Home ওপিনিয়ন উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, সংশয়, সন্দেহ

উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, সংশয়, সন্দেহ

।। ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ ।।

পারিপার্শিক প্রতিকূল পরিবেশে বিভিন্ন কারণে উদ্বেগ বাড়ে, উৎকণ্ঠিত মানুষ সমূহ শারীরিক সামাজিক সমস্যার সম্মুখীন হয়, সংশয় সন্দেহ আস্থার আওতা সঙ্কুচিত করে, গুজব বাড়ে, আত্মবিশ্বাসে ফাটল ধরায়, সমন্বয় সহযোগিতা বাধাগ্রস্ত হয়, স্নেহ-সম্মান-সমীহ ও শ্রেয় বোধের মূল্যবোধ অবক্ষয়ের শিকার হয়। এর প্রতিকারে প্রতিশোধ স্পৃহা প্রবল হয়। আবার প্রতিশোধ স্পৃহা থেকে বাড়াবাড়ি ব্যক্তি ও সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রয়াস অসম্ভব করে তুলতে পারে। কেউ অত্যাচারিত হলে প্রতিশোধ গ্রহণের প্রশ্ন আসে। শরীরে শর্করার পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে যেমন নীরব ঘাতক ডায়াবেটিসের উদ্ভব ঘটে, যে ডায়াবেটিসকে মানবদেহে অনেক রোগের আহ্বায়ক কমিটির কনভেনর মনে করা হয়, তেমনি সহস্রজনের উদ্বেগ উৎকণ্ঠা সংশয় সন্দেহ মানবদেহে তো বটেই দেশ সমাজ ও অর্থনীতিতেও একাধিক দুর্যোগ- দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

আবার এ সবের প্রতিরোধে প্রতিশোধ গ্রহণের ক্ষেত্রে সাম্যের সীমা লঙ্ঘিত হলে প্রতিশোধ গ্রহণও অত্যাচারে পর্যবসিত হতে পারে। প্রতিশোধ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে সীমা লঙ্ঘিত হলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে বাধ্য, যা সামাজিক ভারসাম্য বিনষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আল-কোরআনে ৪২ সংখ্যক সূরা আশ শুরার ৪০ থেকে ৪৩ নং আয়াতে এ প্রসঙ্গে যা বলা হয়েছে তা বিশেষ প্রণিধানযোগ্য- ‘মন্দের প্রতিফল অনুরূপ মন্দ এবং যে ক্ষমা করে দেয় ও আপস-নিষ্পত্তি করে তার পুরস্কার আল্লাহর নিকট আছে। আল্লাহ জালিমদের পছন্দ করেন না। তবে অত্যাচারিত হওয়ার পর যারা প্রতিবিধান করে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না। কেবল তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা অবলম্বন করা হবে যারা মানুষের ওপর অত্যাচার করে এবং পৃথিবীতে অন্যায়ভাবে বিদ্রোহচারণ করে বেড়ায়, তাদের জন্য মর্মন্তুদ শাস্তি। অবশ্য, যে ধৈর্যধারণ করে এবং ক্ষমা করে দেয়, তা হবে দৃঢ় সঙ্কল্পেরই কাজ।’

ন্যায় নীতিশাস্ত্রের বিধান ও ভাষ্যমতে, ‘মন্দের প্রতিফল অনুরূপ মন্দই’ অর্থাৎ তোমার যতটুক আর্থিক অথবা শারীরিক ক্ষতি কেউ করে, তুমি ঠিক ততটুকু ক্ষতি তার করতে পারো (যা প্রতিবিধান হিসেবে হওয়া সমীচীন বিবেচিত হতে পারে) তবে শর্ত এই যে তোমার মন্দ কাজটি যেন পাপকর্ম না হয়। উদাহরণত কেউ তোমাকে জোরপূর্বক মদ পান করিয়ে দিলে তোমার জন্য তাকেও বলপূর্বক মদ পান করিয়ে দেয়া সমীচীন বা জায়েজ হবে না। সমান সমান প্রতিশোধ নেয়ার অনুমতি বা ক্ষমতা থাকলেও, যে ব্যক্তি ক্ষমা করে এবং আপস নিষ্পত্তি করে, তার ভালো পুরস্কার প্রকৃতির নিয়মেই রয়েছে। সুতরাং ক্ষমা করাই উত্তম। যারা প্রতিরোধ প্রতিশোধ নেয়ার সময় ক্রোধের সময় নিজেদের হারিয়ে ফেলে না; বরং তখনো ক্ষমা ও অনুকম্পা তাদের মধ্যে প্রবল থাকে। ফলে ক্ষমা করে দেয়। কোনো সময় অত্যাচারের প্রতিশোধ গ্রহণের প্রেরণা তাদের মধ্যে জাগ্রত হলেও তারা তাতে ন্যায়ের সীমা লঙ্ঘন করে না, যদিও ক্ষমা করে দেয়া উত্তম।

প্রতিশোধ প্রতিকার ততটুকু যতটুকু জুলুম করা হয়েছে, এর সীমা লঙ্ঘিত হলে তা আবার অত্যাচারে পর্যবসিত হতে পারে। প্রতিশোধের মাত্রা অতিশয় আপেক্ষিক, সীমা লঙ্ঘনের সম্ভাবনা ও সমস্যা থেকেই যায় তাই ক্ষমা ও আপস মীমাংসার মাধ্যমে প্রতিশোধ এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা শ্রেয়। তবে যে ক্ষেত্রে ক্ষমা করার ফলে অত্যাচারীর ধৃষ্টতা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে, সে ক্ষেত্রে প্রতিশোধ-প্রতিরোধ গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য হয়ে দাঁড়ায়। ক্ষমা ও প্রতিশোধ দু’টিই অবস্থাভেদে উত্তম। যে ব্যক্তি অনাচার করার পর লজ্জিত হয়, তাকে ক্ষমা করা উত্তম এবং যে ব্যক্তি স্বীয় জেদ ও অত্যাচারে অটল থাকে, তার ক্ষেত্রে প্রতিশোধ নেয়াই উত্তম।

আরও পড়তে পারেন-

এটা বাস্তবিকই কঠিন যে, সব ক্ষেত্রে ধৈর্যধারণ ও ক্ষমা করা। দোষীকে শাস্তি-উপযুক্ত শিক্ষা দেয়ার মানসিকতার মধ্যে ভারসাম্য রাখা কঠিন, এর ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণও কঠিন। কিন্তু ক্ষমতা থাকা সত্তে¡ও প্রতিশোধের স্পৃহাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে সময় তার সুফল বয়ে আনে। গৌতম বুদ্ধের বাণীও তাই- ‘প্রতিশোধের ¯পৃহা পুষে রাখতে নেই, ক্ষমা করে দেয়া বা বিলম্ব করাই প্রতিশোধের উত্তম উপায় (Do not search for (resentment) a long time: resentment cannot be satisfied by resentment, it can only be removed by forgiveness)। বিপদে, অত্যাচারের মুখে, অন্যায়ের সামনে ধৈর্যধারণ কঠিন, প্রতিশোধ¯পৃহাকে সুনিয়ন্ত্রিতভাবে প্রয়োগও তেমন কঠিন। এর বিপরীতে অবস্থান নেয়া নিঃসন্দেহে তাই দৃঢ় সঙ্কল্পের কাজ। ব্যক্তি সমাজ-দেশ ও দুনিয়ায় হানাহানির সর্বনাশা হতে পরিত্রাণ লাভার্থেই এই the noblest form of courage and resolution এর প্রয়োজন।

উদ্বেগ উৎকণ্ঠা সংশয় সন্দেহ থেকে দূরে থাকার একটি প্রকৃষ্ট উপায় হচ্ছে ‘সবর’ বা ধৈর্য অবলম্বন। আল কুরআনের দ্বিতীয় সূরা বাকারার ১৫৫নং আয়াতে বলা হয়েছে, এবং আমি তোমাদিগকে ভয়, ক্ষুধা এবং ধনসম্পদ, জীবন ও ফলফসলের ক্ষয়ক্ষতি দ্বারা অবশ্য পরীক্ষা করব। তুমি (হে রাসূল) শুভসংবাদ দাও ধৈর্যশীলগণকে। ইসলাম প্রচারের প্রাথমিক পর্যায়ে দুশমনদের ব্যাপক অপপ্রচারণায় নব দীক্ষাপ্রাপ্ত মুসলমানদের মন বিষাক্ত করে তোলা হচ্ছিল। মুসলমানদের এ সঙ্কটময়কালে তাদেরকে সূরা বাকারার ১৫৩ নং আয়াতে ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে প্রার্থনা করবার পরামর্শ দিয়ে বলা হয়, ‘আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন।’ এরপর পরই ১৫৪ নং আয়াতে বলা হয়, ‘আল্লাহর পথে যারা নিহত হয় তাদেরকে মৃত বলো না, তারা জীবিত কিন্তু তোমরা তা উপলব্ধি করতে পার না।’

পূর্বে উল্লিখিত ১৫৫ নং আয়াতে বিষয়টি আরো স্পষ্ট করে ধৈর্যশীলদিগের জন্য শুভসংবাদ উল্লেখ করা হয়েছে। বস্তুত এর চাইতে বড় শুভসংবাদ কী হতে পারে যে সৃষ্টিকর্তা স্বয়ং ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন। আরবি ‘সবর’ শব্দের বহুমাত্রিক অর্থ ও তাৎপর্য রয়েছে। আল্লামা ইউসুফ আলীর মতে সবরের ব্যবহারিক অর্থ হতে পারে ১. ধীরস্থিরতা অবলম্বন, তাড়াহুড়া না করা ২. অব্যাহত অধ্যবসায়, একাগ্রতা, একনিষ্ঠতা, দৃঢ়তা, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অর্জনে অবিচল থাকা ৩. কোনো তাৎক্ষণিক কিংবা হঠাৎ কিছু পাবার প্রত্যাশা না করা ৪. বিপদে আপদে পরাজয় কিংবা বিপর্যস্ত পরিস্থিতিতেও বিপদ ও বিসংবাদকে ঠাণ্ডা মাথায় সহজে ও সানন্দে গ্রহণ করা অর্থাৎ ওই সব পরিস্থিতিতে শোকাভিভ‚ত কিংবা ক্রোধান্বিত কিংবা হঠকারী না হওয়া।’ বলা বাহুল্য ‘সবর’ মানবিক গুণাবলির মধ্যে শ্রেষ্ঠতর এবং এর মানসিক ও আত্মিক তাৎপর্য অপরিসীম। সবর-এর গুণ অর্জন স্বাভাবিকভাবেই সহজ নয়। আর এ কারণে এটি অর্জনেও আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের নিকট প্রার্থনার পরামর্শ দেয়া হয়েছে (সূরা বাকারা আয়াত নং ২৫০)।

ভয়, ক্ষুধা, ধন-মালের, ফল ফসলের ক্ষয়ক্ষতি নানান দুর্ঘটনা-উদ্ভূত বলে প্রতীয়মান হয়। সন্দেহ নেই এতে মারাত্মক অর্থনৈতিক বিপর্যয় ঘটে-ব্যক্তি তথা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়জীবনে যেকোনো সময় নানান দুর্ভোগ ও দুর্বিপাক আপতিত হতে পারে। দুর্ভিক্ষ, মহামারী, প্লাবন ইত্যাদি যখন গোটা সমাজের উপর দুর্দশা ও বিপদ নিয়ে আসে তখন গোটা সমাজ তথা সমগ্র রাষ্ট্রব্যবস্থাকে তা ধৈর্যের সাথেই মোকাবেলা করা উচিত। ধীরস্থিরভাবে যে কোনো বিপদ অতিক্রম করার লক্ষ্যে সার্বিক প্রচেষ্টা চালাতে হয়। এ পরিস্থিতিতে ব্যক্তি ও সমষ্টিকে ধৈর্য ও সালাতের শক্তি ও সাহায্য নিতে হয় একই সাথে ঈমানের ওপর দৃঢ় আস্থা রেখে ধৈর্যধারণে অবিচল থাকার জন্য পরস্পরকে সহযোগিতা করতে হয়।

১০৩ সংখ্যক সূরা ‘আসর’-এ ¯পষ্টতই উল্লেখ করা হয়েছে, ‘মানুষ অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত, কিন্তু তারা নয়, যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে এবং পরস্পরকে সত্যের উপদেশ দেয় ও ধৈর্যের উপদেশ দেয়’ (আয়াত নং ২-৩)। বিপদে অন্যের সহযোগিতার বিষয়টিও এখানে বিশেষ তাৎপর্যবহ। বিপদগ্রস্ত সমাজের সকলে ধৈর্যধারণেই কেবল সীমাবদ্ধ থাকবে না পরস্পর সহযোগিতা অর্থাৎ বিপদগ্রস্ত ব্যক্তির বৈষয়িক সাহায্যে এগিয়ে আসাও অতীব গুরুত্বপূর্ণ। জরুরি পরিস্থিতিতে জরুরি পরিকল্পনা গ্রহণ এবং পারস্পরিক সাহায্য আদান প্রদানে ত্যাগ স্বীকারের মাধ্যমে উক্ত প্রয়াসে উপযোগী নেতৃত্ব দান ও সফল কর্ম সম্পাদনে সহায়তা করা বাঞ্ছনীয়। এরূপ ভ‚মিকা পালনে কোনো বিপর্যয়ই কোনো সমাজকে কাবু করতে পারে না।

ধৈর্যধারণের মাধ্যমে বিপদ মোকাবেলার মধ্যে রয়েছে সৃষ্টিকর্তার অপার সন্তুষ্টি ও সমর্থন। সূরা বাকারার ১৭৭ নং আয়াতের এই অংশটি এখানে প্রণিধানযোগ্য- ‘পূর্ব ও পশ্চিম দিকে তোমাদের মুখ ফিরানোতে কোনো পুণ্য নেই, কিন্তু পুণ্য আছে… অর্থসঙ্কটে, দুঃখ ক্লেশে ও সংগ্রামে সঙ্কটে ধৈর্যধারণ করলে।’ হাদিসে আছে,. ‘ধৈর্য এমন একটি গাছ, যার সারা গায়ে কাঁটা কিন্তু ফল অতি সুস্বাদু।’ রালফওয়াল ডু ইমারসন, দার্শনিক ও কবি বলেছেন, ‘প্রকৃতির গোপন শক্তিটিকে অর্জন করার চেষ্টা করো। গোপন শক্তিটি হলো, ধৈর্য।’

রাশিয়ান লেখক লিও টলস্টয় মনে করতেন, ‘ধৈর্য হলো জগতের সবচেয়ে শক্তিমান যোদ্ধা।’ ব্রিটিশ সাহিত্যিক স্যামুয়েল জনসন জানতেন, ‘অসাধারণ কাজগুলো শক্তি নয়, অসীম ধৈর্য দিয়ে সম্পন্ন করতে হয়।’ এ কথা ঠিক যে, বিশ্বাস আর ধৈর্য একে অপরের হাত ধরে চলে। কেউ যখন সবকিছুর পরও সৃষ্টিকর্তার ওপর বিশ্বাস রাখবে, তখন তার জীবনে আনন্দ নেমে আসবে। যখন সৃষ্টিকর্তার ওপর কারো বিশ্বাস থাকবে, সে অনেক বেশি ধৈর্য ধারণ করতে পারবে।

লেখক : সাবেক সচিব, এনবি আরের প্রাক্তন চেয়ারম্যান।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।