Home শিক্ষা ও সাহিত্য জামিয়া মাদানিয়া বারিধারার পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে যা বলেছেন মুফতি জাকির হোসাইন কাসেমী

জামিয়া মাদানিয়া বারিধারার পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে যা বলেছেন মুফতি জাকির হোসাইন কাসেমী

ছাত্রদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য দিচ্ছেন মুফতি জাকির হোসাইন কাসেমী। ছবি- উম্মাহ।

বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ (বেফাক) ও আল হাইআতুল উলইয়া লিল জামিআতিল কওমিয়া বাংলাদেশ-এর কেন্দ্রীয় পরীক্ষায় রাজধানী ঢাকার অন্যতম বিখ্যাত দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা’র মেধা তালিকায় উত্তীর্ণ ছাত্রদের মাঝে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান ও দোয়া মাহফিল শনিবার (১৬ ডিসেম্বর) বাদ মাগরীব জামিয়া প্রাঙ্গনে অনুষ্ঠিত হয়েছে।

পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে জামিয়া মাদানিয়া বারিধারার মুহাদ্দিস মুফতি জাকির হোসাইন কাসেমী ছাত্রদের উদ্দেশ্যে আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী (রহ.)এর উপর স্মৃতিচারণ এবং দিক-নির্দেশনামূলক মূল্যবান বক্তব্য দিয়েছেন।

বক্তব্যে তিনি বলেছেন, চলমান ডিসেম্বর মাস একদিকে বিজয়ের আনন্দের মাস। কারণ, এই মাসে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি চূড়ান্তভাবে বিজয়ী হয়ে স্বাধীন হয়েছে। অন্যদিকে এই বিজয়ের ডিসেম্বর মাসের ১৩ তারিখ অত্র জামিয়ার প্রতিষ্ঠাতা মুহতামিম, আমাদের রাহবার ও প্রিয় শায়েখ হযরত আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী (রহ.) আমাদেরকে এতিম করে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। তাই এই মাস আমাদের জন্য বেদনার স্মৃতিও বহন করে।

মুফতি জাকির হোসাইন কাসেমী বলেন, বিজয়ের মাসে আজকের এই অনুষ্ঠানে যাদেরকে পুরষ্কৃত করা হবে, তারাও সকলে দেশসেরা শিক্ষার্থী হিসেবে বিজয়ী হয়েছেন। তাদের এই বিজয় যেমন আনন্দ বয়ে এনেছে আমাদের সকলের মাঝে, তেমনি এই বিজয়ের মধ্য দিয়ে আমাদের প্রিয় প্রতিষ্ঠানের সাথে গৌরবের খ্যাতিও যুক্ত হয়েছে। তাই অনুষ্ঠানে বিজয়ীদের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানের সকল শিক্ষক, ছাত্র ও কর্মকর্তাগণও খুশি এবং আনন্দিত।

তিনি বলেন, প্রিয় তুলাবাগণ, আনন্দ ও বেদনা মিশ্রিত এই মাসের আজকের মজলিসে আমরা সকলে মহান আল্লাহর দরবারে দোয়া করবো, তিনি যেন আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী (রহ.)কে কবরজগতে রহমতের চাদরে আবৃত রাখেন এবং পরকালে জান্নাতের সুউচ্চ মাকাম দান করেন।

মুফতি জাকির হোসাইন কাসেমী বলেন, উস্তাদদের প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধা বজায় রাখার ক্ষেত্রে রাহবারে মিল্লাত আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী (রহ.) আমাদের জন্য কেমন উদাহরণ রেখে গেছেন, তার ছোট্ট একটি উদাহরণ বলছি। হযরত আল্লামা তাফাজ্জুল হক হবীগঞ্জী (রহ.) আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী (রহ.)এর খুবই অল্প সময়ের উস্তাদ ছিলেন কুমিল্লাতে। অল্প সময়ের এই উস্তাদ-শাগরিদদের সম্পর্ক কতোটা উঁচুমাপের ছিল, সে সম্পর্কে বলছি, আমি সবসময় দেখেছি আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী (রহ.) কোন দিন হযরত আল্লামা তাফাজ্জুল হক হবিগঞ্জী (রহ.)এর সামনে চেয়ারে বসতেন না। হুজুরকে উপরে বসিয়ে তিনি নিচে বসতেন। জমিয়তের প্রোগ্রামে আল্লামা তাফাজ্জুল হক হবীগঞ্জী (রহ.) বলেছিলেন, আল্লামা কাসেমীর মতো ছাত্রের উস্তাদ হয়ে আমি নিজেকে গর্ববোধ করি। আমি হুজুরের (আল্লামা কাসেমী রহ.) সঙ্গে একবার বর্তমান হেফাজত আমীর ও জামিয়া আজিজুল উলূম বাবুনগরের মুহতামিম পীরে কামেল হযরত আল্লামা মহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী (দা.বা.)এর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। তিনি কাসেমী সাহেব (রহ.)কে বলেছিলেন, “কাসেমী সাহেব! আমি আপনাকে শ্রদ্ধা করি, সম্মান করি। কারণ, আপনি কাসেমী। আপনি হযরত কাসেম নানুতুবী (রহ.)এর মসলক তথা নীতি-আদর্শকে ধারণ করেন। আমি আপনাকে বলব, আপনি কখনো বাতেলের সাথে আপোস করবেন না।” তখন কাসেমী সাহেব (রহ.) উত্তরে বলেছিলেন, “হুজুর দোয়া করবেন, আমি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কখনোই বাতেলের সাথে কোনরূপ আপোস বা সমঝোতা করবো না।

এ পর্যায়ে মুফতি জাকির হোসাইন কাসেমী তুলাবাদের উদ্দেশ্য করে বলেন, প্রিয় ছাত্র ভাইয়েরা! আমরা যারা জামিয়া বারিধারা নিয়ে গর্ববোধ করছি, তারানায়ে বারিধারা পাঠ করছি- “এই বারিধারার বুকে আমরা, গড়তো সত্যেরই মিনারা। হেতা মুক্তির পতাকা ওড়াবো, সবে মিলে মিশে আজ আমরা”। কিন্তু এ তারানায়ে বারিধারার কি লক্ষ্য, কি উদ্দেশ্য- এটা জানার ও হৃদয় দিয়ে উপলব্ধিতে আনার আমরা কয়জন চেষ্টা করেছি? আজকের এই মজলিস থেকে আমাদেরকে দৃঢ়ভাবে প্রত্যয় নিতে হবে যে, আমরা জীবনভর বাস্তবিকই সত্যের মিনারা গড়ার লক্ষ্য নিয়ে সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের সাথে মিলেমিশে ঐক্য বজায় রেখে কাজ করে যাবে, ইনশাআল্লাহ।

মুফতি জাকির হোসাইন কাসেমী বলেন, প্রিয় ছাই ভাইয়েরা, আল্লামা কাসেমী (রহ.) মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সত্যের মিনারাকে দৃঢ়তার সাথে আঁকড়ে রেখেছিলেন। আল্লামা কাসেমী (রহ.) আল্লামা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী (দা.বা.)এর সামনে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন হকের পথে অবিচল থাকার উপর। আজকের এই মজলিসে আপনারা সকলেও আসাতেজায়ে কেরামের সামনে এই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হোন যে, কখনো বাতেলের সাথে, মিথ্যার সাথে কোনরূপ আপোস করবেন না। আল্লামা কাসেমী (রহ.) দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন, কিন্তু তাঁর আদর্শ ও মিশন আমাদের কাছে রেখে গেছেন। আমরা সে আদর্শ ও মিশনকে লালন করে এগিয়ে নিতে চেষ্টা করি। বিশেষ করে তিনি ছাত্রদেরকে নিয়ে উস্তাদদের উদ্দেশ্যে বলতেন, ছাত্ররা হচ্ছে উস্তাদের জন্য জমিন। জমিনে যেমন বিজ রোপন করে ফসল উৎপন্ন করা হয়। ছাত্ররাও তাদের সিনাকে আমাদের সামনে পেশ করেছেন বিধায় আমরা তাদের বুকে বিজ বপন করতে পেরেছি। কাজেই আমরা ছাত্রদেরকে স্নেহ মমতা দেই, গুরুত্ব দেই এবং মনযোগ দিয়ে গড়ে তোলার চেষ্টা করি। এতে নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকেও উত্তম বিনিময় দান করবেন।

আরও পড়তে পারেন-

মুফতি জাকির হোসাইন কাসেমী বলেন, প্রিয় ছাত্র ভাইয়েরা, অনেক সময় শিক্ষকরা জামিয়ার শৃঙ্খলা ও শিক্ষার পরিবেশ অটূট রাখার জন্য তোমাদের সামনে জামিয়ার নিয়ম-কানুন পেশ করেন। তাতে তোমাদের কারো কারো কষ্ট হয় আমরা বুঝি। তবে এ আইন-শৃঙ্খলা মেনে চলার মধ্যেই তোমাদের সফলতা, প্রতিষ্ঠানের সফলতা এবং তোমাদের ভবিষ্যৎ গড়ে উঠার চাবিকাঠি। ছাত্র জীবন হচ্ছে নিজেকে গড়ে তোলার সময়। এই গড়ে ওঠার সময় যদি নিয়ম-কানুন না মেনে বিশৃঙ্খলভাবে চলা হয়, তাহলে কীভাবে গড়ে ওঠবে? তাই এখন থেকেই কঠোরভাবে শৃঙ্খলা ও নিয়ম মানার অনুশীলন করতে হবে। এতে করে একদিকে যেমন জামিয়ার পরিবেশ সুন্দর ও সুশৃঙ্খল থাকবে, তেমনি তোমরাও আদর্শবান ও সুন্দর জীবনের অধিকারী হওয়ার মতো যোগ্য হিসেবে গড়ে ওঠবে।

তিনি বলেন, আল্লামা কাসেমী (রহ.) আমাদের কাছে দুটি আমানত রেখে গেছেন। একটি জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা, আরেকটি হলো জামিয়া সোবাহানিয়া। এ প্রতিষ্ঠান দুটিকে তিনি দেওবন্দের নীতি আদর্শের উপর রেখে গেছেন। দারুল উলূম দেওবন্দের নীতি আদর্শ হচ্ছে, তালিম-তরবিয়্যাত, তাজকিয়ায়ে নফস, তাসাউফ, দাওয়াত ও তাবলীগ , সিয়াসত; এ চারটি কাজের সমন্বয় হচ্ছে দারুল উলূম দেওবন্দ। আল্লামা কাসেমী (রহ.) সিয়াসতের ময়দানে হুইল চেয়ারে বসে বিপ্লবী আন্দোলন করে গেছেন। তাজকিয়ায়ে নফসের কাজ করে গেছেন, দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ করে গেছেন। এ ছাড়া দরস-তাদরীসের ক্ষেত্রে তিনি মানুষ গড়ার কারিগর ছিলেন। তিনি আমাদেরকে বারবার বলতেন, ছাত্র পরিবেশে গড়ে ওঠে, আর পরিবেশ গড়ে নিতে হয়। তিনি উর্দুতে বলতেন, “ইনসান মাহওয়াল ছে বনতা হায়, মাহওয়াল আসমান ছে টপকতা নেহি, মাহওয়াল বানানা পড়তা হায়”। অর্থাৎ মানুষ পরিবেশে গড়ে উঠে, পরিবেশ আসমান থেকে নাজিল হয় না। এটা আমাকে আপনাকে গড়ে নিতে হয়।

মুফতি জাকির হোসাইন কাসেমী বলেন, প্রিয় ছাত্র ভাইয়েরা আমরা এখানে পড়ার জন্য ও গড়ার জন্যে এসেছি। সুতরাং পড়ার জন্য যে পরিবেশ দরকার, সেটা বজায় রাখতে হবে আমাদেরই। আল্লাহ তায়ালা তোমাদেরকে যেন এক একজন আল্লামা কাসেমীর (রহ.)এর মতো যোগ্যরূপে গড়ে তুলেন। কাসেমী (রহ.)এর মতো যুগশ্রেষ্ঠ আলেম ও বিপ্লবী নেতা বানিয়ে দেন। আমিন।

মুফতি জাকির হোসাইন কাসেমী বলেন, এ পর্যায়ে আমি শহীদ সৈয়্যদ কুতুবের একটি উক্তি পেশ করছি-

من الذی یعیش لنفسہ فہو یعیش صغیرا ویموت صغیرا، ومن الذی یعیش لغیرہ فھو یعیش کبیرا ویموت کبیرا

অর্থাৎ- যে ব্যক্তি নিজের জন্য সব কিছু করেন, নিজেকে নিজেই ভাবেন, নিজের চিন্তাই বেশি করেন, নিজের চাওয়া পাওয়া লোভ- লালসা নিয়েই ভেবে থাকেন। তিনি যতো দিন দুনিয়ার জন্য বেঁচে থাকেন, ছোট হয়েই থাকেন। যখন মারা যান, তখন ছোট হয়েই মরেন। তার জানাযায় লোকসমাগম হয় না। আর যে ব্যক্তি নিজেকে নিয়ে ভাবেন না, নিজের চাওয়া-পাওয়া লাভ-ক্ষতি নিয়ে কখনো উদ্বিগ্ন হন না। নিজের জীবনকে দ্বীন ইসলাম দেশ, জাতির জন্য উৎসর্গ করেন। তিনি যতো দিন বেঁচে থাকেন বড় হয়ে মর্যাদার সাথেই থাকেন এবং মৃত্যুর সময়ে অনেক খ্যাতি ও সম্মান নিয়েই বিদায় নেন এবং তাঁর জানাযায় অনেক লোকসমাগম হয়।

আল্লামা কাসেমী (রহ.) বাস্তবেও নিজের জন্য কিছুই করেন নাই। তিনি যা করেছেন দ্বীন ইসলাম ও জাতির জন্য উম্মাহর জন্য করেছেন। যার কারণে, তিনি যতো দিন দুনিয়াতে ছিলেন সম্মান ও মর্যাদার সাথেই ছিলেন। মৃত্যুর সময়ও সম্মানের সাথেই বিদায় নিয়েছেন। তাঁর জানাযায়ও লক্ষ লক্ষ উলামা, তুলাবা ও মুসল্লীর সমাগম হয়েছিল। দুনিয়া থেকে বিদায় নেওয়ার পরও তাঁর কর্মগুণে তিনি জাতির কাছে অমর হয়ে আছেন।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।