টিকে দেখিয়ে খাবার খাওয়াতেন। শিশুটি বেড়ে উঠত অবলীলায়। তার মননের প্রস্ফুটন ঘটত উম্মুক্ত আকাশের ন্যায়। সুনির্মল বসু শিশুদের এই পরিস্থিতি উপলব্ধি করেই লিখেছিলেন, ‘বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর, সবার আমি ছাত্র, নানানভাবে নতুন জিনিস শিখছি দিবারাত্র’।

কিন্তু হায়! হঠাৎ করে সব কিছুরই যেন মহাবিপর্যয় হলো। বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে যখন মোবাইল আবিষ্কার হয় এবং ধীরে ধীরে এর কর্মসীমা বৃদ্ধি পেয়ে স্মার্টফোনে পরিণত হয়, তখন থেকে শিশু লালন ও পরিচর্যার প্রেক্ষাপটও পরিবর্তন হয়ে যায়। একবিংশ শতাব্দীর বর্তমান সময়ে এসে, মা তার সন্তান পরিচর্যার জন্য হাতে পেয়েছে স্মার্টফোন নামক এক আশ্চার্য যন্ত্র। যদিও শিশুদের জীবনে এটি যন্ত্র না হয়ে বরং যন্ত্রণা হয়ে উঠেছে। কারণ, আজকালের মায়েরা তার সন্তানের কান্না থামাতে বিভিন্ন গল্পের ডালা না সাজিয়ে বরং শিশুর হাতে তুলে দেয় কার্টুন ভিডিও।

সারা দিনের কর্ম সম্পাদনের পরে মা যখন বিনোদন জগতের (টিভির) সম্মুখে নিজের ক্লান্ত শরীরটা এলিয়ে দেন, তখন সন্তানকে শান্ত করতে ব্যবহার করেন কার্টুন ভিডিও। পাখি, ফুল, ফল দেখিয়ে এবং বাড়ির আঙ্গিনায় হাঁটা হাঁটি করে শিশুকে এখন আর খাওয়ানো হচ্ছে না, বরং তাকে খাওয়ানোর জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে স্মার্টফোন। শিশুকে ঘুম পাড়াতে এখন আর রূপকথার গল্প শুনাতে হয় না। স্মার্টফোন মানেই শিশু চুপচাপ শান্ত, স্মার্টফোন মানেই শিশুর ক্ষুধা বেড়ে যাওয়া। স্মার্টফোন মানেই শিশু তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়া। এ যেন আলাউদ্দিনের প্রদীপ!

স্মার্টফোন কোনো ক্ষতি সাধন ছাড়াই যদি শিশু রক্ষণাবেক্ষণে এত উপকার করত, তাহলে তো কোনো কথাই ছিল না। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, শিশুরা এক মিনিট মোবাইলে কথা বললে মস্তিষ্কে যে কম্পন সৃষ্টি হয় তা স্থির হতে সময় লাগে দুই ঘণ্টা।

আরও পড়তে পারেন-

বুয়েটের তড়িৎ কৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. আনোয়ারুল ফাত্তাহ বলেন, শিশুদের মস্তিষ্ক ইলেকট্রনিক্স পণ্য থেকে নির্গত ক্ষতিকর রশ্মি ধারণের উপযুক্ত নয়। তাছাড়া মোবাইলের যে ভলিউম তার কম্পন খুবই ভয়াবহ। শিশুরা একনাগারে মোবাইল ফোন ব্যবহার করলে তাদের মৃগি রোগ ও হাঁপানীর ঝুঁকি বেড়ে যায়।

অতিরিক্ত স্মার্টফোনের ব্যবহার শিশুর মানসিক বিকাশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এছাড়া এটি ধীরে ধীরে প্রাকৃতিক জগতকে এড়িয়ে তার চিন্তা ও কল্পনাশক্তিকে স্মার্টফেনের রঙিন পর্দার গণ্ডিতে আটকে দেয়। ফলে সে মাদকাসক্তির মতো স্মার্টফোন আসক্তিতে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে তার মধ্যে মানসিক বৈকল্য দেখা দেয়।

ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত বলেন, মোবাইল ফোন থেকে নির্গত রশ্মি শিশুদের দৃষ্টিশক্তির ভীষণ ক্ষতি করে। যেসব শিশু দৈনিক পাঁচ-ছয় ঘণ্টা মোবাইল ফোনে ভিডিও গেম খেলে, খুব অল্প বয়সে তারা চোখের সমস্যায় পড়ে। তিনি আরও দাবি করেন যে, সেদিন খুব বেশি দূরে নয়, যেদিন মোবাইল ফোনকে সিগারেটের চেয়ে বেশি ক্ষতিকর হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। স্মার্টফোনের উপকারিতা অপরিমেয় এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এ যন্ত্রটি একবিংশ শতাব্দীর শিশু ও যুবকদের মননশীলতাকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করছে। এ যেন ঊষালগ্নে প্রস্ফুটিত কোমল ও সু-শোভিত পুষ্পরাজির পদদলন।

এইতো কয়েকদিন পূর্বের কথা, আমাদের এলাকার ছেলে রাতুল। সে কেবলমাত্র ১২তম জন্মদিন পালন করল। ছেলেটি ছোটবেলা থেকে স্মার্টফোনের ব্যবহার আসক্ত হয়ে পড়েছে। ধীরে ধীরে তার মানসিক বৈকল্য দেখা দেয়। ফলে পড়াশোনায় মনোযোগী ছিল না। সারাদিন শুধু গেম খেলে। তার বাবা-মা তাকে অনেক বুঝানোর চেষ্টা করল। মানসিক বৈকল্যতার কারণে তাতে কোনো কাজ হলো না। অবশেষে বাধ্য হয়ে ছেলেটির হাত-পা বেঁধে রাখল। হঠাৎ করে দেখা গেল, তার বাঁধা হাতের অগ্রভাগ দিয়ে একটি জুতা ধরে মোবাইলের মতো ব্যবহার করতে লাগল। ডাক্তার বললেন, অতিরিক্ত স্মার্টফোন ব্যবহারের কারণে এমন হয়েছে।

যেহেতু আজকের শিশু আগামীদিনের ভবিষ্যৎ, তাই স্মার্টফোনের করাল গ্রাস থেকে তাকে মুক্ত করে বিংশ শতাব্দীর পরিচর্যার দিকে নিয়ে যেতে হবে। তাকে নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যেতে হবে। বিভিন্ন প্রকারের উৎসাহমূলক গল্প শুনাতে হবে। প্রতিদিন উম্মুক্ত জায়গায় তার খেলাধূলার ব্যবস্থা করতে হবে। তার দিকে লক্ষ রাখতে হবে, যেন কোনো খারাপের সঙ্গে যেন সে মিশতে না পারে। এভাবেই পরম স্নেহে লালিত শিশুটিকে তার জটিল শৈশব, কৈশর ও বয়ঃসন্ধি কালকে কাটিয়ে সফল জীবনের দিকে পরিচালনা করা পিতা-মাতারই দায়িত্ব।

লেখক: প্রভাষক, জি.এস.এস ডিগ্রী মাদ্রাসা, নেছারাবাদ, পিরোজপুর।

উম্মাহ২৪ডটকম: এসএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।