।। মুফতি খলীল আহমদ কাসেমী ।।
আমরা জানি, দুনিয়ার সাধারণ কোনো বস্তুও যথাযথ নীতিমালা ও আদব রক্ষা ছাড়া অর্জন করা যায় না। তাহলে ইলম- আল্লাহ তাআলার গুণাবলির অন্যতম একটি গুণ এবং তাঁর নূর- কত উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন এক আসমানী সম্পদ! এ মহান সম্পদ কি শরীয়ত ও আদবের পাবন্দি ছাড়া অর্জন করা সম্ভব? নিঃসন্দেহে নয়। ইলম অর্জনের জন্য আমাদের পূর্বসূরি আকাবিরগণ অবর্ণনীয় ত্যাগ ও সাধনা করেছেন, যা আমাদের কল্পনাকেও হার মানায়। তাঁদের জীবনে ইলম অর্জনের জন্য অসংখ্য শর্ত ও আদব পালনের বাধ্যবাধকতা ছিল।
কিন্তু কালের পরিক্রমায় আমরা দুর্বল হয়ে পড়েছি। আমাদের দুর্বলতা ও অলসতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। একারণে ফকিহুল উম্মত হযরত মুফতি মাহমুদ হাসান গাঙ্গুহী (রহ.) বর্তমান যুগের ছাত্রদের অবস্থার প্রতি লক্ষ্য রেখে তাদের জন্য বারোটি সহজ শর্ত ও আদব সংকলন করেছেন, যার নাম দিয়েছেন- ہدايات إثنا عشريه برائے طلبه
আল্লাহ তাআলার দরবারে আমরা আশাবাদী যে, এই আদবগুলো অনুসরণ আমাদের সবাইকে ইলমে নাফে (উপকারী জ্ঞান) ও তার বরকত লাভে সহায়ক হবে।
হযরত মুফতি মাহমুদ গাঙ্গুহী (রহ.)এর ১২টি মূল্যবান উপদেশ
১. বিশুদ্ধ নিয়ত
নিয়তকে পরিশুদ্ধ করা। অর্থাৎ, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ও আত্মশুদ্ধির লক্ষ্যে দ্বীনের গভীর জ্ঞান এবং হালাল-হারাম নির্ণয়ের যোগ্যতা অর্জন করা এবং আমৃত্যু এর ওপর দৃঢ় থাকা।
২. তাকওয়া ও খোদাভীতি
তাকওয়া ও খোদাভীতির সঙ্গে ইলম অর্জন করা। ‘তা’লিমুল মুতাআল্লিম’ কিতাবে একটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে, যে ব্যক্তি তাকওয়া ছাড়া ইলম অর্জন করবে, আল্লাহ তাআলা তাকে তিনটি শাস্তির যেকোনো একটিতে নিক্ষেপ করবেন-
ক) সে অল্প বয়সে মৃত্যুবরণ করবে।
খ) আল্লাহ তাকে কোনো অত্যাচারী শাসকের সেবায় নিয়োজিত করবেন।
গ) তাকে এমন জায়গায় বসবাস করাবেন, যেখানে তার ইলম দ্বারা উপকৃত হওয়ার মতো কেউ থাকবে না।
৩. আল্লাহর আহকামের ওপর আমল
ফরজ ও ওয়াজিব বিধান পালনে যত্নবান হওয়া। সুন্নত ও আদবের পূর্ণাঙ্গ অনুসরণ করা এবং সিলেবাসভুক্ত বিষয়সমূহে সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করা।
৪. ইলমের প্রতিবন্ধকতা পরিহার
ইলম অর্জনের পথে বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। এগুলো থেকে বেঁচে থাকা আবশ্যক। যেমন-
ক) গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা: ছোট-বড় সব ধরনের গুনাহ, বিশেষত চোখ, লজ্জাস্থান ও জিহ্বার গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা। কুদৃষ্টি, অশ্লীল কথাবার্তা এবং অবৈধ আকাক্সক্ষা ইলমের নূরকে নষ্ট করে দেয়। বিশেষ করে শ্মশ্রুবিহীন সুশ্রী বালকদের প্রতি বদনজর অত্যন্ত ক্ষতিকর। এ প্রসঙ্গে হযরত মাওলানা মাসিহুল্লাহ খান (রহ.) বলতেন, “মৌলভি সাহেব! ছেলেদের থেকে বেঁচে থেকো”।
খ) অতিরিক্ত বন্ধুত্ব: পড়াশোনার ক্ষতি করে এমন গাঢ় ও অতিরিক্ত বন্ধুত্ব পরিহার করা।
গ) বিবাহ: ফকিহুল উম্মত (রহ.) বলেন- لِكُلِّ شَيْءٍ آفَةٌ، وَلِلْعِلْمِ آفَاتٌ، أَوَّلُهَا التَّزَوُّجُ অর্থ- “প্রত্যেক বস্তুর জন্য প্রতিবন্ধকতা থাকে, আর ইলমের জন্য প্রতিবন্ধকতা অনেক। তন্মধ্যে প্রথমটি হলো বিবাহ।” একারণে আমাদের আকাবিরগণ ছাত্রজীবনে বিবাহ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিতেন।
ঘ) অসৎ সঙ্গ: এমন ছাত্রের সঙ্গে ওঠা-বসা না করা, যে পড়াশোনায় মনোযোগী নয়; বরং ভবঘুরে ও উদাসীন।
ঙ) মন্দ পরিবেশ: ইলমের জন্য অনুপযোগী পরিবেশ থেকে নিজেকে দূরে রাখা।
চ) হারাম ও সন্দেহযুক্ত খাবার: এ ধরনের খাবার বর্জন করা, কারণ তা অন্তরে অন্ধকার সৃষ্টি করে।
ছ) অনর্থক কাজ: অপ্রয়োজনীয় ও অনর্থক কাজে সময় নষ্ট করা থেকে বিরত থাকা।
৫. অধ্যয়নে কঠোর পরিশ্রম
পড়াশোনায় পূর্ণ মনোযোগ ও কঠোর পরিশ্রম করা। একটি প্রবাদ আছে- اَلْعِلْمُ لَا يُعْطِيْكَ بَعْضَهُ حَتَّى تُعْطِيَكَ كُلَّكَ অর্থ- “তুমি নিজেকে পুরোপুরি বিলিয়ে না দিলে ইলম তার সামান্য অংশও তোমাকে দান করবে না”।
৬. উস্তাদের সঙ্গে আত্মিক সম্পর্ক
এর দু’টি লক্ষণ রয়েছে- ক) পরিপূর্ণ আদব ও সম্মান: কিছু ছাত্র উস্তাদের সামনে অত্যন্ত আদব দেখায় ও প্রশংসায় পঞ্চমুখ থাকে, কিন্তু উস্তাদের আড়ালে গিয়ে তাঁর সমালোচনায় লিপ্ত হয়। এমন ছাত্ররা নিজেদের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক। খ) খিদমতের আকাক্সক্ষা: উস্তাদের প্রতি অন্তরে খিদমতের অকৃত্রিম আকাক্সক্ষা পোষণ করা এবং তাঁর সন্তুষ্টি ও আরামের প্রতি খেয়াল রাখা।
৭. ইলমের উপকরণের সম্মান
কিতাব, কলম, কাগজ, শ্রেণিকক্ষ, এমনকি মাদরাসার বাবুর্চি, পরিচ্ছন্নতাকর্মী ও দারোয়ানের সঙ্গেও সম্মানজনক আচরণ করা। মনে রাখতে হবে, ইলম অর্জনের অন্যতম প্রধান উপায় হলো সম্মান। ইমাম আবু হানিফা (রহ.) বলেন- “আমি যা কিছু পেয়েছি, সম্মানের মাধ্যমেই পেয়েছি। আর যারা ইলমের পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে, তারা আদব ও সম্মান রক্ষা না করার কারণেই হয়েছে”।
৮. মাদরাসার নিয়মশৃঙ্খলা পালন
মাদরাসার সব নিয়মকানুন, বিশেষ করে সময়ের প্রতি যত্নবান হওয়া। সময় স্বর্ণের চেয়েও দামি। একবার চলে গেলে তা আর ফিরে আসে না। খাজা আযিযুল হাসান মাজযুব (রহ.) কত সুন্দর বলেছেন-
ہو رہى ہے عمر مثل برف كم
چپکے چپکے رفتہ رفتہ دم بدم
অর্থ- “জীবন ফুরিয়ে যাচ্ছে বরফগলা পানির মতো, চুপিসারে ধীরে ধীরে প্রতিটি নিশ্বাসে”।
৯. আকার-আকৃতি ও পোশাক-পরিচ্ছদ
পোশাক-পরিচ্ছদ ও চালচলনে উলামায়ে কেরাম ও সলফে সালেহিনের অনুসরণ করা। দাড়ি সুন্নত মোতাবেক রাখা। চুল লম্বা রাখলে তার যত্ন নেওয়া কষ্টসাধ্য ও সময়সাপেক্ষ। তাই ছাত্রদের জন্য ‘হলক’-এর (মাথা মুণ্ডানো) সুন্নতের ওপর আমল করাই উত্তম। এতে আকাবিরদের সুন্নাতের অনুসরণ হবে এবং পড়াশোনায় মনোযোগ ধরে রাখা সহজ হবে।
আরও পড়তে পারেন-
- আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে ইসলামের ভূমিকা
- সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি যেন হুমকির মুখে না পড়ে
- সমৃদ্ধ জাতি নির্মাণে দরকার বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণ ও আলেমদের এগিয়ে আসা
- সালাম-কালামের আদব-কায়দা
- বিবি খাদিজা (রাযি.): ইসলাম ধর্মের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ নারী
১০. উপকারী ইলমের জন্য দোয়া
আল্লাহ তাআলা স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সা.)কে অধিক ইলম প্রার্থনার নির্দেশ দিয়ে বলেন- وَقُلْ رَّبِّ زِدْنِيْ عِلْمًا অর্থ- “এবং বলুন, হে আমার রব, আমার জ্ঞান বৃদ্ধি করে দিন”। (সূরা ত্ব-হা- ১১৪)।
রাসূলুল্লাহ (সা.) দোয়া করতেন- اَللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ عِلْمًا نَافِعًا অর্থ- “হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে উপকারী জ্ঞান প্রার্থনা করছি”।
আবার কখনো এই দোয়া করতেন- اَللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُبِكَ مِنْ عِلْمٍ لَا يَنْفَعُ অর্থ- “হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে এমন জ্ঞান থেকে আশ্রয় চাই, যা কোনো উপকার দেয় না”।
১১. কিতাব লেখকদের জন্য ঈসালে সওয়াব
যেকোনো কিতাব শুরু বা শেষ করার সময় তার লেখকের (যদি তিনি মুমিন হন) জন্য দোয়া করা এবং কুরআন তিলাওয়াত, তাসবিহ ইত্যাদি পড়ে ঈসালে সওয়াব করা। এর মাধ্যমে লেখকের রুহানি ফয়েজ ও বরকত লাভের আশা করা যায়।
১২. উলামা-মাশায়েখের সঙ্গে রুহানি সম্পর্ক
আল্লাহ তাআলা বুযূর্গদের সঙ্গে আধ্যাত্মিক সম্পর্ক স্থাপন ছাড়া ইলম ও আমলে স্বাদ পাওয়া কঠিন। আগেকার আকাবিরগণ ছাত্রদের বাইআত করাতেন না, যেন তাদের পূর্ণ সময় পড়াশোনায় ব্যয় হয়। কিন্তু বর্তমান যুগে ছাত্ররা যেহেতু বিভিন্ন অনর্থক কাজে সময় নষ্ট করে, তাই পরবর্তী আকাবিরগণ এ পদ্ধতিতে পরিবর্তন এনেছেন।
তাঁদের মতে, ছাত্ররা কোনো কামেল শায়েখের হাতে বাইআত হলে এবং তাঁর নির্দেশনা অনুযায়ী চললে অনর্থক কাজ থেকে বেঁচে থাকবে। এতে অন্তরে ইলমের একাগ্রতা এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ভালোবাসা বৃদ্ধি পাবে। যদি কোনো কামেল শায়েখের সান্নিধ্য লাভ সম্ভব না হয়, তবে আকাবিরদের জীবনী ও তাঁদের লিখিত কিতাবাদি পাঠ করবে। ইনশাআল্লাহ, এর মাধ্যমে আখেরাতের ফিকির ও আত্মশুদ্ধির প্রেরণা সৃষ্টি হবে।
ছাত্রদের প্রতি সর্বশেষ আরয হলো, অবসর সময়ে আকাবিরদের কিতাব মনোযোগ দিয়ে মুতালাআ করবে। কারণ, তাঁদের কিতাব তাঁদের সান্নিধ্যের স্থলাভিষিক্ত। আশা করি, ছাত্ররা এই নির্দেশনাগুলোর ওপর আমল করার পরিপূর্ণ চেষ্টা করবে। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
– আল্লামা মুফতি খলীল আহমদ কাসেমী, মুহতামিম- দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসা, চট্টগ্রাম।
অনুলিখনে- মাওলানা মুনির আহমদ।
উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ